💐শ্রীকৃষ্ণের শারদীয় রাসযাত্রা💐

🌻🌺💞🍁💐🏵️💐🍁💞🌺🌻

শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ

সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম I হরে কৃষ্ণ, আগামী ১৪ই কার্ত্তিক, ৩১অক্টোবর ইং রোজ - শনিবার পরাৎ পরব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণের শারদীয় রাসযাত্রা। যিনি ভক্তিপূর্বক এই রাসলীলার বিষয় পাঠ ও শ্রবণ করেন, তাঁর ইহলোকে সুখসম্পদ প্রাপ্তি ও অন্তে বিষ্ণুলোকে গতি হয় এবং ভগবানে পরমাভক্তি লাভ করে থাকেন।

 

💐শ্রীশ্রীরাসলীলা💐

💞🍁💐🏵️💐🍁💞 প্রথম পর্ব্ব

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের সাথে যে ক্রীড়া করেছিলেন, তাকেই রাস বলে । কেউ কেউ এই রাসকে কল্পতরুযাত্রা বলে থাকেন। ভাগবতে লিখিত আছে যে, শ্রীকৃষ্ণ বস্ত্রহরণের দিন গোপিনীদের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, পরবর্তী পূর্ণিমা তিথিতে তিনি রাসলীলা করবেন,-

"যখন করেন হরি বস্ত্রহরণ।

গোপীদের কাছে তিনি করিলেন পণ।।

আগামী পূর্ণিমাকালে তাঁহাদের সনে।

করিবেন রাসলীলা পুণ্য বৃন্দাবনে।।"

 

কাৰ্ত্তিকমাসে পূর্ণিমার দিন নিৰ্ম্মল গগনে পূর্ণ শশধরের উদয় হলে, শ্রীকৃষ্ণ যোগমায়া অবলম্বন করে বিহার করতে ইচ্ছা করলেন। শরৎকাল, আকাশ অতি নিৰ্ম্মল, তাতে পূর্ণচন্দ্রের উদয় হয়েছে । এই চাঁদ, চারিদিক মাতাল করা মল্লিকার গন্ধ – দিব্যস্নাত অলৌকিক এক মায়ায় আচ্ছন্ন রাত। ভগবান কৃষ্ণ যখন দেখলেন ওই পূর্ণচন্দ্র ধীরে ধীরে রক্তিম থেকে গৈরিক বর্ণ ধারণ করল এবং সমগ্র অরণ্য প্লাবিত হল জ্যোৎস্নায় তখন তিনি তাঁর হাতে তুলে নিলেন মোহন বাঁশি, ফুঁ দিলেন বাঁশিতে, – মধুর বংশীধ্বনি ছড়িয়ে পড়ল ব্রজের বনে বনাঞ্চলে, যমুনার তীরে। সেই মন মাতাল করা সুর শোনা মাত্রই গোপীদের মন উন্মনা হল। আশ্চর্য এই সুর কেবল গোপীরাই শুনতে পেল, যারা কৃষ্ণপ্রেমে পাগল; কৃষ্ণ যাদের প্রাণপ্রিয়সখা আর কেউ শুনতে পেল না সেই সুর। এমনকি মা যশোদাও নন। এমনই সুর যা গোপীদের তীব্রভাবে আকর্ষণ করল, যেন আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে তাদের চুম্বকের মত টেনে নিয়ে আসতে লাগল তাদের রাসস্থলীর দিকে। বৃন্দাবনের সকল তরুণী গোপী যারা কৃষ্ণের প্রেয়সী, তারা একে অপরের মনোভাব না জেনেই ছুটে চলল সেই বাঁশির সুরের উৎস সন্ধানে।

 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বামলোচনাদের বিমোহনকারী মধুর অনঙ্গবর্দ্ধন গীত গান করতে লাগলেন। রাস-লীলা-র ব্যাখ্যায় কৃষ্ণের বংশীবাদনকে 'অনঙ্গ বর্দ্ধনম' বলা হয়েছে। কেউ যদি ভগবানের স্পর্শ পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয় বা তাকে সেবা করার জন্য ব্যকুল হয় অথবা ভগবানের কাছ থেকে আনন্দ পেতে বা দিতে চায়, তাহলে তাকে বলে 'অনঙ্গ'। এই শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল 'কাম'। কিন্তু গোপীদের সঙ্গে কৃষ্ণের সম্পর্ককে এতটা সরলীকরণ করে ভাবাটা অপরাধ। বলা হয় গোপীদের সঙ্গে কৃষ্ণের প্রেম আধ্যাত্মিক, জাগতিক নয়।

"সহজে গোপীর প্রেম নহে প্রাকৃত কাম ।

কাম ক্রীড়া সাম্যে তারে কহি কাম নাম ।।

নিজেন্দ্রিয় সুখ হেতু কামের তাৎপর্য্য ।

কৃষ্ণসুখ তাৎপর্য্য হয় গোপীভাব বর্য্য।।

গোপীগণের প্রেম গাঢ় গোপীভাব নাম ।

বিশুদ্ধ নির্ম্মল প্রেম কভু নহে কাম ।। "

 

গোপীরা নিজেদের সবটুকু দিয়ে নিঃস্বার্থভাবে কৃষ্ণকে প্রেম নিবেদন করে। এতে কোনও দ্বিধা নেই, দ্বন্দ্ব নেই। গোপীগণ কিংকৰ্ত্তব্য বিমূঢ় হয়ে যে যেখানে যে অবস্থায় ছিলেন, সে সেই সেই কৰ্ম্ম পরিত্যাগ করে শ্ৰীকৃষ্ণের নিকট ছুটলেন। তাঁরা কেউ কেউ গোরুর দুধ দুইছিলেন, কেউ বা উনুনে দুধ গরম করছিলেন। যেই বাঁশির সুর কানে গেল অমনি তাঁরা দুধ দোওয়া ফেলে ছুটলেন – গোরুর পা বাঁধা রইল, বাছুরটিকে মায়ের কাছে এনে দিতে ভুলে গেলেন, উনুনে দুধ উথলে উঠল । না, কোন দিকে নজর নেই – সব ছেড়ে গোপীরা ছুটলেন। কর্মত্যাগ হল তাদের – যতিকর্ম ত্যাগ। কেউ কেউ আবার পতিসেবা করছিলেন বা সান্ধ্য আহার প্রস্তুত করছিলেন অথবা প্রসাধন ও অঙ্গরাগে ব্যস্থ ছিলেন — সব কাজ তাঁদের অসম্পূর্ণ রইল – তাঁরা ধাবিত হলেন কৃষ্ণসন্দর্শনে।

 

কেউ কেউ দুগ্ধপানরত ছোট শিশুকে ফেলে ছুটলেন – তীব্র স্রোতের অভিমুখে যেভাবে নৌকা ধাবিত হয়, সেইভাবে গোপীরাও কৃষ্ণ অভিমুখে ধাবিত হলেন। তাঁরা সংসারধর্ম, লোকলাজ, স্নেহ ও জাগতিক প্রেমও ভুলে গেলেন। তাঁদের মনপ্রাণ জুড়ে কেবল কৃষ্ণ। ভগবানকে পেতে গেলে এভাবেই তো সর্বস্ব ত্যাগ করতে হয় । তাঁদের পতিপুত্রগণ এই সকল অঙ্গনাদেরকে সেখানে যেতে নিবারণ করলেন , কিন্তু তাঁরা ফিরলেন না । তাঁরা এইরূপ বিমুগ্ধ হয়ে গমন করতে লাগলেন যে, বসনাদি বিপৰ্য্যস্ত হলেও তাঁদের কিছুমাত্র জ্ঞান ছিল না।

 

দ্বিজ চণ্ডীদাসের বর্ণনায়, —

রমণী-মোহন বিলসিতে মন

হইল মরমে পুনি।

গিয়া বৃন্দাবনে বসিলা যতনে

রমিতে বরজ-ধনী।।

 

মধুর মুরলী পূরে বনমালী

রাধা রাধা বলি গান।

একাকী গভীর বনের ভিতর

বাজায়ে কতেক তান।

 

অমিয়া-নিছন বাজিছে সঘন

মধুর মুরলী-গীত।

অবিচল কুলরমণী সকল

শুনিয়া হরল চিত।।

 

শ্রবণে যাইয়া রহল পশিয়া

বেকতে বাজিছে বাঁশী।

‘আইস, আইস’, বলি ডাকয়ে মুরলী

যেন ভেল সুখরাশি।।

 

আনন্দ-অবশ পুলক-মানস

সুকুমারী ধনী রাধে।

গৃহকর্ম্ম যতহৈল বিসরিত

সকল করিল বাধে।।

 

রাইয়ের অগ্রেতে যতেক রমণী

কহয়ে মধুর বাণী।

“ঐ ঐ শুন, কিবা বাজে তান

কেমন করিছে প্রাণী।।

 

সহিতে না পারি মুরলীর ধ্বনি

পশিল হিয়ার মাঝে।”

বরজ-তরুণী হইল বাউরী

হরিল কুলের লাজে।।

 

কেহ পতিসনে আছিল শয়নে

ত্যজিয়া তাহার সঙ্গ।

কেহ বা আছিল সখীর সহিত

কহিতে রভস-রঙ্গ।।

 

কেহ বা আছিল দুগ্ধ আবর্ত্তনে

চুলাতে রাখি বেশালি।

ত্যজি আবর্ত্তন হই আনমন

ঐছন সে গেল চলি।।

 

কেহ শিশু লয়ে কোলেতে করিয়ে

দুগ্ধ করায় পান।

শিশু ফেলি ভূমে চলি গেল ভ্রমে

শুনি মুরলীর গান।।

 

কেহ বা আছিল শয়ন করিয়া

নয়নে আছিল নিঁদ।

যেন কেহ আসি চোরাই লইল

মানসে কাঁটিয়া সিঁদ।।

 

কেহ বা আছিল রন্ধন করিতে

তেমতি চলিয়া গেল।

কৃষ্ণমুখী হৈয়া মুরলী শুনিয়া

সব বিসরিত ভেল।।

 

সকল রমণী ধাইল অমনি

কেহ কাহা নাহি মানে।

যমুনার কুলে কদম্বের মূলে

মিলল শ্যামের সনে।।

 

ব্রজনারীগণে দেখিয়া তখনে

হাসিয়া নাগর রায়।

রাস-বিলসন করিল রচন

দ্বিজ চণ্ডীদাসে গায়।।

ক্রমশ…