🌳🌴🦚💐🌷💐🦚🌴🌳

🐰🐥শ্রীশ্রীবামন দ্বাদশী🐥🐰

🌳🌴🦚💐🌷💐🦚🌴🌳

শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ

সকল সাধু, গুরু, বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম I হরেকৃষ্ণ, আজ বিশেষ শুভদা তিথি গৌর - দ্বাদশী। বিজয়া মহাদ্বাদশী ব্রতের উপবাস I সায়ং সন্ধ্যায় শ্রীহরির পার্শ্ব - পরিবর্ত্তন। শ্রীবামন দ্বাদশী। শ্রীবিষ্ণুশৃঙ্খলযোগ। সকল ভক্তগণকে জানাই কৃষ্ণ প্রীতি শুভেচ্ছা। (পারণ – পরদিন পূর্ব্বাহ্ন ০৯ / ৩২ মিঃ মধ্যে বিজয়া মহাদ্বাদশী ব্রতের পারণ) I আপনি নিজে দ্বাদশী ব্রত পালন করুন ও অন্যকে পালনে উৎসাহিত করুন।

 

"অনুগ্রহায় ভূতানাং মানুষং দেহমাশ্রিতঃ।

ভজতে তাদৃশীঃ ক্রীড়াঃ যাঃ শ্রুত্বা তৎপরো ভবেৎ।।‘’     (ভাগবত - ১০/২৪/২৭ )

অর্থাৎ,- ''ভগবান ভক্ত-অভক্ত নির্বিশেষে সকলকে অনুগ্রহ করবার জন্য গোলকধাম থেকে ভূলোকে এসে লীলা করেন।''

 

যথা তরোর্মূলনিষেচনেন 
তৃপ্যন্তি তৎস্কন্ধভুজোপশাখাঃ । 
প্রাণোপহারাচ্চ যথেন্দ্রিয়াণাং 
তথৈব সর্বার্হণমচ্যুতেজ্যা ।।      (ভাগবত ৪/৩১/১৪)
অর্থাৎ,- গাছের মূলে জল সেচন করলে যেমন সেই গাছের কাণ্ড, ডাল, উপশাখা প্রভৃতি সকলেই তৃপ্তিলাভ করে এবং উদরে আহার্যদ্রব্য প্রদানের দ্বারা যেমন ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তি হয়, তেমনই শ্রীকৃষ্ণের পূজা করলে সমস্ত দেবতাদের পূজা হয়ে যায়।

 

যৎকীর্ত্তনং যৎস্মরণং যদীক্ষণং 
যদ্বন্দনং যচ্ছ্রবনং যদর্হণম্ । 
লোকস্য সদ্যো বিধুনোতি কল্মষং 
তস্মৈ সুভদ্রশ্রবসে নমো নমঃ ।।      (ভাগবত ২/৪/১৫)
অর্থাৎ,- আমি সেই সর্ব মঙ্গলময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করি; যাঁর যশগাথা কীর্ত্তন, স্মরণ, দর্শন, বন্দন, শ্রবণ ও পূজনের ফলে সমস্ত পাপরাশি অচিরেই ধৌত হয়। 

 

বলি মহারাজকে পরাস্ত করে দেবগণকে উদ্ধার করার জন্য এই তিথিতে ভগবান বিষ্ণু, বামন অবতার রূপে অবতীর্ণ হন। এই বামনাবতার লীলায় বেশ কিছু শিক্ষণীয় প্রসঙ্গ রয়েছে। ভগবানের নিকট, কৃষ্ণের নিকট আত্মসমর্পণের গুরুত্ব, ভগবানের সাথে ভক্তের ব্যক্তিগত সম্পর্কের চমৎকারিত্ব, এরকম অনেক কিছু। একবার আপনি কৃষ্ণের নিকট আত্মসমর্পণ করুন, তাহলে আর কোন উদ্বেগই থাকবে না। গুরুর মাধ্যমে কেউ কৃষ্ণের নিকট আত্মসমর্পণ করলে, তিনি সুরক্ষিত, কারণ কৃষ্ণ সম্পূর্ণরূপে তার যত্ন গ্রহন করছেন।

 

কৃষ্ণ গীতায় বলেছেন, ''আমার ভক্তের বিনাশ নেই।''

ক্ষিপ্রং ভবতি ধর্মাত্মা শশ্বচ্ছান্তিং নিগচ্ছতি ।

কৌন্তেয় প্রতিজানীহি ন মে ভক্তঃ প্রণশ্যতি ।।     (গীতা ৯ - ৩১)

অর্থাৎ,- তিনি শীঘ্রই ধর্মাত্মায় পরিণত হন এবং নিত্য শান্তি লাভ করেন। হে কৌন্তেয়! তুমি দীপ্ত কন্ঠে ঘোষণা কর যে, আমার ভক্ত কখনও বিনষ্ট হন না।

 

আমরা এই লীলা থেকে আরো একটি শিক্ষা লাভ করি যে, গুরু এবং শিষ্যের মধ্যে কি সম্পর্ক? তাহলে, এখান থেকে আমরা অনেক শিক্ষাই লাভ করতে পারি। এমন নয় যে, বিনোদনের জন্য গল্প আকারে বামনদেব ও বলি মহারাজের লীলাটি এখানে বর্ণিত হয়েছে। এর একটি অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য রয়েছে, যখন আপনি একজন যথার্থ পারমার্থিক গুরুর তত্ত্বাবধানে থেকে পুরাণে বর্ণিত এই বিশেষ লীলা পাঠ করবেন, তখন বুঝতে পারবেন যে, এর একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক রয়েছে এবং সেই সমস্ত পরিস্থিতিতে সেসব মহান ভক্তরা কিরূপ আচরণ করছেন, তা দেখেও আমরা বিশেষ শিক্ষা লাভ করতে পারি। তাঁদেরকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।

 

''মহাজন যেনঃ গত স পন্থা ।।''

অর্থাৎ,-  উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে, সংকটপূর্ণ অবস্থাতে, বিশেষ দৃষ্টান্তমূলক পরিস্থিতিতে তাঁদের পরীক্ষা করা হয় এবং যেহেতু তাঁরা মহান, তাই তাঁরা সফলভাবে উত্তীর্ণ হন। তাঁরা যথার্থ কাজটি করেন অথবা এমনকি তাঁরা ভুলও করেন। যাই হোক, তখন আমরা তাদের পরিণতিও দেখতে পাই। তাই আমাদের জন্য একটি বিশেষ শিক্ষা হল, আমাদের উচিত উৎকৃষ্ট উদাহরণরূপে মহান ব্যক্তিদের অনুসরণ করা এবং যারা ব্যর্থ হয়েছেন তাদের আচরণ বর্জন করা।"

 

বলি মহারাজ ছিলেন মহাভাগবত শ্রীপ্রহ্লাদ মহারাজের পৌত্র। দৈত্যকুলদ্ভুত হলেও তিনি ছিলেন বিষ্ণুভক্ত। কিন্তু অসুরকুলের স্বভাব বশত দেবগণের সহিত তার বিরোধিতা ছিল। বলি মহারাজ ব্রহ্মার তপস্যা করে তাকে সন্তুষ্ট করেন। ব্রহ্মার বরে বলীয়ান হয়ে বলি মহারাজ অচিরেই স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল ত্রিলোকের আধিপত্য অর্জন করেন। স্বর্গরাজ্য দখল করে তিনি দেবতাদের সেখান থেকে বিতাড়িত করেন। এভাবে বিতাড়িত হওয়ার পরে কোনো  উপায়ান্তর না দেখে দেবগণ ভগবান শ্রীবিষ্ণুর নিকট গমন করেন। দেবগণের অবস্থা দেখে তাদের রক্ষা করার জন্য ভগবান বিষ্ণু বামন (ক্ষুদ্রকায় ব্রাহ্মণ) রূপে আবির্ভূত হন।

 

একদিন বলি মহারাজ যজ্ঞ করছিলেন এবং তিনি ঘোষণা করে ছিলেন, তার কাছে থেকে যে যা দান চাইবে, তা তিনি দেবেন। তখন ভগবান বিষ্ণু, বামনদেব রূপে বলি মহারাজার কাছে এলেন ছোট বালক রূপে, তাকে দেখে বলি মহারাজ খুব আনন্দিত হয়েছিলেন। বামনদেব বললেন,-  আমার ত্রিপাদ ভূমি চাই অর্থাৎ তিন পায়ের মাপে যতটা জায়গা হয় সেই জায়গা টা তার চাই। তখন বলি মহারাজ বললেন,-  তুমি বালক তাই তুমি কিছু বোঝো না। তোমার এই ছোট ছোট পায়ের মাপে জমি নিয়ে তুমি কি করবে..? তুমি এর চেয়েও আরো বড়ো কিছু জিনিস চাও, তুমি চাইলে আমি তোমাকে একটা গ্রহলোক দান করতে পারি। তখন বামন দেব বললো আমার বেশি কিছু চাই না, আমার পায়ের মাপে তিন পা’ ভূমি আমি যজ্ঞের জন্য চাই।

 

বামনদেব বললেন,- ''হে রাজন ত্রিভুবনের মধ্যে ইন্দ্রিয় তৃপ্তির যত বস্তুই থাক অজিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি তাতে কখনো সন্তুষ্ট হয় না। ত্রিপাদভূমিতে যদি সন্তুষ্ট না হই তাহলে নয়টি বর্ষ সমন্বিত একটি দ্বীপ লাভ করেও সন্তুষ্ট হব না। তখন সপ্তদ্বীপ লাভের ইচ্ছা হবে। পৃথু, গয় প্রমুখ পরাক্রমশালী রাজারা সপ্তদ্বীপের আধিপত্য লাভ করেও সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। অসন্তোষ কখনো সুখ দিতে পারে না। সন্তুষ্ট ব্রাহ্মণের তেজ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। বলি মহারাজ প্রীত হয়ে বললেন বেশ তোমার যা ইচ্ছা তাই গ্রহণ কর। বামনদেব বললেন দান দেবার আগে সংকল্প কর। 

 

এদিকে বলি মহারাজের গুরুদেব, দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য তিনি বুঝতে পেরে বলি মহারাজ কে বাধা দিয়ে বললেন এই বালকটি আর কেউ না, স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু। ইনি অদিতির গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেছেন, দেবতাকে রক্ষা করবার জন্য আর অসুর কে নিধন করবার জন্য। তিনি ছলনা করে তোমার সব কিছু কেড়ে নেবে, তুমি কথা ফিরিয়ে নাও। ত্রিপাদ ভূমি গ্রহণের ছলনায় তিনি তোমর সর্বস্ব হরণ করবেন। জ্ঞানবান ব্যাক্তি তার সম্পদকে পাঁচ ভাগে ভাগ করেন ধর্মের জন্য এক, যশের জন্য এক, ঐশ্বর্য্যের জন্য এক, ইন্দ্রিয় সুখভোগের জন্য এক ও কুটুমৃব পালনের জন্য একভাগ। তাই এই সময় জল স্পর্শ করে কিছুই দান করব না এমনটা বলাই শ্রেয় হবে। এতে তোমার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হবে না কারণ পাঁচটি বিষয়ে মিথ্যা বলা নিন্দনীয় নয়, যথা,-

 

১. জীবিকা অর্জনে

২. জীবন বিপন্ন হলে

৩. কন্যা সম্প্রদানে (বিবাহকালে)

৪. গাভী ও ব্রাহ্মণের হিতার্থে

৫. শত্রুর হাত থেকে কাউকে রক্ষা করতে।

 

বলি মহারাজ বললেন, না আমি ব্রাহ্মণ কে কথা দিয়ে দিয়েছি, আর যদি ইনি ভগবানই হয়ে থাকেন তাহলে এর চেয়ে বড়ো দাতা কোথায় পাবো..? তখন তিনি গুরু কে ত্যাগ করে দিলেন এবং হাতে জল নিয়ে সংকল্প করে বামন দেব কে ত্রিপাদভূমি গ্রহণ করতে বললেন। সাথে সাথে বামনরূপী ভগবান এক বিরাট রূপ ধারণ করলেন। বলি মহারাজ ও তার পত্নী বিন্ধ্যাবলী ভগবানের পদধৌত করলেন। বামন দেব বিশাল বড়ো আকৃতি রূপ ধারণ কর এক পদে নীচের সপ্তলোক, আরেক পদে উপরের সপ্তভুবন অধিকার করে নিলেন। তারপর বামন দেব বললো আর একটা পা কোথায় রাখবো..?

 

বলি মহারাজ ভগবানকে বললেন যে তিনি যেন বলি মহারাজের মস্তকের উপর তার তৃতীয় পা রাখেন। তখন ভগবান বলি মহারাজের মাথায় পা রাখলেন এবং সেই পদভারে বলিমহারাজ পাতালে প্রবিষ্ট হলেন। ভগবান বিষ্ণু চিন্তা করলেন যে এই বলি আমার সকল পরিকল্পনা সম্বন্ধে অবগত হয়েও আমার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য নিজেকে 'আত্মনিবেদন' করেছে। তখন ভগবান বলি মহারাজকে স্বর্গলোকের চেয়েও মনোহর  সুতল লোক দান করলেন এবং বললেন আমি সব সময় তোমার লোকে অবস্থান করবো; আমি তোমার রাজ্যে পাহারাদার হয়ে তোমার রাজ্য রক্ষা করবো আর এই দিনটা সেই দিন। ভগবান তাকে সুতল লোকের অধিশ্বর পদ দান করলেন এবং তাকে বরপ্রদান করলেন যে সাবর্ণি মন্বন্তরে তিনি ইন্দ্রপদ লাভ করবেন। তখন থেকে বলি মহারাজ সুতললোকে রাজত্ব করতে লাগলেন এবং প্রলয়ের পর তিনি ভগবদ্ধামে ফিরে যাবেন।

 

হরি হে দয়াল মোর জয় রাধানাথ ।

বার বার এইবার লহ নিজ সাথ ।।

 

বহু যোনি ভ্রমি' নাথ, লইনু শরণ ।

নিজগুণে কৃপা কর অধমতারণ ।।

 

জগত - কারণ তুমি জগত - জীবন ।

তোমা ছাড়া কা'র নাহি, হে রাধারমণ ।।

 

ভুবনমঙ্গল তুমি ভুবনের পতি ।

তুমি উপেক্ষিলে নাথ কি হইবে গতি ।।

 

ভাবিয়া দেখিনু এই জগত - মাঝারে ।

তোমা বিনা কেহ নাহি এ দাসে উদ্ধারে ।।

🍁জয় বলি মহারাজের জয়🍁🍁জয় ভগবান শ্রীবামনদেবের জয়🍁