🌳🦚💐🏵️🌷🏵️💐🦚🌳

🌷শ্রী শ্রী উপদেশামৃত🌷

🌳🦚💐🏵️🌷🏵️💐🦚🌳

                                     (শ্রীল রূপ গোস্বামী বিরচিত)

শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীপ্রভু শ্রীগৌরপার্ষদ শ্রীশিবানন্দ সেনাত্মজ  শ্রীল পরমানন্দ দাস বা শ্রীপুরীদাস বা শ্রীকবিকর্ণপুর রচিত শ্রীচৈতন্যচন্দ্রোদয় নাটকোক্ত (৯ম অঙ্ক সাৰ্ব্বভৌমবাক্য) নিম্নলিখিত শ্লোকটি উদ্ধার করিয়া শ্রীশ্রীমন্মহাপ্রভুর দ্বিতীয় স্বরূপ শ্রীল শ্রীরূপ গোস্বামীপাদের মহিমা বর্ণন করিয়াছেন,-

‘’প্রিয়স্বরূপে দয়িতস্বরূপে প্রেমস্বরূপে সহজাভিরূপে ।

নিজানুরূপে প্রভুরেকরূপে ততানরূপে স্ববিলাসরূপে ॥‘’  -চৈঃ চঃ মধ্য ১৯১১

অর্থাৎ,-  নিজের প্রিয় স্বরূপ (ভক্তরূপ), দয়িত স্বরূপ (আত্মস্বরূপ), প্রেমস্বরূপ ( প্রেমময় নিজাভিন্ন রূপ ), সহজাভিরূপ ( স্বাভাবিক মনোজ্ঞরূপবিশিষ্ট ) এবং নিজের অনুরূপ - এবম্ভূত  স্বীয় বিলাসরূপ শ্রীরূপ গোস্বামীতে প্রভু ( মহাপ্রভু ) (ভক্তিরসশাস্ত্র ) বিস্তার করিয়াছিলেন অর্থাৎ তদ্বারা ভক্তিরস- শাস্ত্র প্রকাশ করিয়াছিলেন ।

 

শ্রীমদ্‌ রূপ গোস্বামী হইতে শ্রৌতপারস্পর্য্যে আমাদের গুরুবর্গ শ্রীল শ্রীজীব-শ্রীরঘুনাথ - শ্রীকৃষ্ণদাস-শ্রীনরোত্তম - শ্রীবিশ্বনাথ-শ্রীবলদেব- শ্রীজগন্নাথ- শ্রীভক্তিবিনোদ শ্রীগৌরকিশোর তথা  প্রভুপাদ শ্রীশ্রীমদ্ ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর এবং তদভিন্নবিগ্রহ — অম্মদীয় পরম গুরুপাদপদ্ম শ্রীচৈতন্য গৌড়ীয় মঠাধ্যক্ষ আচার্য্য প্রবর ওঁ ১০৮শ্রী শ্রীমদ্ ভক্তিদয়িত মাধব গোস্বামী বিষ্ণুপাদ প্রমুখ সকলেই ঐরূপানুগাভিমানী; শ্রীরূপের কিঙ্করানুকিঙ্কর বলিয়া আত্ম- পরিচয় প্রদান করিতেই যেন সকলেই গৌরব অনুভব করেন। শ্রীরূপানুগবর শ্রীল ঠাকুর নরোত্তম ‘’শ্রীচৈতন্যমনোঽভীষ্টং স্থাপিতং যেন ভূতলে । স্বয়ং ( সোহয়ং ) রূপঃ কদা মহং দদাতি স্বপদান্তিকম্ ॥‘’ ‘’শ্রীরূপ-রঘুনাথ পদে হইবে আকুতি। কবে হাম বুঝব সে যুগল পীরিতি।।''

 

 শ্রীরূপ মঞ্জরী পদ সেই মোর সম্পদ, সেই মোর ভজন পূজন', “শুনিয়াছি সাধুমুখে বলে সৰ্ব্বজন। শ্রীরূপ কৃপায় মিলে যুগলচরণ।। শ্রীরূপের কৃপা যেন আমা প্রতি হয়। সেপদ আশ্রয় যার সেই মহাশয় ৷’’ ‘’প্রভু লোকনাথ কবে সঙ্গে লঞা যাবে । শ্রীরূপের পাদপদ্মে মোরে সমর্পিবে।।''  ‘শ্রীরূপ মঞ্জরীপদ সেবোঁ  নিরবধি । তাঁর পাদপদ্ম মোর মন্ত্র-মহৌষধি।।‘’  ‘প্রেম ভক্তিরসকৃপ, ‘যুগল উজ্জ্বল রস তনু' ইত্যাদি গীতি গান করিয়া শ্রীরূপচরণে প্রগাঢ় অনুরাগ প্রদর্শন করিয়াছেন । শ্রীল  কবিরাজ গোস্বামী তাঁহার - শ্রীচরিতামৃতের সর্ব্বত্রই অপূর্ব অনুরাগে শ্রীরূপানুগত্য প্রদর্শন করিয়াছেন। পরমারাধ্য প্রভুপাদের ‘’আদদানস্তৃণং দন্তৈরিদং যাচে পুনঃ পুনঃ। শ্রীমদ রূপপদাম্ভোজ- ধূলিঃ স্বাং জন্মজন্মনি ॥‘’ – এই বাণীই ছিল জীবাতু।

 

অপ্রকট কালের পূর্ব্বাহ্নেও প্রভুপাদ ‘শ্রীরূপমঞ্জরীপদ এই গীতিটি শ্রবণাগ্রহ প্রকাশ করিয়া ' তচ্চরণাশ্রিত শিষ্যগণকে  -‘’জন্মে জন্মে শ্রীরূপ প্রভুর পাদপদ্মের ধূলিই আমাদের স্বরূপ - আমাদের সর্ব্বস্ব; জগতে শ্রীরূপানুগ চিন্তা- স্রোতঃ প্রবাহিত হউক ;  আপনারা শ্রীরূপানুগগণের একান্ত আনুগত্যে শ্রীরূপ-রঘুনাথের কথা পরমোৎসাহে ও নির্ভীককণ্ঠে প্রচার করুন। এইরূপ শ্রীরূপানুগত্যের উপদেশ প্রদান করিতে করিতে নিত্যলীলায়  প্রবেশ করিয়াছেন। সেই শ্রীরূপ গোস্বামিপ্রভুই এই একাদশ শ্লোকাত্মক 🌷শ্রীউপদেশামৃত🌷বিতরণ- কারী। সুতরাং জগদ্গুরু তিনি—“তাঁর উপদেশ মন্ত্রে মায়া-পিশাচী পলায়। কৃষ্ণভক্তি পায়, কৃষ্ণ নিকট যায় " এই উপদেশামৃতানুসরণমুখেই শ্রীমন্মহাপ্রভুর 'শিক্ষাষ্টক' অনুশীলনীয়।

 

শ্রীমন্মহাপ্রভুর মর্ম্মজ্ঞ শ্রীচৈতন্য-মনোহভীষ্টসংস্থাপক শ্রীরূপ মহাবদান্য মহাপ্রভু যে অনর্পিতচর উন্নত উজ্জ্বল রস — স্বভক্তিসম্পৎ বিতরণ করিতে আসিয়াছেন, তাহার আস্বাদনযোগ্যতা উদয় করাইবার জন্যই এই শ্রীচৈতন্যশিক্ষাসার উপদেশামৃতের অবতারণা করিয়াছেন। সুতরাং ইহা সদগুরুপাদাশ্রিত সাধক মাত্রেরই সর্ব্বাগ্রে আশ্রয়ণীয় কণ্ঠহার হওয়া একান্ত প্রয়োজন । ইহার আনুগত্যে শিক্ষাষ্টকাণুশীলন হইতে থাকিলেই শ্রীমন্মহাপ্রভুর শিক্ষার প্রকৃত মৰ্ম্ম হৃদয়ঙ্গম হইতে পারিবে। শ্রীল ঠাকুর ভক্তিবিনোদ তাঁহার ‘’বৈষ্ণব ঠাকুর দয়ার সাগর’’ এই শরণাগতি গীতিতে বৈষ্ণব সমীপে যে “ছয় বেগ দমি' ছয় দোষ শোধি' ছয় গুণ দেহ দাসে। ছয় সংসঙ্গ দেহ হে আমারে বসেছি সঙ্গের আশে।।‘’ ইত্যাদি প্রার্থনা জ্ঞাপন করিয়াছেন I

 

তাহাতে উপদেশামৃতের প্রথম শ্লোকেই ভক্তির প্রতিকূল ঐ ছয় বেগ, দ্বিতীয় শ্লোকে ভক্তির কণ্টক স্বরূপ ভক্তিনাশক ঐ ছয় দোষ, তৃতীয় শ্লোকে ভক্তির অনুকূল বা ভক্তিসাধক ঐ ছয় গুণ এবং চতুর্থ শ্লোকে ভক্তিপোষক উক্ত ছয় সৎসঙ্গের কথাই উদ্দিষ্ট হইয়াছে। শ্রীশ্রীল ঠাকুর তাঁহার ‘সজ্জনতোষণী পত্রিকার ১ম বর্ষের ১১শ সংখ্যায় উক্ত ভক্তি- নাশক ‘ষড়, দোষ' এবং ১১শ বর্ষের ২য়, ৪র্থ, ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ১১শ সংখ্যায় উক্ত ভক্তিসাধক ‘ষড়, গুণ' সম্বন্ধে দ্বাদশটি পরম উপাদেয় বিস্তৃত প্রবন্ধ প্রকাশ করিয়াছেন। ঐ সকল বহু শিক্ষা-সম্বলিত প্রবন্ধ আমরা 'ঐচৈত্যবাণী’ পত্রিকায় উদ্ধার করিয়াছি। অতঃপর পঞ্চম শ্লোকে মধ্যম ভক্তের কনিষ্ঠ, মধ্যম ও উত্তমাধিকারী ত্রিবিধ বৈষ্ণব সেবা কি প্রকার, তাহা বলা হইয়াছে, ষষ্ঠ শ্লোকে প্রাকৃত দৃষ্টিতে অপ্রাকৃত বৈষ্ণব দর্শন-প্রয়াসকে নিষেধ করা হইয়াছে I

সপ্তম শ্লোকে অবিদ্যাগ্রস্ত জীবের শ্রীকৃষ্ণনামাদি অনুশীলন-প্রণালী কথিত হইয়াছে। অষ্টম শ্লোকে উপদেশসার জাতরুচিক্রমে ব্রজে বাস পূর্ব্বক ব্রজজনানুগত্যে কীৰ্ত্তন-স্মরণাদিতে অখিলকাল যাপন উপদিষ্ট হইয়াছে, নবম শ্লোকে অন্যান্য ধাম হইতে বৈকুণ্ঠের শ্রেষ্ঠতা, তদপেক্ষা শ্রীকৃষ্ণজন্মনিবন্ধন মাথুর মণ্ডল, তদপেক্ষা রাসস্থলী বৃন্দারণ্য, তদপেক্ষা গিরিরাজ গোবর্দ্ধন, তদপেক্ষাও রাধাকুণ্ডের শ্রেষ্ঠতা জ্ঞাপন পূৰ্ব্বক শ্রীকুণ্ডতটকেই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ভজনস্থান বলিয়া নির্দেশ করা হইয়াছে; দশম শ্লোকে সৎকর্ম্মনিরত কৰ্ম্মী হইতে গুণত্রয়বর্জ্জিত  ব্রহ্মজ্ঞানী, তাহা হইতে জ্ঞানবিমুক্ত ভক্তিপ্রধান সনকাদি শুদ্ধভক্ত, তদপেক্ষা প্রেমৈকনিষ্ঠ নারদাদি, তদপেক্ষা কৃষ্ণগতপ্রাণা ব্রজসুন্দরীগণ, তদপেক্ষা শ্রীরাধিকা শ্রীকৃষ্ণের অত্যন্ত বল্লভা, শ্রীরাধার ন্যায় তদভিন্ন রাধাকুণ্ডও কৃষ্ণের অত্যন্ত প্রিয় I

 

সেই শ্রীকুণ্ডতটবাসী অষ্টকাল ভজনকারীরই সর্ব্বশ্রেষ্ঠত্ব জ্ঞাপন করা হইয়াছে এবং একাদশ শ্লোকে অন্যান্য সাধকভক্ত ত' দূরের কথা নারদাদি প্রেষ্ঠবর্গের পক্ষেও যে প্রেম দুর্লভ, সেই প্রেম এই শ্রীরাধাকুণ্ডে একবার স্নান- কারীর পক্ষে সুলভ হয়, ইহা বলা হইয়াছে। তবে অপ্রাকৃত অনুভূতি ব্যতীত প্রাকৃত অভিমানে এই স্নান ও স্নানফল প্রেম সুলভ হয় না। শ্রীল ঠাকুর তাঁহার ‘পীযূষবর্ষিণী-বৃত্তি'তে তাই লিখিয়াছেন,- "রাধাকুণ্ডই সমস্ত ভজনপরায়ণদিগের বাসযোগ্য স্থান। অপ্রাকৃত ব্ৰজে অপ্রাকৃত জীব অপ্রাকৃত গোপীদেহ লাভ করিয়া শ্রীরাধাকুণ্ডে স্বীয় গুরুরূপা সখীর কুঞ্জে পাল্যদাসীভাবে অবস্থিতি করতঃ বাহ্য নিরন্তর নামাশ্রয় পূর্ব্বক কৃষ্ণের অষ্টকালীয় সেবায় শ্রীমতী রাধিকার পরিচর্যা করাই শ্রীচৈতন্য- চরণাশ্রিত ব্যক্তির ভজনচাতুরী।”

 

এই উপদেশামৃতে ক্রমান্বয়ে মূল শ্লোক, অন্বয়, শ্রীশ্রীরাধারমণ সেবারত শ্রীরাধারমণ দাসকৃত ‘উপদেশ প্রকাশিকা (সংস্কৃত) চটীকা', শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর লিখিত ‘শ্রীউপদেশামৃত-ভাষ্য ও ‘পীযূষবর্ষিণী-বৃত্তি', শ্রী শ্রীল ঠাকুর ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী লিখিত “শ্রীউপদেশামৃতভাষ্য' ও 'অনুবৃত্তি'—এই ক্রমে গুমফিত হইয়াছে । পরমারাধ্য শ্রীল প্রভুপাদ তাঁহার ‘অনুবৃত্তি'র শেষভাগে লিখিয়াছেন- এই এউপদেশামৃত অষ্টশ্লোকের 'অনুবৃত্তি' লিখিবার পর শ্রীল ঠাকুর ভক্তিবিনোদ ব্রজবন বিজয় করেন। শ্রীশ্রীল প্রভুপাদ ৪২৮ শ্রীচৈতন্যাব্দে  হৃষীকেশ মাসে ২২শ দিবসে শ্রীধাম মায়াপুর ব্রজপত্তনে বসিয়া শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর লিখিত ‘পীযূষবর্ষিণী বৃত্তির অনুগমনে তাঁহার ‘অনুকৃতি লিখন সমাপ্ত করেন ।

 

শ্রীগুরুগৌরচরণাশ্রিত শুদ্ধভজন পিপাসু ভক্তমাত্রেরই সাধন পথে এই মহাজনব্যাখ্যা-সম্বলিত শ্রীরূপশিক্ষাসার নির্য্যাস স্বরূপ উপদেশামৃতানুসরণে শ্রীগৌরশিক্ষাসার স্বরূপ শিক্ষাষ্টকাণুশীলনের একান্ত প্রয়োজনীয়তা বোধে অস্মদীয় পরমকরুণাময় শ্রীগুরুপাদপদ্ম ওঁ ১০৮শ্রী শ্রীমদ্ভক্তিদয়িত মাধব গোস্বামী বিষ্ণুপাদ নিঃশ্রেয়সার্থী জীবমাত্রেরই কল্যাণার্থ এই গ্রন্থরত্ন প্রকাশ করিলেন ।

 

ভক্তির প্রতিকূল কি কি ?

বাচো বেগং মনসঃ ক্রোধবেগং, জিহ্বাবেগমুদরোপস্থবেগম ।

এতান্ বেগান্ যো বিষহেত ধীরঃ, সৰ্ব্বামপীমাং পৃথিবীং স শিষ্যাৎ ॥ ১॥

 

অন্বয় । যেঃ ( যেই ) ধীর: (ভুক্তি-মুক্তি সিদ্ধিবাহার হিত পণ্ডিত ব্যক্তি) বাচোবেগং ( বাক্যের বেগ ) মনসঃ বেগং (মনের বেগ ) ক্রোধবেগং (ক্রোধের বেগ ) জিহ্বাবেগং ( জিহ্বার বেগ) উদবেগ ( উপরের বেগ ) উপস্থবেগং ( উপস্থের বেগ ) এতান বেগান ( এই ষড় বেগ ) বিষহেত ( ধারণ করিতে সমর্থ ) সঃ (তিনি) ইমাং ( এই ) সৰ্ব্বাং (সমস্ত ) পৃথিবীং ( পৃথিবীকে ) শিষ্যাৎ ( শাসন করিতে পারেন ) ॥ ১॥

 

শ্রীউপদেশামৃত ভাষ্য (শ্রীভক্তিবিনোদ ঠাকুর লিখিত)

গুরুকপা বলে লভি সম্বন্ধ বিজ্ঞান। কৃতিজীব হয়েন ভজনে যত্নবান ।।

সেই জীবে শ্রীরূপ-গোস্বামিমহোদয় । উপদেশামৃতে ধন্য করেন নিশ্চয় ।। 

গৃহী গৃহত্যাগী ভেদে দ্বিপ্রকার জনে । উপদেশ ভেদ বিচারিবে বিজ্ঞগণে ।।

গৃহী প্রতি এই সব উপদেশ হয় । গৃহত্যাগী প্রতি ইহা পরাকাষ্ঠাময় ।।

বাক্যবেগ মনোবেগ ক্রোধবেগ আর । জিহ্বাবেগ উদর উপস্তবেগ ছার।।

এই ছয় বেগ সহি কৃষ্ণনামাশ্রয়ে।  জগৎ শাসিতে পারে পরাজিয়া ভয়ে ।। 

কেবল শরণাগতি কৃষ্ণভক্তিময়। ভক্তি-প্রতিকূল ত্যাগ তার অঙ্গ হয় ।।

ছয় বেগ সহি যুক্ত-বৈরাগ্য আশ্রয়ে । নামে অপরাধশূন্য হইবে নিৰ্ভয়ে ।।

 

পীযূষবর্ষিণী বৃত্তি

শ্রী শ্রী গোদ্রুম চন্দ্রায় নমঃ । যত কৃপাসাগরোদ্ভূতমুপদেশামৃতং ভূবি। শ্রীরূপেণ সমানীতং গৌরচন্দ্রং ভজামি তম ।। নত্বা গ্রন্থপ্রণেতারং টীকাকারং প্রণমা চ ।।

ময়া বিরচাতে বৃত্তিঃ পীযূষ-পরিবেশনী। “অন্যাভিলাষিতা শূন্যং জ্ঞানকৰ্ম্মাানাবৃতম্। আনুকূল্যেন কৃষ্ণানুশীলনং ভক্তিরুত্তমা।”- শ্রীভক্তিরসামৃতসিন্ধু । এই কারিকাসম্মত আনুকূল্যের সঙ্কল্প ও প্রতিকূল্যের বর্জ্জন সহকারে ভক্তির অনুশীলনই ভজনপরায়ণ ব্যক্তিদিগের নিতান্ত প্রয়োজন। আনুকূল্যের সঙ্কল্প ও প্রতিকূল্যের বর্জ্জন শুদ্ধাভক্তির সাক্ষাৎ অঙ্গ নয় কিন্তু ভক্তির অধিকারদাতা শরণাপত্তিলক্ষণ-শ্রদ্ধার অঙ্গদ্বয় । যথা “আনুকুল্যস্য সঙ্কল্প: প্রতিকূল্যস্য বর্জ্জনম্ রক্ষিষ্যতীতি বিশ্বাসে। গোপ্তৃত্বে বরণং তথা। আত্ম- নিক্ষেপকার্পণ্যে যড় বিধা শরণাগতিঃ” — শ্রীভক্তিরসামৃতসিন্ধু ।

 

এই শ্লোকে প্রতিকূলবর্জ্জনের ব্যবস্থা। বাক্যের বেগ, মনের বেগ, ক্রোধের বেগ, জিহ্বার বেগ, উদরের বেগ ও উপস্থের বেগ এই ছয়টা যে ব্যক্তি বিশেষরূপে সহ্য করিতে সমর্থ হন তিনি এই সমস্ত পৃথিবী শাসন করিতে পারেন। "ক্রোধামর্ষাদিভির্ভাবৈরাক্রান্তং যস্য মানসম্। কথং তত্র মুকুন্দস্য স্ফূর্ত্তি সম্ভাবনা ভবেৎ”। শ্রীভাগবত। এই শ্লোকের তাৎপর্যে জানা যায় যে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মৎসরতা এই সকল উৎপাত মানবের মনে সর্ব্বদা উদয় হইয়া বাক্যের বেগ অর্থাৎ ভূতোদ্বেগকারী বচনপ্রয়োগ দ্বারা; মানস বেগ অর্থাৎ নানাবিধ মনোরথ দ্বারা, ক্রোধের বেগ অর্থাৎ রূঢ়বাক্যাদি প্রয়োগ দ্বার; জিহ্বার বেগ অর্থাৎ মধুর, অম্ল, কটু, লবণ, কষায় তিক্ত-ভেদে ঘড় বিধ রসলালসাদ্বারা • উদরের বেগ অর্থাৎ অত্যন্ত ভোজন প্রয়াসদ্বারা I

 

উপস্থের বেগ অর্থাৎ স্ত্রীপুরুষ সংযোগ লালসা দ্বারা মনকে অসদ্বিষয়ে আবিষ্ট করে। সুতরাং চিত্তে ভক্তির শুদ্ধ অনুশীলন হয় না । ভজন প্রয়াসী ব্যক্তির চিত্তকে ভক্তিপ্রবণ করিবার জন্য অস্মত্তত্ত্বাচার্য্য  শ্রীমদ রূপগোস্বামী এই শ্লোকটির সর্ব্বাগ্রে অবতরণ করিয়াছেন। উক্ত ষড়বর্গনিবৃত্তি করিবার চেষ্টাই যে ভক্তিসাধন তাহা নহে, কিন্তু ভক্তিমন্দিরে প্রবেশের যোগ্যতা- সাধন মাত্র । কৰ্ম্মমার্গে ও জ্ঞানমার্গে এই ষড় বর্গ নিবৃত্তির উপদেশ আছে, তত্তৎ সাধন প্রণালী ভক্তের পালনীয় নয়। কৃষ্ণনাম রূপ চরিতাদি শ্রবণ- কীৰ্ত্তন ও অনুস্মরণই সাক্ষাৎ ভক্তি। ভক্তি অনুশীলন সময়ে উক্ত ষড় বেগ আসিয়া অপক্ক সাধকের সাধনে প্রতিবন্ধকতা আচরণ করে। সেই সময় ভক্ত অনন্যশরণাগতির ভাবে দশ নামাপরাধ দমন চেষ্টার মধ্যে নামবল কৃপায় এই প্রতিবন্ধক ও শুদ্ধভক্তসঙ্গ - প্রভাবে দূর করিতে সমর্থ হন ।

 

তদাশ্রয় অপরাধ যথা— “শ্ৰুত্বাপি নাম মাহাত্ম্যং যঃ প্রীতিরহিতোহধর্মঃ । অহং মমাদিপরমো নাম্নি সোহপ্যপরাধ- ক্বৎ।” শ্রীপদ্মপুরাণ। ভক্তগণ যুক্তবৈরাগ্যপরায়ণ অর্থাৎ শুষ্ক বৈরাগ্যের অধিকারী ন’ন। সুতরাং বিষয় সংস্পর্শাদি পরিত্যাগের ব্যবস্থা তাহাদের সম্বন্ধে নাই। মনের বেগ যে অসতৃষ্ণা, তাহা রহিত হইলেই নেত্রবেগ, ঘ্রাণবেগ ও শ্রবণবেগ নিয়মিত হয়, অতএব ষড় বেগজয়কারী আত্মানুগত ব্যক্তি পৃথিবী জয়ী হন। এই বেগ সহনোপদেশ কেবল গৃহীভক্তের পক্ষে কেন না গৃহত্যাগীর পক্ষে পরাকাষ্ঠারূপ সম্পূর্ণ বেগাদি বর্জ্জন গৃহত্যাগের পূর্ব্বেই সিদ্ধ হইয়াছে ৷ ১ ॥

 

কৃষ্ণেতর কথা বাচবেগ তার নাম। কামের অতৃপ্তে  ক্রাধবেগ মনোধাম।।

সুস্বাদু ভোজনশীল জিহ্বাবেগদাস । অতিরিক্ত ভোক্তা যেই উদরেতে আশ।।

ঘোষিতের ভৃত্য স্ত্রৈণ কামের কিঙ্কর। উপস্থবেগের বশে কন্দর্পতৎপর।।

এই ছয় বেগ যার বশে সদা রয়। সে জন গোস্বামী করে পৃথিবী বিজয় ॥১॥ শ্রীউপদেশামৃত ভাষা [ শ্রীল ঠাকুর ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী লিখিত ]