Friday, January 31, 2020


শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য
(আবির্ভাব)
''ব্রজে আবেশরূপত্বাদ্ব্যূহো যোহপি সদাশিবঃI
এবাদ্বৈতগোস্বামী চৈতন্যাভিন্নবিগ্রহঃ।।''

ব্রজের আবরণ রুপত্বপ্রযুক্ত যিনি সদাশিবব্যূহ বলিয়া প্রসিদ্ধ,তিনিই শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য,শ্রীচৈতন্যের অভিন্ন শরীর।শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য সম্বন্ধে শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে শ্রী স্বরূপ দামোদর গোস্বামীর কড়চায় প্রমাণ করিয়া এইরূপ নিরূপণ করিয়াছেন

‘’মহাবিষ্ণুর্জগৎ কর্ত্তা মায়য়া যঃ সৃজত্যদঃ I
তস্যাবতার এবায়মদ্বৈতাচার্য্য ঈশ্বরঃ।।

অদ্বৈতঃ হরিণাদ্বৈতাচার্য্যং ভক্তিশংসনাৎ।
ভক্তাবতারমীশং তমদ্বৈতাচার্য্যমাশ্রয়ে।।‘’

'যে মহাবিষ্ণু মায়াদ্বারা এই জগৎকে সৃষ্টি করেন,তিনি জগৎকর্ত্তা,ঈশ্বর অদ্বৈতাচার্য্য তাঁহারই অবতার। হরি হইতে অভিন্ন তত্ত্ব বলিয়া তাঁহার নাম 'অদ্বৈত'।ভক্তিশিক্ষক বলিয়া তাঁহাকে 'আচার্য্য' বলে,সেই ভক্তাবতার অদ্বৈতাচার্য্য ঈশ্বরকে আমি আশ্রয় করি।'
শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর প্রভুপাদ শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য সম্বন্ধে চৈতন্যচরিতামৃতে অনুভাষ্যে এইরূপ লিখিয়াছেন ইনি আচার্য্য,বিষ্ণুর আচরণ মঙ্গলময়।শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্যের অপর নাম শ্রীকমলাক্ষ I

"জগত-মঙ্গল অদ্বৈত, মঙ্গল-গুণধাম।
মঙ্গলচরিত্র সদা, মঙ্গল যাঁর নাম।।

মহাবিষ্ণুর অংশ অদ্বৈত গুণধাম।
ঈশ্বরের অভেদ তেঁহ অদ্বৈত পূর্ণনাম।।

বৈষ্ণবের গুরু তেঁহ জগতের আর্য।
দুই নাম মিলনে হৈল অদ্বৈত আচার্য।।

কমল নয়নের তেঁহ যাতে অঙ্গ, অংশ।
কমলাক্ষ বলি ধরে নাম অবতংশ।।‘’

অদ্বৈত আচার্য মাঘ মাসের শুক্লা-সপ্তমী তিথিতে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ বংশে শ্রীকুবের পণ্ডিত এবং শ্রীমতি নাভাদেবীকে অবলম্বন করে শ্রীহট্টের নিকটবর্ত্তী নবগ্রামে  সন ১৩৫৫ শকাব্দে,১৪৩৪ খ্রিষ্টাব্দে আবির্ভুত হন।

শ্রীকুবের পণ্ডিত এবং শ্রীমতি নাভাদেবী অন্তর্ধানলীলা করিলে শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য পিতামাতার পারলৌকিককৃত্য সম্পন্ন করিবার জন্য গয়া - যাত্রার ছলে সমস্ত তীর্থ পর্যটন করেন।বৃন্দাবনধামে আসিয়া শ্রীকৃষ্ণ আরাধনায় নিমগ্ন হইলে জানিতে পারিলেন কৃষ্ণ নবদ্বীপে প্রকটিত হইবেন।শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য বৃন্দাবন হইতে গোড়দেশে ফিরিয়া নবদ্বীপে কিছুদিন অবস্থানের পর শান্তিপুরে শুভাগমন করেন।বিষ্ণুতত্ত্ব মাত্রই শ্রী,ভূ লীলা,-এই ত্রিশক্তিধৃক শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য নিজস্বরূপের সম্পূর্ণতা প্রকাশের জন্য শক্তি - গ্রহণলীলা করিলেন।বিপ্রশ্রেষ্ঠ শ্রীনৃসিংহ ভাদুড়ীর দুই কন্যা শ্রীসীতাদেবী শ্রীদেবী শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্যের পত্নী হইলেন।

'আচার্য্যের ভাৰ্য্যা দুই জগৎ পূজিতা।
সর্ব্বত্র বিদিত নাম শ্রী আর সীতা ।।'

'যোগমায়া ভগবতী গৃহিণী তস্য সাম্প্ৰেতং।
সীতারূপেণাবর্তিনা 'শ্রী'নামনা তৎ প্রকাশতঃ।।'

ভগবতী - যোগমায়া শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্যের পত্নী সীতাদেবী এবং তৎপ্রকাশ 'শ্রী' রূপে সম্প্রতি অবতীর্ণা হইলেন। শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্যের দুইস্থানে স্থিতি,যথা শান্তিপুরে এবং নবদ্বীপ - মায়াপুরে শ্রীবাস পণ্ডিতের গৃহের সন্নিকটে।শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য ভগবত তত্ত্ব হইয়াও গুরুগ্রহণের অত্যাবশ্যকতা শিক্ষা দেবার জন্য শ্রীমাধবেন্দ্র পুরীপাদের নিকট দীক্ষা গ্রহণ লীলাভিনয় করিয়াছিলেন।স্বয়ং ভগবান শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আবির্ভাবের পূর্ব্বে তাঁহার গুরুবর্গের আবির্ভাব।শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য গুরুবর্গের সহিত আবির্ভূত হইয়া কলিরপ্রথম সন্ধ্যায় ভাবিকালোচিত অনাচারের প্রাবল্য এবং জগৎ কৃষ্ণভক্তি শূন্য হইয়াছে।এই অবস্থায় কোন অংশাবতার অবতীর্ণ হইয়া জগন্মঙ্গল বিধান করিতে পারিবেন না।সাক্ষাৎ স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অবতীর্ণ হইলেই জগতের কল্যাণ হইবে,এই প্রকার চিন্তা করিয়া শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য গঙ্গাজল তুলসী দ্বারা শ্রীকৃষ্ণ - পাদপদ্মে পূজাবিধান করতঃ স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবতরণের জন্য হুঙ্কার করিতে লাগিলেন।শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্যের  ভক্তি আর অনুরাগের শক্তিতে ভগবান করুণার নিলয় হয়ে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু রুপে জগতের বুকে আবির্ভুত হন।

"
তুলসীমঞ্জুরীসহিত গঙ্গাজলে।
নিরবধি সেবে কৃষ্ণে মহাকৌতুহলে।।
হুঙ্কার করয়ে কৃষ্ণ আবেশের তেজে।
যে ধ্বনি ব্রাহ্মাণ্ড ভেদি বৈকুণ্ঠতে বাজে।।
যে প্রেমের হুঙ্কার শুনিঞা কৃষ্ণনাথ।
ভক্তিবশে আপনে যে হইলা সাক্ষাৎ।।"
                                (
চৈতন্যভাগবত আদিলীলা)
ফাল্গুনী পূর্ণিমার চন্দ্রগ্রহণ ছলে নবদ্বীপ - শ্রীমায়াপুরে শ্রীকৃষ্ণ - সংকীর্ত্তনের সহিত সংকীর্ত্তনপিতা অবতারী শ্রীগৌরচন্দ্র উদিত হইলেন। শ্রীগৌরচন্দ্রের আবির্ভাবের পর শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য প্রভুর অনুমতি লইয়া তাঁহার ভার্য্যা শ্রীসীতাদেবী শান্তিপুর হইতে নবদ্বীপ - শ্রীমায়াপুরে উপহার লইয়া বালক - শিরোমণি শ্রীগৌরগোপালকে দর্শনের জন্য আসিলেন এবং ধান্য - দুর্ব্বাদি শিরে দিয়া আশীর্বাদ করিলেন।শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য নবদ্বীপ শ্রীমায়াপুরে সংস্কৃত টোল সংস্থাপন করিয়া শাস্ত্রানুশীলন লীলা প্রকট করিলেন।শ্রীমন্মহাপ্রভুর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শ্রীবিশ্বরূপ প্রত্যহ প্রাতে গঙ্গাস্নান করিয়া অদ্বৈতাচার্য্য সভায় শাস্ত্র ব্যাখ্যা শ্রবণ করিতে যাইতেন।সংসার অনিত্য এবং মনুষ্যজন্মের একমাত্র কৃত্য কৃষ্ণভজন,এইরূপ বিচার করিয়া বিশ্বরূপ সংসার ত্যাগের সংকল্প করিয়া পিতামাতা বিবাহের আয়োজন করিতেছেন দেখিয়া সংসার ত্যাগ করতঃ সন্ন্যাস গ্রহণ করিলেন এবং শ্রীশঙ্করারণ্য নামে খ্যাত হইলেন।

বৈষ্ণব যে কোন কূলে আবির্ভূত হইলেও তিনি যে সকলের বন্দনীয় পূজ্য তাহা শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্যের লীলা বৈশিষ্ট্য খ্যাপিত হইয়াছে।লোকশিক্ষক শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য তাঁহার আচরণ সর্ব্বতোভাবে শাস্ত্র সম্মত এবং হরিদাস ঠাকুরের ন্যায় বৈষ্ণবের ভোজন কোটীব্রাহ্মণ ভোজনতুল্য,তাহা প্রখ্যাপনের জন্য কেবলমাত্র বৈষ্ণব ব্রাহ্মণের ভোজ্য শ্রাদ্ধপাত্র হরিদাস ঠাকুরকে অর্পণ করিয়াছিলেন।শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য প্রভুকে যিনি বৈষ্ণবের মধ্যে সর্ব্বশ্রেষ্ঠজ্ঞানে সেবা করেন,তাঁহাকেই বৈষ্ণব বলা যাইবে,আর যাঁহারা অদ্বৈত প্রভুকে বিষয়জাতীয় কৃষ্ণবুদ্ধি করিয়া শ্রীগৌরসুন্দরকে আশ্রয়জাতীয় ভক্তজ্ঞান করিলেন,তাঁহারা কোনদিনই কৃষ্ণপাদপদ্ম লাভ করিতে পারিবেন না।
সর্ব্বজীবের প্রতি দয়ার্দ্রচিত্ত শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্যের প্রতি শচীমাতার কটাক্ষকেও মহাপ্রভু ক্ষমা না করিবার লীলা প্রদর্শন করতঃ বৈষ্ণবপরাধ হইতে সাবধান করিয়াছেন। বাৎসল্যরসের সেবিকা সাক্ষাৎ যশোদাদেবীর অভিন্নস্বরূপ শ্রীশচীমাতার অপরাধ যেখানে ক্ষমাই হইতেছে না,সেখানে অন্যের কথা কি বলাযায়।এখানে আরও একটি বিষয় শিক্ষণীয় যে,বৈষ্ণবের কখনও অভিমান হয় না।স্বয়ং ভগবান গৌরহরিকে গর্ভে ধারণ করিয়াও শচীমাতার কোন অভিমান ছিল না।নিজকৃত অপরাধের কথা জানার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিনা দ্বিধায় অদ্বৈতাচার্য্যের নিকট যাইয়া ক্ষমা চাইলেন।
কাটোয়াতে কেশবভারতীর নিকট সন্ন্যাস গ্রহণের পর শ্রীমন্মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণপ্রেমে বিহ্বল হইয়া বৃন্দাবনাভিমুখে ধাবিত হইলে শ্রীমন নিত্যানন্দ প্রভু শ্রীমন্মহাপ্রভুর অপূর্ব্ব সন্ন্যাসমূর্ত্তি নবদ্বীপ বাসি ভক্তগণকে প্রদর্শনের জন্য বালকগণের মাধ্যমে বৃন্দাবন পরিবর্ত্তে গঙ্গাতীরে শান্তিপুরে শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্যের গৃহে অবস্থান করেছিলেন।শান্তিপুরে মহাপ্রভুর আগমন - সংবাদ জানিতে পারিয়া শচীমাতা এবং নবদ্বীপবাসী ভক্তগণ অদ্বৈতাচার্য্যের গৃহে আসিয়া শ্রীমন্মহাপ্রভুর অপূর্ব্ব সন্ন্যাসমূর্ত্তি দর্শন করিয়া বিরহজনিত সুখলাভ করিলেন।

তৃতীয় বৎসর গৌড়দেশ হইতে মহাপ্রভুর ভক্তগণ,মহাপ্রভু শৈশবকালে যে সকল দ্রব্য ভোজন করিতে ভালবাসিতেন;সেই সকল দ্রব্য - সম্ভার লইয়া গৃহিণীগণসহ পুরীতে পৌঁছিলে ভক্তবৎসল মহাপ্রভু তাঁহাদের প্রদত্ত - দ্রব্যসমূহ প্রীতির সহিত ভোজন করিয়াছিলেন।একদিন অদ্বৈতাচার্য্য প্রভু কর্তৃক বিশেষভাবে আমন্ত্রিত হইয়া মহাপ্রভু ভিক্ষার্থ তাঁহার গৃহে গিয়াছিলেন।অদ্বৈত- গৃহিণী পাককার্য্যের দ্রব্যাদি সজ্জিত করিয়া দিলে শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য স্বয়ং রন্ধন করিলেন। অদ্বৈতাচার্য্যের হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা তিনি মহাপ্রভুকে একাকী মনের সাধে খাওয়াইবেন।  দৈববশতঃ সেইদিন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া এবং ঝড় বৃষ্টি হওয়ায় মহাপ্রভুর সহিত যে সকল সন্ন্যাসী ভিক্ষা করিতে আসিতেন,তাঁহারা কেহই আসিতে পারেন নাই। মহাপ্রভু একাকী উপস্থিত হইলে শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য মনের আনন্দে মহাপ্রভুকে বহুবিধ ব্যঞ্জনাদি ভোজন করাইলেন।ইন্দ্রদেব অদ্বৈতাচার্য্যের ইচ্ছা পূর্ত্তি করায় তাঁহাকে কৃষ্ণের সেবকরূপে স্তব করিলেন।  শ্রীমন্মহাপ্রভু শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্যের মনোগত ভাব বুঝিয়া তাঁহার মহিমা কীর্ত্তন করিতে করিতে বলিলেন,যাঁহার ইচ্ছা স্বয়ং কৃষ্ণ পূর্ণ করেন,ইন্দ্র তাঁহার আজ্ঞা পালন করিবেন,ইহাতে আশ্চর্য্য কি ?
শ্রীমন্মহাপ্রভু স্বয়ং শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্যের গুণ - মহিমা কীর্ত্তনমুখে তাঁহার তত্ত্ব প্রকাশ করিয়াছেন।

'অদ্বৈতাচার্য্য গোসাঞি সাক্ষাৎ ঈশ্বর।
তাঁর সঙ্গে আমার মন হইল নির্ম্মল।।
সর্ব্বশাস্ত্রে কৃষ্ণভক্ত্যে নাহি যাঁর সম।
অতএব অদ্বৈত - আচার্য্য তাঁর নাম।।
যাঁহার কৃপাতে ম্লেচ্ছের হয় কৃষ্ণভক্তি।
কে কহিতে পারে তাঁর বৈষ্ণবতা শক্তি ।।'
১৪৮০ শকাব্দে তিনি অপ্রকটলীলা করেন অর্থাৎ তাঁহার প্রকটলীলা ১২৫ বৎসর।

💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐 🌷 কামদা একাদশী 🌷 💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐 শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ সকল সাধু , গুরু , বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দের...