🌷উদ্ধব সংবাদ🌷

💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐

🍇বিশেষ পোষ্ট🍇

শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ

সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম I

''হরি - গুরু - বৈষ্ণব তিনিহেঁ স্মরণ।

তিনেহেঁ স্মরণ হইতে বিঘ্ন বিনাশন।।

অনায়াসে হয় নিজ বাঞ্ছিত পূরণ ।।''

 

‘’বন্দে নন্দ ব্রজস্ত্রীণাং পাদরেণুমভীক্ষশঃ।

যাসাং হরিকথোদগীতং পুনাতি ভুবনত্রয়ম।।‘’

🌻গোপীদের সঙ্গে উদ্ধবের কথোপকথন🌻 
উদ্ধব বললেন,- ‘’হে সৌভাগ্যবতীগণ! শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তোমাদের প্রগাঢ় প্রেম ও ভক্তি জন্মেছে। শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তোমাদের বিরহ, আমার প্রতিও অনুগ্রহ প্রদান করেছে; কারণ সেজন্যেই আমিও ভগবৎ - প্রেমিকাদের মুখদর্শন করতে পারলাম। হে সাধ্বীগণ! এখন আমি তোমাদের কাছে সেই সুখময় সংবাদ প্রকাশ করব, যা আমি আমার প্রভুর কাছ থেকে বহন করে নিয়ে এসেছি। তা শ্রবণ করলে অবশ্যই তোমাদের মনে সুখ উৎপাদন হবে। তোমাদের ভর্ত্তা শ্রীকৃষ্ণের সকল গুহ্য কাজই আমি সম্পাদন করে থাকি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,- ‘’হে গোপীগণ! আমার সাথে তোমাদের বিচ্ছেদ হয়নি। কারণ আমি সর্বাত্মা। আকাশাদি অর্থাৎ আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল ও বায়ু পঞ্চমহাভূত যেমন সকল ভূতের আশ্রয়, আমিও তেমনি মন, প্রাণ, বুদ্ধি, ইন্দ্রিয় ও গুণগণের আশ্রয়রূপে সকল হৃদয়ে বিরাজ করি। 

আমি আমার অচিন্ত্য শক্তির প্রভাবে পঞ্চভূত, ইন্দ্রিয় ও গুণস্বরূপ নিজের দ্বারা নিজেকেই সৃষ্টি করি, পালন করি এবং কখনও বা ধ্বংস করি। জীবের আত্মা শুদ্ধ জ্ঞানময়, কারণ গুণ কখনও তাকে স্পর্শ করতে পারে না। তিনি চৈতন্যস্বরূপ। শুদ্ধ, সুষুপ্ত, স্বপ্ন ও জাগরণরূপ মনোবৃত্তি দ্বারাই তিনি বিশ্বতৈজস প্রাজ্ঞরূপে প্রতীয়মান হন। নিদ্রাভঙ্গে প্রবুদ্ধ ব্যক্তি যেমন অলীক স্বপ্ন দেখে মনে মনে সুখ, দুঃখ অনুভব করে, সেরূপ মায়াময় ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয় জালে জীবাত্মা যে অবস্থায় আবদ্ধ হয় সর্বাগ্রে সে মন ও ইন্দ্রিয়কে দমন করা কর্তব্য অর্থাৎ মনই অলীক স্বপ্নের মত বিষয়ের আরাধনা কর, মনের নিরোধই সর্বশাস্ত্রের তাৎপর্য বাক্য। এই মনোনিরোধই বেদোক্ত কর্মকলাপ, অষ্টাঙ্গযোগ, সাংখ্য, সন্ন্যাস, তপস্যা, ইন্দ্রিয়দমন এবং সত্য এ সমস্ত ব্যাপারে নদীসমূহের সমুদ্রে মিলিত হওয়ার মত।

এক মনের নিরোধেই সকলের পরিসমাপ্তি হয়। হে সুন্দরীগণ! আমি যে তোমাদের দৃষ্টির আড়ালে আছি, আমাকে ধ্যানের দ্ধারা তোমার আমার নৈকট্য লাভ করবে এটি হচ্ছে উদ্দেশ্য। প্রিয়তম দূরে অবস্থান করলে স্ত্রীগণের মন যেমন আবিষ্ট হয়, নিকটবর্তী বা দৃষ্টির গোচরে থাকলে স্ত্রীগণের মন তেমন আবিষ্ট হয় না। তাই তোমরা মনকে বিষয়বৃত্তি হতে নিবৃত্ত করে নিরন্তর আমাতে মন সন্নিবেশিত করে নিত্য ধ্যান করতে করতে শ্রীঘ্রই আমাকে প্রাপ্ত হবে। হে কল্যাণীগণ! বৃন্দাবনের মধ্যে নিশীথকালে আমি যখন রাসক্রীড়া করছিলাম, তখন যে সকল ব্রজস্ত্রীগণ স্বজনের প্রতিবন্ধকতায় রাসক্রীড়ায় আসতে পারেনি, তারা আমার লীলা চিন্তায় দেহ ত্যাগ করে আমাকেই প্রাপ্ত হয়েছে।"

প্রিয়তম শ্রীকৃষ্ণের আদেশবার্তা শ্রবণ করে ব্রজনারীগণের চিত্ত আশ্বস্ত হলো এবং তাদের স্মৃতিপটে ক্রমশঃ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলাসমূহ উদ্ভাসিত হতে লাগল। গোপীনিগণ প্রসন্নচিত্তে উদ্ধবকে বলল,- ‘’হে সৌম্য! সৌভাগ্য এই যে, যদুকুল বিদ্বেষী কংস অনুরচসহ নিহত হয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণ এখন কুশলে আছেন, এটিই আমাদের কাছে সুখের বিষয় সন্দেহ নেই, শ্রীকৃষ্ণ আমাদের প্রতি যে ভালবাসা প্রদর্শন করতেন মধুপুরীর কামিনীদেরও কি সেরূপই ভালবাসেন ? তিনি কি সে সকল অঙ্গনার স্নিগ্ধ ও সলজ্জ হাস্যসহ মুখ অবলোকন করে আমাদের মত তার অর্চনা করেন? শ্রীকৃষ্ণ রতিবিশেষজ্ঞ, পুরকামিনীদের প্রিয় এবং তাদের বাক্য ও বিলাসাদি দ্ধারা পূজিত হবেন এতে আর সন্দেহ কি? হে সাধু! আমরা গ্রাম্যনারী। পুরস্ত্রীগণের সভায় কথাচ্ছলে কি গোবিন্দ কখনও আমাদেরকে স্মরণ করেন?" 

তখন অন্য একজন বিদগ্ধ গোপনারী বলল,- ‘’হে উদ্ধব! কুমুদ-কুন্দ-পুষ্প ও শশাঙ্ক সুশোভিত বৃন্দারণ্যের বিপিনমধ্যে শ্রীকৃষ্ণ যখন নিশীথকালে রাসক্রীড়া করতেন, আমাদের চরণে-নূপুর শিঞ্জিত হতো। তারমধ্যে গোবিন্দ কত মনোমুগ্ধকর কথা বলতে বলতে আমাদের সাথে ক্রীড়া করতেন। সেই সকল রাত্রির কথা কি তিনি এখনও স্মরণ করেন? আমরা সকল গোপনারী রাসচক্রে তাঁর মনোমুগ্ধকর কথা শুনে স্তব করেছিলাম। হে সাধুবর! ইন্দ্র যেমন অমৃতবর্ষণ দ্বারা নিদাঘতপ্ত বনরাজিকে সঞ্জীবিত করেন, সেরূপ জগত সংসারের পালক ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কি স্বকীয় সুখময় করস্পর্শাদি দ্বারা আমাদের তাপিত অঙ্গকে সুশীতল করার জন্য এই ব্রজধামে আগমন করবেন?”

অপর গোপনারীগণ বলল,-  ‘’সখি! তুমি কি বলছ। তিনি তার শত্রু ধ্বংস করেছেন। রাজ্য লাভ করেছেন। রাজ-কন্যাদেরকে বিবাহ করে, বন্ধু-বান্ধব দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে মথুরাপুরে পরম সু্খে জীবন যাপন করছেন। এমন ঐশ্বর্য্য সুখ পরিত্যাগ করে তিনি কেন এখানে আসবেন ?’’ 

অপর কোন কামিনী বলল,- ‘’ সখিগণ তোমরা প্রকৃত তত্ত্ব অবগত নও। শ্রীকৃষ্ণ পূর্ণকাম এবং সকলের আশা পূরণের সার্মথ্য তিনি ধারণ করেন। তিনি জিতেন্দ্রিয়, আমরা বনচারিনী কি তার অভিলাষ পূর্ণ করতে পারি? রাজকন্যা বা অন্য কোন গোপীনারী দ্বারা প্রয়োজন সিদ্ধ হতে পারে না, হবার নয়। পিঙ্গলা নামক স্মৈরিণী বলেছিল, "নৈরাশ্যই পরম সুখ। আমরা তা জানি। কিন্তু তারপরও আমরা আশা যে ছাড়তে পারছিনা। আমরা কি করব? আমারদের কি করা উচিৎ। সেই উত্তমশ্লোক ভগবানের লীলাবার্ত্তা শ্রবণে কার না ইচ্ছা হয়। যিনি ইচ্ছা পোষণ না করলে স্বয়ং কমলাও যাঁর অঙ্গ পরিত্যাগ করতে পারে না।

আর সে অচ্যুতকে আমরা বিস্মৃত হতে পারলে ক্লেশ হয় না, কিন্তু আমাদের তো বিস্মরণ ঘটছে না। আমরা যে ভুলতে পারছিনা। হে প্রভো উদ্ধব! ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলরামসহ এ নদী, পর্বত, সরোবর ও বনপ্রদেশে বিচরণ করে বেণুধ্বনি করে গাভী চরাতেন। সে সকল স্থানে তাঁর অপূর্ব শোভাবিশিষ্ট পদচিহ্ন অবলোকন করেই স্মৃতি পটে উদ্ভাসিত হচ্ছে এবং বার বার মনে পড়ছে। কিছুতেই তো তাঁকে ভুলতে পারছিনা। হে উদ্ধব! শ্রীকৃষ্ণের মনোহর গতি, উদার হাস্য, লীলাবলোকন ও মধুর বচন আমাদের চিত্ত হরণ করেছে; তাই কেমন করে তাকে বিস্মৃত হবো? হে কৃষ্ণ! হে নাথ! হে ব্রজনাথ! হে আর্ত্তিনাশক! হে গোবিন্দ! এ গোকুল দুঃখসাগরে নিমগ্ন হয়ে আছে, তুমি এসে গোকুলকে উদ্ধার কর।"

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সন্দেশ বার্তা শ্রবণ করে ব্রজনারীগনের বিরহ ব্যাথা প্রশমিত হলো। উদ্ধবের উপদেশাবলী শ্রবণ করে জানতে পারলেন যে শ্রীকৃষ্ণ ইন্দ্রয়াতীত, স্বয়ং পরমাত্মা। তাই তারা উদ্ধবকে গুরুজ্ঞানে পূজা করলেন। তারপর কয়েক মাস উদ্ধব গোকুলে অবস্থান করে গোকুলবাসীকে কৃষ্ণ-লীলা-কথা শুনিয়ে পরম আনন্দ দান করলেন। ভগবদ্ভক্ত উদ্ধব যতদিন ব্রজপুরে অবস্থান করেন ততদিন কৃষ্ণের লীলা কীর্ত্তন করেছেন, সে সকল দিন তাদের কাছে ক্ষণতুল্য মনে হয়েছিল। উদ্ধব ব্রজের নদী, বন, পর্বত, ও পুষ্পিত কানন দেখে দেখে ব্রজবাসীগণকে শ্রীকৃষ্ণের কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন। গোপীকামিনীদের চিত্ত শ্রীকৃষ্ণেই আসক্ত, শ্রীকৃষ্ণের জন্যই তারা ব্যাকুলিত, কৃষ্ণ বিরহে তাদের যত কাতরতা দর্শনে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে তাদেরকে নমস্কার করার পূর্বেই এরূপ গান করেছেন যে, এই গোপবধূগণ যখন শ্রীকৃষ্ণে এরূপ চিত্ত সমর্পণ করতে সক্ষম হয়েছে, তখন জগতে তাদের জন্মই সার্থক।

সংসার বিমুখ মুনিগণ এবং আমাদের মত অভক্তেরাও চিরকাল প্রার্থনাই করছি কিন্তু কৃপা লাভে সমর্থ হচ্ছিনা। অখিলাত্মা গোবিন্দে গোপীদের সেই পরম প্রেম জন্মেছে। হরি কথায় যার অনুরাগ আছে, তার ব্রহ্মজন্মে প্রয়োজন কি? এ সকল গোপকামিনী বনচারিণী; ব্যভিচারে দোষিত, এরাই বা কোথায়? আর পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের পরম প্রেমই বা কোথায়? ঈশ্বর ভজনশীল অজ্ঞ ব্যক্তিরও পরম মঙ্গল করেন, না জেনে অমৃত পান করলেও তাতে মঙ্গল লাভ হয়ে থাকে। রাসোৎসবে ভগবানের ভুজদন্ড যাদের কন্ঠার্পিত হয়েছিল, যারা পরম মঙ্গল লাভ করেছিল, সে সকল ব্রজনারীরা যে প্রসাদ লাভ করেছিল, অন্যান্য কামিনীদের কথা দূরে থাক, যিনি শ্রীহরির একান্ত অনুরাগভাজন হয়ে বক্ষঃস্থলে বাস করেন, সেই লক্ষ্মীও সে প্রসাদ পান না; পদ্মগন্ধা ও পদ্মবর্ণা দীপ্তিমতী স্বর্গকামিনীরাও পান না।

এই সকল গোপিনীগণ দুস্ত্যজ ও আত্মীয়স্বজন, পতি-পুত্রাদি পরিত্যাগ করে, বেদে যাঁর অন্বেষণ করতে হয়, সেই গোবিন্দপদবী ভজনা করছে; সুতরাং বৃন্দাবনের বনমধ্যে যে গুল্ম, লতা এবং ওষধি এদের চরণরেণু সেবা করছে, আমি যেন তাদের মধ্যেও একজন হয়ে বৃন্দাবনে বাস করতে পারি । লক্ষ্মীদেবী যাঁর অর্চনা করেন এবং ব্রহ্মাদি আপ্তকাম মুনিগণ মানসমন্দিরে যাঁর অর্চনা করেন, ভগবানের সেই চরণ-কমল এরা রাসোৎসবে কুচমণ্ডলে আলিঙ্গন করে সন্তাপ দূর করেছিলেন। আমি সেই সকল নন্দগোকুলস্থ গোপবনিতাদের চরণরেণু বার বার প্রণাম করি, যাদের হরিকথা-গান ত্রিভুবনকে পবিত্র করছে। 

উদ্ধব কিছুদিন গোকুলে কাটিয়ে পরে গোপীগণ, নন্দ ও যশোদার কাছ হতে বিদায় নিয়ে মথুরায় যাত্রা করার উদ্দেশ্যে রথে আরোহন করলেন। তার যাত্রাকালে নন্দাদি গোপবৃন্দ রামকৃষ্ণের জন্য উপটকন সমেত তার সমীপে আগমন করে অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন,- ‘’হে উদ্ধব! আমাদের একান্ত প্রার্থনা আমাদের মন প্রান সকল যেন কৃষ্ণপাদপদ্মকে আশ্রয় করে থাকে, বাক্য যেন তাঁর গুণগাথাই গান করে এবং দেহ যেন কৃষ্ণপ্রণামাদি কার্য্যে রত থাকে। ঈশ্বরের ইচ্ছায় নিজ নিজ কর্মবশে যে কোন যোনিতেই জন্মগ্রহণ করি, আমাদের মঙ্গল কার্যের অনুষ্ঠান ও দানাদি দ্ধারা ভগবান শ্রীকৃষ্ণেই যেন আমাদের মতি থাকে।‘’  গোপগণ কর্তৃক কৃষ্ণভক্তি দ্ধারা এ রূপে পূজিত হয়ে, উদ্ধব পুনরায় কৃষ্ণ পালিতা মথুরায় আগমন করলেন। পরে শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম করে ব্রজবাসীগণের ঐকান্তিক ভক্তির কথা নিবেদন করে তাদের প্রদত্ত উপহার সমাগ্রী বাসুদেব, বলরাম ও রাজার সমীপে অর্পণ করলেন।
(সমাপ্ত )