Tuesday, August 9, 2022

 

🌲🦚💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🦚🌲

🦜🌻বৈষ্ণবের বিরহ তিথি🌻🦜

🌲🦚💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🦚🌲

শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ

সকল সাধু, গুরু, বৈষ্ণব গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম I হরে কৃষ্ণ, আজ বিশেষ শুভদা তিথি। আজ শ্রীল রুপগোস্বামী শ্রীল গৌরীদাস পণ্ডিত গোস্বামীর  শুভ বিরহ তিথি।

শ্রীরূপমঞ্জরী খ্যাতা যাসীদ্ বৃন্দাবনে পুরা

সাদ্য রূপাখ্যগোস্বামী ভূত্বা প্রকটতামিয়াৎ।।”  (গৌরগণোদ্দেশদীপিকা ১৮০ শ্লোক)

অর্থাৎ,- যিনি বৃন্দাবনে পূর্ব্বে রূপমঞ্জরী নামে খ্যাতা ছিলেন, তিনি অধুনা গৌর লীলা পুষ্টির জন্য রূপগোস্বামীরূপে প্রকটিত হইয়াছেন।

 

রাধারাণীর অনুগতা সখীগণের মধ্যে প্রধানা ললিতা সখী, ললিতার অনুগতা মঞ্জরীগণের মধ্যে প্রধানা রূপমঞ্জরী। এইজন্য গৌরলীলাতে ষড় গোস্বামীর মধ্যে প্রধান রূপগোস্বামী। শ্রীআশুতোষ দেবের নূতন বাংলা অভি ধানে রূপগোস্বামীর প্রকটকালের স্থিতি ১৪৮৯ খৃষ্টাব্দ হইতে ১৫৫৮ খৃষ্টাব্দ অথবা ১৪১০ শকাব্দ হইতে ১৪৭৯ শকাব্দ প্রদত্ত হইয়াছে। শ্রীরূপগোস্বামী ভৌমলীলায় ভরদ্বাজগোত্রীয় কর্ণাটদেশীয় ব্রাহ্মণ-রাজবংশে আবির্ভূত হইয়া ছিলেন। তাঁহার পিতৃদেব ছিলেন শ্রীকুমারদেব। শ্রীজননীদেবীর পরিচয় জানা যায় না। শ্রীল নরহরি চক্রবর্ত্তী ঠাকুর (শ্রীল ঘনশ্যাম দাস) রচিত শ্রীভক্তিরত্নাকর গ্রন্থে শ্রীজীব গোস্বামীর ঊর্ধ্বতন সপ্তপুরুষের পরিচয় প্রদত্ত হইয়াছে (ভক্তিরত্নাকর ১। ৫৪০-৫৬৮)

 

শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে অনুভাষ্যে বংশপরিচয় সম্বন্ধে এই রাপ লিখিয়াছেন— “ভরদ্বাজগোত্রীয় জগদগুরু 'সৰ্ব্বজ্ঞা' নামক এক মহাতমা স্থাপনা শক শতাব্দীতে কর্ণাটদেশে ব্রাহ্মাণ রাজবংশে সমুদিত হন। তাঁহার পুত্র অনিরুদ্ধের রূপেশ্বর হরিহর নামক তনয়ছয় জন্মে। কিন্তু তাঁহারা উভয়েই রাজ্য হইতে বঞ্চিত হইলে জ্যেষ্ঠ রূপেশ্বর শিখরভূমিতে বাস স্থাপন করেন। রূপেশ্বরের পুত্র পদ্মনাভ গঙ্গাতীরে নৈহাটী নামক গ্রামে বাস করিয়া পাঁচটা পুত্র লাভ করেন। তন্মধ্যে সৰ্ব্বকনিষ্ঠ মুকুন্দের পুত্র মহাসদাচারী কুমারদের সনাতন, রূপ অনুপমের জনক। কুমারদের বাকলা চন্দ্রদ্বীপে বাস করেন। তদানীন যশোহর প্রদেশের অন্তর্গত ফতেয়াবাদ নামক স্থানে তাঁহার আলয় ছিল। তাঁহার কতিপয় পুত্রের মধ্যে তিনটী পুত্র বৈষ্ণবধর্ম্ম গ্রহণ করেন।

 

শ্রীবল্লভ চন্দ্রদ্বীপ হইতে নিজজ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শ্রীরূপ শ্রীসনাতনের সহিত গৌড়ে রাম কেলি গ্রামে কৰ্ম্মোপলক্ষে বাস করিয়াছিলেন। এখানেই জীব গোস্বামীর জন্ম হয়। নবাব সরকারের কার্য্য করায় তিনজনেই মল্লিক উপাধি লাভ করেন। শ্রীমন্মহাপ্রভু যে-কালে রামকেলিতে গিয়াছিলেন, সেই সময়ে অনুপমের সহিত তাঁহার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। শ্রীরূপ গোস্বামী বিষয়কার্য্য ত্যাগ করিয়া শ্রীমহাপ্রভুর চরণোদ্দেশ্যে শ্রীবৃন্দাবনে যাইবার কালে বল্লভ তাঁহার সঙ্গী হন।"  --চৈঃ চঃ ১০। ৮৪ অনুভাষ্যে রামকেলিগ্রামে শ্রীকেলিকদম্ববৃক্ষ তমালবৃক্ষের তলদেশে শ্রীরাপ শ্রীসনাতনের সহিত শ্রীমন্মহাপ্রভুর প্রথম সাক্ষাৎকার হইয়াছিল। তথায় শ্রীরূপগোস্বামী প্রতিষ্ঠিত রূপসাগর নামে একটি বৃহৎ সরোবর অদ্যাপি বিদ্যমান আছে।

 

তদানীন্তন গৌড়ের বাদশাহ হুসেনশাহের অধীনে শ্রীরূপ, শ্রীসনাতন শ্রীঅনুপম রাজকার্য্য করিতেন। সনাতন গোস্বামী প্রধানমন্ত্রী, রূপগোস্বামী শাসনবিভাগের বিশেষ দায়িত্বশীল উজীর (মন্ত্রী) পদবী লাভ করিয়াছিলেন। রূপগোস্বামীর বাদশাহ প্রদত্ত নাম 'দবিরখাস' এবং সনাতন গোস্বামীর নাম 'সাকরমল্লিক' ছিল। যে সময়ে মহাপ্রভু রূপ-সনাতনের সহিত রামকেলিগ্রামে মিলিত হইয়াছিলেন, সেই সময়ে মহাপ্রভুর সঙ্গে অসংখ্য হিন্দু দেখিয়া হুসেনশাহ বাদশাহ চিন্তিত হইয়া রূপগোস্বামীর নিকট মহাপ্রভুর পরিচয় জানিতে চাহিয়াছিলেন। রূপগোস্বামী মহাপ্রভুর মহিমা বাদশাহকে কৌশলে বুঝাইয়া দিলে বাদশাহ নিশ্চিত্ত হইলেন। চৈতন্যচরিতামৃত মধ্যলীলা প্রথম পরিচ্ছেদে হুসেনশাহ রূপগোস্বামীকে যে দবিরখাস নামে সম্বোধন করিয়াছিলেন, তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়।

 

"দবিরখাসেরে রাজা পুছিল নিভৃতে।

গোসাঞির মহিমা তেঁহ লাগিল কহিতে।।"   (- চৈঃ চঃম ১। ১৭৫)

 

‘’শেষখণ্ডে শ্রীগৌরসুন্দর মহাশয়।

দবিরখাসেরে প্রভু দিলা পরিচয় ৷।

প্রভু চিনি, দুই ভাইর বন্ধ-বিমোচন।

শেষে নাম থুইলেন রূপ-সনাতন।।”   (- চৈঃ ভাঃ ২।১৭১-১৭২)

 

‘’হেনই সময়ে দুই মহাভাগ্যবান্

হইলেন আসিয়া প্রভুর বিদ্যমান ।।

সাকর মল্লিক আর রূপদুই ভাই।

দুই-প্রতি কৃপাদৃষ্টে চাহিলা গোসাঞি।।”  (— চৈঃ ভাঃ ১। ২৩৮-২৩৯ )

 

শ্রীবৃন্দাবন ঠাকুর লিখিত শ্রীচৈতন্যভাগবতের উপরি উল্লিখিত প্রমাণের দ্বারা সুনিশ্চিতভাবে রূপ গোস্বামীর বাদশাহ প্রদত্ত নাম 'দবিরখাস' এবং সনাতন গোস্বামীর বাদশাহ প্রদত্ত নাম 'সাকর মল্লিক' স্থিরীকৃত হয় শ্রীকৃষ্ণলীলার পার্ষদদ্বয় শ্রীরূপ-সনাতনের সংসার ত্যাগ করতঃ শ্রীগৌর লীলাপুষ্টির সময় আসিলে অন্তর্যামী পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু ভক্ত বৃন্দসহ রামকেলি গ্রামে আসিয়া তাহাদের সহিত মিলিত হইলেন। ভৌমলীলায় জগদ্বাসীর শিক্ষার জন্য ভক্ত ভগবান নিজেদের স্বরূপগত ভাব গোপন রাখিবার চেষ্টা করিলেও পরস্পরের সান্নিধ্যে স্বরূপগত ভাবের প্রাকট্য হইয়া পড়ে। এইজন্য রূপ-সনাতন মহাপ্রভুকে দর্শন করামাত্রই স্বাভাবিকভাবে মহাপ্রভুতে আকৃষ্ট এবং মহাপ্রভুও তাঁহাদের প্রতি আকৃষ্ট হইলেন। সাংসারিক লোকের শিক্ষার জন্য তাঁহারা সাংসারিক লোকের ন্যায় ব্যবহার করিয়াছেন।

 

শ্রীমন্মহাপ্রভু অগণিত ভক্তসহ রামকেলি গ্রামে আসিলে তদানীন্তন বাংলার বাদশাহ হুসেনশাহ ভীত হইয়াছিলেন এবং মহাপ্রভুকে সন্দেহ করিয়াছিলেন। কেশব নামক একজন ক্ষত্রিয় ভক্ত মহাপ্রভুর তত্ত্ব অবগত ছিলেন, তিনি এইজন্য বাদশাহকে বুঝাইলেন— 'একজন ভিখারী সন্ন্যাসী তীর্থভ্রমণে বাহির হইয়াছেন, সঙ্গে দুই চারিটী লোক আছে, তজ্জন্য ভয় পাইবার কোন কারণ নাই।' বাদশাহ রূপগোস্বামীকে উক্ত বিষয়ে জিজ্ঞাসা করিলে রূপ গোস্বামীও মহাপ্রভুর মহিমা বলিয়া তাঁহার সংশয় দূরীভূত করিলেন। পরে রূপ-সনাতন দুইভাই মধ্যরাত্রে মহাপ্রভুর সহিত সাক্ষাৎকারের আশায় প্রথমে নিত্যানন্দ হরিদাসের সহিত মিলিত হইলেন। তাঁহারা রূপ-সনাতনকে মহাপ্রভুর নিকট আনিলে রূপ-সনাতন দুই গুচ্ছ তৃণ দন্তে ধারণ করতঃ গলবস্ত্র হইয়া মহাপ্রভুর পাদপদ্মে প্রণত হইয়া এইরূপ দৈন্যোক্তিসহ রোদন করিতে লাগিলেন,-

 

‘’জগাই-মাধাই হৈতে কোটী কোটী গুণ।

অধম পতিত পাপী আমি দুইজন।।

ম্লেচ্ছজাতি, ম্লেচ্ছসঙ্গী, করি ম্লেচ্ছকৰ্ম্ম।

গো-ব্রাহ্মণ-দ্রোহি সঙ্গে আমার সঙ্গম।।

মোর কর্ম্ম মোর হাতে-গলায় বান্ধিঞা।

কুবিষয়বিষ্ঠা-গর্ভে দিয়াছে ফেলিয়া।।

শ্রীমন্মহাপ্রভু রূপ-সনাতনের অত্যন্ত দৈন্যোক্তিপূর্ণ বাক্যসমূহ শ্রবণ করতঃ কৃপাদ্রচিত্ত হইয়া রূপসনাতন সম্বন্ধে যেসব কথা বলিয়াছিলেন, তাহাতে রূপসনাতন যে বদ্ধজীবান্তর্গত সাধারণ মনুষ্য নহেন, তাঁহারা ভগবানের নিত্য পার্ষদ, ইহা স্পষ্টরূপেই প্রমাণিত হয়, যথা— (শ্রীচৈতন্যচরিমামৃত মধ্যলীলা ১ম পরিচ্ছেদ ২১২-২১৬)

 

"গৌড়-নিকট আসিতে নাহি মোর প্রয়োজন

তোমা-দুহা দেখিতে মোর ইহা আগমন ।।

এই মোর মনের কথা কেহ নাহি জানে

সবে বলে, কেনে আইলা রামকেলি গ্রামে ।।

ভাল হৈল, দুই-ভাই আইলা মোর স্থানে

ঘরে যাহ, ভয় কিছু না করিহ মনে ।।

জন্মে জন্মে তুমি দুইকিঙ্কর আমার

অচিরাতে কৃষ্ণ তোমায় করিবে উদ্ধার ।।

এত বলি' দুহার শিরে ধরিল দুই হাতে

দুই ভাই ধরি' প্রভুর পদ নিল মাথে ।।

‘’ভক্তকৃপাদ্বারাই জীবের উদ্ধার হয়’—জগদ্বাসীকে ইহা শিক্ষা দিবার জন্য শ্রীমন্মহাপ্রভু নিত্যানন্দ, হরিদাস, শ্রীবাস, গদাধর, মুকুন্দ, জগদানন্দ, মুরারি, বক্রেশ্বর আদি ভক্তবৃন্দের দ্বারা রূপ-সনাতনকে আশীর্ব্বাদ করাইলেন।

 

এতৎপ্রসঙ্গে,-

‘’যাঁহা সঙ্গে চলে এই লোক লক্ষকোটী

বৃন্দাবন যাইবার নহে পরিপাটী ।।

সনাতন গোস্বামীর এইরূপ বাক্য শ্রবণ করিয়া শ্রীমন্মহাপ্রভু বৃন্দাবন যাওয়া স্থগিত করতঃ কানাইর নাটশালা হইতে প্রত্যাবর্তনের সঙ্কল্প গ্রহণ করিলেন। শ্রীরূপ-সনাতনের দ্বারা জগদ্বাসীকে শিক্ষা দিবেন তাহার সূচনা রাম কেলিগ্রামে শ্রীমন্মহাপ্রভুর সহিত তাঁহাদের সাক্ষাৎকার শ্রীমন্মহাপ্রভুর ইচ্ছায় রূপসনাতনের হৃদয়ে তীব্র বৈরাগ্যের উদয় হইল, সংসার ত্যাগের ইশারা তাঁহারা লাভ করিলেন। দুইভাই বিষয় ত্যাগের উপায় চিন্তা করিয়া বহু ধন দিয়া দুই ব্রাহ্মণকে বরণ করতঃ কৃষ্ণামন্ত্রে পুরশ্চরণ করাইলেন।

 

শ্রীল রূপগোস্বামী রাজকার্য হইতে অবসর গ্রহণ করতঃ জ্যেষ্ঠভ্রাতা সনাতন গোস্বামীর জন্য গৌড়ে মুদিঘরে দশ হাজার মুদ্রা রাখিয়া অবশিষ্ট, সমস্ত ধন লইয়া নৌকাযোগে বাকলা চন্দ্রদ্বীপে আসিলেন। তথায় অর্দ্ধেক ধন ব্রাহ্মাণ বৈষ্ণবকে প্রদান করিলেন। এক চতুর্থাংশ কুটুম্ব ভরণপোষণের জন্য এবং এক চতুর্থাংশ আপদধন হিসাবে বিশ্বাসী বিপ্রস্থানে গচ্ছিত রাখিলেন। মহাপ্রভু বনপথে কখন বৃন্দাবন যাত্রা করিবেন তাহা জানিবার জন্য তিনি দুইজন চর পুরুষোত্তমক্ষেত্রে পাঠাইলেন। এদিকে শ্রীসনাতন গোস্বামী প্রধান মন্ত্রীর কার্য্য ছাড়িয়া দিয়া পীড়াচ্ছলে পণ্ডিতগণকে লইয়া গৃহে ভাগবত আলোচনা করিতে থাকিলে বাদশাহ হুসেনশাহ প্রথমে বৈদ্যের মাধ্যমে এবং পরে নিজে যাইয়া সাক্ষাদভাবে উহা জানিতে পারিয়া তাঁহাকে প্রধান মন্ত্রীর কার্য্য করিবার জন্য বিশেষভাবে বলিলেও তাঁহার অনিচ্ছা দেখিয়া তাঁহাকে কারারুদ্ধ করতঃ যুদ্ধের জন্য ওড়িষ্যায় যাত্রা করিলেন।

 

মহাপ্রভু বনপথে বৃন্দাবন যাত্রা করিয়াছেন সংবাদ আসিলে শ্রীরূপ গোস্বামী গৃহত্যাগ করতঃ নিজভ্রাতা অনুপম মল্লিকের সহিত মহাপ্রভুর উদ্দেশ্যে যাত্রা করিলেন। শ্রীরূপগোস্বামী পত্রের মাধ্যমে শ্রীসনাতন গোস্বামীকে কারাগারে উক্ত সংবাদ জানাইয়া যেকোনভাবে মুক্ত হইয়া বৃন্দাবন যাত্রার জন্য সঙ্কেত করিলেন। রূপগোস্বামী প্রয়াগে আসিয়া পৌছিলে মহাপ্রভু তথায় আছেন জানিতে পারিলেন। দাক্ষিণাত্য বিপ্রগৃহে মহাপ্রভুর দর্শন লাভ করিয়া প্রেমাবিষ্ট হইয়া পড়িলেন। দান্তে দুইগুচ্ছ তৃণ ধারণ করতঃ শ্রীরূপ অনুপম নানা শ্লোক উচ্চারণমুখে অত্যন্ত দৈন্যভরে পুনঃ পুনঃ দণ্ডবৎ প্রণতি জ্ঞাপন করিতে থাকিলে শ্রীমন্মহাপ্রভু স্নেহাবিষ্ট হইয়া বলিলেন—‘কৃষ্ণের করুণা কিছু না যায় বর্ণনে। বিষয়কূপ হৈতে তোমা কাড়িল দুইজনে।।

 

ভগবানের অভক্ত চতুর্ব্বেদী ব্রাহ্মণ অপেক্ষা শ্বপচকুলোদ্ভূত ভগবদ্ভক্ত ভগবানের প্রিয়, ভগবান্ যে প্রকার পূজ্য, তদ্ভক্তও তদ্রূপ পূজ্যএইরূপ ভক্ত-মহিমাসূচক শ্লোক উচ্চারণপূর্ব্বক শ্রীমন্মহাপ্রভু দুইজনকে আলিঙ্গন এবং দুইজনের মস্তকে শ্রীপাদপদ্ম স্থাপন করতঃ কৃপা করিলেন মহাপ্রভুর কৃপা লাভ করতঃ কৃত কৃতার্থ হইয়া দুইজনে জোড়হস্তে প্রণাম করিলেন,-

নমো মহাবদান্যায় কৃষ্ণপ্রেম প্রদায় তে

কৃষ্ণায় কৃষ্ণচৈতন্যনাম্নে গৌরত্বিষে নমঃ ।।'

 

শ্রীমন্মহাপ্রভু প্রয়াগে দশ দিন অবস্থান করতঃ দশাশ্বমেধ ঘাটে নিভৃতস্থানে কৃষ্ণতত্ত্ব, ভক্তিতত্ত্ব, রসতত্ত্বসর্ব্বতত্ত্ব এবং কালধর্ম্মে লুপ্ত বৃন্দাবনের রসকেলিবার্তা শ্রীরূপগোস্বামীতে শক্তি সঞ্চার পূর্ব্বক বিস্তার করিয়াছিলেন। ইহাইশ্রীরূপশিক্ষানামে প্রসিদ্ধ। শ্রীশিবানন্দ সেনের পুত্র কবি কর্ণপূর নিজ গ্রন্থে মহাপ্রভুর সহিত রূপের মিলনের কথা প্রচুর রূপে কীৰ্ত্তন করিয়াছেন।

কালেন বৃন্দাবনকেলিবাৰ্ত্তা

লপ্তেতি তাং খ্যাপয়িতুং বিশিষ্য

কৃপামৃতেনাভিষিষেচ দেব-

স্তত্রৈব রূপঞ্চ সনাতনঞ্চ।।”   (— চৈঃ চঃ নাটকে ৩৮)                                                                                                                                                                                               

কালে বৃন্দাবনকেলি-বাৰ্ত্তা লুপ্ত হইয়াছিল, সেই লীলা বিশেষ করিয়া বিস্তার করিবার জন্য শ্রীগৌরাঙ্গ দেব কৃপামৃতের দ্বারা তথায় শ্রীরূপকে এবং শ্রীসনাতনকে অভিষিক্ত করিয়াছিলেন

‘’প্রিয়স্বরূপে দয়িতস্বরূপে প্রেমস্বরূপে সহজাভিরূপে

নিজানুরূপে প্রভুরেকরূপে ততান রূপে স্ববিলাসরূপে ।।”  (- চৈঃ চঃ নাটকে ৯ম) অঙ্কে নিজের প্রিয়স্বরূপ, দয়িতস্বরূপ প্রেমস্বরূপ, স্বাভাবিক মনোজ্ঞরূপবিশিষ্ট মুখ্যরূপ এবং নিজের অনুরূপ,এবস্তুত স্বীয় বিলাসরূপ শ্রীরূপ গোস্বামীতে প্রভু (ভক্তিরস-শাস্ত্র) বিস্তার করিয়াছিলেন। শ্রীমন্মহাপ্রভু শ্রীল রূপগোস্বামীর মাধ্যমে বৃন্দাবনের রসকেলি সম্বন্ধে এবং ব্রজপ্রেমলাভের অভিধেয় বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করিয়াছিলেন।

 

‘’সনাতন-কৃপায় পাইনু ভক্তির সিদ্ধান্ত।

শ্রীরূপ-কৃপায় পাইনু ভক্তিরসপ্রান্ত ।।”  (- চৈঃ চঃ ৫। ২০৩)

 

‘’শ্রীরূপদ্বারা ব্রজের রস-প্রেমলীলা

কে কহিতে পারে গম্ভীর চৈতন্যের খেলা।।”   (- চৈঃ চঃ অন্ত্য ৫। ৮৭)

 

‘’বৃন্দাবনীয়াং রসকেলিবাৰ্ত্তাং

কালেন লুপ্তং নিজশক্তিমুকঃ।

সঞ্চার্য্য রূপে ব্যতনোৎ পুনঃস

প্রভোবিধৌ প্রাগিব লোক সৃষ্টিম্।।‘’ — চৈঃ চঃ ১৯।

 

সৃষ্টির পূর্ব্বে ব্রহ্মার হৃদয়ে যেরূপ (সম্বন্ধাভিধেয়-প্রয়োজনাত্মক ভগব ত্তত্ত্ব) প্রেরণা করিয়াছিলেন, সেইরূপ রূপগোস্বামীতে সমুৎসুক হইয়া নিজশক্তি সঞ্চারণপূর্ব্বক কালধর্ম্মে লুপ্ত বৃন্দাবনের রসকেলিবার্তা বিস্তার করিয়াছিলেন। ‘’ভক্তিরসামৃতসিন্ধু‘’গ্রন্থ লিখিবার সাক্ষাৎ নির্দেশ শ্রীরূপগোস্বামী শ্রী মন্মহাপ্রভুর নিকট হইতে প্রয়োগে লাভ করিয়াছিলেন। ভক্তিরসামৃতসিন্ধু পূৰ্ব্ববিভাগ শ্লোকে শ্রীল রূপগোস্বামী উহা ব্যক্ত করিয়াছেন

‘’হৃদির্যস্য প্রেরণয়া প্রবর্ত্তিতোহহং বরাকরূপোহপি

তস্য হরেঃ পদকমলং বন্দে চৈতন্যদেবস্য।।‘’

‘’হৃদয়ে যাঁহার প্রেরণাদ্বারা সামান্য কাঙ্গালরূপ আমি ভক্তিগ্রন্থ রচনে প্ৰবৰ্ত্তিত হইয়াছি, সেই শ্রীচৈতন্যদেব হরির পদকমল আমি বন্দনা করি।‘’

 

শ্রীমন্মহাপ্রভু প্রয়াগে দশদিন অবস্থান করতঃ শ্রীরূপগোস্বামীকে শিক্ষা প্রদান করিয়া প্রয়াগ হইতে বারাণসী যাইবার জন্য উদ্যোগ করিলে শ্রীল রূপগোস্বামীও শ্রীমন্মহাপ্রভুর সহিত যাইতে ব্যাকুল হইলেন। কিন্তু শ্রীমন্মহাপ্রভু শ্রীল রূপগোস্বামীকে বৃন্দাবনে যাইতে এবং বৃন্দাবন হইতে প্রত্যাবৰ্ত্তনকালে গৌড়দেশ হইয়া নীলাচলে তাঁহার সহিত মিলিত হইবার জন্য আদেশ প্রদান করিলেন। শ্রীল রুপগোস্বামী শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণকুলে আবির্ভূত হইয়াও ম্লেচ্ছের অধীনে চাকুরী করিয়াছিলেন বলিয়া নিজেকে ম্লেচ্ছবোধে জগন্নাথ মন্দিরে জগন্নাথ দর্শনে গেলেন না সিদ্ধবকুলে হরিদাস ঠাকুরের নিকটে অবস্থান করিতে লাগিলেন। শ্রীমন্মহাপ্রভু রূপগোস্বামীকে সর্ব্বোত্তম অধিকারী জানিয়াও রূপগোস্বামী দ্বারা জগৎ বাসীকে ভক্তানুকূল দৈন্যশিক্ষা দিবার জন্য রূপগোস্বামীকে জগন্নাথমন্দিরে যাইতে আদেশ করেন নাই।

 

‘’হরিদাস-দ্বারে সহিষ্ণুতা জানাইল

সনাতন-রূপ-দ্বারে দৈন্য প্রকাশিল ।।”   (-ভক্তিরত্নাকর ১। ৬৩১)

 

শ্রীমন্মহাপ্রভু হরিদাস ঠাকুরের স্থানে রূপগোস্বামীকে দর্শন প্রদানের জন্য হঠাৎ আসিয়া উপস্থিত হইলেন, রূপগোস্বামীর দৈন্য রসসিক্ত শুদ্ধপ্রেমে আকৃষ্ট হইয়া তাঁহাকে আলিঙ্গন করিলেন। হরিদাস ঠাকুর এবং রূপগোস্বামীর সহিত একস্থানে বসিয়া শ্রীমন্মহাপ্রভু কুশল প্রশ্ন, সনাতনের বার্তা প্রভৃতি বিষয়ে সংলাপ এবং ইষ্টগোষ্ঠী করিলেন। তৎপরে একদিন মহাপ্রভু সমস্ত ভক্তগণকে লইয়া তথায় উপস্থিত হইলে রূপগোস্বামী সকলের চরণ বন্দনা করিলেন। শ্রীমন্মহাপ্রভু স্নেহবিষ্ট হইয়া শ্রীঅদ্বৈত শ্রীনিত্যানন্দের দ্বারা রূপগোস্বামীকে আশীর্ব্বাদ করাইলেন। শ্রীল হরিদাস ঠাকুর শ্রীল রূপ গোস্বামী গোবিন্দের মাধ্যমে প্রত্যহ শ্রীমন্মহাপ্রভুর অবশেষ প্রসাদ পাইয়া কৃতকৃতার্থ হইলেন

 

কৃষ্ণেরে বাহির নাহি করিহ ব্রজ হৈতে

ব্রজ ছাড়ি কৃষ্ণ কভু না যান কাহাতে ।।

শ্রীমন্মহাপ্রভুর নিকট ভঙ্গীক্রমে এইরূপ নির্দেশ প্রাপ্তি শ্রীল রূপ গোস্বামীর বিদগ্ধ মাধব রচনার মূল সূত্রপাত হয়। শ্রীমন্মহাপ্রভু শ্রীসত্যভামাদেবীর ইচ্ছা জানিয়া শ্রীল রূপগোস্বামীললিত মাধব' 'বিদগ্ধ মাধব' দুইটি পৃথক্নাটক রচনা করিলেন।

 

একদিন শ্রীল রূপগোস্বামী বিদগ্ধমাধব নাটক রচনা করিতেছিলেন। শ্রীমন্মহাপ্রভু তথায় অকস্মাৎ উপনীত হইয়া রূপগোস্বামীর মুক্তার ন্যায় হস্তাক্ষরের ভূয়সী প্রশংসা করতঃ তাঁহার তালপত্রে লিখিত কৃষ্ণনামের মহিমা সূচক অপূর্ব্ব শ্লোক পাঠ করিয়া প্রেমাবিষ্ট হইলেন।

তুণ্ডে তাণ্ডবিনীরতিং বিতনুতে তুণ্ডাবলী লব্ধয়ে

কর্ণক্রোড়কড়ম্বিনী ঘটয়তে কর্ণার্বুদেভ্যঃ স্পৃহাম্।

চেতঃ প্রাঙ্গণসঙ্গিনী বিজয়তে সৰ্ব্বেন্দ্রিয়াণাং কৃতিং

নো জানে জনিতা কিয়স্তিরমূতৈঃ কৃষ্ণেতি বর্ণদ্বয়ী।।”  (– বিদগ্ধমাধব)

অর্থাৎ,- ''কৃষ্ণ'' এই দুইটী বর্ণ কত অমৃতের সহিত যে উৎপন্ন হইয়াছে, তাহা জানি না;— দেখ, যখন (নটীর ন্যায়) তাহা তুণ্ডে (মুখে) নৃত্য করে, তখন বহু তুণ্ড (মুখ) পাইবার জন্য রতি বিস্তার (অর্থাৎ আসত্তি বর্দ্ধন) করে, যখন কর্ণকুহরে প্রবেশ করে (অঙ্কুরিত হয়), তখন অর্ব্বদকর্ণের জন্য স্পৃহা জন্মায়, যখন চিত্তপ্রাঙ্গণে (সঙ্গিনীরূপে) উদিত হয়, তখন সমস্ত ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়াকে বিজয় করে।

 

নামাচার্য্য শ্রীল হরিদাস ঠাকুর রূপগোস্বামী-কৃত শ্লোকে কৃষ্ণনামের অত্যদ্ভূত মহিমা শ্রবণ করিয়া পরমোল্লাসে নৃত্য করিতে লাগিলেন। 'কৃষ্ণ নামের মহিমা শাস্ত্র সাধুমুখে জানি। নামের মাধুরী ঐছে কাহা নাহি শুনি।। শ্রীমন্মহাপ্রভু স্বরূপদামোদর, রায় রামানন্দ, সাৰ্ব্বভৌম ভট্টাচার্য্যাদি ভক্ত গণকে লইয়া রূপগোস্বামীর নিকট আসিলেন। শ্রীমন্মহাপ্রভুর নির্দেশক্রমে শ্রীল রূপগোস্বামী কৃষ্ণনামের মহিমাত্মক, “তুণ্ডে তাণ্ডবিনী শ্লোকে পাঠ করিলে ভক্তগণ আনন্দে বিস্মিত হইলেন।সবে বলে নাম মহিমা শুনিয়াছি অপার। এমন মাধুর্য্য কেহ বর্ণে নাহি আর।।' শ্রীরায় রামানন্দ বিদগ্ধমাধব, ললিত মাধবের বিষয়বস্তু সম্বন্ধে রূপগোস্বামীর সহিত আলোচনা করিয়া চমৎকৃত হইলেন। রায় রামানন্দ রূপগোস্বামীর নিকট ইষ্টদেব সম্বন্ধে বর্ণন শুনিতে ইচ্ছা করিলেন।

 

রূপগোস্বামী প্রথমে শ্রীমহাপ্রভুর সম্মুখে উহা কহিতে সঙ্কোচবোধ করিলে শ্রীমন্মহাপ্রভুর পুনঃ পুনঃ নির্দেশক্রমে পরে পাঠ করিয়া শুনাইলে মহাপ্রভু 'এই অতিস্তুতি হৈল' বলিয়া বাহ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করিয়াছিলেন, কিন্তু ভগবদ্ভক্তগণ শ্লোক শুনিয়া আনন্দসাগরে নিমগ্ন হইলেন। উহা বিদগ্ধমাধবের ১ম অঙ্কের মঙ্গলাচরণের ২য় শ্লোক। যথা

‘’অনর্পিতচরীং চিরাৎ করুণয়াবতীর্ণঃ কলৌ

সমর্পয়িতুমুন্নতোজ্জ্বলরসাং স্বভক্তিশ্রিয়ম্।

হরিঃ পুরটসুন্দরদ্যুতিকদম্বসন্দীপিতঃ

সদা হৃদয়কন্দরে স্ফুরতু বঃ শচীনন্দনঃ।।

 

 

‘’সুবর্ণকাত্তিসমূহ দ্বারা দীপ্যমান শচীনন্দন হরি তোমাদের হৃদয়ে স্ফূর্ত্তি লাভ করুন। তিনি যে সর্ব্বোৎকৃষ্ট উজ্জ্বলরস জগৎকে কখনও দান করেন নাই, সেই স্বভক্তি সম্পত্তি দান করিবার জন্য কলিকালে অবতীর্ণ হইয়াছেন।‘’ শ্রীল রূপগোস্বামীর অপ্রাকৃত প্রেমরসযুক্ত কবিত্ব শুনিয়া রায় রামানন্দ সহস্রমুখে উহার প্রশংসা করিতে লাগিলেন।

‘’এত শুনি রায় কহে প্রভুর চরণে।

রূপের কবিত্ব প্রশংসি সহস্র বদনে।।

কবিত্ব না হয় এই অমৃতের ধার।

নাটক লক্ষণ সব সিদ্ধান্তের সার।

প্রেম-পরিপাটী এই অদ্ভূত বর্ণন।

শুনি' চিত্তকর্ণের হয় আনন্দ ঘূর্ণন।।‘’  — চৈঃ চঃ ১। ১৯২-১৯৪

 

বৃন্দাবনে শ্রীল রূপগোস্বামী শ্রীগোবিন্দের সেবা এবং শ্রীসনাতন গোস্বামী মদনমোহনের সেবা প্রকাশ করিলেন। শ্রীভক্তিরত্নাকর গ্রন্থে শ্রীগোবিন্দদেবের প্রাকট্যের কথা এইরূপভাবে বর্ণিত আছেশ্রীমন্ মহাপ্রভুর চারিটী নির্দ্দেশলুপ্ত তীর্থউদ্ধার, শ্রীবিগ্রহের সেবাপ্রকাশ, শুদ্ধভক্তিশাস্ত্র প্রচার, নামপ্রেম প্রচাররূপগোস্বামী যথাযথরূপে পালন করিয়াছিলেন। ব্রজেন্দ্রনন্দন শ্রীগোবিন্দবিগ্রহের সেবা প্রকাশ কি প্রকারে হইবে চিন্তিত হইয়া শ্রীরূপগোস্বামী ব্রজমণ্ডলে শ্রীগোবিন্দদেবের অন্বেষণে গ্রামে গ্রামে বনে বনে ভ্রমণ করিয়া ছিলেন। যোগপীঠে ভগবানের অবস্থিতি শাস্ত্রে এইরূপ লিখিত আছে, কিন্তু ব্রজবাসীর ঘরে ঘরে অন্বেষণ করিয়া কোথাও গোবিন্দদেবের দর্শন না পাইয়া ধৈর্য্যচ্যুত হইয়া যমুনার তীরে বিরহ ব্যাকুল হৃদয়ে বসিয়া রহিলেন।

 

এমন সময় ব্রজবাসীর রূপ ধারণ করতঃ সুন্দর একজন পুরুষ তাঁহার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সেই ব্রজবাসী অত্যন্ত মধুর বচনে রূপগোস্বামীর দুঃখের কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। রূপগোস্বামী তাঁহার রূপ বচনে আকৃষ্ট হইয়া হৃদয়ের সকল কথা নিবেদন করিলেন। ব্রজবাসী রূপগোস্বামীকে সান্ত্বনা প্রদান করিয়া কহিলেন—“চিন্তার কোন কারণ নাই। বৃন্দাবনে গোমাটিলা নামক যোগপীঠে গোবিন্দদেব গোপনে অবস্থান করিতেছেন। একটি শ্রেষ্ঠ গাভী প্রত্যহ পূৰ্ব্বাহ্ণে উল্লাসভরে তথায় দুগ্ধ প্রদান করেন।' এইকথা বলিয়া ব্রজ বাসী অন্তর্দ্ধান করিলে রূপগোস্বামীকৃষ্ণ আসিয়াছিলেন চিনিতে পারিলাম না' বলিয়া মূৰ্চ্ছিত হইয়া পড়িলেন। শ্রীল রূপগোস্বামী কোনপ্রকারে বিরহ দুঃখ সম্বরণ করতঃ ব্রজবাসিগণকে গোবিন্দদেবের প্রাকট্য স্থানের কথা নির্দেশ করিলেন।

 

 ব্রজবাসিগণ পরমোল্লাসে গোমাটিলা-ভূমি খনন করিলে তাহা হইতে কোটী কন্দর্পমোহন ব্রজেন্দ্রনন্দন শ্রীগোবিন্দদেবের আবির্ভাব হয়। গোবিন্দদেব বিগ্রহ শ্রীকৃষ্ণের প্রপৌত্র কর্তৃক প্রকটিত বলিয়া কথিত শ্রীল রূপগোস্বামী-রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে ১৬টা বিশেষ গ্রন্থের নামভক্তিরত্নাকর' গ্রন্থে উল্লিখিত হইয়াছে যথা,- শ্ৰীহংসদূতকাব্য, শ্রীমদুদ্ধবসন্দেশ, শ্রীকৃষ্ণজন্মতিথির বিধি, শ্রীবৃহদ গণোদ্দেশদীপিকা, শ্রীলঘুগণোদ্দেশদীপিকা, শ্রীকৃষ্ণ এবং তৎপ্রিয়গণের মনো হরা স্তবমালা, প্রসিদ্ধ বিদগ্ধমাধব ললিতমাধব, দানলীলাকৌমুদী, ভক্তিরসা মৃতসিন্ধু, উজ্জ্বলনীলমণি, প্রযুক্তাখ্যাতচন্দ্রিকা, মথুরা-মহিমা, পদ্যাবলী, নাটক চন্দ্রিকা, লঘুভাগবতামৃত উপরিউক্ত গ্রন্থসমূহ ছাড়াও শ্রীরূপগোস্বামী উপদেশামৃত, নামাষ্টক, সিদ্ধান্তরত্ন, কাব্যকৌস্তুভ আদি লিখিয়াছেন।

 

বৃন্দাবনে শ্রীরাধাদামোদর মন্দিরের পশ্চাতে শ্রীরূপগোস্বামীর মূল সমাধিমন্দির এবং ভজনকুটীরের অবস্থিতি। এতদ্ব্যতীত নন্দগ্রামের নিকটে টেরিকদমে শ্রীল রূপগোস্বামীর ভজনকুটীর বিদ্যমান। টেরিকদমে শ্রীল রূপগোস্বামীর শ্রীল সনাতন গোস্বামীকে ক্ষীরপ্রসাদ দিবার ইচ্ছা হইলে রাধা রাণী বালিকাবেশে ক্ষীররন্ধনের জন্য রূপগোস্বামীকে দুগ্ধ, চাল চিনি দিয়া ছিলেন। শ্রীল সনাতন গোস্বামী ক্ষীরপ্রসাদ আস্বাদন করিয়া প্রেমাবিষ্ট হইয়া ছিলেন। শ্রীরাধারাণীকে কষ্ট দেওয়া হইয়াছে জানিতে পারিয়া সনাতন গোস্বামী রূপগোস্বামীকে পুনঃ ক্ষীররন্ধন করিতে নিষেধ করিয়াছিলেন ভাদ্রমাসের শ্রীঝুলন একাদশীর পরদিবস শুক্লাদ্বাদশী তিথিতে শ্রীল রূপগোস্বামী তিরোধানলীলা করেন।

No comments:

Post a Comment

🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴🌴🌳 🌻🌼 শ্রীবলরামের রাসযাত্রা 🌹 শ্রীকৃষ্ণের বসন্তরাস 🌼🌻 🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴...