💐শ্রীকৃষ্ণের শারদীয় রাসযাত্রা💐

🌻🌺💞🍁💐🏵️💐🍁💞🌺🌻

শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ

সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম I আজ ১৪ই কার্ত্তিক, ৩১অক্টোবর ইং রোজ - শনিবার পরাৎ পরব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণের শারদীয় রাসযাত্রা। যিনি ভক্তিপূর্বক এই রাসলীলার বিষয় পাঠ ও শ্রবণ করেন, তাঁর ইহলোকে সুখসম্পদ প্রাপ্তি ও অন্তে বিষ্ণুলোকে গতি হয় এবং ভগবানে পরমাভক্তি লাভ করে থাকেন।

💐শ্রীশ্রীরাসলীলা💐

💞🍁💐🏵️💐🍁💞 তৃতীয় পর্ব্ব

হে কৃষ্ণ, আমরা তোমার জন্য সব কিছুই ত্যাগ করলাম। লোক, লাজ, ভয়, কাম, অহংকার – সকলই ত্যাগ করলাম। আমাদের অন্তর জুড়ে শুধু তুমি। তুমি আমাদের হৃদয়ে আছো সখা। আমরা চিরকাল তোমাকে হৃদয়েই অধিষ্ঠিত করে রাখবো। শুধু তুমি দেখা দাও, নাথ, তুমি দেখা দাও। গোপীরা সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণের শরণাগত হল । হে প্রভু, তোমাকে ছাড়া আর কিছুই জানি না। তাদের দুচোখে দরদর অশ্রুধারা, অন্তর প্রেমে উদ্বেল।

তাঁরা মিলিত হয়ে উচ্চৈঃস্বরে গান করতে করতে শ্রীকৃষ্ণের অন্বেষণে উন্মত্তের মত বনে বনে ভ্রমণ করতে আরম্ভ করলেন এবং যিনি আকাশের ন্যায় প্রাণীদেরর বাইরে ও অভ্যন্তরে অবস্থিত সেই পরম পুরুষের কথা বনস্পতি দেরকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন, “হে অশ্বত্থ ! হে প্লক্ষ ! হে ন্যগ্রোধ ! শ্ৰীনন্দের নন্দন প্রেম ও হাস্যবিলাসিত কটাক্ষদ্বারা আমাদের চিত্তহরণ করে পলায়ন করেছেন, তোমরা কি তাঁকে দেখেছ ? হে কুরুবক ! হে নাগ ! যাঁর হাসি মানিনীদের মানহরণ করে, সেই রামানুজ কি এইখান দিয়ে গমন করেছেন ? এইভাবে তাঁরা প্রতি বৃক্ষ ও লতার নিকটে গমন করে অতি করুণভাবে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন । কিন্তু কোথাও শ্রীকৃষ্ণের সন্ধান পেলেনল না। তখন তাঁরা শ্ৰীকৃষ্ণের অন্বেষণে অতিশয় বিহ্বলা হয়ে তাঁর বিবিধ ক্রীড়ার অনুসরণ করতে লাগলেন। এক গোপী কৃষ্ণ হলেন, আর এক গোপিকা পুতনা হয়ে৷ স্তন্যপান করাতে লাগলেন । একজন শকট হলেন, অপর একজন কৃষ্ণ হয়ে তাকে পদ প্রহার করলেন। এইভাবে গোপিকারা বৃন্দারণ্যে ভগবানের সকল প্রকার লীলারই অনুকরণ করতে লাগলেন ।

গোপিকারা কৃষ্ণবিরহে উন্মত্তপ্রায় হয়ে কখনো হাসি, কখনো কান্না, কখনো স্তব করতে লাগলেন। এমন সময় হাস্যবদন, পীতাম্বর, বনমালী কৃষ্ণ তাঁদের সম্মুখে আবির্ভূত হলেন । গোপিকাগণ প্রিয়তমকে সন্মুখে দেখে৷ আনন্দিত হলেল । তাঁদের নয়ন কমল প্রফুল্ল হয়ে উঠল । তথন তাঁরা যেন পুনর্জীবন প্রাপ্ত হলেন। তাঁরা সকলে শ্ৰীকৃষ্ণের কাছে নানা প্রকার তাঁদের মনোব্যথা জানাতে লাগলেন । যেমন মুমুক্ষু ব্যক্তিরা ঈশ্বরকে প্রাপ্ত হয়ে সংসারতাপ মোচন করে, তেমনই গোপিকারা কেশবদর্শন করে পরমানন্দ লাভ করে বিরহজ সন্তাপ পরিত্যাগ করলেন I

বৈষ্ণব কবি যদুনন্দন দাস সেই মহারাস বর্ণনা করছেন,-

বিহাগড়া॥

নাচত ঘন, নন্দলাল, রসবতী করি সঙ্গে।

রবাব খমক পীনাক বীণা, বাজত কত রঙ্গে।।

কোই গায়ত, কোই বায়ত, কোই ধরত তাল।

সখীগণ মেলি নাচিছে গাইছে মোহিত নন্দলাল।।

শুক নাচিছে শারী নাচিছে বসিয়া তরুর ডালে।

কপোত কপোতী দুহুঁ জন মেলি ধরিছে কতেক তালে।।

কুরঙ্গ নাচিছে ময়ূর নাচিছে নাচিছে কোকিল পাখী।

বায়স নাচিছে ক্রোঞ্চ নাচিছে নাচিছে কপোত হেরি।

তরুলতা যত আনন্দে নাচিছে ফল ফুল সারি সারি।।

ফুলের উপর ভ্রমরা নাচিছে ভ্রমরী নাচিছে রঙ্গে।

মধুকর যত নাচে শত শত, মধু পিয়ে তার সঙ্গে।।

ব্রহ্মা নাচিছে সাবিত্রী সহিতে পুলকে পূরিত অঙ্গ।

বৃষের উপর মহেশ নাচিছে পার্ব্বতী করি সঙ্গ।।

মিহির নাচিছে স্বপত্নী সহিতে রোহিণী সহিত চাঁদে।

যত দেবগণ আনন্দে নাচিছে হিয়া থির নাহি বাঁধে।।

সুরাসুরগণ আনন্দে নাচিছে পাতালে নাগের সনে।

কূর্ম্ম সহিতে অনন্ত নাচিছে অতি আনন্দিত মনে।।

সুমেরু সহিতে পৃথিবী নাচিছে বলিয়ে ভালিরে ভালি।

গোবর্দ্ধন গিরি আনন্দে নাচিছে যার তটে রাস কেলি।।

যমুনা নাচিছে তরঙ্গের ছলে নাচিছে মকর মীনে।

এ যদুনন্দন হেরিয়া বিভোর যুগল উজ্জ্বল গানে।। 

রাসমণ্ডলে প্রিয়সঙ্গতা কামিনীদের বলয়, নুপুর ও কিঙ্কিণীর ঝণৎকারে গভীর শব্দ সমুত্থিত হতে লাগল । ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ সেই গোপিকাদের মধ্যে স্বর্ণবর্ণ মণিগণে মণ্ডিত মরকতমণির মত সাতিশয় শোভা পেতে লাগলেন। পদন্যাস, ভুজ কম্পন, সহাস্য ভ্রূবিলাস, বঙ্কিমকটিতট, কম্পিত কুচমণ্ডল, বিস্রস্তবসন এবং গগুস্থলে দোদুল্যমান কুণ্ডলদ্বারা কৃষ্ণকামিনীদের বদন কমল ঘৰ্ম্মে আপ্লুত হল। তাঁদের কবরী ও কাঞ্চী শ্লথ হয়ে পড়ল । তাঁরা শ্রীকৃষ্ণের গুণগান করতে করতে মেঘচক্রে তড়িৎ মালার মত বিরাজ করতে লাগল। নানা রাগরঞ্জিত -কণ্ঠ গোপীগণ নৃতা করতে করতে শ্ৰীকৃষ্ণের অঙ্গস্পর্শে আনন্দিত হয়ে উচ্চৈঃস্বরে গান করতে আরম্ভ করল, সেই গানে ব্ৰহ্মাও পরিপূর্ণ হল । কৃষ্ণ যেরূপ স্বর ও রাগে গান করেছিলেন, গোপীরাও তার অনুরূপ স্বর ও রাগে গান করতে লাগলেন। শ্ৰীকৃষ্ণ তাঁদের এরূপ গান শুনে স্বয়ং বিমোহিত হলেন। "

এইভাবে গোপীগণ রাসক্রীড়ায় পরিশ্রান্ত হয়ে পড়লেন । তখন তাঁদের মল্লিকা শ্লথ হয়ে গেল । কেউ বাহু দিয়ে মাধবের স্কন্ধধারণ করল, কেউ বা গলদেশে বেষ্টিত উৎপলের মত সুগন্ধি চন্দনচর্চিত শ্রীকৃষ্ণের করকমল আঘ্রাণকরে রোমাঞ্চিত হয়ে চুম্বন করল। নৃত্য করতে করতে কামিনীদের কুণ্ডল দুলতে লাগল। সেই কুণ্ডলের আভায় ভগবানের গণ্ডস্থল শোভিত হল। এইরূপে নানাভাবে বিশুদ্ধ তানলয়যুক্ত গন্ধৰ্ব্ব ও মানবগণের বিস্ময় উৎপাদক নৃত্য ও গীত চলতে লাগল ।

বালক যেরূপ নিজের প্রতিবিম্ব নিয়ে খেলা করে, তেমনি ভগবান রমাপতি নানাভাবে আলিঙ্গন, করমর্দন, স্নিগ্ধ কটাক্ষ বিক্ষেপ এবং উদ্দামবিলাস ও হাস্য দ্বারা ব্রজসুন্দরীদের সঙ্গে ক্রীড়া করতে লাগলেন । তাঁর অঙ্গসঙ্গ হতে যে নিরতিশয় আনন্দ জন্মাল, তাতে ব্ৰজাঙ্গনাদের ইন্দ্রিয়গুলি আকুল হয়ে পড়ল । ব্ৰঙ্গাঙ্গনারা আনন্দে বিভোর হলেন, তাঁদের গলদেশ থেকে মালা বিচ্যূত হল, আভরণ খসে পড়তে লাগল । কেশ আলুলায়িত, দুকুল ও কুচপট্টিকাগুলি আগের মত যথাযথ ধারণ করতে সমর্থ হল না । শ্রীকৃষ্ণের বিহার-দর্শনে খেচর-কামিনীরা স্মরশরে পীড়িত হয়ে মুগ্ধ হলেন। চন্দ্রমাও তারকাদের সঙ্গে বিস্মিত হয়ে তাদের নিজ নিজ গতি ভুলে গেলেন, সুতরাং রজনী অত্যন্ত দীর্ঘ হয়ে উঠল, তার ফলে বিহারও অনেকক্ষণ ধরে চলল ।

ভগবান আত্মারাম হয়েও যতজন গোপী লীলাক্রমে নিজেকে ততজন করে তাঁদের সাথে ক্রীড়া করতে লাগলেন । অনেকক্ষণ ক্রীড়া করে তাঁরা যখন শ্রান্ত হয়ে পড়লেন, তখন ভগবান তাঁদের মুখকমল মুছিয়ে দিলেন। তারপরে তিনি এই কামিণীদের সঙ্গে যমুনাসলিলে গিয়ে সেখানে নানাপ্রকার জলকেলি করতে লাগলেন । এইভাবে ভগবান কৃষ্ণ সুরত ক্রীড়াকে অবরোধ করে রাসলীলা করেছিলেন । শুকদেব পরীক্ষিতকে রাসলীলার বিষয় শ্রবণ করালে তাঁর মহা সংশয় উপস্থিত হয়, এই জন্য তিনি শুকদেবকে প্রশ্ন করেন, — "হে ব্রহ্মন ! ধৰ্ম্মের স্থাপন এবং অধৰ্ম্মের দণ্ডবিধান করবার জন্য জগদীশ্বর ভগবান পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন । তিনি ধৰ্ম্মসেতুর বক্তা, কর্তা, ও রক্ষিতা হয়ে কিভাবে পরদার সম্ভোগরূপ অধৰ্ম্মের অনুষ্ঠান করেছিলেন।

ভগবান কৃষ্ণ আত্মারাম, তাঁর এরূপ করবার অভিপ্রায় কি ? আমার এই সংশয় অপনোদন করুন ।" তখন শুকদেব বললেন, " ঈশ্বরদের ধৰ্ম্ম অতিক্রম ও সাহস দেখা যায় , তেজস্বীদের তাতে দোষ হয় না। অগ্নি যেমন সকলই ভোজন করে থাকেন, তেমনি ঈশ্বরের কোন বিষয়ে দোষ সম্ভব হয়না । যাঁরা ঈশ্বর নন, তাঁরা কখনও এরূপ আচরণ করবেন না। মহাদেব ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তি মুঢ়তাবশতঃ বিষপান করলেই মৃত্যুমুখে পতিত হবে । ঈশ্বরের বাক্য সত্য এবং তাঁর আচরণও কখনো কখনো সত্য হয়। অতএব তাঁরা যা বলেন, যাঁদের বুদ্ধি আছে, তাঁরা তাই করবেন । ভগবান যা করেন, তার অনুকরণ করা বিধেয় নয় । যিনি গোপীদের, গোপীর স্বামীদের এবং যাবতীয় দেহীর অভ্যন্তরে বিরাজ করছেন এবং যিনি বুদ্ধ্যাদির সাক্ষী, তিনি ক্রীড়াচ্ছলে এই দেহ ধারণ করে এরূপ বিবিধ ক্রীড়া করে থাকেন।

জীব এই সব কথা শুনে তাঁর প্রতি ভক্তিমান হতে পারবে । " শুক বললেন,- "ভগবানের এই রাসলীলা পরম অদ্ভূত এবং সকল পাপনাশক। যিনি ভক্তিপূর্বক এই রাসলীলার বিষয় শ্রবণ করেন, তাঁর ইহলোকে সুখসম্পদ প্রাপ্তি ও অন্তে বিষ্ণুলোকে গতি হয় এবং ভগবানে পরমাভক্তি লাভ করে থাকেন, অবিলম্বে কামরূপ মানসিক পীড়া থেকে বিমুক্ত হয়ে থাকেন। "      ( ভাগবত ১০ম স্কন্ধ, রাস পঞ্চাধ্যায় )

রাসলীলা'-য় যে নৃত্য পরিবেশিত হয় তার নাম 'রাস-নৃত্য' । এটি পাঁচ ভাগে বিভক্ত, যথাক্রমে-- মহারাস, বসন্তরাস, কুঞ্জরাস, দিব্যরাস, নিত্যরাস। প্রেমরসের এই পঞ্চলীলায় সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ মহারাস-এ। এই পর্যায়েই রয়েছে কৃষ্ণের সঙ্গে রাধা-র অভিসার, গোষ্ঠী অভিসার, গোপীগণের আলাপ, কৃষ্ণনর্তন, রাধানর্তন, গোপীদের নর্তন, শ্রীকৃষ্ণের অন্তর্ধান-প্রত্যাবর্তন, পুষ্পাঞ্জলি, গৃহগমণ।

কাৰ্ত্তিকী পূর্ণিমার দিন বিভবানুসারে রাসযাত্রা বিধান করা কর্তব্য। এই দিন নৃত্য গীত ও বাদ্য আদি নানারকম উৎসব করতে হয়। যিনি এই অনুষ্ঠান করেন, তিনি ইহলোকে বিবিধ সুখভোগ করে অন্তকালে বিষ্ণুলোকে গমন করে থাকেন। কাৰ্ত্তিকী পৌর্ণমাসীর দিন ভগবান রাসক্রীড়া করেছিলেন, এই জন্য ঐ দিনই রাসক্রীড়া বিধেয় । এই দিনে রাসযাত্রার পদ্ধতি অনুসারে অর্দ্ধরাত্রে পূজা ইত্যাদি সহকারে উৎসব করতে হয় ।

  সমাপ্ত