Monday, October 19, 2020


নিত্যলীলা প্রবিষ্ট ওঁ বিষ্ণুপাদ পরিব্রাজকাচার্য্য ত্রিদন্ডী স্বামী ১০৮ শ্রী - শ্রীমদ্ভক্তিপ্রমোদ  পুরী গোস্বামী মহারাজ

(আবির্ভাব)

ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় শুদ্ধ বৈষ্ণব ধর্মের যে নবজাগরণ শুরু হয়েছিল জগতগুরু ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের হাত ধরে তা অবিভক্ত ভারতের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের আধুনিক শুদ্ধ তত্ত্বমূলক গৌড়ীয় বিচার দর্শনের দ্বারা মুগ্ধ হয়ে অনেক শিক্ষিত তরুণ যুবক গৌড়ীয় মঠে যোগদান করেছিলেন এবং প্রভুপাদের মিশনকে আরও বেগবান করে পুরো বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তেমনি এক যুবকের কথা আজ আমরা আলোচনা করব, যিনি বৈষ্ণব সাধক পণ্ডিত  শ্রীল ভক্তিপ্রমোদ পুরী গোস্বামী মহারাজ।

জন্ম এবং বাল্যকাল

১৮৯৮ সালের অক্টোবর বাংলাদেশের যশোর জেলার গঙ্গারামপুরে এক ব্রাহ্মণ বংশে মহারাজ জন্মগ্রহণ করেন। উনার পিতার নাম তারিনীচরণ চক্রবর্তী এবং মাতার নাম শ্রীমতী রাম রাগিনী দেবী। উনার বাল্যনাম ছিল প্রমোদ ভূষণ চক্রবর্তী। বাল্যকালে উনি উনার ভক্তিমার্গ প্রদর্শক গুরু শ্রীল ভক্তিরত্ন ঠাকুর(ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের গুরুভ্রাতা) এর সংস্পর্শে এসেছিলেন। সজ্জন তোষনী পড়ার মাধ্যমে মহারাজ গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধারার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ধীরে ধীরে চৈতন্য চরিতামৃত, চৈতন্যভাগবত, চৈতন্য শিক্ষামৃত আদি গ্রন্থ পাঠ এবং ভক্তিরত্ন ঠাকুরের মাধ্যমে উনি ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের সংস্পর্শে এসেছিলেন।

গৌড়ীয় মঠে যোগদান

১৯১৫ সালে মহারাজ যখন মায়াপুরের যোগপীঠে ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের সংস্পর্শে আসেন তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুন পড়ুয়া ছিলেন। সেদিনটি ছিল পরমহংস গৌরকিশোর দাস বাবাজী মহারাজের অপ্রকট দিবসের অনুষ্ঠান এর আগের দিনই গৌরকিশোর দাস বাবাজী অপ্রকট লীলা  করেছিলেন। মহারাজ যখন ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরকে প্রথম দর্শন করেছিলেন তখনই উনি মনে মনে উনাকে আধ্যাত্মিক গুরু রূপে বরণ করে নিয়েছিলেন। ১৯২৩ সালে শুভ জন্মাষ্টমীর পুণ্যলগ্নে মহারাজ ভক্তিসিদ্ধান্ত ঠাকুরের কাছ থেকে হরিনাম দীক্ষা প্রাপ্ত হন। উনার ব্রহ্মচারী আশ্রমের নাম ছিল শ্রীপ্রণবানন্দ ব্রহ্মচারী’।

প্রচারের হাতেখড়ি

তখন গৌড়ীয় মঠের স্বর্ণযুগ চলছিল। গৌড়ীয় মঠ ভারতে একটি সুপ্রসিদ্ধ পারমার্থিক সংগঠন রূপে দ্রুত গতিতে বিস্তার লাভ করছিল। ১৯২০ সালে পুরো বাংলায় বৈষ্ণব পণ্ডিত হিসেবে শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের নাম প্রচারের প্রথম সারিতে ছিল।উনার জ্বালাময়ী ভাষণ,তুখোড় জ্ঞান, শুদ্ধ বৈষ্ণব ধারার নবদিগন্ত উন্মোচন করেছিল। আউল,বাউল,কর্তাভজা, সহজীয়াদের দ্বারা মৃতমায় শুদ্ধ বৈষ্ণব ধারাকে উনিই পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। গৌড়ীয় মঠের শিক্ষা, বিচারধারা এবং একদল উদ্যমী জ্ঞানী, শিক্ষিত যুবকদের প্রচারে মহাপ্রভুর শুদ্ধ বৈষ্ণব ধর্ম সহজীয়াবাদ থেকে উদ্বারীকৃত হয়েছিল, যার মধ্যে একজন তরুণ প্রচারক ছিলেন ভক্তি প্রমোদ পুরী গোস্বামী মহারাজ।

গুরুদেবের সেবা

ভক্তিপ্রমোদ পুরী গোস্বামী মহারাজ ১৩ বছর ঘনিষ্টভাবে ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের সেবা করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। উনি প্রভুপাদের লেকচার রেকর্ডিং, চিঠিপত্রের দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন। শ্রীল প্রভুপাদের যে সমস্ত লেকচার,কিংবা চিঠি আমরা এখন পাচ্ছি সেগুলো ভক্তিপ্রমোদ পুরী গোস্বামী মহারাজেরই প্রচেষ্টা এবং সংরক্ষণের ফল। মহারাজ বিভিন্ন বৈষ্ণবীয় বই পত্র নিয়ে গভীর গবেষণা করতেন।

গৌড়ীয়মঠের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব

মহারাজ দীর্ঘ বছর গৌড়ীয় মঠের আর্টিকেল এবং ম্যাগাজিনের প্রুফরিডার এবং এডিটর ছিলেন। ১৯২৬ সালে উনি বিশ্বের প্রথম বৈষ্ণব পত্রিকা "দৈনিক নদীয়া প্রকাশের" দায়িত্বভার প্রাপ্ত হন। দীর্ঘ বছর তিনি এই দায়িত্বে ছিলেন। শ্রীল প্রভুপাদ উনার কাজকর্মে খুব সন্তুষ্ট হয়ে "মহা-মহোপদেশক" এবং "প্রত্ন-বিদ্যালংকার" উপাধিতে ভূষিত করেন। মহারাজ সব দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সংরক্ষণ করেছিলেন তাই এই উপাধি উনি পেয়েছিলেন। ১৯৩৭ সালে ভক্তিসিদ্ধান্ত ঠাকুরের অপ্রকটের পর বাগবাজার গৌড়ীয় মঠের ম্যাগাজিনের মাধ্যমে উনি "শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বানী প্রচার করেছিলেন।

১৯৬৪ সালে ভক্তিদয়িত মাধব গোস্বামী মহারাজের অনুরোধে শ্রীচৈতন্য গৌড়ীয় মঠের " চৈতন্য বাণী ম্যাগাজিনের " এডিটোরিয়াল বোর্ডের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। জীবনের ৩৩ বছর ম্যাগাজিন,পত্রিকা, এসবের মাধ্যমেই উনি গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন সবার মাধ্যমে সুচারুভাবে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। সর্বোপরি, ৬৪ বছর বয়স অব্ধি উনি বৈষ্ণব ফিলোসোফি এবং থিয়োলজি নিয়ে নিত্য লেখা চালিয়ে গিয়েছিলেন। ১০০ উপর ভাগবতীয় কবিতা, ছোট গল্প, রচনা, চিঠি, ডায়েরি, বইয়ের বিশাল স্টোররুম উনি নিজ হাতে তৈরি করেছিলেন।

সন্ন্যাস এবং মঠ স্থাপন

১৯৪২ সালে ভক্তিসিদ্ধান্ত ঠাকুর উনাকে স্বপ্নে সন্ন্যাস নেবার আদেশ করেন। ৫১ বর্ষ বয়সে ৩মার্চ ১৯৪৭ সালে পরম পবিত্র শ্রীগৌরপূর্ণীমা শুভ তিথিতে শ্রীধাম নবদ্বীপ অন্তর্গত সমুদ্রগড় শ্রীচম্পক হট্ট শ্রীশ্রীগৌরগদাধর জীউ মন্দির প্রাঙ্গণে সতীর্থ গুরুভ্রাতা শ্রীল ভক্তিগৌরব বৈখানস মহারাজের কাছ থেকে চাম্পাহাটিতে উনি সন্ন্যাস নিয়েছিলেন। তাঁহার সন্ন্যাস নাম 'ত্রিদণ্ডিভিক্ষু শ্রীমদ্ভক্তিপ্রমোদ  পুরী গোস্বামী মহারাজ'। ভক্তিহৃদয় বন মহারাজ এবং ভক্তিদয়িত মাধব গোস্বামীর মতো উনিও পুরো দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। ভক্তিবিলাস তীর্থ মহারাজের অধীন যোগপীঠের মুখ্য পূজারী হিসেবে দীর্ঘ বছর ভক্তিপ্রমোদ পুরী গোস্বামী মহারাজ সেবা করেছিলেন।

১৯৫০ সালে নিভৃত ভজনের নিমিত্তে অম্বিকা কালনায় গঙ্গার ঘাটে উনি কুটিরবাস করছিলেন। বর্ধমানের রাজা উনার দৈন্যতায় মুগ্ধ হয়ে ১৯৫৮ সালে রাধারাণীর আবির্ভাব তিথিতে অনন্ত বাসুদেব মন্দির দান করেন। ১৯৮৯ সালে শ্রীগৌরপূর্ণীমা পুণ্য তিথিতে শ্রীল মহারাজ মায়াপুরের ঈশোদ্যান ‘’শ্রীগোপীনাথ গৌড়ীয় মঠ’’ স্থাপন করেন। গৌর গদাধর,জগন্নাথ,রাধা গোপীনাথ,লক্ষ্মী নৃসিংহ বিগ্রহ উনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পুরী,বৃন্দাবন, কলকাতা এবং মেদিনীপুরেও উনি মঠ স্থাপন করেছিলেন। দিবানিশি উনি লিখতেন। উনার ভক্তরা গভীর রাতেও উনাকে গ্রন্থ লিখতে দেখতেন। বৈষ্ণব সাহিত্য দর্শনের এমন কোন জায়গা বাকি নেই যেখানে উনি আলোকপাত করেননি।

মহা প্রস্থান

১৯৯৫সালে উনার জ্ঞান,পাণ্ডিত্য এবং ধারাবাহিক বৈষ্ণব দর্শনের প্রচারের জন্য গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজ উনাকে "বিশ্ব বৈষ্ণব এসোসিয়েশন " এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেন। অগ্রহায়ণ ১৪০৫ শুক্লা চতুর্দশী ১৯৯৮ সালের ২২ নভেম্বর প্রাতঃ কালে শ্রীল মহারাজ পার্থিব লীলা সাঙ্গ করে শ্রী শ্রী রাধাগোবিন্দের নিশান্তলীলায় প্রবেশ করেন। উনার পার্থিব শরীর জগন্নাথ পুরী থেকে শ্রীধাম মায়াপুর গোপীনাথ গৌড়ীয় মঠে নিয়ে আসা হয় এবং সেখানেই সমাধিস্থ করা হয়।





 

No comments:

Post a Comment

🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴🌴🌳 🌻🌼 শ্রীবলরামের রাসযাত্রা 🌹 শ্রীকৃষ্ণের বসন্তরাস 🌼🌻 🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴...