🏵️🌺🌷🌺🏵️

💐সদগুরু💐

🏵️🌺🌷🌺🏵️

খুবই গুরুত্ত্বপূর্ণ পোষ্ট

শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ

সকল সাধু, গুরু, বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম I

‘’গুরু - বৈষ্ণব  - ভগবান তিনিহেঁ স্মরণ ।

তিনেহেঁ স্মরণ হইতে হয় বিঘ্ন বিনাশন ।।

অনায়াসে হয় নিজ বাঞ্ছিত পূরণ  I I

 

আজানুলম্বিত - ভুজৌ কনকাবদাতৌ,

সংকীর্ত্তনৈকপিতরৌ কমলায়তাক্ষৌ।

বিশ্বম্ভরৌ দ্বিজবরৌ যুগধর্ম্মপালৌ,

বন্দে জগৎপ্রিয়করৌ করুণাবতারৌ।

 

সদগুরু বিচার || শ্রীল রঘুনাথ দাস, গৌরসিংহদাস, গোবিন্দদাস বাবাজীদের মধ্যে কথোপকথন 

রঘুনাথদাসজীঃ মহাপ্রভু বলিলেন,-

ব্রজের এই ভাব তুমি লইতে নারিবা।

দূরে রহি নতি স্তুতি প্রণতি জানাইবা।।

এখন সকলেই গোপীসাজিতে চাহে ও গোপীভাব লইতে চায়।

 

গৌরসিংহদাসঃ অপরাধ মার্জনীয়! আজ-কাল তথাকথিত ভেকধারী কিছু বাবাজীগণ দেশে-দেশে ঘুরে মৎস্য-মাংসভোজীদের মন্ত্র-দীক্ষা প্রদান করছেন।  এতে যদি তাদের মানব জীবন সার্থক হয় এবং ভজনে অগ্রসর হওয়ার অধিকার পায় এতে সমস্যা কোথায় ?

 

গৌরসিংহদাসঃ- শাস্ত্রের সিদ্ধান্তই হচ্ছে এই যে, জীব হত্যা করে মৎস্য-মাংস ভোজন করা মহাপাপ। মনুস্মৃতিতে ( ৫/১৫ ) বলা হয়েছে,-

যো যস্য মাংসমশ্নাতি স তন্মাংসদ উচ্যতে।

মৎস্যাদঃ সর্বমাংসাদঃ তস্মান্ মৎস্যান্ বিবর্জয়েৎ।।

"যে যাহার মাংস ভক্ষণ করে, সে ব্যক্তি তন্মাংসখাদক বলিয়া কথিত হয়; কিন্তু মৎস্যভোজী সৰ্ব্বমাংস ভোজী ( যেহেতু মৎস্য গরু-শূকরাদি যাবতীয় প্রাণীর মাংসই ভোজন করে ), সুতরাং এক মৎস্য-ভোজনে সকল মাংসই ভোজন করা হয়। অতএব মৎস্য- ভোজন সর্ব্বতোভাবে পরিত্যাজ্য।"

 

মনুস্মৃতিতে ( ৫/৫১ ) আরও বলা হয়েছে,-

অনুমন্তা বিশসিতা নিহন্তা ক্রয়বিক্রয়ী ।

সংস্কৰ্ত্তা চোপহৰ্ত্তা চ খাদকশ্চেতি ঘাতকাঃ ।।

"যাহার অনুমতিতে পশু হত্যা করা হয়, যে অস্ত্র দ্বারা পশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খণ্ড খণ্ড করে, যে পশু বধ করে, যে মাংসের ক্রয়-বিক্রয় করে, যে মাংস পাক করে, যে মাংস পরিবেশন করে এবং যে মাংস ভক্ষণ করে, ইহাদিগকে ঘাতক বলা হয়।"

মনুস্মৃতিতে ( ৫/৫৫ ) আরও বলা হয়েছে,-

মাংস ভক্ষয়িতামুত্র যস্য মাংসামিহাদ্ম্যহম্ ।

এতন্মাংসস্য মাংসত্বং প্রবদন্তি মনীষিণঃ ।।

"ইহলোকে আমি যার মাংস ভোজন করিতেছি, পরলোকে সে আমাকে ভক্ষণ করিবে। পণ্ডিতেরা "মাংস" শব্দের অর্থ ( 'মাং' আমায়, 'সঃ' সে ভোজন করিবে ) এইরূপ প্রতিপন্ন করিয়াছেন।"

 

শ্রীহরিভক্তিবিলাসে (২/৭) বলা হয়েছে,-

স্নেহাদ্বা লোভতো বাপি যো গৃহ্নীয়াদ্ দীক্ষয়া ।

তস্মিন্ গুরৌ সশিষ্যে তদ্দেবতাশাপ আপতেৎ ।।

"দীক্ষাবিধি ব্যতীত যে গুরু স্নেহ বা লোভবশতঃ শিষ্য গ্রহণ করেন, শিষ্যের সহিত সেই গুরুদেবের উপর দেবতা সকলের বা মন্ত্রের অধিষ্ঠাতৃদেবের অভিশাপ প্রাপ্ত হন।"

মহাভারতে (উদ্যেগপর্ব,১৭৯/২৫ )বলা হয়েছে,-

গুরোরপ্যবলিপ্তস্য কার্যাকার্যমজানতঃ ।

উৎপথপ্রতিপন্নস্য পরিত্যাগাে বিধীয়তে I I

"জড় জাগতিক ভোগ্য বিষয়ে লিপ্ত, কর্তব্য-অকর্তব্য বিবেকরহিত, মূঢ় এবং শুদ্ধভক্তি ব্যতীত ইতর পন্থানুগামী ব্যক্তি নামে মাত্র গুরু, তাঁকে অবশ্যই পরিত্যাগ করাই বিধি।"

 

শ্রীসনাতন গোস্বামী প্রভু শ্রীহরিদাস ঠাকুরকে বলেছেন,-

আপনে আচরে কেহ, না করে প্রচার ।

প্রচার করেন কেহ, না করেন আচার ।।

'আচার', 'প্রচার' - নামের করহ 'দুই' কার্য্য ।

তুমি - সর্ব্ব-গুরু, তুমি - জগতের আর্য্য ।।     (চৈঃ চ অন্ত্যলীলা, ৪/১০২-১০৩ )

শ্রীমদ্ভাগবতে ( ১১/৩/২১ ) বলা হয়েছে,-

তস্মাদ্ গুরুং প্রপদ্যেত জিজ্ঞাসুঃ শ্রেয় উত্তমম্ ।

শাব্দে পরে চ নিষ্ণাতং ব্ৰহ্মণুপশমাশ্রয়ম্ ।।

অর্থাৎ,- "নিজের সদ্গতি বা পরম মঙ্গল কি, সেই সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী হয়ে সদ্গুরুর চরণাশ্রয় করতে হয়। সদ্গুরু হচ্ছেন তিনি, যিনি শব্দব্রহ্মে অর্থাৎ বেদশাস্ত্ৰসিদ্ধান্তে সুনিপুণ, পরব্রহ্মে নিষ্ণাত অর্থাৎ, যিনি ভগবদ্ অনুভূতি লাভ করেছেন। যিনি জাগতিক কোনও ক্ষোভের বশীভূত নন, তিনিই সদ্গুরু।"

 

কলিযুগে নাস্তিক সভ্যতার দুর্বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের উৎপাতমূলক কার্য্যকলাপের ফলে সাধারণ জনমানসে ধাম, তীর্থের মাহাত্ম্যই ধরা পড়ে না। বর্তমানে মানুষ নানা দেবদেবীর মূর্তি বানিয়ে পূজা করছে, নেশা করছে, নাচছে, মদ পান করছে। বহু জীবজন্তু বধ করছে। মাছ-মাংস খেয়ে ফূর্তি করছে। আবার দেখা যায়, অনেকে ভগবদ্বিগ্রহ রেখেছে। শ্রীগৌরাঙ্গ, রাধা-কৃষ্ণ, লক্ষ্মী-নারায়ণ কিংবা শালগ্রামের অর্চনা করছে, অথচ তারা মাছ-মাংস ভক্ষণ ইত্যাদি ভগবদ্বিরোধী আচরণে তৎপর হয়ে তাদের রক্ষিত ও অর্চিত ভগবদ্-মূর্তির প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করছে। সেক্ষেত্রে শ্রীবিগ্রহ পরমার্থপ্রদ হন না। বরং অনর্থই ভোগ করতে হয়। তাই, মৎস্য-মাংস ভোজীদের দ্বারা ভগবানের বিগ্রহ-পূজা একেবারেই নিষিদ্ধ। শাস্ত্রে নির্দেশিত,-

সেই মূর্তি করি যেবা ভজে নারায়ণ ।

জীবহিংসা করে যদি, নাহি প্রয়োজন ।।   ( শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিণী, ৭/৫/৩২ )

 

 

গোবিন্দদাসঃ- সবই ঠিক আছে, তবে তারা কি কৃপা থেকে বঞ্চিত হবে? যারা আমিষ আহার করে তারা তো অজ্ঞানী, তাই বলে কি তারা ভগবানের চরণ সেবার অধিকারী হবে না? তবে তারা কি ভগবানের কৃপা থেকে বঞ্চিত হবেন ? জগাই-মাধাই কি প্রসাদ ভোজী ছিল? নিতাইচাঁদ কেন তাদের কৃপা করলেন? চাপাল-গোপাল প্রসাদ ভোজী ছিল? তারা প্রসাদ ভোজী ছিল না।বৈষ্ণবদের গুণ এটাই তারা পতিতদের উদ্ধার করবেন। "ব্রহ্মাণ্ড তাড়িতে শক্তি ধরে জনে জনে।" পতিত বলে তাদের কৃপা করে দীক্ষা দেওয়া কি দোষের কিছু ? বাবাজীরা হয়তো সেই ক্ষমতা রাখেন যে, আমিষ ভোজীদের হৃদয়ে ভক্তিবীজ বপন করা। হে আপনি বলতে পারেন কয়জন আমিষভোজী ব্যক্তি এভাবে ভক্ত হয়ে গেছে! একটা দৃষ্টান্ত দিচ্ছি, একটা শিক্ষক ভাল ছাত্র, খারাপ ছাত্র উভয়কেই শিক্ষা প্রদান করে। যে খারাপ ছাত্র সে পরীক্ষায় ফেল করে। এখানে দোষটা কি শিক্ষকের? দোষ তো ছাত্রের।শিক্ষকের কর্তব্য সকলকে শিক্ষা দান করা ভাল হোক বা খারাপ। যার যার কর্মফল তাকে ভোগ করতে হবে।

 

তদ্রূপ, কোনো গুরুদেব বা বাবাজী যদি ঐ খারাপ ছাত্রের মতো তাকে ভজনের পথে অগ্রসর করার চেষ্টা করে আর সে যদি না অনুসরণ করে এতে কি গুরুদেবের কোনো দোষ আছে? এতে তো আমরা বলতে পারি না তিনি অবৈধ কাজ করছে...!! আর আমাদের এটাও উচিত নয় বৈষ্ণবের দোষ দেখা। কোনো শুদ্ধ ভক্ত তো অন্য ভক্তকে নিন্দা কখনোই করতে পারে না। তাই আমার মনে হয় যার যার ভাবে থেকে ভজন করাটাই মুখ্য বিষয়। আপনি অনেক কিছু সম্পর্কে অবগত আছেন। সেই তুলনায় আমি অতি তুচ্ছ। ভুলভ্রান্তি হলে মনে করি নিশ্চয় বুঝিয়ে দেবেন। আর অপরাধ করে থাকলে মার্জনা করবেন।

 

গৌরসিংহদাসঃ- ধন্যবাদ, আপনাকে সত্য স্বীকার করার জন্য। অবশ্যই তারাও কৃপা লাভ করবেন, কিন্তু তাদেরকে শ্রীগুরুগৌরাঙ্গের আদেশ-উপদেশ শ্রদ্ধা সহিত পালন করতে হবে। তা-না হইলে স্মৃতিশাস্ত্র শিরোমণি শ্রীহরিভক্তিবিলাসে ( ১/৬৮ ) বর্ণিত আছে,- "পাপ ও কুৎসিত কার্য্য হইতে যাহাদিগকে উপদেশ প্রমাণাদি দিয়াও ভাল করা যায় না, যে ব্যক্তি গুরুদেবের কঠোর উপদেশ পালনও সহ্য করিতে সম্পূর্ণ অক্ষম, সেইরূপ মনুষ্যদিগকে কখনো শিষ্যরূপে গ্রহণ করিবে না।" শ্রীহরিভক্তিবিলাসে ( ১/৬৯-৭০ ) বর্ণিত আছে,- "লোভের বশবর্তী হইয়া যাঁহারা এই সকল পাপকার্য্যে রত ব্যক্তিবর্গকে দীক্ষিত করিয়া থাকেন, তাহারা ইহলোকে দেবতাদের  অপ্রিয়পাত্র হন। তাহারা দরিদ্র হন, পুত্র-কলত্রাদি বর্জ্জিত হইয়া থাকেন। দেহাবসানের পর তাঁহারা নরকাদি ভোগ করিয়া পরে তির্যক্-যোনি ( পশু-পক্ষী জন্ম ) প্রাপ্ত হইয়া থাকেন।"

 

সদ্গুরু হচ্ছেন ভগবানের প্রতিনিধি পরম কৃষ্ণভক্ত। তিনি কৃষ্ণভক্তি বিরুদ্ধ কথা বলেন না। তিনি কৃষ্ণনাম কৃষ্ণমহিমা কীর্ত্তন  করেন তিনি জগজ্জীবকে উদ্ধারের জন্য কৃষ্ণকথা বিশ্বব্যাপী প্রচার করেন। তিনি কৃষ্ণভক্তি বিরুদ্ধ আচরণ করেন না। তিনি কলির চতুর্বিধ আড্ডায় যুক্ত হন না অর্থাৎ, মাছ মাংস ডিম ইত্যাদি আহার, চা পান বিড়ি সিগারেট তম্বাখু ইত্যাদি সেবন, তাসপাশা জুয়া দাবা খেলা, অবৈধ মেলামেশা করেন না। তিনি মহাপ্রভু অনুমোদিত চার সম্প্রদায়ের কোনও একটির অন্তর্ভুক্ত। একজন সদ্গুরু তাঁর পূর্বতন আচার্য্যের অত্যন্ত প্রিয়জন এবং তাই তিনি আচার্য্যের নির্দেশ পালন করে চলেন। আর এভাবেই গুরু-শিষ্য এক বৎসর কাল একত্র বাস করবেন। শ্রীহরিভক্তিবিলাসে ( ১/৭৩-৭৭ ) বর্ণিত আছে,- "অন্ততঃ এক বৎসর গুরু-শিষ্য একত্র বাস করিয়া পরস্পর ব্যবহার ও স্বভাব জানিয়া পরে গুরু-শিষ্য সম্বন্ধ করিবেন।

 

মন্ত্রমুক্তাবলীতে লিখিত হইয়াছে যে এক বর্ষব্যাপী একত্রে কালযাপন করিবার পর পরস্পর পরস্পরের স্বভাব জানিতে ও বুঝিতে পারিলে উভয়েই গুরুত্ব ও শিষ্যত্ব অবগত হইতে পারে। অন্য কোনমতে জানিতে পারা যায় না, ইহাই স্থির সিদ্ধান্ত। পক্ষান্তরে শ্রুতিশাস্ত্রেও বলা হইয়াছে– এক বৎসরকাল একসঙ্গে অবস্থান না করিলে তাহাকে মন্ত্রদান করিতে নাই। আবার সারসংগ্রহ নামক গ্রন্থে বলা হইয়াছে এক বৎসরকাল সদ্গুরু নিজ আশ্রিত শিষ্যকে পরীক্ষা করিবেন। যেমন মন্ত্রীবর্গের দোষসমূহ রাজাতে বর্ত্তিত হয় এবং পত্নীর পাপ নিজ স্বামীতে, সেইরূপ শিষ্যের অর্জ্জিত পাপ গুরু নিশ্চয় পাইয়া থাকেন৷" যারা ভক্তির ভাব দেখায় কিন্তু সর্বদা কুকর্মে ওস্তাদ তাদের ভণ্ড বলে। মুখে হরিনাম করে কিন্তু কলির পাপকর্ম ছাড়ে না। মাছ-মাংস ভক্ষণ, জুয়া-তাসে মন, নেশা-ভাঙে রুচি, অবৈধ যৌনতায় আসক্তি তারা ভণ্ড বলেই বিবেচিত।

 

এভাবে ভক্তিজীবন থেকে পতিত হলেও নিজেকে ভক্তরূপে লোক দেখানোই ভণ্ডামি। মন্দ অভিসন্ধি অন্তরে রেখে ভাল ভাল সহানুভূতিপূর্ণ কথা বা ভাব দেখানোই কপট ব্যক্তির স্বভাব। তারা অনেক সময় কাকুতিপূর্ণ কথা বলে। অনেক সময় তাদের মুখে শোনা  যায়—"আমি ভগবানকে বিশ্বাস করি।" "সাধন-ভজন করা খুবই ভাল।" "আমার ভজন করার প্রয়োজন আছে।" "আমিও পরে সময়মতো ভক্ত হব।" "এই ঘর দুয়ার আর কি দরকা।"এই ধরনের কথাগুলিও কপটতার লক্ষণ। শ্রীমদ্ভাগবতে নির্দিষ্ট কলির আড্ডাগুলির প্রথমটিই হল মাছ-মাংস আহার। এই নরকুলে মৎস্য ভোজীরা কলির দাসত্ব করছে, তারা বিষ্ণু বা শ্রীকৃষ্ণের দাসত্ব করছে না। অতএব কলিবদ্ধ মৎস্যভুকের বৈষ্ণবতা বিচারের আর কি কথা ?

 

যেমন, ধনী লোকের ধন নষ্ট হওয়ার ভয় আছে, কিন্তু নির্ধনের ধন নষ্ট হওয়ার প্রশ্নটাই অবান্তর। আবার এই জগতে অনেক দরিদ্র ব্যক্তি আছে। কিন্তু তাদের সাজ পোশাকে হাবভাবে মনে হয় ধনাঢ্য পরিবারের লাট সাহেবের নাতি। কিন্তু সেটি তাদের আসল রূপ নয়। তেমনই, তুলসী মালা গলায়, তিলক নাকে, শিখাধারী সাজলেই তাকে বৈষ্ণব বলা হবে, এমন নয়। আমাদের জানতে হবে যে, বৈষ্ণবকুলে মাছ-মাংস, চা-জর্দা-পান বিড়ি-সিগারেট, তাস-জুয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যদি কেউ ভুলক্রমে এই সমস্ত আজেবাজে বস্তু গ্রহণ করে থাকেন, তবে অচিরেই তার পক্ষে সেইগুলি সম্পূর্ণরূপে বর্জন করে বৈষ্ণবপাদপদ্মে আশ্রয় গ্রহণ করা উচিত। অন্যথায় বৈদিক শাস্ত্রের বিধান অনুসারে তাকে অবশ্যই নরকগামী হতে হবে। তাছাড়া কেবল বৈরাগী হয়ে গেলে কিছুই পাওয়া যাবে না। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রতি যদি আকর্ষণ না থাকে, তবে সেরূপ বৈরাগীর কোন অর্থ হয় না।

 

শাস্ত্রে বলা হয়েছে,- আনুকূল্যস্য সঙ্কল্পঃ প্রাতিকূল্যস্যবিবর্জ্জনম্। ( চৈঃ চ মধ্যলীলা,২২/৯৭) আনুকূল্যসঙ্কল্প অর্থাৎ, 'কৃষ্ণভক্তির যাহা অনুকূল, তাহাই আমি স্বীকার করিব', এইরূপ সঙ্কল্প; প্রাতিকূল্যস্যবিবর্জ্জন অর্থাৎ, 'কৃষ্ণভক্তির যাহা প্রতিকূল, তাহা আমি অবশ্য বর্জ্জন করিব', এইভাবে ত্যাগ। বৈরাগ্য দুই প্রকার—ফল্গু আর যুক্ত। ফল্গু বলতে লোক দেখানো বৈরাগ্য কিন্তু অন্তরে থাকে ভোগ আকাঙক্ষা। যুক্ত বলতে বাহ্যত যথাযোগ্য ভোগে যুক্ত এবং বিষয় গ্রহণ করেও বিষয়সমূহ শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিযুক্ত করেন। কিন্তু অন্তরে বিষয়ে অনাসক্ত এবং পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণের প্রতি একান্ত আসক্তিযুক্ত। সেই যুক্ত বৈরাগ্য অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়। ত্যাগ ও ভোগে দুইই পরিত্যজ্য। 'বিষয়-মুমুক্ষু' ভোগের বুভুক্ষু দুয়ে ত্যজ মন, দুই 'অবৈষ্ণব' ( বৈষ্ণব কে ? ) বিষয়-আশয় ফেলে দেওয়া কিংবা ভোগ করা—দুই-ই অভক্তির লক্ষণ।

 

 

জগাই-মাধাই, চাপাল-গোপাল হচ্ছেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নিত্যপার্ষদগণ, তাঁরা কোন সাধারণ জীব নন। ভগবৎলীলা পরিকর হিসেবেই এই ধরাধামে অবতীর্ণ। আর শ্রীনিত্যানন্দপ্রভু ও শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু হচ্ছেন সাক্ষাত ভগবৎতত্ত্ব। শ্রীচৈতন্যদেবের বাল্যলীলায় একটি কুকুরছানা তাঁর স্পর্শে দিব্য দেহে হরিকীর্ত্তন করিতে করিতে বৈকুন্ঠগমন করেন। সেই কথা শ্রীচৈতন্যমঙ্গলে আদিখণ্ডে বর্ণিত আছে,-

‘’গৌরাঙ্গ পরশে কুক্কুর ভাগ্যবান্ ।

স্বভাব ছাড়িয়া তার হইল দিব্যজ্ঞান ।।

রাধাকৃষ্ণ, গোবিন্দ বলিয়া ডাকে নাচে ।

নদীয়ার লোক দেখি সব ধায় পাছে ।।

কুক্কুরের আবেশ এমন সভে দেখি ।

পুলকিত সব অঙ্গ-অশ্রুময় আঁখি ।।

আচম্বিতে শান-দেহ ছড়ি ভাগ্যবান্ ।

কৃষ্ণলোক হৈঞা করে গোলোকে পয়ান ।।

আচম্বিতে দিব্য এক রথ যে আসিয়া ।

আকাশের পথে যায় তাহারে লইয়া ।। 

সুবর্ণের রথ চারু সহস্রশিখর ।

মণি-মুকুতার ঝারা করে ঝলমল ।।

লক্ষ লক্ষ ঘন্টাধ্বনি হইছে তাহাতে ।

কাংস্য-করতাল তাথে বাজে যুথে যুথে ।।

শঙ্খধ্বনি, জয়ধ্বনি, হরিধ্বনি শুনি ।

গন্ধর্ব্ব-কিন্নর গায় রাধাকৃষ্ণ-বাণী ।।

ধ্বজপতাকা সব উড়ে রথােপরে ।

সূৰ্য্যের মণ্ডল ঢাকে—কিরণ উজোরে ।।

রথ–মধ্যস্থানে বসি রত্নসিংহাসনে ।

কমনীয়–কান্তি তেঁহো অতি মনোরমে ।। 

দিব্য আভরণ তার অঙ্গে অঙ্গে সাজে ।

কোটি কোটি মদন মুর্চ্চিত হয় লাজে ।।

পরমশীতল হৈল কোটিচন্দ্র জিনি ।

রাধাকৃষ্ণ, গৌরাঙ্গ বলিয়া করে পানি ধ্বনি ।।

সিদ্ধগণ সভে আসি চামর করিয়া ।

চলিলা গোলোক পথে তাহারে লইয়া ।।  

ব্রহ্মা-শিব-সনকাদি সবে কর জুড়ি ।

গৌরাঙ্গ-মহিমা গান সবে রথ বেড়ি ।।

জয় জয় কৃপাসিন্ধু শচীর নন্দন ।

এমন করুণা প্রভু না কৈল কখন ।।

কুক্কুব উদ্ধার করি গোলোকে পাঠায় ।

দিব্য দেহ হেন কভু কেহো নাহি পায় ।।

জয় জয় অগতির গতি গৌরহরি ।

জয় জয় অবতার সভার উপরি ।।

তোর করুণায় কলি-জীব নিস্তারিব ।

আর কিবা লীলা ভোর অলৌকিক হব ।।

মোরা-সব দেব কবে হ'ব ভাগ্যবান্ ।

পাইব তোমার পদ-প্রসাদ প্রধান ।।

কুক্কুর তরিয়া যায় তোমার পরশে ।

এমন করুণা কভু নাহি হৃষীকেশ ।। 

কবে মেরা হইব এমন ভাগ্যভাগী ।

কুক্কুরে কৃতার্থ কৈলে–তাই মোরা মাগি ।।

নমো নমঃ অদোষ-দরশী গৌররায় ।

নমো নমঃ তোমার সুন্দর দুই পায় ।।

অনুব্রজি হেনরূপে সব দেবগণ ।

কবে মোরা পাব গৌরচন্দ্রের চরণ ।।

এথা গোলোকেরে আইলা মহাভাগ্যবান্ ।

গৌরাঙ্গের লীলা অনুব্রত তথা গান ।।

হেন অদভুত গোরাচাঁদের প্রকাশ ।

আনন্দে কহয়ে গুণ এ লোচনদাস  I I’’

 

তাছাড়া শ্রীমন্মহাপ্রভু সাতটি তালবৃক্ষকেও আলিঙ্গন করে তাঁদের উদ্ধার করেন। শ্রীমন্নিত্যানন্দ প্রভু ও শ্রীমন্মহাপ্রভুর কৃপা লাভ করে কিন্তু জগাই-মাধাই আর কোন প্রকার পাপকার্য্য করেননি, চাপাল-গোপাল আর বৈষ্ণবাপরাধ করেননি। তাঁরা যেদিন কৃপা করেছেন তারপর থেকে জগাই-মাধাই, চাপাল-গোপাল মদ্যপান, মৎস্য-মাংস ভোজন, স্ত্রীসঙ্গাদি পাপকর্ম সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করেছিলেন কদাপি পাপাচরণ করেননি এমনকি স্বপ্নেও অন্যজীবকে কষ্ট প্রদান করেননি৷ তথাকথিত ভেকধারী বাবাজী বা সন্ন্যাসীগণ ভক্তি-বিস্তার-ছলে অযােগ্য শিষ্যাদি করিয়া নিজ জনসংখ্যাদি বৃদ্ধির প্রচেষ্টায় রত কিন্তু অমল পুরাণ শ্রীমদ্ভাগবতে ( ৭/১৩/৮ ) বলেছেন—

ন শিষ্যাননুবধ্নীত গ্রন্থান্ নৈবাভ্যসেদ্ বহূন্ ।

 

ন ব্যাখ্যামুপযুঞ্জীত নারম্ভানারভেৎ ক্বচিৎ ।।

‘’প্রলোভনাদি দ্বারা বহুশিষ্য সংগ্রহ, বহুশাস্ত্র অভ্যাস, গ্রন্থব্যাখ্যা দ্বারা উপজীবিকা কল্পন, এবং মঠাদি নির্ম্মাণ করিবে না ।‘’ 

‘’বহু শিষ্য-লোভেতে অযোগ্য শিষ্য করে ।

ভক্তিশূন্য শাস্ত্রাভ্যাসে তর্ক করি' মরে ।। 

ব্যাখ্যাবাদ-বহ্বারম্ভে বৃথা কাল যায় ।

নামে যাঁর রুচি সে-ই এ সব না চায় ।।"

( সচ্চিদানন্দ শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর কৃত শ্রীভজন-রহস্য, চতুর্থ যাম-সাধন, ৫ থেকে সংগৃহীত।)