🍁বেদ ও শ্রীকৃষ্ণ🍁

💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐

🍇বিশেষ পোষ্ট🍇

শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ

সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম I

''যথা তরোর্মূলনিষেচনেন-

তৃপ্যন্তি তৎস্কন্ধভুজোপশাখাঃ ।

প্রাণোপহারাচ্চ যথেন্দ্রিয়াণাং

তথৈব সর্বার্হণমচ্যুতেজ্যা ।।''       (ভাগবত ৪/৩১/১৪)

অর্থাৎ,- গাছের মূলে জল সেচন করলে যেমন সেই গাছের কাণ্ড, ডাল, উপশাখা প্রভৃতি সকলেই তৃপ্তিলাভ করে এবং উদরে আহার্যদ্রব্য প্রদানের দ্বারা যেমন ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তি হয়, তেমনই শ্রীকৃষ্ণের পূজা করলে সমস্ত দেবতাদের পূজা হয়ে যায়।।

বেদ শব্দের অর্থ জ্ঞান এবং সেটি ভগবান থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বেদ শাশ্বত ও অপৌরুষেয়। পরম জ্ঞান নিত্য ও কোনো মানুষের রচিত নয়। শাস্ত্রীয় ইতিহাস অনুসারে, সৃষ্টির আদিতে ব্রক্ষ্মান্ডের প্রথম জীব স্বয়ম্ভু ব্রক্ষ্মা এই বেদ-জ্ঞান লাভ করেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণর নিকট থেকে। তাঁর বেণুধ্বনির মাধ্যমে।

যো ব্রক্ষ্মাণং বিদধাতি পূর্ব্বং যো

বৈ বেদাংশ্চ গাপয়তি স্ম কৃষ্ণঃ।।    ( অথর্ব বেদ)

অর্থাৎ,- "যিনি সৃষ্টির আদিতে ব্রক্ষ্মাকে বৈদিক জ্ঞান উপদেশ করেছিলেন এবং পূর্বে বৈদিক জ্ঞান বিস্তার করেন, তিনিই শ্রীকৃষ্ণ।।"

ব্রক্ষ্মসংহিতায় শ্রীকৃষ্ণকে বেদের সারসত্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে,

"তুষ্টাব বেদসারেণ স্তোত্রেণানেন কেশবম।"

বেদ অনুসারে, ব্রক্ষ্মা ভগবান শ্রীবিষ্ণু হতে উদ্ভূত, আর শ্রীকৃষ্ণ শ্রীবিষ্ণুরও উৎস। জড় জগতে ভগবানের তিনটি পুরুষাবতার বিষ্ণুরূপ প্রকাশিত:-

১. প্রথম পুরুষাবতার:- কারণোদকশায়ী বিষ্ণু বা মহাবিষ্ণু। কারণ-উদক সাগরে (কার্যকারণ মহাসাগর) শায়িত এই মহাবিষ্ণুর বিরাট শরীর থেকে কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড প্রকাশিত হয়, মহাপ্রলয়ে (অবলুপ্তি) সমস্ত জড় ব্রহ্মাণ্ডগুলি ধ্বংস হয়ে সূক্ষ্ম জড় উপাদনরূপে(মহত্তত্ব) তাঁর দিব্য শরীরে বিলীন হয়।

২. দ্বিতীয় পুরুষাবতার:- গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু। মহাবিষ্ণু নিজেকে কোটি কোটি রূপে বিস্তার করে, প্রতিটি ব্রহ্মাণ্ডে প্রবেশ করে, ব্রহ্মাণ্ডের গর্ভোদকে শয়ন করেন। তারপর ব্রক্ষ্মাকে সৃষ্টি করেন। ব্রক্ষ্মার মাধ্যমে সূর্য ও চতুর্দশ ভুবন বা গ্রহলোকসমূহ সৃষ্টি করেন।

৩. তৃতীয় পুরুষাবতার:- ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণু। প্রতি ব্রহ্মাণ্ডে শ্রীবিষ্ণু নিজেকে অসংখ্য রূপে বিস্তার করে, জীবসত্তাকে ভগবদধামে ফিরে আসতে সাহায্য করার জন্য প্রত্যেক জীব হৃদয়ে পরমাত্মা রূপে অবস্থান করেন। এইভাবে অসংখ্য অনন্তরূপে ভগবান নিজেকে বিস্তার করেন, কিন্তু তিনি 'অদ্বৈতম' (অ-দ্বৈত) তিনি এক ও অভিন্ন এবং সকল রূপের পরম উৎস শ্রীকৃষ্ণ স্বরূপ। এটিই বৈদিক শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত।

অদ্বৈতম-অচ্যুতম-অনাদিম-অনন্তরূপম

আদ্যং পুরাণপুরুষং নবযৌবনঞ্চ।

বেদেষু দুর্লভম-অদুর্লভম-আত্মভক্তৌ

গোবিন্দম-আদি পুরুষং তমহং ভজামি।।     (ব্রক্ষ্মসংহিতা ৫/৩৩)

অর্থাৎ,- "যিনি অদ্বৈত, অচ্যুত, অনাদি, অনন্তরূপসম্পন্ন, আদি পুরাণপুরুষ হয়েও নিত্য নবনবায়মান যৌবনসম্পন্ন সুন্দর পুরুষ, বেদাদি শাস্ত্র পাঠে দুর্লভ কিন্তু শুদ্ধ আত্ম ভক্তির লভ্য, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।"

বেদে সর্বদেবতার উপাস্য ভগবান রূপে শ্রীবিষ্ণুকে স্তুতি করা হয়েছে। যেমন ঋগবেদে (১/২২/২0) বলা হয়েছে,

ওঁ তদবিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা-

পশ্যন্তি সূরয়ো দিবীব চক্ষুরাততম।

তদবিপ্রাসো বিপন্যবো জাগৃবাংষঃ

সমিন্ধতে বিষ্ণোর্যৎ পরমং পদম।।

অর্থাৎ,- "পরমেশ্বর বিষ্ণুই হচ্ছেন পরম সত্য, সুরগণ তাঁর পাদপদ্ম দর্শনে সর্বদাই উদগ্রীব। সূর্যের মতোই ভগবান তাঁর শক্তিরশ্মির বিস্তার করে সর্বত্র ব্যাপ্ত আছেন।"

শ্রীবিষ্ণু শ্রীকৃষ্ণেরই প্রকাশ বা বিস্তার, শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত, যেমন সকল বেদ উপনিষদের সার গীতোপনিষদ, ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণকে বিষ্ণু বলে সম্বোধন করা হয়েছে।

অমী হি ত্বাং সুরসঙ্ঘা বিশন্তি

কেচিদ্ ভীতাঃ প্রাঞ্জলয়ো গৃণন্তি।

স্বস্তীত্যুক্ত্বা মহর্ষিসিদ্ধসঙ্ঘাঃ

স্তুবন্তি ত্বাং স্তুতিভিঃ পুষ্কলাভিঃ।।      (গীতা - ১১/২১)

অর্থাৎ,- হে প্রভু! সমস্ত দেবতারা তোমার শরণাগত হয়ে তোমাতেই প্রবেশ করছেন। কেউ কেউ ভীত হয়ে করজোড়ে তোমার গুণগান করছেন। মহর্ষি ও সিদ্ধেরা ‘জগতের কল্যাণ হোক’ বলে প্রচুর স্তুতি বাক্যের দ্বারা তোমার স্তব করছেন।

নভঃস্পৃশং দীপ্তমনেকবর্ণং

ব্যাত্তাননং দীপ্তবিশালনেত্রম্।

দৃষ্ট্বা হি ত্বাং প্রব্যথিতান্তরাত্মা

ধৃতিং ন বিন্দামি শমং চ বিষ্ণো।।     (গীতা - ১১/২৪)

অর্থাৎ,- হে বিষ্ণু! তোমার আকাশষ্পর্শী, তেজোময়, বিবিধ বর্ণযুক্ত, বিস্তৃত মুখমন্ডল ও উজ্জ্বল আয়ত চক্ষুবিশিষ্ট তোমাকে দেখে আমার হৃদয় ব্যথিত হচ্ছে এবং আমি ধৈর্য ও শম অবলম্বন করতে পারছি না।

তেজোভিরাপূর্য জগৎ সমগ্রং

ভাসস্তবোগ্রাঃ প্রতপন্তি বিষ্ণো।।      (গীতা -১১/৩০)

অর্থাৎ,- হে বিষ্ণু! তুমি তোমার জ্বলন্ত মুখসমূহের দ্বারা সকল লোককে গ্রাস করছ এবং তোমার তেজোরাশির দ্বারা সমগ্র জগৎকে আবৃত করে সন্তপ্ত করছ।

শ্রীকৃষ্ণই শ্রীবিষ্ণু রূপে সর্বজীবের অন্তরস্থিত পরমাত্মা,

অহমাত্মা গুড়াকেশ সর্বভূতাশয়স্থিতঃ।

অহমাদিশ্চ মধ্যং চ ভূতানামন্ত এব চ।।      (গীতা - ১০/২০)

অর্থাৎ,- হে গুড়াকেশ! আমিই সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থিত পরমাত্মা। আমিই সর্বভূতের আদি, মধ্য ও অন্ত।

বিষ্ণুমূর্তি-সমূহ, রাম-নৃসিংহ ইত্যাদি অবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণরই প্রকাশ, অংশ, কলা। শ্রীকৃষ্ণই স্বয়ং ভগবান।

"এতে চাংশ কলাঃ পুংসঃ

কৃষ্ণস্ত ভগবান স্বয়ম।।"     - (ভাগবত - ১/৩/২৪)

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পূর্ণপরাৎপর পুরুষ, সেজন্য তাঁর থেকে অসংখ্য ভগবৎ-রূপ বিস্তার হলেও তিনি তাঁর পূর্ণস্বরূপে নিত্যবিরাজমান। শ্রীঈশোপনিষদে যেমন বলা হয়েছে, (আবাহন)

ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।

পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে ।।

অর্থাৎ,- "পরমেশ্বর ভগবান সর্বতোভাবে পূর্ণ। তিনি সম্পূর্ণভাবে পূর্ণ বলে এই দৃশ্যমান জগতের মতো তাঁর থেকে উদ্ভূত সব কিছুই সর্বতোভাবে পূর্ণ। যা কিছু পরম পূর্ণ থেকে উদ্ভূত হয়েছে তা সবই পূর্ণ। কিন্তু যেহেতু তিনি হচ্ছেন পরম পূর্ণ, তাই তাঁর থেকে অসংখ্য অখণ্ড ও পূর্ণ সত্তা বিনির্গত হলেও তিন পূর্ণরূপেই অবশিষ্ট থাকেন।"

 

ভগবদগীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণর কয়েকটি উক্তি,-

"বেদ্যং পবিত্রং ওঙ্কার.." - ৯/১৭ - আমাকে পবিত্র ওঙ্কার বলে জানবে।

"প্রণবঃ সর্ববেদেষু.." - ৭/৮ - সমস্ত বেদে উল্লেখিত প্রণব(ভগবানের নির্বিশেষ নাম) আমিই।

"বেদে চ প্রথিতঃ পুরুষোত্তম" - ১৫ /১৮ - বেদে আমি পুরুষোত্তম নামে খ্যাত।

"বেদানং সামবেদোহস্মি.." - ১০/২২ - সমস্ত বেদের মধ্যে আমি সামবেদ।

"ঋক সাম যজুরেব চ " - ৯/১৭ - ঋক, সাম, যজুর্বেদাদিও আমি।

"বৃহৎসাম তথা সাম্নাং গায়েত্রী ছন্দসামহম" - ১০/৩৫ - আমি সামবেদের মধ্যে বৃহৎসাম, সমস্ত ছন্দের মধ্যে গায়েত্রী।

 

"অহং হি সর্বযজ্ঞানাং ভোক্তা চ প্রভুরেব চ" - ৯/২৪ - আমি সমস্ত যজ্ঞের ভোক্তা, প্রভু।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আরও বিপ্লবাত্মক কথা বলেছেন।   

যামিমাং পুষ্পিতাং বাচং প্রবদন্ত্যবিপশ্চিতঃ

বেদবাদরাতাঃ পার্থ নান্যদন্তীতি বাদিনঃ।।

কামাত্মানঃ স্বর্গপরা জন্মকর্মফলপ্রদাম্।

ক্রিয়াবিশেষবহুলাং ভোগৈশ্বর্যগতিং প্রতি।।      (গীতা ২/৪২ - ৪৩)

অর্থাৎ,- বিবেকবর্জিত লোকেরাই বেদের পুষ্পিত বাক্যে আসক্ত হয়ে স্বর্গসুখ ভোগ,উচ্চকুলে জন্ম, ক্ষমতা লাভ আদিসকাম কর্মকেই জীবনের চরম উদ্দেশ্য বলে মনে করে। ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ ও ঐশ্বর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তারা বলে যে, তার ঊর্ধ্বে আর কিছুই নেই।

ভগবদগীতাকে সমস্ত বেদ-উপনিষদের সার-নির্যাস বলা হয় (সর্বোপনিষদোগাবো)। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উক্তি ও ভগবদগীতার তথ্যের সাথে বেদ-উপনিষদের মৌল তত্ত্বের সুস্পষ্ট সামঞ্জস্য রয়েছে। নিম্নে কিছু সাদৃশ্য লক্ষ্য করলেই তা স্পষ্ট হবে।

১. ভগবদগীতা - ৮/৯  নং শ্লোক ও ১৩/১৮  নং শ্লোক আর শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের (৩/৮) নং শ্লোক একই।

২. গীতার ১৫/১৪ নং শ্লোক আর বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৫/৯/১  নং শ্লোক একই।

৩. গীতার ৯ /১০  নং শ্লোক আর ঐতরেয় উপনিষদ ৩/১১ নং শ্লোক এক।

৪. গীতার ১৫/১৮  নং শ্লোক আর ছান্দোগ্য উপনিষদ ৮/১২/১৩ নং শ্লোকে একই কথা বলা হয়েছে।

৫. গীতার ৭/২ নং শ্লোক আর মুন্ডক উপনিষদ ১ /৩  নং শ্লোকে একই কথা বলা হয়েছে।

৬. গীতার ১০/২ নং শ্লোক আর শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৬/ ৭-৮ নং শ্লোক একই।

৭. গীতার ২/২0 নং শ্লোক আর কঠোপনিষদ ১/২/১৮ নং শ্লোক একই।

🌷জয় বেদপুরুষ শ্রীকৃষ্ণের জয়🌷🌷জয় সকল ভক্তবৃন্দের জয়🌷