Sunday, December 6, 2020

🌳🌴🦚💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🦚🌴🌳

🌷"ভগবৎ বিরহ শ্রীকৃষ্ণ স্মরণ"🌷

🌳🌴🦚💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🦚🌴🌳

খুব গুরুত্বপূর্ণ পোষ্ট

শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ

সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম I

নমস্ত্রিকাল - সত্যায় জগন্নাথ সুতায় চ।

- ভৃত্যায় -পুত্রায় - কলত্রায় তে নমঃ।।

 

‘’ভগবৎ বিরহ’’

ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষানুযায়ী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সর্বদাই সর্বত্র বিরাজমান, ঠিক যেমন সূর্য সব সময়ই আকাশে বিরাজমান। কখনো কখনো তিনি আবির্ভূত হন, আবার কখনো কখনো তিনি অন্তর্হিত হন। আবির্ভাবে যেমন তাঁর সান্নিধ্য লাভ করা যায়, তেমনি অন্তর্হিত হলেও শ্রবণ, কীর্তন স্মরণাদি ভগবৎ ভজনের মাধ্যমেও ভগবৎ সান্নিধ্য লাভ করে ভক্তরা পরমানন্দ অনুভব করেন। বিশেষত ভগবৎ বিরহে কৃষ্ণ স্মরণ করে ভগবানের শ্রেষ্ঠ ভক্তরা ভগবৎ-ভাবনায় তন্ময় হয়ে থাকতেন। ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা হচ্ছে, ভগবৎ বিরহে হরিভজন। এই ভাবে ভগবৎ সান্নিধ্য আরো নিবিড় ভাবে লাভ হয়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর এই জগৎ থেকে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর লীলা সংবরণ করলে, কৃষ্ণবিরহে শোকাকুল শ্রীকৃষ্ণ পার্ষদ উদ্ধব ভগবানের লীলাবিলাস সমূহ স্মরণ করে বিদুরের কাছে বর্ণনা করেছিলেন।

 

উদ্ধব ছিলেন নিত্যসিদ্ধ কৃষ্ণভক্ত । বাল্যকাল থেকেই তিনি কৃষ্ণমূর্তি নিয়ে খেলা করতেন । এইভাবে জন্ম থেকেই তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত কৃষ্ণভক্তি ছিলো। সেই কৃষ্ণমূর্তিকে পোশাক পরানো, ভোগ নিবেদন করা, তাঁর পূজা করা, সবই তিনি করতেন। এইটি হচ্ছে নিত্যমুক্ত ভক্তের লক্ষণ; এঁরা কখনও ভগবানকে ভুলতে পারেন না। এইভাবে শৈশবে উদ্ধব সব সময়ই কৃষ্ণমূর্তি সেবায় তন্ময় হয়ে থাকতেন। পাঁচ বছর বয়সে তাঁর মা তাঁকে প্রাতঃরাশের জন্য ডাকলেও কৃষ্ণ সেবায় নিযুক্ত থাকায়, তিনি তা নিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। শ্রীমদ্ভগবদ গীতায় উল্লেখ করা হয়েছে,-

"শুচীনাং শ্রীমতাং গেহে যোগভ্রষ্টোহভিজায়তে।"

 অর্থাৎ, ভজনে উন্নত ব্যক্তি পরবর্তী জীবনে সদাচার সম্পন্ন ধনীর গৃহে জন্মগ্রহণ করেন

 

এই ভাবে উদ্ধব শৈশব থেকেই অবিরাম ভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিযুক্ত ছিলেন। শেষ বয়স পর্যন্ত তাঁর কৃষ্ণসেবা অব্যহত ছিলো। বিদুর উদ্ধবকে কৃষ্ণ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলে, উদ্ধবের তক্ষুণি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সমস্ত কথা স্মরণ হতে লাগলো। কৃষ্ণস্মরণ হতেই তিনি ভগবদ্ভাবে অভিভূত হয়ে পড়লেন, এক মুহূর্তের জন্য তিনি নির্বাক হয়ে পড়লেন। ভগবৎ ভক্তিতে আপ্লুত উদ্ধব কৃষ্ণচরণকমল স্মরণ করে আবিষ্ট হয়ে ভাবের গভীর থেকে আরো গভীরে নিমজ্জিত হলেন। তাঁর দেহ বিবর্ণ হয়ে পড়লো, তাঁর দুচোখ বেয়ে অবিরল ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। বিদুর দেখলেন উদ্ধবের মধ্যে দিব্য ভগবৎ-প্রেমের সকল লক্ষণসমূহ। তখন উদ্ধব এই বাহ্য জগতের সব কথা ভুলে গিয়েছিলেন। তিনি অশ্রু মোচন করে বিদুরকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা বলতে লাগলেন। "শুদ্ধভক্ত এই দেহে অবস্থান কালেও সর্বদাই ভগবদ্ধামে বিরাজমান।"

 

উদ্ধব বললেন,- "আমাদের কুশল সংবাদ কি আর বলবো, মহাকাল সর্প আমাদের গৃহকে গ্রাস করেছে, কৃষ্ণসূর্য অস্তমিত হয়েছেন।" শ্রীকৃষ্ণকে সূর্যের সঙ্গে তুলনা যথার্থ হয়েছে। কারণ কৃষ্ণের আবির্ভাব অন্তর্ধান সূর্যোদয় সূর্যাস্তেরই মতো। ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু খুব সুন্দর ভাবে এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করেছেন। ভগবানের একটি লীলা এই ব্রহ্মান্ডে শেষ হলে, সেই লীলাটি অন্য ব্রহ্মান্ডে প্রকট হয়। সূর্য যেমন সব সময় আকাশে রয়েছে, কৃষ্ণলীলা ঠিক সেই রকম নিত্য। এই লীলা সব সময় অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে, এর কোনো বিরতি নেই। শাস্ত্রে বর্ণিত ভগবানের বিভিন্ন লীলাগুলি সবই যথাসময়ে ঘটে। দিনে একবার সূর্যোদয়ের মতো ব্রহ্মার একদিনে কৃষ্ণলীলা এক একটি ব্রহ্মান্ডে অনুষ্ঠিত হয়।

 

বৈষ্ণবাচার্য শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুরের মতে, যাদবদের বিনাশের সংবাদ পেয়ে বিদুর গভীর শোকে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। উদ্ধব বিদুরের শোকাকুল হওয়ার কারণ বুঝতে পেরেছিলেন, ‘সূর্যাস্তের পর সর্বত্রই অন্ধকার নেমে আসে।এই বলে বিদূরের কাছে তিনি সহানুভূতি প্রকাশ করেছিলেন। কৃষ্ণ-সূর্যের অস্ত গমনে, সমগ্র বিশ্বসংসারে শোকের ছায়া নেমে এসেছিলো। কারোর মনে সুখের লেশমাত্র ছিলো না, বিদুরের মতোই উদ্ধব অন্যান্যরাও গভীর শোকে কাতর হয়ে পড়েছিলেন।বিশ্ববাসীর দুর্ভাগ্য, আরো দুর্ভাগ্য যাদবদের কেনোনা অপ্রাকৃত দিব্য গুণাবলী দর্শন করেও আদি পুরুষ পরমেশ্বর ভগবান বলে শ্রীকৃষ্ণকে চিনতে পারলেন না।উদ্ধব জানতেন যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান। কিন্তু সুবর্ণ সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও তিনি ভগবানের সেবা করতে পারলেন না ভেবে বেদনা বোধ করেছিলেন।

 

আবির্ভাবের পর থেকে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ভগবত্তা, তাঁর,"ষড়-ঐশ্বর্য-

ঐশ্বর্যস্য সমগ্রস্য বীর্যস্য যশসঃ শ্রিয়ঃ
জ্ঞান বৈরাগ্যয়োশ্চৈব ষণ্নং ভগ ইতীঙ্গনা ।।      (বিষ্ণুপুরান //৭৪)
অনুবাদঃ- পূর্ণ ঐশ্বর্য, পূর্ণ শক্তি, পূর্ণ সৌন্দর্য, পূর্ণ খ্যাতি (যশ), পূর্ণ জ্ঞান পূর্ণ বৈরাগ্য এগুলি হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের ছয়টি ঐশ্বর্য। অর্থাৎ, পূর্ণ ঐশ্বর্য, বল, যশ, সৌন্দর্য, জ্ঞান বৈরাগ্য প্রদর্শণ করলেও তাঁকে শুধু একজন অসাধারণ ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব বলে মনে করেছিলো অনেক মূর্খ। যারা মূর্খ তারা ভগবানকে চিনতেই পারলো না। আর যারা কৃষ্ণেরই বংশের, অর্থাৎ, যাদবরা সর্বদা কৃষ্ণের ভগবৎ সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁকে সকলের হৃদয়ে অবস্থিত পরমাত্মা বলে জানলেও তাঁকে আদি পুরুষ পরমেশ্বর ভগবান বলে চিনতে পারলেন না। এই কথা ভেবে উদ্ধব গভীর শোকে অত্যন্ত আকুল হয়ে বিলাপ করেছিলেন। সুগভীর ভগবদ ভক্তিই এর কারণ। শুদ্ধ ভক্ত এই ভাবে সব চেয়ে অভাগা বলে মনে করে নিজেকে।

 

যাদের শাস্ত্রীয় বিশ্বাস আছে তারা ভগবানকে যথাযথ স্বীকার করে, শ্রীকৃষ্ণ যখন জগতে লীলা প্রকট করেছিলেন, তখন বিভিন্ন লোক তাঁকে বিভিন্নভাবে গ্রহণ করেছিলো। বৈদিক শাস্ত্রে এবং সর্বশ্রেষ্ঠ আচার্যরা কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকে আদি পুরুষ পরমেশ্বর ভগবান বলে স্বীকার করেছেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন যদু বংশের কুলতিলক। যাদবদের পরম সৌভাগ্য যে, তাঁরা ভগবানকে অন্তরঙ্গ ভাবে সেবা করতে পেরেছেন, তাঁর পুত সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পেয়েছেন। আর যারা তাঁকে একজন সাধারণ মানব বলে মনে করেছে, তারা নিশ্চয় ভগবানের মায়া দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েছে। যাদের ভগবানে বিশ্বাস নেই, ভগবদ্গীতায় বিশ্বাস নেই, যারা মনে করে দুর্যোধনাদি বধের জন্য ব্রহ্মশাপে যদুবংশ ধ্বংস হয়েছে, তারা হচ্ছে ভগবদ্বিদ্বেষী। তাদের বুদ্ধি নারকীয়, যারা ভক্ত, কৃষ্ণ ভজন করেন, তাঁরাই কিন্তু ভগবানকে যথার্থভাবে জানেন। তাঁরা জানেন, ভগবান তাঁর কর্মফল দ্বারা প্রভাবিত হন না।

 

ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ঘোষণা করেছেন,-

মাং কর্মাণি লিম্পন্তি মে কর্মফলে স্পৃহা।

ইতি মাং যোহভিজানাতি কর্মভির্ন বধ্যতে।।    ( গীতা /১৪ )

অর্থাৎ,- কোন কর্মই আমাকে প্রভাবিত করতে পারে না এবং আমিও কোন কর্মফলের আকাঙ্ক্ষা করি না। আমার এই তত্ত্ব যিনি জানেন, তিনিও কখনও সকাম কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ হন না। 

মহারাজ যুধিষ্ঠরের রাজসূয় যজ্ঞানুষ্ঠানে নিম্ন, মধ্য ঊর্ধ্বলোক থেকে দেবতারা সমবেত হয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের অনুপম দিব্যরূপ দর্শন করা, সেটি সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার নিপুণ শিল্প কর্ম বলে তারা মনে করেছিলেন। জগতে সব চেয়ে সুন্দর কিছু থাকলে তাকে হয় নীলকমল বা তাকে আকাশের পূর্ণচন্দ্রের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। কিন্তু বিভিন্ন গ্রহ লোকের দেবতাদের মতে নীলকমল বা নির্মল আকাশের পূর্ণ চন্দ্রের সৌন্দর্য কৃষ্ণের রূপে তুলনায় অতীব তুচ্ছ। দেবতারা ভেবেছিলেন, লোকপিতা ব্রহ্মা যেমন তাদের সৃষ্টিকর্তা, সেই রকম তিনি শ্রীকৃষ্ণেরও সৃষ্টিকর্তা। প্রকৃত পক্ষে তা সত্যি নয়, পক্ষান্তরে ব্রহ্মাকে সৃষ্টি করেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ।

 

শ্রীকৃষ্ণের দিব্য রূপের সৃষ্টি করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। ভগবদ্গীতায় কৃষ্ণ স্বয়ং বলেছেন,-

অহং সর্বস্য প্রভবো মত্তঃ সর্বং প্রবর্ততে।

ইতি মত্বা ভজতে মাং বুধা ভাবসমন্বিতাঃ ।।

অর্থাৎ,- "আমি সমস্ত কিছুর উৎস সবকিছু আমার থেকে উৎপত্তি হয়েছে" অর্থাৎ ভগবান হচ্ছেন সবকিছুর স্রষ্টা, সবকিছু পালন করেন এবং তিনি সবকিছু সংহার করতে পারেন। বৃন্দাবনে গোপালকৃষ্ণ শৈশব লীলাবিলাসের সময় কখনও কখনও শিশুর মতো রোদন করতেন, কখন বা হাসতেন, তখন তাঁকে এক সিংহ শাবকের মতো মনে হতো। যোগী বা জ্ঞানীরা ভগবানের সব লীলা আস্বাদন করতে পারেন না। নন্দ, উপানন্দ, মা যশোদাদি পিতৃ স্থানীয় মাতৃ স্থানীয় ব্রজের গোপ-গোপীরাই শুধু শ্রীকৃষ্ণের এই সব লীলা আস্বাদন করতেন । ভগবানের এই সব লীলা আস্বাদন করতে চাইলে নন্দ-যশোদাদি ব্রজবাসীর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হবে। শ্রীকৃষ্ণ ব্রজবাসী সকলের প্রাণপ্রিয় ছিলেন। এমন কি গরু-বাছুর, তারাও শ্রীকৃষ্ণকে প্রাণাধিক ভালবাসতো।

 

গরু চরাতে বনে গেলে, কখনো কখনো অসুররা আক্রমণ করতো। শিশু কৃষ্ণ তাদের দেখে যেনো অবাক হয়ে যেতেন। কিন্তু পরক্ষণেই সিংহশাবকের মতো সেই অসুরকে বধ করতেন। তাঁর সখা অন্যান্য গোপবালকেরা বিস্মিত হতেন আর বাড়ি ফিরে গিয়ে বাবা-মা অন্যান্যদের কৃষ্ণের এই সব অদ্ভুত বিস্ময়কর কার্যাবলী বিশদ ভাবে বলতেন। সবাই শ্রীকৃষ্ণের এই সব কাহিনী শুনে তাঁর অশেষ গুণগান করতেন। তাই শ্রীকৃষ্ণ শুধু নন্দ- যশোদাকেই আনন্দ দান করতেন না, এইভাবে সমস্ত ব্রজবাসীকে শ্রীকৃষ্ণ অফুরন্ত আনন্দ দান করতেন। পাখিদের রব নানা বৃক্ষে সুশোভিত যমুনাতীর দিয়ে সর্বশক্তিমান ভগবান গোপাল কৃষ্ণ গোধন গোপ সখাদের নিয়ে গোষ্ঠে যেতেন। বৃন্দাবনের যমুনার তীর অপূর্ব সুন্দর। নানা ফুল-ফলে সেই যমুনার উপকূল পূর্ণ। আম, জাম, কাঁঠাল, তালাদি নানা সুমিষ্ট ফল সগন্ধি পুষ্পে সুশোভিত এই বৃন্দাবন। হংস, বক, ময়ূর-ময়ূরীর রবে সেই নদীতট, বৃক্ষসকল এবং বনভূমি নিনাদিত ছিলো। সেই বৃন্দাবনের বৃক্ষ-পশু-পক্ষীরা সকলেই পুণ্যাত্মা।

 

গোপালকৃষ্ণ গোপ গোপী সকলকে আনন্দ দানের জন্যই এরা ব্রজে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন আচ্ছাদিত অগ্নিশিখার মতো। একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ যেমন উপযুক্ত জ্বালানির সংস্পর্শে এক বিরাট অগ্নিকান্ড ঘটাতে পারে, সেই রকম ছোট্ট গোপাল কৃষ্ণ কখন নন্দালয়ে, কখন প্রিয় পার্ষদ গোপবালকদের সঙ্গে বৃন্দাবনে খেলাধূলার সময় পুতনা, অঘাসুর, বকাসুর, প্রলম্বাসুর, ইত্যাদি অনেক ভয়ঙ্কর অসুর বধ করেছিলেন। শ্রীপতি ভগবান সুন্দর সুন্দর বৃষদের গোচারণে নিয়ে যাবার সময় মধুর সুরে বংশীধ্বনি করে প্রিয় গোপসখাদের দিব্য আনন্দ দান করতেন। শ্রীমদ্ভাগবতে উল্লেখ করা হয়েছে যে,

"ইত্থং সতাং ব্রহ্মসুখানুভূত্যা  দাস্যং গতানাং পরদৈবতেন।

মায়াশ্রিতানাং নরদারকেণ  সাকং বিজহুঃ কৃতপুণ্যপুঞ্জাঃ॥"

অর্থাৎ, এই সব গোপ বালকেরা বহু বহু জীবন পুঞ্জীভূত পুণ্যকর্মের ফলে আজ লীলা পুরুষোত্তম ভগবানের খেলার সাথী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছে। তারা সাধারণ বালক নয়। ভগবানের দিব্যলীলা বিলাসের সহচর হওয়া সাধারণ জীবের পক্ষে সম্ভব নয়। এই সব গোপবালকেরা আগের জন্ম বহু বহু জীবন ধরে ছিলেন মহাঋষি, মহাযোগী।

 

কৃতপুণ্যপুঞ্জাঃঅর্থাৎ বহু বহু পুণ্যজীবনের ফলে আজ তারা ভগবানের দিব্যলীলাবিলাসে অংশগ্রহণে সুযোগ পেয়েছেন। তাঁর পুতসান্নিধ্য লাভের সুযোগ পেয়েছেন, ভগবান গোপাল কৃষ্ণের খেলার সাথী হয়েছেন। কৃষ্ণকে তাঁদের সব চেয়ে অন্তরঙ্গ প্রিয়তম সখা রূপে তারা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পরিচয়, তাঁর ভগবত্তা নিয়ে গোপ সখারা কখনো মাথা ঘামাতো না। কখন ভোর হবে, কখন তাঁরা কৃষ্ণের সঙ্গে গরু চরাতে বনে যাবে, সেখানে গিয়ে সারাদিন কৃষ্ণের সঙ্গে সকল গোপসখারা খেলা ধূলায় কৃষ্ণের দিব্য সান্নিধ্যে অপ্রাকৃত আনন্দ লাভ করবে, সব কথা আগের রাতে চিন্তা করে গভীর আগ্রহে তারা সূর্যোদয়ের অপেক্ষা করতো। তাঁরা গোপালকৃষ্ণকে এতো ভালবাসতো।

 

নন্দ মহারাজের হাজার হাজার গোধন ছিলো। তিনি ছিলেন কংসের রাজ্যের বৈশ্য ভূস্বামী। গোরক্ষা গোপালন বৈশ্যের কাজ। কৃষ্ণ তখন বালক। তাঁর বয়স তখন ছয় কি সাত বছর। তাই নন্দ মাহরাজ অন্যান্য গোপবালকেদের সঙ্গে কৃষ্ণকে তাঁর গোধন তত্ত্বাবধানের দায়িত্বভার দিয়েছিলেন। বিশেষত গরু চরাবার দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। গরু চরাতে গিয়ে অন্য সব গোপবালকদের সঙ্গে কৃষ্ণ বৈচিত্রময় অনেক লীলাবিলাস করেছিলেন। কৃষ্ণ যখন তাঁর প্রিয় বংশীধ্বনি করতেন, এই বংশীধ্বনি এতই মধুর যে তা শুনে মায়াবাদীদের অন্তিম লক্ষ্য ব্রহ্মানন্দের কথা গোপবালকদের কাছে অতি তুচ্ছ বলে মনে হতো। কৃষ্ণের নানা রকমের বাঁশির কথা শ্রীল রূপ গোস্বামী তাঁর রচিতভক্তিরসামৃতসিন্ধুগ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।

 

লোকপিতা ব্রহ্মাজীও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই অপ্রাকৃত বংশীর উল্লেখ করেছেন এই ভাবে,-

"বেণুং ক্কণন্তমরবিন্দদলায়তাক্ষং  

বর্হাবতংসমসিতাম্বুদসুন্দরাঙ্গম্।

কন্দর্পকোটিকমনীয়বিশেষশোভং।

গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি॥"

নারায়ণের চেয়ে ভগবান কৃষ্ণের যে ৪টি বেশি বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তার একটি হচ্ছে এই বেণুমাধুর্য। বৈদিক অর্থনীতি অনুসারে সমাজে মানুষের আর্থিক অবস্থা তার শস্যভান্ডার গোধনের পরিমাণের উপর নির্ভর করতো। নন্দ মহারাজের হলুদ, সবুজ, কালো রেখাযুক্ত নানা রঙের অনেক হাজার হাজার সুন্দর সুন্দর গাভী বলদ ছিলো। এই সকল সুদেহী সবল আনন্দোৎফুল্ল গোধন বৃন্দাবনের পরিবেশকে প্রাণবন্ত করে তুলেছিলো।

 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলাভূমি এই বৃন্দাবন আজও আছে। ভক্তকুল আজও ব্রজবিহার করেন। যাঁরা ভগবৎ-দর্শন করতে চান, যাঁরা ভগবদ্ধামে ফিরে যেতে চান তাঁরা শ্রেষ্ঠ ভগবদ্ভক্ত উদ্ধব, বিদুর আদির পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা অনুযায়ী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যেমন সকলের উপাস্য, তাঁর ধাম বৃন্দাবনও তেমনি সকলের উপাস্য। কারণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর এই অপ্রাকৃত ধাম অভিন্ন। উদ্ধব বিদুর পাঁচ হাজার বছর আগে কৃষ্ণ সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। জড় চোখে ভগবানকে না দেখা গেলেও, আজও হাজার হাজার ভগবৎ রসপিপাসু বৃন্দাবনে গিয়ে দিব্য আনন্দ আস্বাদন করেন।

 

বৈদিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী অর্থনৈতিক উন্নতি নির্ভর করে গোধন শস্যভান্ডারের প্রাচুর্যের উপর। এই ভাবে প্রচুর খাদ্যশস্য পর্যাপ্ত গোধন দ্বারা মানব সমাজের খাদ্য সমস্যার সমাধান করা যায়। মানব সমাজের অর্থনৈতিক সমস্যাও এইভাবে গোধন শস্য, এই দুটির দ্বারা দূর করা যায়। এই ভাবে আদি গুরু ভগবান কৃষ্ণ স্বয়ং আচরণ করে শিক্ষা দিয়েছেন যে কৃষি গোপালন বা গোরক্ষা হচ্ছে আদর্শ বৈশ্যের বৃত্তি। বৈদিক শাস্ত্রেও বৃষকে পিতার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। আর গাভীকে মাতা বলা হয়েছে। কারণ মানব সমাজে পিতার মতো বৃষ জমি চাষ করে খাদ্য উৎপাদন করে। মানব সমাজ যেমন মাতৃস্তন্যে লালিত হয়, তেমন গো-মাতাও আমাদের সব চেয়ে উপাদেয় দুগ্ধ দান করে পালন করে।

 

বর্তমান জগতে বিশাল বিশাল কসাইখানায় প্রতিদিন অসংখ্য গো-হত্যা করে মানব সমাজের জীবনী শক্তির অপরিসীম ক্ষয়সাধন চলছে। এই সমস্যার সমাধানে, সকলকে আমিষ আহার, অবৈধ স্ত্রীসঙ্গ, আসব পান জুয়াখেলাদি পাপকর্ম ত্যাগ করে মহামন্ত্র,-

‘’হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে I

হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে I I’’

-কীর্ত্তন করতে অনুরোধ করা হচ্ছে। নিষ্পাপ জীবন যাপন করে নিরপরাধে সকলে 'হরিনাম' কীর্ত্তন করলে কৃষ্ণময় হওয়া যায়। এই ভাবে শ্রবণ, কীর্ত্তন, ভগবৎ স্মরণাদি করে জীবকুল জীবনের অন্তিম লক্ষ্য ভগবদ্ধামে চলে যেতে পারে। এই কৃষ্ণচেতনা অনুশীলন করে, এই জীবনেই অভয়, অশোক অমৃত আস্বাদন করতে পারে। শ্রেষ্ঠভক্ত, ভগবৎ পার্ষদ উদ্ধবের জীবন থেকে আমরা এই শিক্ষা লাভ করি।

 

No comments:

Post a Comment

🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴🌴🌳 🌻🌼 শ্রীবলরামের রাসযাত্রা 🌹 শ্রীকৃষ্ণের বসন্তরাস 🌼🌻 🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴...