Sunday, January 26, 2020

বিরহের দশম দশা
মরিব মরিব সখি নিশ্চয় মরিব।
কানু হেন গুণনিধি কারে দিয়া যাব।।
তোমরা যতেক সখি থেকে মঝু সঙ্গে।
মরণ কালে কৃষ্ণনাম লিখো মোর অঙ্গে।।

ললিতা প্রাণের সখি মন্ত্র দিও কানে
মোর দেহ পোড়ে যেন কৃষ্ণনাম শুনে।।
না পোড়াইও মোর অঙ্গ, না ভাসাইও জলে
মরিলে তুলিয়া রেখো তমালের ডালে ।।

সেই সে তমাল তরু কৃষ্ণবর্ণ হয়।
অচেতন তনু মোর তাহে যেন রয়
কবহু সে পিয়া যদি আসে বৃন্দাবনে
 পরাণ পাইব আমি পিয়া দরশনে ।।

পুন যদি চান্দমুখ দরশ না পাব।
বিরহ অনলে মোর তনু তেয়াগিব ।।
কহিতে কহিতে ধনি মূরছিত ভেল
ধাই বিশাখা তারে কোলে করি নিল ।।

থর থর কাঁপে অঙ্গ ক্ষীণ বহে শ্বাস।
নাসাগ্রে তুলা ধরি দেখয়ে নিশ্বাস ।।
শ্রবণে বদন দেই কহে কৃষ্ণনাম।
চেতন পাইয়া কহে কাহাঁ ঘনশ্যাম ।।

সম্মুখে তমাল হেরি করে নিরীক্ষণ।
উন্মাদিনী হয়ে যায় দিতে আলিঙ্গন ।।
ঐছন ধনির দশা করি নিরীক্ষণ।
গোবিন্দ দাস ভেল সজল নয়ন
শ্রীকৃষ্ণ মথুরায় গিয়ে আর বৃন্দাবনে ফিরে এলেননা শ্রীকৃষ্ণবিরহে উন্মাদিনী রাধার দশম দশা উপস্থিত। রাধাঠাকুরানী বিলাপ করছেন। শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের জ্বালা তাঁর কাছে মৃত্যুর সমান। তাই তিনি বিরহ সাগরে ডুবে সখীকে বলছেন পিয়ার বিরহ আর তিনি সহ্য করতে পারছেন না, এইবার তাঁর মৃত্যু আসন্ন। যাঁর বিরহে মৃতপ্রায়, মৃত্যু কালে রাধিকা সেই কানাইকেই জন্মজন্মান্তরের প্রিয়রূপে পাওয়ার জন্য বিধাতার কাছে বর চাইছেন। মরণকালেও রাধিকার একটিমাত্র দুঃখ শেষসময়ে তিনি কৃষ্ণ দরশন পেলেন না। তাঁকে না দেখে মরেও যে শান্তি নেই শ্রীগোবিন্দ দাসের উপরোক্ত পদটিতে বিরহিনী রাইয়ের দশম দশার ছবিটি পরিস্ফুট হয়েছে

বিরহের চরমাবস্থায় শ্রীরাধারাণী দশম দশাগ্রস্ত। দশম-দশা মৃত্যু ! মরণ সময়ের সকল লক্ষণ এখানে প্রকাশ পাচ্ছে। শ্রীরাধার প্রবল উৎকন্ঠা, প্রাণ ত্যাগের সময় উপস্থিত, দেহে প্রাণ আর থাকবে না। এমন অবস্থায় নীলরতনের কী করবেন! কে তাঁকে দেখবে, প্রেম-সেবায় তুষ্ট করবে! কার কাছে দিয়ে যাবে প্রাণের প্রাণ স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণকে? "কানু হেন গুণনিধি কারে দিয়ে যাব।" শ্রীরাধারাণী ভাবলেন ,মরম বুঝে সেবা করার মত একমাত্র চন্দ্রাবলীই আছেন। তাকেই সঁপে যাব আমার কালমাণিক! ডেকে পাঠালেন চন্দ্রাবলীকে। 
 শৈব্যাদি সখীগণ গিয়ে নিয়ে এলেন চন্দ্রাবলীকে তিনি শ্রীরাধারাণীর বিরহ অবস্থাটি দেখলেন! প্রেম যত গাঢ় হবে , বিরহ-বেদনা হবে তত তীব্র। চন্দ্রাবলী বুঝলেন, শ্রীরাধার কৃষ্ণপ্রেম অনেক গভীরতর। সে তাঁর সমকক্ষ কোনও মতেই নয়। কৃষ্ণপ্রেমধনে শ্রীরাধা অনেক বড় ধনী ! শ্রীরাধারাণীর  সঙ্গে বিরোধিতা ভালো হয় নি। তাঁর উচিৎ ছিল শ্রীরাধার আনুগত্যে চলা। জীবনে একটা চরম ভুল হয়েছে বুঝে পেয়েছেন, সেই পুরুষের সঙ্গ তিনি চিরন্তন কালের জন্য কামনা করেন।
শ্রীরাধা চন্দ্রাবলী উভয়েই শ্রীকৃষ্ণের মধুর -রসের পরম আশ্রয়, রূপে-গুণে দুজনেই প্রায় সমতুল্যা এবং শ্রীকৃষ্ণের পরম-প্রেমবতী। তাঁদের কৃষ্ণপ্রেমের পার্থক্যগুলি হল এইশ্রীরাধার মধুস্নেহ, চন্দ্রাবলীর ঘৃতস্নেহ, শ্রীকৃষ্ণের আদরে চন্দ্রাবলী সব সময়েই বশীভূতা, শ্রীরাধা কখনও কখনও। শ্রীরাধা বামা নায়িকা, চন্দ্রাবলী দক্ষিণা - বামা বলে শ্রীরাধা সব সময় মানযুক্তা, অপরদিকে দক্ষিণা বলে চন্দ্রাবলী দাক্ষিণ্য ভাবপূর্ণা। শ্রীরাধার প্রেম মদীয়তাময়, চন্দ্রাবলীর প্রেম তদীয়তাময়। শ্রীরাধা জানেন কৃষ্ণ আমারই, আর কারো নয়, তো চন্দ্রাবলী জানেন আমি শ্রীকৃষ্ণের, আর কারো নই। শ্রীরাধার প্রেমে কৃষ্ণ বশীভূত, চন্দ্রাবলী শ্রীকৃষ্ণের প্রেমে মুগ্ধা
 লীলার সৌকর্যার্থে বিপক্ষে থেকে লীলার পুষ্টি করেন চন্দ্রাবলী এবং সংকর্ষণ অর্থে শ্রীভগবানের লীলাদির কার্যকরী শক্তি তিনি মধুর -রসে চন্দ্রাবলী সংকর্ষণ-স্থানীয়। সখ্য -রসে বলদেবের যে স্থান মধুর রসে চন্দ্রাবলীর সেই স্থান। বলদেব সখ্য-রসের লীলায় কখনও উপস্থিত থেকে বা কখনও অনুপস্থিত থেকে লীলা পুষ্টি করেন, যেমন ব্রহ্ম-মোহন লীলায় কালীয়দমন লীলায়। বলরাম অনুপস্থিত থেকে লীলা সফল করেছেন। সেরূপ চন্দ্রাবলী কখনও অনুকূলে থেকে কখনও বা প্রতিকুল আচরণ করে লীলার পুষ্টি করেন। এরূপেই ব্রজলীলার রস-সমুদ্রে নানা বৈচিত্র্যের তরঙ্গ -রঙ্গ চলতে থাকে।
চন্দ্রাবলী রাধারাণীর বিরোধের ভাবটি সব সময়ে থাকে না। শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের কালেই ওই ভাব থাকে। বস্তুতঃ রস বৈচিত্র্য আস্বাদনের জন্যই শ্রীকৃষ্ণ দুজনের মধ্যে থেকে উভয়েরই পার্থক্যটি অর্থাৎ বিরোধ রক্ষা করেন। তিনি মধ্য হতে সরে গেলে আর বিরোধ থাকে না। রাধা আর চন্দ্রা তখন এক আত্মা এক প্রাণ হয়ে যান  

জয় শ্রী কৃষ্ণ ।।

No comments:

Post a Comment

🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴🌴🌳 🌻🌼 শ্রীবলরামের রাসযাত্রা 🌹 শ্রীকৃষ্ণের বসন্তরাস 🌼🌻 🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴...