Wednesday, January 15, 2020


শ্রীল জয়দেব গোস্বামী
(তিরোভাব)
শ্রীল জয়দেবের আবির্ভাবকাল একাদশ বা দ্বাদশ শতাব্দীতে বীরভূম জেলার অজয়নদের তীরবর্তী কেন্দুবিল্ব  গ্রামে তাঁর জন্ম। কেউ কেউ তাঁকে উৎকল দেশে,অপর কাহারও মতে দাক্ষিণাত্যে  অধিবাসী বলেও মনে করেন। তাঁর পিতা ছিলেন ভোজদেব, মাতা বামাদেবী এবং  স্ত্রী পদ্মাবতী।শ্রীজয়দেব অজয় নদ হইতে শ্রীরাধামাধব বিগ্রহ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন I অজয় নদের তীরে কুশেস্বর শিবের স্থানে বসিয়া তিনি বিশ্রাম করিতেন এবং সাধন ভজনে নিমগ্ন থাকিতেন I শ্রীল জয়দেব বঙ্গদেশের রাজা শ্রীলক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালে রাজধানী নবদ্বীপ নগরে লক্ষ্মণ সেন রাজার রাজপ্রাসাদের নিকটবর্ত্তী স্থানে অনেকদিন অবস্থান করিয়াছিলেন I তিনি কিছুকাল লক্ষ্মণ সেনের সভায় রাজকবি ছিলেন I শ্রীলভক্তিবিনোদ ঠাকুর - রচিত নবদ্বীপধাম - মাহাত্ম্য গ্রন্থ পাঠে জানা যায় শ্রীজয়দেব - রচিত 'দশাবতার স্তোত্র' শ্রীলক্ষ্মণ সেন রাজা শুনিয়া চমৎকৃত হইয়াছিলেন এবং রাজবেশ পরিত্যাগ পূর্ব্বক জয়দেবের সহিত দেখা করিতে গিয়েছিলেন I শ্রীজয়দেবের সাক্ষাৎ সান্নিধ্যে আসিয়া রাজা তাঁহার মহাপুরুষোচিত অলৌকিক লক্ষণ দর্শনে তাঁহার প্রতি আরও অধিক আকৃষ্ট হইয়াছিলেন I রাজা তাঁহার পরিচয় প্রদান পূর্ব্বক তাঁহার রাজপ্রাসাদে যাইয়া তাঁহাকে অবস্থানের জন্য অনুরোধ করিলেন I বিষয়ী রাজগৃহে যাইতে তিনি অনিচ্ছা প্রকাশ করিলেন I তিনি শ্রীজগন্নাথ ক্ষেত্রে চলিয়া যাইবেন বলিয়া রাজাকে বলিলেন I লক্ষ্মণ সেন রাজা তাহাতে মর্ম্মাহত হইয়া কবিবর শ্রীজয়দেবকে নবদ্বীপ ছাড়িয়া না যাইতে প্রার্থনা করিলেন এবং নবদ্বীপ মণ্ডলের মধ্যে রমণীয় চাঁপাহাটি গ্রামে অবস্থান করিতে বলিলেন I তিনি কখনও জয়দেবের অনুমতি ব্যতীত তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইবেন না I রাজার দৈন্যোক্তিতে সন্তুষ্ট হইয়া জয়দেব চাঁপাহাটিতে অবস্থান করিলেন I

মহাপ্রভুর পার্ষদ দ্বিজ বাণীনাথ মহাপ্রভুকে যেরূপ সত্যযুগে চম্পকবর্ণ বিপ্ররূপে তথায় দর্শন করিয়াছিলেন,ভক্তবর জয়দেবও তদ্রুপ প্রথমে শ্রীরাধাগোবিন্দ পরে রাধাগোবিন্দ - মিলিততনু চম্পকবর্ণস্বরূপ শ্রীমন্মহাপ্রভুকে তথায় দর্শন করিয়াছিলেন I মহাপ্রভু তাঁহাকে দর্শন দিয়া পুরুষোত্তম ধামে যাইবার জন্য আদেশ প্রদান করিলেন I তিনি মহাপ্রভু আদেশ পালনের জন্য পুরুষোত্তম ধাম গমন করিলেন I তিনি উৎকল রাজার সভাপণ্ডিত হইয়াছিলেন I তাঁহার রচিত অপ্রাকৃত বিপ্রলম্ভ রসপূর্ণ কবিতা গ্রন্থের নাম 'শ্রীগীতগোবিন্দ' বা 'অষ্টপদী' I

এইরূপ কথিত হয় যে,শ্রীজগন্নাথদেবের আজ্ঞায় শ্রীজয়দেব পদ্মাবতীকে পত্নীরূপে গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন I জয়দেব আবার সংসারী হইলেন I এক নারায়ণবিগ্রহও প্রতিষ্ঠা করিলেন এবার তাঁহার হৃদয়ে কৃষ্ণপ্রেমের স্রোত বহিতে লাগিল,সেই স্রোতে ভাসিতে ভাসিতে অপূর্ব্ব পীযূষ - পূরিত গীত - গোবিন্দ প্রচার করিলেন I কথিত আছে,জয়দেব  গীতগোবিন্দে সকল রস সকল ভাবের অবতারণা করিলেন,কিন্তু মান - প্রকরণে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ খণ্ডিতা নায়িকা রাধারাণীর পায়ে ধরিবেন,এই কথাটি লিখিতে সাহসী হইতেছেন না I দৈবক্রমে একদিন তিনি সমুদ্রস্নানে বাহির হইয়াছেন,এই সময়ে স্বয়ং জগন্নাথ জয়দেবের বেশে তাঁহার গৃহে প্রবেশ করিয়া তাঁহার পুঁথি খুলিয়া ''দেহি পদপল্লবমুদারং'' এই বাক্যদ্বারা তাঁহার 'স্মরগরলখণ্ডনং মম শিরসি মণ্ডনং' এই চরণের পাদপূরণ করিয়া গেলেন I পদ্মাবতী এত শীঘ্র জয়দেবকে আসিতে দেখিয়া কহিলেন ''এইমাত্র তুমি স্নান করিতে গেলে,এর মধ্যে ফিরিয়া আসিলে কেন ? জয়দেবরূপী শ্রীকৃষ্ণ উত্তর দিলেন - যাইতে যাইতে একটি কথা মনে পড়িয়া গেল,পাছে ভুলিয়া যাই,সেইজন্যই আসিয়া লিখিয়া গেলাম I'' জয়দেবরূপী শ্রীকৃষ্ণ এই বলিয়া যেমন চলিয়া গেলেন,তাহারই অল্পক্ষণ পরে জয়দেব স্নান করিয়া গৃহে উপস্থিত হইলেন I এবার পদ্মাবতী খুবই অবাক্ হইয়া বলিলেন, এই তুমি স্নান করিতে গিয়েছিলে,ফিরে এসে এই কতক্ষণ লিখিয়া গেলে,আবার এত অল্পসময় মধ্যে কিরূপে আসিলে ?এখন আমার মনে সন্দেহ হইতেছে,যে লিখিয়া গেল সেই বা কে,আর তুমিই বা কে ? বুদ্ধিমান জয়দেব তখনি গিয়া আপনার পুঁথি খুলিয়া দেবাক্ষর দর্শন করিলেন I পুলকে প্রেমাবেশে তাঁহার হৃদয় বহিয়া অশ্রু বিগলিত হইতে লাগিল I পদ্মাবতীকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ''তুমিই ধন্য, তোমারই জন্ম সার্থক,তোমার ভাগ্যে মহাপ্রভুর দর্শন লাভ হইল,আমি হতভাগ্য,সেইজন্য তাঁহার দর্শন পাইলাম না I'' 

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু শেষলীলায় শেষ ১২ বৎসর রাধাভাবে বিভাবিত হইয়া গূঢ় প্রেমরস আস্বাদনকালে জয়দেবের রচিত গীতগোবিন্দ আস্বাদন করিয়াছিলেন I

''শ্রীরাধার প্রলাপ যৈছে উদ্ধব দর্শনে I
সেইমত উন্মাদ প্রলাপ করে রাত্রিদিনে II

বিদ্যাপতি জয়দেব চণ্ডীদাসের গীত I
আস্বাদনে রামানন্দ স্বরূপ সহিত II’’

শুনা যায়, শ্রীজয়দেব দীর্ঘকাল বৃন্দাবনে বাস করিয়া স্বীয় জন্মভূমি কেন্দুবিল্ব গ্রামে আসিয়া সাধন ভজন করেন I তিনি প্রত্যহ বহুদূরে গিয়া গঙ্গাস্নান করিতেন I একদিন দৈবক্রমে গঙ্গাস্নানে যাইতে না পারিয়া তিনি অত্যন্ত কাতর হইলে গঙ্গাদেবী কেন্দুবিল্ব গ্রামে প্রবাহিত হইয়া তাঁহাকে কৃপা করেন I কথিত হয় স্বীয় জন্মভূমিতেই শ্রীজয়দেবের সাধনলীলার পরিসমাপ্তি ঘটে I

শ্রীজয়দেব পণ্ডিত পৌষী কৃষ্ণা - ষষ্ঠী তিথিতে তিরোধানলীলা করেন I তাঁহার পবিত্র স্মৃতি সংরক্ষণার্থ অদ্যাপি প্রতিবর্ষে কেন্দুবিল্ব গ্রামে মাঘ - সংক্রান্তির দিন মেলার অধিষ্ঠান হয় I



No comments:

Post a Comment

🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴🌴🌳 🌻🌼 শ্রীবলরামের রাসযাত্রা 🌹 শ্রীকৃষ্ণের বসন্তরাস 🌼🌻 🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴...