💐🏵️💞🌺🌷🌺💞🏵️💐

🌷বৈষ্ণবের বিরহ তিথি🌷

💐🏵️💞🌺🌷🌺💞🏵️💐

শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ

সকল সাধু, গুরু, বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম I হরে কৃষ্ণ, আজ বিশেষ শুভদা তিথি।  আজ পরম ভাগবতবর শ্রীল ভক্তিহৃদয় বনদেব গোস্বামী মহারাজের অন্তরঙ্গ পার্ষদ পূর্বতন আচার্য্য, পরমারাধ্যতম পতিতপাবন পরমকরুণাময় শ্রীনিত্যানন্দের - অভিন্ন - প্রকাশ, ভাগবত - জ্ঞান - প্রদাতা ভগবানের - সেবায় - অধিকার - প্রদানকারি অস্মদীয় গুরুপাদপদ্ম, নিত্যলীলা প্রবিষ্ট ওঁ বিষ্ণুপাদ পরিব্রাজকাচার্য্য ত্রিদণ্ডি স্বামী ১০৮ শ্রীমদ রসিকানন্দ বন দেব গোস্বামী গুরু মহারাজের শুভ তিরোভাব তিথি  পূজা।

শ্রীল মহারাজের প্রণাম মন্ত্র:

হেমাঙ্গং হরিকীর্তনোৎসবমতিং সারস্বতং সত্তমং।

সৌমং শাস্ত্র বিদং রসজ্ঞমলং মাধুর্যমুগ্ধাশয়ম্।।

শ্রীবিদ্যুদ্রমণাখ্য কুঞ্জসদনে সেবাপরং সদ্গুণং।

বন্দে বিষ্ণুপদং বরেণ্য-রসিকানন্দং বনাখ্যংগুরুম।।

অর্থাৎ,- যাঁর শ্রীতাঙ্গ স্বর্ণকান্তিবিশিষ্ট, শ্রীহরিকীর্তনে যাঁর মতি মহোৎসব লাভ করে, যিনি শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের শ্রীচরণাশ্রিতের শ্রীচরণাশ্রিত, যিনি সর্বধর্ম পরিত্যাগে সত্তম বা ব্রজভজনে সত্তম, যিনি মধুর মূর্তি শাস্ত্র রহস্য জ্ঞাতা, ব্রজরসবিষয়ে অভিজ্ঞ, নির্মল হৃদয়, মধুররসে মঞ্জুরীভাবে যাঁর চিত্ত মুগ্ধ, যিনি শ্রীগুরুদেবের শ্রীবিদ্যুৎরমনাখ্য কুঞ্জে নিত্য সেবাপরায়ণ, যিনি সদ্গুণবান্ সেই বিষ্ণুপাদবরেণ্য শ্রীল রসিকানন্দ বনাখ্য গুরুদেবকে আমি বন্দনা করি।

আবির্ভাব

অধুনা বাংলা দেশের সাতক্ষীরা জেলার অন্তর্গত কালীগঞ্জ থানার অধীন বিষ্ণুপর-এর জমিদার মাতুলালয়ে ১৯১৪ সালের ১১ই আগষ্ট (মতান্তরে ৭ই আগষ্ট) বাংলা ২৬শে শ্রাবণ : মঙ্গলবার : ১৩২১ সালে তারাপদ ভূমিষ্ট হন। স্বগ্রাম সোনাতলা বিষ্ণুপুরের পার্শ্ববর্তী গ্রাম। পিতা ছিলেন সরল, সত্যমূর্তি ও ন্যায়নিষ্ঠ ৺ সত্যচরণ সরদার। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, মধ্যজীবনে সুদীর্ঘকাল শ্বশুরকূলের আড়তে চাকরীরত এবং শেষ জীবনে ছিলেন ব্যবসায়ী। মাতা জমিদার বংশোদ্ভূতা সুরধুনী দেবী ছিলেন স্নেহপ্রবণা, মধুর স্বভাবা এবং ধর্মপরায়ণা মহিলা। জমিদার নন্দিনী—কিন্তু তাঁর আলাপ-চারিতা সর্বদাই প্রতিপক্ষের হৃদয় স্পর্শ করত। সত্যচরণ দুই পুত্র ও দুই কন্যার জনক ছিলেন। তারাপদ পত্রদের মধ্যে ছিলেন কনিষ্ঠ।

কর্মজীবন

এম. এ. পাশ করে তারাপদবাবু ১৯৪০ সালের জানুয়ারী মাসে বিষ্ণুপর প্রাণকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাইস্কুলের অতিরিক্ত প্রধান শিক্ষক রূপে যোগদান করেন । ১৯৪১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে দ্বিতীয় বিভাগে বি. টি. পাশ করে কর্মস্থলে প্রত্যাবর্তন করেন এবং ঐ বৎসর জুনমাসে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকপদে বৃত হন । শিক্ষকতা ছাড়া জনসেবার জন্য বিষ্ণুপর ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টরূপে প্রভুত সাফল্য অর্জন করেন। তদানীন্তন সাতক্ষীরা মহকুমার ইউনিয়ন বোর্ড'গুলির প্রেসিডেন্টদের মধ্যে ভাল কাজের জন্য তিন বৎসর কালের মধ্যে একটি ঘড়ি ( Wrist watch ) উপহার পান। |

 

১৯৪৪ সালে প্রথম গঠিত খুলনা জেলা স্কুল বোর্ডে নির্বাচিত সদস্যরূপে যোগদান করেন। দুর্গম গ্রাম সমূহের অভ্যন্তরে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন তাঁর শিক্ষানুরাগ ও বিদ্যোৎসাহিতার সাক্ষ্য বহন করে। প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থেকেও তিনি কতিপয় সমাজ-দরদী যুবকের সক্রিয় সহায়তায় এবং জনসাধারণের অকৃপণ সহযোগিতায় নৈশবিদ্যালয় ( বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র) প্রতিষ্ঠা করেন। দুঃস্থ আর্ত্ত মাননুষের জন্য হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শুরু, করেন এবং বহু দূরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্ত মানুষকে নিরাময় করে প্রভূত খ্যাতি অর্জ্জন করেন। 

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে জাপানী বোমা বর্ষণের ভয়ে অনেক কলেজ কতৃপক্ষ গ্রামাঞ্চলে নিজ নিজ কলেছেড়া শাখা স্থাপনে তৎপর হল। এই সুযোগে বিষ্ণুপুরে পি. কে. এম উচ্চ বিদ্যালয়ের সু বিস্তৃত প্রাঙ্গণে একটি মহাবিদ্যালয় স্থাপনের আন্তরিক প্রচেষ্টা সফলতার দ্বারদেশে উন্নীত হবার মুর্হূর্ত্তে শুধুমাত্র কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তির অসহযোগিতায় পরিকল্পনাট পরিত্যক্ত হয়। মহাবিদ্যালয় স্থাপনে সর্বাধিক সহযোগিতা করে ছিলেন বিদ্যালয়ের সহ-প্রধান শিক্ষক শ্রীবীরেন্দ্র মোহন সেন মহাশয়।

সেবা সমিতি

এই সময়ে তারাপদবাবু, আর্ত্ত মানুষের সেবায় উৎসর্গীকৃত প্রান আদর্শ চরিত্রের কতিপয় যুবককে নিয়ে গড়ে তুললেন “সেবা-সমিতি” রাত্রি জাগরণ করে রোগীর সেবা, মৃতদেহ সৎকার, রাস্তাঘাট সংস্কার,  পুরনো ডোবা-পুষ্করিণীর কচুরী পানা নিষ্কাশন প্রভৃতি ছিল এই সেবা সমিতির চিহ্নিত কার্যক্রম। নিঃস্বার্থ সেবাপরায়ণতায় এই সেবা-সমিতি সহৃদয় মানুষের আশীর্বাদ ধন্য হয়ে উঠেছিল।

দেশত্যাগ

দেশত্যাগ করবার দোলাচল বৃত্তির মধ্যে স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হল কার্টয়াহাট  বি, কে, এ, পি, ইন্‌ষ্টিটিউশনের স্বনামধন সম্পাদক শ্রীকিশোর মোহন দাস মহাশয়ের আহ্বান। সে আহ্বান তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি। তাই একদিকে প্রতিষ্ঠা ও পরিচয়ের -অতি নিবিড় আকর্ষণীয় সান্নিধ্যে নিস্তরঙ্গ জীবন পরিহার করে নতুন পরিবেশের অপরিচয়তা এবং আশান্বিত প্রতিকূলতার বন্ধুর পথ পরিক্রমাই বেছে নিলেন। ১৯৫১ সালের ২১শে জানুয়ারী বামা, কাটয়াহাট বি, কে, এ, পি, ইনষ্টিটিউশনে যোগ দিলেন তিনি।  তারাপদবাবুর প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদানের পর বিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষার ফলাফল দেশবাসীর সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে বিদ্যালয়ের জয়যাত্রা অব্যাহত রইল তাঁর বিদ্যালয় জীবনের শেষ দিন ১৯৭৯ সালের ৩১শে মার্চ পর্যন্ত।

অন্যান্য সেবামূলক কার্য

এপারে (পশ্চিমবঙ্গ : ভারতবর্ষ') প্রবীণ শিক্ষকের দায়িত্ব স্কন্ধে নিয়েও তিনি সায়েস্তানগর ইউনিয়ন বোর্ডের Administrator ( প্রশাসক) থাকা কালে পাঁচ বছরের মধ্যে ইছামতীর উত্তর পারে Test Relief এর মাধ্যমে প্রথম এক মাইল দীর্ঘ পাকা রাস্তা নির্মাণ, এলাকার অনেক রাস্তাঘাট সংস্কার, একাধিক প্রাইমারী স্কুলের গৃহ নির্মাণ তাঁর স্মরণীয় অবদানের মধ্যে পড়ে। কার্টয়াহাট  Post Office-কে Sub-Office- এ রূপান্তরিত করা, কার্টয়াহাটে একটি বালিকা বিদ্যালয় ( Girls School) স্থাপন করা এবং এলাকায় বৈদ্যুতিকরণ এবং কার্টয়াহাটে সাধারণ পাঠাগার প্রতিষ্ঠার কাজ ত্বরান্বিত করবার প্রচেষ্টায় তিনি ছিলেন অগ্রণী।

আন্তর্জাতিক ধর্ম মহাসম্মেলনে যোগদান

১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বর মাস। পশ্চিম জার্মানীর মারবর্গ শহরে International History of Religious Conferences এ যোগদানের জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন সাধু শ্রীমন্মহাপ্রভুর বাণীর অদ্বিতীয় প্রবক্তা পরম ভাগবত গৌড়ীয় ত্রিদণ্ডিস্বামী শ্রীমদ্ভক্তি হৃদয় বন গোস্বামী মহারাজের আহ্বানে তিনি সাড়া দিয়ে প্রতিনিধি মণ্ডলীতে স্থান করে নিলেন। পশ্চিম ইউরোপের জার্মানী ছাড়া ইতালী, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, নরওয়ে, সুইডেন এবং লণ্ডন পরিভ্রমণ করবার সুযোগ লাভ করেন। সর্বত্র শ্রীল মহারাজ (তদানীন্তন শ্রীপাদ তমাল কৃষ্ণ ব্রহ্মচারী) বিশেষ বিশেষ প্রতিষ্ঠানে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রীমন্মহাপ্রভুর প্রেমধর্মের বাণী সাফল্যের সঙ্গে প্রচার করেন ।

ভারত-তীর্থ পরিক্রমা

১৯৪৩ সাল। জীবনের অনেক বৎসরের মধ্যে একটি সাচিহ্নিত বৎসর। এই বৎসরেই তিনি শ্রীল ভক্তিহৃদয় বন গোস্বামী মহারাজের নিকট তদীয় শ্রীধাম বৃন্দাবনস্থ ভজন কুটীরে গৌড়ীয় পাঞ্চরাত্রিক দীক্ষা গ্রহণ করেন। দীক্ষান্তে তাঁর নাম হয় শ্রীপাদ তমাল কৃষ্ণ ব্রহ্মচারী। দীক্ষা গ্রহণের অব্যবহিত পরে তদীয় শ্রীগুরু পাদপদ্মের সঙ্গে তিনি দক্ষিণ-পশ্চিম উত্তর ভারতের যাবতীয় তীর্থ পরিক্রমা করবার সৌভাগ্য লাভ করেন।

শিক্ষকতা কার্যে অবসর গ্রহণ

Matriculation Certificate অনুযায়ী তাঁর Service. Period যেখানে শেষ হবার কথা তিনি তাঁর ২ বৎসর পূর্বে´ ১৯৭৯ সালের ৩১শে মার্চ অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর যুক্তি Certificate-এ বয়স কম করে দেখান আছে। সত্যের পুজারী সত্যের অপলাপ করে আথের গুছাতে রাজী হন নি। এমন কি পরিচালক সংস্থার সদস্যদের সম্মিলিত আবেদনেও তিনি তাঁর অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত হতে বিচ্যুত হন নি।

সন্ন্যাস গ্রহণ ও প্রচার

শ্রীল মহারাজ আনুষ্ঠানিকভাবে বিদ্যালয় ত্যাগের পরদিনই নিজ গুরুপাদপদ্মের অভিলাশনুযায়ী   গৃহত্যাগ করেন এবং কলকাতা শীলপাড়াস্থিত ভজন আশ্রমে গরু-সন্নিধানে উপস্থিত হন। পরদিবস ১৯৭৯ সালের ১০ই এপ্রিল তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করে ত্রিদণ্ডিস্বামী শ্রীল রসিকানন্দ বন মহারাজ নামে পরিচিত হন। ঐ বছরে তিনি তদীয় শ্রীগুরুদেব শ্রীমদ্ভক্তিহৃদয় বন মহারাজের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতে হায়দ্রাবাদ শহরে চারদিনের অধিবেশনে যোগ দেন। তথায় ‘অচিন্ত্য ভেদাভেদতত্ত্ব এবং কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ম্' এই বিষয়ের উপর ভাষণ দান করেন ।

অতঃপর কভুর গৌড়ীয় মঠের অধিবেশনে ভাষণ দান করে তিরুপতি হয়ে মাদ্রাজ গৌড়ীয় মঠে পৌঁছান। শ্রীল ভক্তি হৃদয় বনমহারাজের সঙ্গে শ্রীল মোহনানন্দ বন মহারাজ ও গোপেশ ব্রহ্মচারী বর্তমানে শ্রীল গোপানন্দ বন মহারাজ এবং শ্রীচৈতন্য মঠের অনেক সেবকগণও ছিলেন। মাদ্রাজ গৌড়ীয় মঠে পৌঁছবার পর শ্রীল বন মহারাজের Heart Attack হয়। সেই সময় শ্রীল রসিকানন্দ বন মহারাজ তদীয় গুরুপাদপদ্মের সেবার দায়িত্ব নিয়ে কিছুদিনের মধ্যে সুস্থ করে তোলেন।

দক্ষিণ ভারত থেকে কলকাতা প্রত্যাবর্তন করে শ্রীল ভক্তিহৃদয় বন মহারাজ তদীয় একনিষ্ঠ সেবক শ্রীল প্রাণতোষ প্রভুর গৃহে উপস্থিত হন। শ্রীল রসিকানন্দ বন মহারাজ ঐ সময় কলকাতাস্থ ভজন আশ্রমে আগমন পূবক আশ্রমের দায়িত্ব নিয়ে পরিচালনা করতে থাকেন। ভজন আশ্রমে থেকে প্রতিদিন প্রাণতোষ প্রভুর গৃহে তদীয় শ্রীগুরুদেবের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। শ্রীপাদ প্রাণতোষ প্রভু কলকাতা ভজন আশ্রম গ্রহণ করার অনুরোধ জানালে শ্রীল বন মহারাজ রোষচিত্তে বলেছিলেন—“আমি বিষয়ী নই, আমি সন্ন্যাসী। ওখানে কেউ থাকবে না, ঐ বিষয় ফিরিয়ে দাও। বিষয় সংগ্রহ করার রুচি আমার নাই।” এই কথা শুনে প্রাণতোষ প্রভু ভয়ে তিন দিবস স্বীয় শ্রীগুরুদেবের কাছে যান নাই। সেই সময় শ্রীল রসিকানন্দ মহারাজ গুরুদেবের পায়ে ধরে অনুরোধ করলে তিনি ভজন আশ্রয় গ্রহণে স্বীকার করেন। অনস্তর গোপেশ প্রভুকে সন্ন্যাস দিয়েআশ্রমের অধ্যক্ষপদ দান করেন ।

শ্রীল ভক্তিহৃদয় বন মহারাজের অপ্রকটের পূর্বে তাঁর বৃন্দাবনস্থ ভজন কুটীরে শ্রীল কৃষ্ণানন্দ বন মহারাজ, শ্রীল মোহনানন্দ বন মহারাজ, শ্রীল গোপানন্দ বন মহারাজ, শ্রীল রসিকানন্দ বন মহারাজ, শ্রীপাদ ব্রজবাসী প্রভু এবং শ্রীযুক্ত বিভূতি ভূষণ দে মহাশয় সকলকে তদীয় শয়নকক্ষে একান্তে ডেকে শ্রীল রসিকানন্দ মহারাজকে লক্ষ্য করে আশীর্বাদ করেন,—“আমি সারাজীবন তোমাকে বহু, পরীক্ষা করেছি এবং কঠোর বাক্য বলেছি। সেইসব কঠোর শাসন ও বাক্যাবলি তুমি অতি ধৈর্যের সহিত সহ্য করেছ। তোমার এই ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার জন্য আমি তোমার প্রতি প্রসন্ন হয়েছি। কঠোর পরীক্ষায় তুমি অন্যত্র চলে যেতে পারতে, কিন্তু তুমি চলে না গিয়ে শ্রীগুরুতে যে অচলা ভক্তির পরিচয় দিয়েছ, তজ্জন্য আমি পরম প্রসম হয়েছি। আমি তোমাকে আশীর্বাদ  প্রদান করি, মদীয় ভজন কুটীরের সেবায় অগ্রনী হয়ে শ্রীশ্রীরাধাগোবিন্দের সেবায় নিরত থাকুন। শ্রীল কৃষ্ণানন্দ মহারাজ ও গোপানন্দ মহারাজ আমাকে আজীবন সেবা করেছে, এঁদের সম্মান করে চলবেন।

আচার্যপদে অভিষেক

১৯৮২ সালে শ্রীল রসিকানন্দ বন মহারাজের শ্রীগুরুপাদপদ্ম ত্রিদণ্ডিস্বামী শ্রীমদ্ভক্তি হৃদয় বন দেব-গোস্বামী মহারাজের অপ্রকটের পর তিনি শ্রীধাম বৃন্দাবনস্থ ভজন কুটীর, কলিকাতার ভজন আশ্রম এবং হিঙ্গলগঞ্জের চৈতন্য আশ্রম-এর আচার্য পদে অভিষিক্ত হন এবং তদীয় গুর পাদপদ্মের শেষ ইচ্ছানুসারে ( will ) একই সঙ্গে তিনি শ্রীশ্রীরাধাগোবিন্দজী ট্রাষ্টের সভাপতিও হন। মঠের সর্বময় কর্তা হবার পর গুরুদেবের অভিলষিত কর্মসূচী সম্পাদনের দায়িত্ব নিজ স্কন্ধে তুলে নিলেন। ইতঃপূর্বে শ্রীধাম বৃন্দাবনে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের ভক্তবৃন্দের জন্য নির্মিত হয়েছে ভক্তি নিকেতন (Guest House)।

মূলতঃ স্বচ্ছল ও অভিজাত শ্রেণীর ভক্তদের জন্য এই Guest House। কিন্তু বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার সাধারণ ভক্তজনের জন্য শ্রীধাম বৃন্দাবনে থাকা এবং প্রসাদ পাওয়ার কোন সব্যবস্থা তখন পর্যন্ত ছিল না। তদীয় গুরুপাদ পদ্মের একান্ত অভিলাষ ছিল—“এই সব মুঢ় ম্লান মুক”দের জন্য একটী যাত্রী নিবাস নির্মাণ করা। তাঁর প্রকটকালেই তিনি এ অভিলাষ প্রকাশ করেন। আচার্যপদে অভিষিক্ত হয়ে শ্রীল রসিকানন্দ বন মহারাজ তদীয় গুরুদেবের অভিপ্রেত কার্যটী সম্পাদনের জন্য তৎপর হন। এই সঙ্গে শ্রীধামে একটী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনেও তাঁর প্রচেষ্টাকে রূপায়িত করবার প্রয়াসে তিনি যত্নবান হন।

গুরুদেবের এই দুইটি  অভিলষিত কার্যের জন্য তিনি নতুন করে বস্তুতঃ তদীয় জীবনকে উৎসর্গ করলেন। যাত্রী নিবাসের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পাসপোর্ট করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও প্রবেশ করেন এবং বহু  কৃচ্ছসাধন করে পর্যাপ্ত অর্থে'র অনেকখানি সংগ্রহ করেন।  শ্রীল মহারাজ পশ্চিম বাংলার হিঙ্গলগঞ্জ ও দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন গ্রাম, বসিরহাট শহর এবং উত্তর বসিরহাট অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা এবং বনগাঁ মহকুমার বিভিন্ন গ্রাম হতে অর্থ সংগ্রহ করেন। কোথাও পদব্রজে, কোথাও নৌকাযোগে, কোথাও ট্রেন, কোথাও রিক্সা বা ভ্যান যোগে তিনি যাতায়াত করেছেন। কিন্তু যাত্রাপথের মুখ্য অংশ পদব্রজেই গমন করতে হত তাঁকে। এই পরিভ্রমণে কোন রিজার্ভ গাড়ীও করা সম্ভব হয়নি। আশী বয়স, তবও মঠের জন্য সংগৃহীত অর্থে'র একটি কপর্দকও তিনি নিজের স্বচ্ছন্দ্যের জন্য ব্যয় করতেন না।

অবশেষে “যাত্রী নিবাস” নির্মিত হল । তিনতলা বাড়ী। নীচের তলায় পাঁচখানি ঘর এবং একটী হল ঘর । দোতলায় নয়খানি ঘর। তিনতলায় দু ’খানা ঘর। মোজাইক করা, attached bath room | প্রতিটী কক্ষই স্বয়ং সম্পূর্ণ। এই যাত্রীনিবাস ভক্তিনিকেতন নামে চিহ্নিত ৷ হৃদয় বন দেব-গোম্বামী মহারাজের অকৃত্রিম স্নেহনিলয় সব্যসাচী সাধক ত্রিদণ্ডিস্বামী শ্রীল রসিকানন্দ বন গোম্বামী মহারাজ।

শ্রীল মহারাজের চারিত্রিক গুণাবলী

জীবন শুরুর প্রথম পাঠ দেশ-প্রাণতার এবং লোক হিতৈষিতার। তদীয় শিক্ষাগুরু, দক্ষিণ শ্রীপুর  উচ্চবিদ্যালয়ের শ্রুতকীর্তি' প্রধান শিক্ষক শ্রীনির্মল কুমার বসু , মহাশয়-এর মুখে নতুন করে “উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত” শ্রবণ করে মানব কল্যাণের মহামন্ত্রে উজ্জীবিত হলেন। পরবর্তীকালে জীবনভর শুধু মানুষের কল্যাণ সাধনই করে গেছেন। সব্যসাচী সাধকের ন্যায় একদিকে মানুষের ব্যবহারিক কল্যাণ সাধন, অন্যদিকে ভক্ত-অনুগত জনের পারমার্থিক কল্যাণ সাধনই ছিল তাঁর চিন্তা ও চেতনার নৈরন্তর্য ।

কাটিয়াহাটে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, পাকারাস্তা নির্মাণ, পাঠাগার স্থাপন, Electricity আনবার ব্যবস্থা ও উপায় নির্ধারণ, শ্রীধাম বৃন্দাবনে ভক্তিসদন (Guest House), ভক্তি নিকেতন (যাত্রী নিবাস ) কাটিয়া হাটে শ্রীশ্রীব্রজবাসর সংস্থাপন, হিঙ্গলগঞ্জে চৈতন্য আশ্রম প্রতিষ্ঠায় এবং পিয়াড়ায় দোলোৎসবের প্রবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণের মধ্যে তাঁর নৈপন্যের এবং সাংগঠনিক কর্মদক্ষতার স্বাক্ষর নিহিত। বস্তুতঃ তিনি ছিলেন উৎসর্গীকৃত মহাপ্রাণের অধিকারী। অমেয় মানবপ্রীতি তাঁর অনিন্দ দেহকান্তির ন্যায় ছিল সতোৎসারিত শ্রীল মহারাজ শ্রীধাম বৃন্দাবন যাত্রার টিকিট Cancel করে বাদুড়িয়ার শ্রীপাদ কৃষ্ণ কুমার প্রভুর সমুৎসুকা ভক্তপ্রাণা পত্নীকে দীক্ষা দান করেন।

তদীয় গরু পাদপদ্মের অভিলষিত বৈষ্ণব পারমার্থিক বিশ্ববিদ্যালয় ( Vaishnab theological University ) কে Deemed University-তে রূপান্তরিত করণের সামূহিক প্রচেষ্টা ভক্ত ও শ্রদ্ধানুজেনের নিকট হতে সংগৃহীত অর্থনুকূল্যে ভক্তিসদন ও ভক্তিনিকেতনের প্রতিষ্ঠা তাঁর গুরুদেবের অভীপ্সিত অঙ্গীকারেরই বাস্তবায়ন ৷ জগতের মহাপ্রাণ মহামানবদের মতই সাধারণ মানুষের মঙ্গল তাঁর চিত্তদেশ অধিকার করে থাকত। তিনি অসীম ধৈর্য' ও অপরিমেয় তিতিক্ষার সাথে সর্বংসহা ধরিত্রীর ন্যায় সব সহ্য করতেন। সব বুঝেও তিনি নিশ্চুপ থাকতেন। সহানভূতিশীল কোন অনুগত জন উৎক্ষিপ্ত হলে তাঁকে হরিনাম করবার নির্দেশ দিতেন আর প্রসন্নতার আলোকচ্ছটায় সমস্ত রকম অন্ধভাবনা এব বিকৃতকৃত্যের তিরস্করণী ছিন্ন ভিন্ন করে দিতেন।

শ্রীল মহারাজ অসাধারণ দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। মঠের দু’জন আশ্রামকের অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি জনৈক তরুণী বিধবা রমণীকে দীক্ষা দিতে বা মঠের কার্যাদিতে নিয়োগে ও রাজী হন নি। মঠের শৃঙ্খলা, বিশুদ্ধতা এবং সর্বোপরি আদর্শ অক্ষুর্ন রাখবার প্রয়াসে তাঁর এই কঠোরতা ও অনমনীয়তা মুষ্টিমেয় কিছু আশ্রমিকের উষ্মা এবং অসন্তোষের কারণ হলেও ভবিষ্যৎ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছে যে, তিনি কতদূর দূরদর্শী এবং নিয়ম শৃঙ্খলার নিয়ামক ছিলেন।

তদীয় গরু পাদপদ্ম যেমন বহির্বিশ্বে গৌরবাণীর অসপত্ন প্রচারক থাকা সত্বেও বাংলার সাধারণ, নিম্নবিত্ত মানুষের কথা বিন্দুমাত্র ভুলতে পারতেন না, শ্রীল মহারাজও তেমনি সারাজীবন বাংলার সাধারণ মানুষের মধ্যেই প্রচার করে গেছেন গৌরকৃষ্ণের ভুবন মঙ্গলকর বাণী। এমন মানব বিগ্রহের অপ্রকট হবার স্থান হিসাবে তিনি তাঁর প্রিয়জন অধ্যুষিত এলাকা বাংলাদেশের কেন্দ্রভূমি কলকাতার আশ্রমকেই নির্দিষ্ট করেছিলেন কেন? নইলে শ্রীধামের টিকিট Cancel করবার নির্দেশ তিনি দিতেন না। হয়ত ঈশ্বরীয় বিধানের এও এক অমোঘ রূপায়ণ । জ্ঞান ও বৈরাগ্যের মুর্ত্ত  বিগ্রহ, ত্যাগ ও কৃচ্ছতার জাজ্জল্যমান প্রকাশ, স্নেহ ও মমতার অনিঃশেষ উৎস ছিলেন সর্ববিধ কল্যাণের প্রতিমূর্তি শ্রীল মহারাজ।

শ্রীল মহারাজের উপদেশ ও বাণী

১। বিশ্বকে বাদ দিয়ে বিশ্বনাথের আরাধনা অসফল।

২। দেহধারী ভাগবত ও গ্রন্থ ভাগবত—দয়েরই সাহচর্য সাধনানুকূল।

৩। তিনি শিষ্যদের বলতেন—'আমার গরুভাইদের শাসন করবার জন্য আমার গুরুদেব আছেন, আর তোমাদের শাসন করবার জন্য আমিই আছি।'

৪। সংসারী লোকেরা তাদের স্ত্রী, পুত্র ও পরিবারের সুখের জন্য সারাদিন পরিশ্রম করতে পারে, আর আমি আমার শ্রীগুরুদেবের সেবার জন্য ভিক্ষা করতে পারব না কেন?

 

৫। শ্রীল ভক্তিহৃদয় বন মহারাজ চৈত্রের শুক্লাপঞ্চমী তিথিতে হিঙ্গলগঞ্জ শ্রীচৈতন্য আশ্রমে আগমন করেন, তাই অম্মদীয় শ্রীগুরু অসুস্থ অবস্থাতেও হিঙ্গলগঞ্জে গিয়েছিলেন।

৬। বুঝলে মানুষ মুখ বুজে যায়, আর কথা কয় না। যে পর্যন্ত লোক না বুঝে, সে পর্যন্ত অপরকে বুঝায়।

৭। ভবব্যাধির ঔষধ শ্রীহরিনাম, অনুপান- পরনিন্দা পরচর্চা বর্জন।

৮। সকল কার্যই সত্ত্ব, রজো ও তমোগুণের ক্রিয়া, সকলই যখন গুণ তখন কারও দোষ ধরবে কেমন করে?

৯। যিনি আমাকে শ্রদ্ধা করেন তিনি আমার ছোট ভাই, আর যিনি আমাকে নিন্দা করেন তিনি আমার বড় ভাই, কেন না, তিনি আমাকে শাসন করে শোধন করেন।

 

১০। আমার সকল কামনা পূর্ণ করেন না বলে তাঁকে আমি ভগবান বলি । সকল কামনা পূর্ণ হয়ে গেলে আমি অসুর হয়ে যেতাম।

১১। লোভী গুরু ও পাথরের নৌকা দুই-ই অতল তলে ডুবে যায়। পিতা সন্তানকে ভরণপোষণ করেন কিছু পাওয়ার প্রত্যাশায়। কিন্তু প্রকৃত গুরু, সতত শিষ্যের মঙ্গল চিন্তা করেন, কিছু, প্রত্যাশা করেন না।

১২। আত্মশোধন হয় নিন্দা ও প্রশংসায়। পাহাড়ের উপরে উঠতে গাড়ীর সামনে ও পিছনে দু’টা ইঞ্জিন থাকে, একটা টানে আর একটা ঠেলে। তদ্রূপ প্রশংসা সামনে টানে আর নিন্দা পিছনে ঠেলে।

১৩। জীবের মন গলে তাপে, তাপ হয় দুঃখে । অতএব দঃখই জীবের সুখের কারণ। মন না গললে হৃদয় কোমল হয় না। কোমল হৃদয় না হলে ভগবানের আসন হয় না।

১৪। সিদ্ধ মানে গলে যাওয়া। যেমন চাউল সিদ্ধ - ভাত। সেইরূপ সিদ্ধপুরুষ সকলের নিকটেই গলে যায় এবং সকলের চিত্তকে গলিয়ে দেয়।

১৫। এই কলিকালে তিনজন প্রবঞ্চক, যথা— (১) স্বয়ং বিষয়ী হয়ে যিনি জ্ঞানের কথা বলেন, (২) নেশা করে যিনি ধ্যান করেন, (৩) বৈরাগী হয়ে যিনি কামিনী-কাঞ্চনে প্রমত্ত থাকেন।

১৬। 'আমি বুঝি' এই বোঝা সকলের মাথায় চেপে আছে। মহতের চরণে দণ্ডবৎ করে যে ব্যক্তি বোঝা নীচে ফেলতে পারে তাকে দিয়ে মহৎ কার্য— সাধিত হয়।

১৭। মানুষ অষ্টপাশে বাঁধা। অভিমানে স্ফীত হলে বাঁধন আরও শক্ত হয়। তৃণাপেক্ষা সবু হলে বাঁধন ঢিলে হয়ে যায়, তখন সহজে বেরিয়ে আসে।

১৮। শাস্ত্র শাসন করে। শাসন দুষ্টের জন্য। স্বভাবে থাকলে আর শাস্ত্রের দরকার হয় না।

১৯। 'আমি তোমার'—এটি দাসভাব; তখন আমি পাল্য আর ভগবান্ পালক। তুমি আমার'—এটা প্রেম ; তখন ভগবান্ পাল্য ও আমি পালক ।

২০। জীবে জীবে মিলন সৌভাগ্যের কথা, আর ভক্তের সহিত মিলন পরম সৌভাগ্যের কথা।