🌳🦚💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🦚🌳

💐শ্রীজগন্নাথদেবের জ্বর লীলা💐

🌳🦚💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🦚🌳

শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ

সকল সাধু, গুরু, বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম I

‘’গুরু - বৈষ্ণব  - ভগবান তিনিহেঁ স্মরণ ।

তিনেহেঁ স্মরণ হইতে হয় বিঘ্ন বিনাশন ।।

অনায়াসে হয় নিজ বাঞ্ছিত পূরণ । I’’

 

নমস্ত্রিকাল - সত্যায়জগন্নাথসুতায়চ।

স - ভৃত্যায়স -পুত্রায়স - কলত্রায়তেনমঃ।।

 

স্কন্দপুরাণ অনুযায়ী, পুরীর মন্দিরে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার পরে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন এই অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলেন। স্নান যাত্রার আগের দিন জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রাকে জগন্নাথ মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে বাহির করে মন্দির প্রাঙ্গণে বিশেষ ভাবে তৈরি এবং পুষ্প, পল্লব, তোরণ আর পতাকা দ্বারা সুসজ্জিত স্নানমণ্ডপে নিয়ে এসে স্নানবেদীতে বসানো হয়। মন্দিরের উত্তর দিকে অবস্থিত সুনাকুয়া নামক স্বর্ণবেষ্টিত একটি কুয়া থেকে ১০৮ স্বর্ণ কলসিপূর্ণ সুবাসিত জল এনে বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে সেই জল শুদ্ধিকরণ করে স্নানযাত্রার দিন দেবতাদের স্নান করানো হয়।

 

যে কুয়োর জলে বিগ্রহদের স্নান করানো হয়, তার মুখ বছরে শুধু এই দিনই খোলা হয় তারপর কুয়ার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেবকরা কুয়া থেকে জল আনার সময় মুখে কাপড় বেঁধে যান, যাতে তাদের নিঃশ্বাস দ্বারাও জল না অপবিত্র হয়। দেবতাদের স্নানের পূর্বে তাঁদের সিল্কের কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় তারপর লাল বর্ণের একপ্রকার চূর্নের প্রলেপ দেওয়া হয়, তারপর ১০৮ টি স্বর্ণ কলসপূর্ণ পবিত্র জল দিয়ে একে একে বিগ্রহগুলিকে অভিষিক্ত করা হয় বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ, শঙ্খধ্বনি ও হরিনাম সংকীর্তন সহযোগে। এরপর জগন্নাথ আর বলরামকে গজবেশে সাজানো হয় এবং সুভদ্রাকে পদ্মবেশে সাজানো হয়।

 

এই স্নানযাত্রা দেখতে মন্দিরে বহু ভক্তের আগমন ঘটে, বলা হয়, এই স্নানযাত্রা দর্শনে দর্শনার্থীর পাপমোচন হয়। স্নানযাত্রার পর ১৫ দিন পর্যন্ত তিন ভাইবোন নিভৃতবাসে থাকেন। লৌকিক বিশ্বাস, জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমার দিন অত্যধিক স্নানের ফলে তিন ভাইবোনের জ্বর হয়। তাই, এই সময় তাঁদের গোপনে রাজবৈদ্যের চিকিৎসাধীনে একটি সংরক্ষিত কক্ষে রাখা হয়। জগন্নাথের এই অসুস্থতার পর্যায়টি অনবসর বা অনসর নামে পরিচিত। এই সময় ভক্তেরা দেবতার দর্শন পান না। তাদের দর্শনের জন্য বিগ্রহের পরিবর্তে মূল মন্দিরে তিনটি পটচিত্র রাখা হয়। এই ১৫ দিনে ভগবানের নিত্য পূজা পাঠ কিন্তু চালু থাকে।

 

প্রকৃতপক্ষে, অনবসর কালে, জগন্নাথ জ্বর লীলা করেন। আমাদের জ্বর হলে, যেমন আমাদের পরিবার পরিজনেরা আমাদের যত্ন একটু বেশি করেন, তেমনই ভগবানের ইচ্ছা হয় তাঁর মন্দিরের সেবক দয়িতাপতিদের কাছ থেকে আরও সেবা নেওয়ার। তাই, এই সময় জগন্নাথদেব সহ তাঁর ভাইবোনের আরো যত্ন পুরীর মন্দিরে, তাঁদের সেবকরা করেন যাতে দেবতারা দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন। এই বিশেষ সেবাকে বলে জগন্নাথের অনসর গুপ্ত রীতি সেবা। জ্বরের সময় তাঁদের অনবসর পানা নামক এক ধরনের বিশেষ পাচন, বিভিন্ন ফলের রস, মিষ্টান্ন এবং আরো অনেক পাচন - ঔষধি নিবেদন করা হয়।

 

স্নান যাত্রার পর অষ্টমী তিথিতে জগন্নাথ দেবের “মৈলম লাগি" সেবা করা হয়, এক ধরনের মলম দিয়ে প্রভুর শ্রীঅঙ্গে প্রলেপ দেওয়া হয় আর বলভদ্র দেব আর সুভদ্রা দেবীকে ফুলোরী তেল সর্বাঙ্গে লাগানো হয়। দশমীর দিন জগন্নাথ দেবের জ্বর খুব বেড়ে যায়, তখন তাঁকে দশমূল পাচন খাওয়ানো হয়। স্নান যাত্রার দিন ১০৮ ঘড়া জলে স্নানের ফলে, দেবতাদের বিগ্রহ সমূহ বিবর্ণ হয়ে পড়ে। তাই, স্নান যাত্রার ১২ দিন পর তিন দেবদেবীর তথাকথিত জ্বর সেরে গেলে এই তিন মূর্তিকে নানা লতাপাতা ইত্যাদির ভেষজ রঙ দিয়ে অঙ্গরাগ করান পুরীর দত্ত মহাপাত্ররা, এই দত্ত মহাপাত্ররা পুরীর মন্দিরে দেবতাদের বিগ্রহ রঙ করেন।

 

নব রঙে আর নানান সাজে সুসজ্জিত করে পুনরায় মূল মন্দিরে মূর্তিত্রয়কে আষাঢ় অমাবস্যার দিন, অর্থাৎ, রথ যাত্রার দুইদিন পূর্বে আর স্নান যাত্রার ১৫ তম দিনে পুরীর মূল মন্দিরের গর্ভগৃহে নিয়ে এসে রত্নসিংহাসনে তাঁদের বসিয়ে দর্শনার্থীদের সামনে দর্শন হেতু উন্মুক্ত করা হয়। এই দিনকে বলা হয় নবযৌবন উৎসব। এই অমাবস্যাকে বলা হয় ওড়িয়া ভাষায় উভা অমাবস্যা বা প্রকাশ্য অমাবস্যা। ওড়িয়া ভাষায় উভা মানে উপস্থিত বা প্রকাশ হওয়া, অনবসর কালের পর ভগবান জগন্নাথদেবের এই প্রথম প্রকাশ বা মন্দিরে উপস্থিত হবার জন্য এই অমাবস্যার এমন নাম।

 

কিন্তু, এই বিগ্রহ সমূহকে রঙ করলেও চক্ষুদান করা বাকি থাকে। এরপরের দিন অর্থাৎ, প্রতিপদের দিন অর্থাৎ, স্নান যাত্রার পরে ১৬ তম দিনে দেব মূর্তিগুলির সুন্দর করে নেত্র অঙ্কন করে নেত্রদান করা হয়, একেই নেত্র উৎসব বলা হয়। এই নেত্রদানের জন্য তিনটি রূপার পাত্রে কালো রং নিয়ে বিশেষ মন্ত্রচ্চারণের মাধ্যমে দেবতাদের নেত্র অঙ্কন করা হয়। এই নেত্রদানের মাধ্যমে ভগবান যেমন ভক্তদের অনিমেষ নয়নে কৃপা দৃষ্টিতে পুনরায় দেখতে পান, তেমনই ভক্তরাও এক পক্ষকাল ভগবান দর্শনের বিরহ কাল কাটিয়ে পুনরায় ভগবানকে দর্শন করে ভগবান প্রদত্ত ভক্তিনেত্র বা জ্ঞাননেত্র ফিরে পায়।

 

এরপর, আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথি, অর্থাৎ, রথযাত্রার দিনে তিন দেবতাকে চন্দন, পুষ্প, নানান অলঙ্কার, আভুষণ সহযোগে সাজিয়ে মন্দির থেকে দয়িতাপতিরা কোলে করে বাহির করে মন্দিরের বাইরে দাঁড়ানো সুসজ্জিত তিনটি পৃথক নয়ানভিরাম রথে তুলে নিয়ে দেবতাদের রথ মধ্যস্থ বেদীতে বসায়। মন্দিরের ভগবান, মন্দিরের বাইরে ভক্তদের নিকট এসে তাদের কৃপা করেন। প্রসঙ্গত, অনবসর বা অনসর কালে জগন্নাথ দেবকে মূল মন্দিরে দর্শনের জন্য না পাওয়ায়, অনেক দর্শনার্থী এই সময় আলালনাথ বা আলভারনাথ মন্দিরে যান। অলরনাথ বা আলভারনাথ বা আলালনাথ হলেন শ্রীবিষ্ণুর আর এক নাম।

 

এই অলরনাথ মন্দির রয়েছে ওড়িশায়। ইহা পুরির নিকটে ২৩ কিমি দূরে ব্রহ্মগিরিতে অবস্থিত। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, প্রভু জগন্নাথদেব, এই সময়কালে অলরনাথ দেবের মধ্যে প্রকাশিত হন। এই ব্রহ্মগিরিতে ব্রহ্মা সত্যযুগে বিষ্ণুর পূজা করতেন,তাই, সেই স্থানের নাম হয় ব্রহ্মগিরি। এই মন্দিরে বিষ্ণু ভগবানের মূর্তিকে অলরনাথ বা আলালনাথ বলা হয়। মনে করা হয়, জগন্নাথ আর অলরনাথ অভিন্ন। চৈতন্য মহাপ্রভু পুরীতে অবস্থানকালে শ্রী জগন্নাথকে প্রতিদিন দর্শন করতে যেতেন; অনবসর সময় যখন প্রভু এবং তাঁর ভাইবোনদের ১৫ দিনের জন্য গোপন কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তিনি তাঁর প্রিয় প্রভুকে দেখতে পেলেন না।

 

কথিত আছে, তখন মহাপ্রভু জগন্নাথ শ্রীচৈতন্যদেবকে ব্রহ্মগিরিতে অলরনাথ দেবের দর্শন করতে বলেছিলেন, যে তিনি সেই সময় ঐ মন্দিরে অলরনাথ রূপে বিরাজ করবেন। তাই শ্রীচৈতন্যদেব অলরনাথ মন্দিরে অলরনাথের দর্শনে এই অনবসরকাল  ১৫ দিন সেখানে যেতেন। তারপর থেকে এখনও সেই রীতি অনুযায়ী ভক্তরা শ্রীজগন্নাথের অনসর সময়ে এই মন্দিরে ভিড় করেন। আজও অলরনাথ মন্দিরে সেই শিলাখন্ড বিদ্যমান, যার উপরে দাঁড়িয়ে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু হরিনাম সংকীর্ত্তন করতেন।

 

হরি হরি! বিফলে জনম গঙাইনু।

মনুষ্য জনম পাইয়া,   রাধাকৃষ্ণ না ভজিয়া,

জানিয়া শুনিয়া বিষ খাইনু ।।

 

গোলোকের প্রেমধন, হরিনাম-সংকীর্ত্তন,

রতি না জন্মিল কেনে তায়।

সংসার-বিষানলে,   দিবানিশি হিয়া জ্বলে,

জুড়াইতে না কৈনু উপায় ।।

 

ব্রজেন্দ্রনন্দন যেই,   শচীসুত হৈল সেই,

বলরাম হৈল নিতাই ।

দীনহীন যত ছিল,   হরিনামে উদ্ধারিল,

তার সাক্ষী জগাই মাধাই ।।

 

হা হা প্রভু নন্দসুত,   বৃষভানুসুতাযুত,

করুণা করহ এইবার ।

নরোত্তমদাস কয়,   না ঠেলিহ রাঙ্গা পায়,

তোমা বিনে কে আছে আমার ।।

💞জয় পতিতপাবন শ্রীজগন্নাথদেবের জয়💞