Wednesday, January 29, 2020


শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া দেবী
(আবির্ভাব)
''শ্রীসনাতন মিশ্রোহয়ং পুরা সত্রাজিতো নৃপ।
বিষ্ণুপ্রিয়া জগন্মাতা সৎ কন্যা ভূস্বরূপিণী।।''

''পূর্ব্বে যিনি সত্রাজিৎ রাজা ছিলেন,তিনিই পরজন্মে সনাতন মিশ্র নামে অভিহিত হইয়াছেন।ভূস্বরূপিণী জগন্মাতা বিষ্ণুপ্রিয়া ইঁহারই কন্যা হয়েছিলেন।
যদুবংশীয় রাজা সত্রাজিতের কন্যা সত্যভামাকে কৃষ্ণ বিবাহ করিয়াছিলেন।গৌরলীলায় রাজা সত্রাজিৎ সনাতন মিশ্র এবং সত্যভামা বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী।শ্রীবিষ্ণুতত্বমাত্রই শ্রী - ভূ - লীলা ত্রিশক্তি ধৃক। শ্রীগৌরনারায়ণের শ্রীশক্তিস্বরূপিণী শ্রীলক্ষ্মীপ্রিয়াদেবী ভূ - শক্তিস্বরূপিণী অর্থাৎ ভক্তিশক্তিস্বরূপিণী শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়াদেবী এবং লীলাসক্তি শ্রীধাম।শ্রীগৌরকৃষ্ণের শক্তি শ্রীগদাধর পণ্ডিত গোস্বামী।

বিদ্যা দুইপ্রকার।যথা পরা অপরা।পরাবিদ্যাস্বরূপিণী শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর শুভাবির্ভাব তিথি শ্রীপঞ্চমীতে (মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমীতে) শুদ্ধভক্তগণ তাঁহার পূজা বিধান করিয়া থাকেন।সাংসারিক ব্যক্তিগণ জড়বিদ্যায় উৎকর্ষতা লাভের জন্য উক্ত তিথিতে অপরা - বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রীদেবী সরস্বতী পূজা করেন।
শ্রীগৌরানারায়ণের শক্তিরূপে শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর আবির্ভাব শ্রীল বৃন্দাবনদাস ঠাকুরের রচিত শ্রীচৈতন্যভাগবতে এবং শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর রচিত শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে উল্লিখিত হইয়াছে।

''আদিখণ্ডে,পূর্ব্ব পরিগ্রহের বিজয়।
শেষে রাজপণ্ডিতের কন্যা পরিণয় ।।''

''পূর্ব্ব পরিগ্রহ অর্থাৎ প্রভুর প্রথম পরিণীতা লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী,তাঁহার বিজয় অর্থাৎ দেহ - সংরক্ষণ স্বধামযাত্রা;প্রভুর দ্বিতীয়বার রাজপণ্ডিত সনাতন মিশ্রের কন্যা শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর পাণিগ্রহণ শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর - কৃত গৌড়ীয় - ভাষা দ্রষ্টব্য।

''তবে বিষ্ণুপ্রিয়া ঠাকুরানীর পরিণয়।
তবে ' করিল প্রভু দিগ্বিজয়ী জয়।।''

পূর্ব্ববঙ্গে ছাত্রগণের সহিত অধ্যাপনা লীলারসে নিমগ্ন থাকিবার জন্য শ্রীমন্মহাপ্রভুর নবদ্বীপে ফিরিতে বিলম্ব হওয়ায় শ্রীলক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী বিরহ সহন করিতে অসমর্থ হইয়া প্রভুর পাদপদ্ম ধ্যান করিতে করিতে অপ্রকট লীলা আবিষ্কার করিলেন। শ্রীমন্মহাপ্রভু নবদ্বীপে ফিরিয়া বিরহ সন্তপ্তা জননীকে সান্ত্বনা প্রদান করিলেন।অতঃপর শচীমাতা পুত্রের দ্বিতীয়বার বিবাহের জন্য উদ্বিগ্ন হইয়া কাশীনাথ পণ্ডিতকে ঘটকরূপে নবদ্বীপবাসী রাজপণ্ডিত সনাতন মিশ্রের নিকট প্রেরণ করিলেন। তাঁহার বিষ্ণুভক্তিপরায়ণা কন্যা বিষ্ণুপ্রিয়ার সহিত বিবাহসম্বন্ধ স্থির করার জন্য।সনাতন মিশ্রের প্রতি  কাশীনাথ পণ্ডিতের উক্তি…

''বিশ্বম্ভর পণ্ডিতেরে তোমার দুহিতা।
দান কর, সম্বন্ধ উচিত সর্ব্বথা ।।

তোমার কন্যার যোগ্য সেই দিব্যপতি।
তাঁহার উচিত এই কন্যা মহা - সতী।।

যেন কৃষ্ণ রুক্মিণীতে অন্যোহন্য উচিত।
সেইমত বিষ্ণুপ্রিয়া নিমাই পণ্ডিত ।।''

বুদ্ধিমান সনাতন প্রভুর বিবাহের যাবতীয় ব্যয় ভার স্বেচ্ছায় বহন করিতে স্বীকৃত হইলেন।শ্রীবিশ্বম্ভরের সহিত বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর বিবাহ সম্বন্ধ স্থির হইলে শুভলগ্নে শুভদিনে মহাসমারোহে অধিবাস উৎসব সম্পন্ন হয়।প্রভু পাল্কীর সাহায্যে গোধূলিলগ্নে রাজপণ্ডিত শ্রীসনাতন মিশ্রের গৃহে আসিয়া উপস্থিত হইলে।বেদাচার লোকাচার অনুযায়ী গৌরবিষ্ণুপ্রিয়ার বিবাহলীলা সম্পাদিত হয়।লক্ষ্মীনারায়ণের নিত্য বিবাহলীলার কথা শ্রবণ করিলে জীবের প্রাকৃত জগতের ভোক্ত - ভোগ্য - সম্বন্ধযুক্ত পুরুষ - প্রকৃতির দাম্পত্য স্পৃহা থাকে না,নারায়ণ - কেহ সর্ব্বজগতের ভোক্তা রূপে উপলব্ধির বিষয় হয়।বুদ্ধিমন্ত খান মহাপ্রভুর আলিঙ্গন কৃপালাভ করিয়া ধন্যাতিধন্য হইলেন।

বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী  শৈশবকাল হইতেই পিতৃ - মাতৃ বিষ্ণুতে ভক্তিপরায়ণা ছিলেন এবং প্রত্যহ তিনবার গঙ্গাস্নান করিতেন।তৎকালে শচীমাতার সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইত।তিনি প্রণাম করিলে শচীমাতা আশীর্বাদ করিতেন।শ্রীমন্মহাপ্রভু চব্বিশ বৎসর বয়সে কাটোয়ায় শ্রীকেশব ভারতীর নিকট সন্ন্যাস গ্রহণবার্ত্তা শ্রবণে বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর অত্যন্ত বিরহ সন্তপ্তা অবস্থা অদ্বৈতপ্রকাশ গ্রন্থে বর্ণিত হইয়াছে।প্রত্যহ প্রত্যুষে শচীমাতার সহিত গঙ্গাস্নান,সমস্ত দিন গৃহমধ্যে অবস্থান। চন্দ্র সূর্য্যও যাঁহার রূপ দেখেন না,ভক্তবৃন্দ যাঁহার শ্রীচরণ ব্যতীত রূপ দেখিতে পান না,যাঁহার কণ্ঠধ্বনিও কেহ শুনিতে পান না,সর্ব্বদা অশ্রুবর্ষণ করিতে করিতে ম্লানমুখে অবস্থান,কেবলমাত্র শচীমাতার অবশেষের দ্বারা জীবনধারণ,বিরলে নাম - কীর্ত্তন,হরিনামামৃতে গাঢ়রুচি,শ্রীগৌরাঙ্গের চিত্রপট প্রেমভক্তি সহযোগে  নিভৃতে সেবা,শ্রীগৌরাঙ্গপাদপদ্মে আত্মসমর্পণ,সহধর্মিণীর আদর্শ 'তৃণাদপি সুনিচ' শ্লোকের সহিষ্ণুতার আদর্শ।
শ্রী লোচনদাস ঠাকুর বিষ্ণু প্রিয়া দেবীর মহাপ্রভুর বিরহচৈতন্যমঙ্গল’ গ্রন্থে বর্ণন করিয়াছেন।

''বিষ্ণুপ্রিয়া কান্দনেতে পৃথিবী বিদরে। 
পশু পক্ষী লতা তরু পাষাণ ঝুরে ।।
পাপিষ্ঠ শরীর মোর প্রাণ নাহি যায়।
ভূমিতে লোটাঞ্চা দেবী করে হায় হায় ।।
বিরহ অনল শ্বাস বহে অনিবার।
অধর শুকায়,কম্প হয় কলেবর ।।''

বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী যে ভজন আদর্শ প্রদর্শন করিয়াছেন তাহা শ্রীজাহ্নবামাতার শিষ্য শ্রীনিত্যানন্দ দাস তাঁহার রচিত 'প্রেমবিলাস' গ্রন্থে বর্ণন করিয়াছেন।

''ঈশ্বরীর নাম গ্রহণ শুন ভাই সব।
সে কথা শ্রবণে লীলা হয় অনুভব।।
নবীন মৃদ্ভাজন আনে দুইপাশে ধরি।
এক শূন্যপাত্র আর পাত্রে তণ্ডুল ভরি।।
একবার জপে ষোলনাম বত্রিশ অক্ষর।
এক তণ্ডুল রাখেন পাত্রে আনন্দ অন্তর।।
তৃতীয় প্রহর পর্য্যন্ত লয়েন হরিনাম।
তাতে যে তণ্ডুল হয়,লইয়া পাকে যান।।
সেই তণ্ডুল মাত্র রন্ধন করিয়া।
ভক্ষণ করান প্রভুকে অশ্রুযুক্ত হইয়া।।
রাত্রিদিন হরিনাম প্রভুর সংখ্যা যত।
সে চেষ্টা বুঝিতে নারী বুদ্ধি অতি হত।।
প্রভুর প্রেয়সী যেঁহ তাঁহার কি কথা।
দিবানিশি হরিনাম লয়েন সর্বথা।।
তাঁহার অসাধ্য কিবা নামে এত আর্ত্তি।
নাম লয়েন তাহে রোপণ করেন প্রভুশক্তি।।''


শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়াদেবী সর্ব্বপ্রথম গৌরমূর্ত্তি প্রকাশ করিয়া পূজা করিয়াছিলেন।ইঁহার সেবিত শ্রীগৌরাঙ্গের  মূর্ত্তি অদ্যাপিও নবদ্বীপে পূজিত হইতেছেন। মহাপ্রভুর সন্ন্যাস গ্রহণ পরে শ্রীঈশান ঠাকুর শ্রীবংশীবদন ঠাকুর শচীমাতা বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর দেখাশুনা করিতেন এবং বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর কৃপা লাভ করিয়াছিলেন।

No comments:

Post a Comment

🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴🌴🌳 🌻🌼 শ্রীবলরামের রাসযাত্রা 🌹 শ্রীকৃষ্ণের বসন্তরাস 🌼🌻 🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴...