Friday, January 24, 2020

নিত্যলীলা প্রবিষ্ট ওঁ বিষ্ণুপাদ পরিব্রাজকাচার্য্য ত্রিদন্ডী স্বামী ১০৮ শ্রী - শ্রীমদ্ভক্তিগৌরব বৈখানস গোস্বামী মহারাজ
(তিরোভাব)
১৮৭৭ খৃঃ কার্ত্তিক মাসে কৃষ্ণ প্রতিপদ তিথিতে গঞ্জাম জেলায় বড়গড় গ্রাম নিবাসী জমিদার এবং কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবারে জ্যৈষ্ঠ পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেন I পিতা মাতা শিশুর নাম রাখেন 'উজ্জ্বলেশ্বর রথ I ইহার পিতার নাম যদুমনী রথ এবং মাতার নাম ললিতাদেবী I পিতা পিতামহাদি পূর্ব্বপুরুষগণ এবং ইনি,সকলেই পুরুষানুক্রমে  বড়গড় রাজার  রাজ্পৌরহিত্যের কার্য্যভার অতি সম্মানের সহিত বহন করিয়া আসিতেছিলেন I পিতা যদুমনী রথ যথাযথ সময়ে শুভলগ্নে শিশুর উপনয়নাদি সংস্কার যজ্ঞ সমাপন করিলেন এবং বিদ্যালাভ করিবার জন্য গুরুর হস্তে সমর্পন  করিলেন I ইনি শিশুকাল হইতেই গম্ভীর মৌনী প্রকৃতির ছিলেন I অতি শীঘ্র সকল শিশু পাঠ্য আয়ত্ত করিয়া গুরু এবং অন্যান্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিলেন I শিশুর অস্বাভাবিক প্রতিভা দর্শন করিয়া পিতা নিকটস্থ ভঞ্জনগর উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্ত্তি করিয়া দিলেন I একদিন সকল সহপাঠিগণ মধ্য হইতে সর্ব্ব বিষয়ে অগ্রণী অধিকার সূত্রে স্কুলের শিক্ষকগণ এবং অন্যান্য সকলের মুখ উজ্জ্বল করিয়া যথাক্রমে সংস্কৃত উড়িষ্যা ভাষায় রাজনীতি,অর্থনীতি,তর্কনীতি এবং সমগ্র দর্শন শাস্ত্রে মহাপান্ডিত্য পূর্ণ যোগ্যতা অর্জ্জন করিয়া রাজ্যের সকলের প্রীত্যস্পদ সকলের হৃদয়কে জয় করেন I

এক সময় উক্ত রাজ্যের (উড়িষা) রাজা উজ্জ্বলেশ্বরের  প্রতিভার কথা শ্রবণ করিয়া রাজসভাকবি এবং রাজপণ্ডিতমণ্ডলীর সহিত প্রশ্নোত্তর মুখে বিভিন্ন আলোচনার দ্বারা পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের জন্য সাদরে আমন্ত্রণ জানান  এবং সেই সঙ্গে উক্ত সভায় পণ্ডিতন্বনমন্য রূপে সভাপতির শাস্ত্রযুক্তি দ্বারা সমস্ত প্রশ্নের যথার্থ সদুত্তর  এবং নানা মতবাদ প্রচণ্ড প্রতাপের সঙ্গে খণ্ড - বিখণ্ডিত করিয়া উক্ত সভার সমস্ত পণ্ডিতমণ্ডলীকে পরাস্ত করিয়া জয়লাভ করেন I রাজা পারিষদগণ সহ ইঁহার এমন পান্ডিত্যে অত্যন্ত মুগ্ধ হইয়া ইঁহাকে ''পাট্টযোশী'' উপাধি প্রদান করেন এবং সেই সঙ্গে সভার 'শ্রেষ্ঠ সভাকবি' রূপে এবং 'রাজগুরুর' পদে সম্মানিত করিয়া ঘোষণা করেন,শুধু তাই নয়,স্বয়ং রাজা তাঁহাকে নিজের অভিন্ন আত্মা রূপে সর্ব্বক্ষণ নিজের নিকটেই রাখিতেন I
এক সময় রাজা পারিষদগণ সহ রাজগুরুকে সঙ্গে লইয়া বনভ্রমণ করিতে যাত্রা করিলেন I ক্রমে বহু দূরবর্ত্তী স্থানে গভীর অরণ্য মধ্যে অত্যন্ত ক্ষুধার্ত্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িলেন I তিনি আর চলিতে না পারিয়া এক বৃক্ষমূলে আশ্রয় লইলেন I এদিকে দিনের শেষে সন্ধ্যা নামিল I রাজগুরু যোগবলে একটি কুটির এবং একজন শবরকে প্রকাশ করিলেন I সেই  শবর বহু কন্দমূল দ্বারা পাট্টযোশীর আদেশে রাজা সহ সকলের উদর পূর্ত্তি করিয়া খাওয়াইলেন I রাজার ক্ষুধা নিবৃত্তি হইলে উক্ত কুটির মধ্যে সুখে রাত্রিতে বিশ্রাম করিয়া প্রশান্ত হইলেন I প্রভাত কালে রাজ্যে ফিরিবার সময় রাজা পাট্টযোশীকে বলিলেন,- গত রাত্রে এমন গভীর অরণ্য মধ্যে অতি অপরূপ সুমিষ্ট কন্দমূল ভোজন করিয়া আমরা সকলে এত সুন্দর সুস্থ আছি I খুবই তৃপ্ত হইয়াছি I আপনি বনবাসী লোকটিকে ডাকুন আমি উহাকে কিছু উপহার দিতে চাই I সময়ান্তরে রাজা দেখিলেন কোন কুটির এবং শবর কিছুই নাই কেবল ভয়ঙ্কর গভীর জঙ্গল মাত্র, রাজা পূর্ব্ববৎ সেই বৃক্ষ তলাতেই বসিয়া আছেন I তিনি অবাক হইয়া বলিলেন কি ? কেমন হইল ? রাজগুরু হাসিতে লাগিলেন I তখন রাজার বুঝিতে আর বিন্দুমাত্রও সন্দেহ থাকিল না I সমস্ত রাজগুরু পাট্টযোশীর অলৌকিক  কার্য্য I

১৯২১ খ্রীঃ ইনি গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়া ব্রহ্মপুর জেলে কিছুদিন বাস করিয়া ছিলেন I জেলে বাস কালীন উনার কথায় এবং ব্যবহারে দিব্য দর্শনে মুগ্ধ হইয়া সরকার অতি শীঘ্র মুক্তি দিয়েছিলেন I

১৯২৪ খ্রীঃ গঞ্জাম জেলায় শ্রীল প্রভুপাদের প্রচার কালে ইনি তাঁহার দর্শন লাভ করিয়াছিলেন I ১৯৩২ খ্রীঃ কলিকাতা থেকে শ্রীল প্রভুপাদের সহিত নৌকা যোগে মায়াপুরে আসিবার কালে পানের থুক গঙ্গায় ফেলিলে, তাহা দেখিয়া শ্রীল প্রভুপাদ গঙ্গার মহিমা কীর্ত্তন করিলেন,তাহা শ্রবণ করিয়া গঙ্গাদেবী চরণে এবং শ্রীহরির চরণে ক্ষমা প্রার্থনা করিতে করিতে ইনি বহুদিনের সঙ্গী রূপোর পানের কৌটা সরস্বতীর চরণে বিসর্জ্জন দিয়া চিরকালের মত পানের নেশা পরিত্যাগ করিলেন I শ্রীধাম মায়াপুরে শ্রীচৈতন্যমঠে পৌঁছিয়া গৌর  লীলাস্থান দর্শন করিয়া শ্রীল প্রভুপাদের শ্রীচরণে পতিত হইয়া শ্রীহরিনাম দীক্ষা গ্রহণ করিলেন I

শ্রীচৈতন্যমঠে থাকা কালে একদিন শ্রীল প্রভুপাদের চরণে কিছু হরিকথা কীর্ত্তনের জন্য নিবেদন করিলেন I তখন শ্রীল প্রভুপাদ সেই মূহুর্ত্ত্যে মঠের বাগিচায় কার্য্যরত শ্রীপাদ রামদাস প্রভুর নিকট হরিকথা শ্রবণের জন্য প্রেরণ করেন I তখন ইনি বাগানে যাইয়া রামদাস প্রভুর চরণে শ্রীল প্রভুপাদের আদেশ নিবেদন করিলেন I ইহা শ্রবণ করিবামাত্র শ্রীপাদ রামদাস প্রভু অত্যন্ত দুঃখের সহিত বলিতে লাগিলেন আমি তো নিতান্ত মূর্খ অজ্ঞ হরিকথা কি তাহা কিছুই জানি না I আমি কি আপনাকে হরিকথা শুনাইব I শ্রীল প্রভুপাদ কি জন্য আমাকেই আদেশ করিলেন জানি না I তবে,তাঁহার শ্রীআদেশ শিরে ধারণ করতঃ আপনাকে তাঁহারই শ্রীমুখপদ্ম নিঃসৃত কিছু হরিকথা বলিব আপনি শ্রবণ করুন I এই বলিয়া অত্যন্ত অস্বাভাবিক দৈন্যের সহিত কাঁদিতে কাঁদিতে শ্রীপাদ রামদাস প্রভু অত্যন্ত প্রেম বিহ্বল হইয়া হরিকথা কীর্ত্তন করিয়া শ্রবণ করাইলেন বাগানের মধ্যেই I শ্রীপাদ রামদাস প্রভুর এইরূপ দৈন্য দর্শন করিয়া এবং অত্যন্ত প্রেম বিহ্বলাক্রান্ত হরিকথা শ্রবণ করিয়া অত্যন্ত আশ্চর্য্য হইলেন সেই সঙ্গে অতীব মুগ্ধ হইলেন I এই কথা শ্রীল প্রভুপাদের চরণে জানাইলেন,তখন শ্রীল প্রভুপাদ বিচার করিয়া বুঝিলেন যে ইনি ঠিক বৈষ্ণব চিনিয়াছেন I সেই হইতে শ্রীল প্রভুপাদ ইঁহার প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়া কৃপা করিয়া ১৯৩৪ খ্রীঃ,১লা মার্চ্চ ফাল্গুনমাসে গৌরপূর্ণিমা দিনে ত্রিদণ্ডসন্ন্যাস প্রদান করিলেন I সন্ন্যাসনাম দিলেন 'ত্রিদন্ডীস্বামী শ্রীমদ্ভক্তিগৌরব বৈখানস মহারাজ' I শ্রীল প্রভুপাদের ইচ্ছায় শ্রীচৈতন্যমঠের সেবায় মনোনিবেশ করিলেন I বহু গৌড়ীয় গ্রন্থ সংস্করণ এবং সংস্কৃত ভাষায় বক্তৃতা বিষয়ে শ্রীল প্রভুপাদের পাশে থাকিয়া চৈতন্যমঠের বহুসেবা করিয়াছেন I ফলে শ্রীল প্রভুপাদের অত্যন্ত প্রীতিভাজন হন I

শ্রীল প্রভুপাদের অপ্রকটের পর ইনি বহরম পুর শহরে রাধাকৃষ্ণ মন্দিরের পাশে একটি চালাঘর ভাড়া লইয়া ভজন করিতেন এবং ভিক্ষা দ্বারা জীবন নির্বাহ সেবা করিতেন I ১৯৫০ খ্রীঃ ইনি সোমনাথ সাহু রামমোহন পট্টনায়েককে দীক্ষাদি দ্বারা শিষ্য করিলেন I বহরমপুর শহরে প্রেমনগর স্থানে ''সারস্বত আশ্রম'' নামে প্রথম একটি মঠ প্রতিষ্ঠা করিয়া প্রভুপাদের কথা প্রচার করেন I উক্ত আশ্রমটির ছাদ ঢালাইয়ের দিন মধুসূদন শর্ম্মা নামে এক সেবক মারা গেল I ইহাতে মহারাজ মঠের ভবিষ্যৎ অশুভ লক্ষণ বিচার পূর্বক আশ্রমটি বিক্রয় করিয়া দেন I পুনরায়  গৌঞ্জ নামক স্থানে শ্রীপাদ কৃষ্ণদাসপ্রভুর চালা বাড়িতে থাকিয়া ১৯৫৯ খ্রীঃ,কৃষ্ণদাসপ্রভুকে লইয়া চালা ঘরটি মঠ আকারে রূপ দিয়া  বিগ্রহ স্থাপনাদি দ্বারা সেবা প্রকাশ করিলেন I ক্রমান্বয়ে এই মঠকে কেন্দ্র করিয়া শ্রীমদ ভক্তিবৈভব পুরীগোস্বামী মহারাজ,শ্রীমদ ভক্তিদয়িত মাধব গোস্বামী মহারাজ,শ্রীপাদ নিত্যানন্দ প্রভু,শ্রীপাদ কৃষ্ণদাস প্রভু এবং ধরাকোট রাজার রাজপুরোহিত শ্রীপাদ আনন্দলীলাময়বিগ্রহ প্রভু আদি সকলে মিলিয়া অবিরাম শ্রীহরিকথা প্রচার করিলেন I ইহার ফল স্বরূপ উড়িষ্যা রাজ্যে অগণিত নর - নারী শ্রীহরিনাম গ্রহণ করিয়া চিরদিনের সংসার যন্ত্রণা হইতে মুক্তির পথ খুঁজিয়া পাইলেন I

১৯৬৬ খ্রীঃ জানুয়ারী,বাং - ২২শে মাঘ শুক্লা প্রতিপদে শ্রবণা নক্ষত্র যুক্ত মধ্যাহ্ন সময়ে ৯৫ বৎসর বয়সে শ্রীল মহারাজ, গৌঞ্জনগর আশ্রমে নিশ্বাস ত্যাগ তথা অপ্রকটলীলা প্রকাশ পূর্বক গোলকলীলায় অপ্রাকৃত সেবায় প্রবেশ করিলেন

No comments:

Post a Comment

🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴🌴🌳 🌻🌼 শ্রীবলরামের রাসযাত্রা 🌹 শ্রীকৃষ্ণের বসন্তরাস 🌼🌻 🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴...