🌷উদ্ধব সংবাদ🌷

💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐

🍇বিশেষ পোষ্ট🍇

শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ

সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম I

 

যৎকীর্ত্তনং যৎস্মরণং যদীক্ষণং

যদ্বন্দনং যচ্ছ্রবনং যদর্হণম্ । 

লোকস্য সদ্যো বিধুনোতি কল্মষং

তস্মৈ সুভদ্রশ্রবসে নমো নমঃ ।।  (ভাগবত ২/৪/১৫)

অর্থাৎ,- আমি সেই সর্ব মঙ্গলময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করি; যাঁর যশগাথা কীর্ত্তন, স্মরণ, দর্শন, বন্দন, শ্রবণ ও পূজনের ফলে সমস্ত পাপরাশি অচিরেই ধৌত হয়।

 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আজ্ঞাবহ হয়ে উদ্ধবের ব্রজপুরে আগমন I

দ্বিতীয় - পর্ব্ব

নিশাবসানে গোপবধূগণ ঘুম হতে উঠে গৃহস্থালীর কাজ সম্পন্ন করে দধিমন্থন করতে আরম্ভ করলেন। গোপীগণের মুখমণ্ডল অরুণবর্ণ কুঙ্কুমে রঞ্জিত ছিল এবং কর্ণ-কুণ্ডলের কিরণচ্ছটায় কপোলদেশ অধিক শোভা প্রাপ্ত হয়েছিল। তাদের কাঞ্চী প্রভৃতিতে মণিগুলি প্রজ্জ্বলিত দীপের আভায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল। গোপীদের কঙ্কণমালায় অলঙ্কৃত ভুজযুগ দ্বারা মন্থনরজ্জু আকৃষ্ট হয়ে তাদের নিতম্ব, স্তন ও হারগুচ্ছ সকল হেলতে দুলতে লাগল। পদ্মপলাশ -লোচন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করে গাওয়া, ব্রজাঙ্গনাদের গীতধ্বনি ও দধিমন্থন ধ্বনি একত্রে মিলিত হয়ে আকাশ মণ্ডল স্পর্শ করল। সে গীতের প্রভাবে সকল অমঙ্গল দূরীভূত হয়। ভগবান সূর্যদেব উদিত হলে ব্রজনারীগণ ব্রজদ্বারে স্বর্ণখচিত রথ দেখে বলল,-  "এই রথ কার ? যে ব্যক্তি কংসের প্রয়োজনে আমাদের কৃষ্ণকে আমাদের কাছ হতে মথুরায় নিয়ে গিয়েছিলেন সেই অক্রুর কি আবার এসেছেন? আমাদের দেহ দ্বারা কি অক্রুর মৃতপ্রভু কংসের পিণ্ডদান করবেন?"

ইতিমধ্যে উদ্ধব স্নান, আর সন্ধ্যা বন্দন সম্পন্ন করে সেখানে আগমন করলেন। আজানুলম্বিত বাহু, নবীন পদ্মতুল্য নয়ন, পীতম্বর, পদ্মমালী, সুন্দর বদন সেই উদ্ধবকে দেখে ব্রজনারীরা বিস্মিত হলো। তারা বলাবলি করতে লাগল,- ‘’কে এই সুদর্শন পুরুষ? কোথা হতে এসেছেন? কার দূত? তার বেশভূষা দেখছি আমাদের অনিন্দ্যসুন্দর শ্রীকৃষ্ণের মত। তারা তাকে ঘিরে দাড়াল।‘’  যখন তারা বুঝতে পারলেন উদ্ধব শ্রীকৃষ্ণের বার্তাবাহক হয়ে এখানে এসে্ছেন তখন ব্রজনারীরা সলজ্জ হাস্য ও সুমিষ্ট বাক্যে তাকে অর্চন করলেন। গোপীরা তাকে কুশল প্রশ্ন করে বলল,- ‘’আমরা জেনেছি, আপনি যদুপতি কৃষ্ণের সেবক।

 

পিতামাতার প্রিয় করতেই আপনার প্রভূ আপনাকে এখানে প্রেরণ করেছেন। এছাড়া এ ব্রজে তার আর কিছূ স্মরণীয় দেখি না। যারা সংসার ত্যাগী মুনি, বন্ধুর প্রতি স্নেহাকর্ষন তাদেরও থাকে- সে স্নেহ তারাও ত্যাগ করতে পারে না। অন্যের সঙ্গে মিত্রতা কেবল কার্যানুসারেই করা হয়। স্ত্রীদের সঙ্গে পুরুষের মিত্রতা, পুষ্পরাজির সাথে ভ্রমরদের মিত্রতারই অনুরূপ। বারবধূ- নির্ধন ব্যক্তিকে, প্রজাগণ- অসমর্থ রাজাকে, কৃতবিদ্যা ব্যক্তি গুরুকে এবং পুরোহিত- দক্ষিণাদান অন্তে যজমানকে পরিত্যাগ করে; বিহঙ্গেরা ফলশূন্য বৃক্ষকে ত্যাগ করে যায়, অতিথি ভোজনান্তেই গৃহ পরিত্যাগ করে, মৃগগণ দগ্ধ অরণ্য ছেড়ে যায় এবং জারগণ সম্ভোগান্তে অনুরক্ত অতৃপ্ত কামিনীকে পরিত্যাগ করে থাকে। সাধারণত বাস্তবে এই রকমই দেখা যায়।"

ব্রজনারীদের বাক্য, কায় ও মন সম্পূর্ণভাবে গোবিন্দে অর্পিত ছিল। কৃষ্ণদূত উদ্ধব ব্রজে আগমন করলে শ্রীকৃষ্ণের বাল্য ও কৈশোরের ঘটনাগুলি স্মরণ করতে করতে নির্লজ্জ হয়ে লৌকিক ব্যবহার ত্যাগ করে তারা রোদন করতে লাগল। প্রিয়ের আগমন আসন্ন চিন্তা করতে করতে কোন এক গোপী ভ্রমরকে দেখে, প্রিয় যেন তাকে দূত প্রেরণ করেছে, এরূপ কল্পনা করে বলতে লাগল,- ‘’হে ধূর্ত্তের বন্ধু! আমাদের চরণ স্পর্শ কোরনা। আমাদের  সপত্নীর কুচমন্ডলে শ্রীকৃষ্ণের যে বনমালা বিলুন্ঠিত হয়েছে, তোমার শ্মশ্রুতে তার কুম্কুম রয়েছে; মধুপতি সে সকল মাননীদেরকেই  প্রসন্ন করুন। আমাদেরকে প্রসন্ন করে কি হবে? তুমি তো যদুপতিয দূত, - এখানে কেন আগমন?

 

তোমার জন্যই তো তিনি যদু সভায় উপহাসাস্পদ হবেন। তুমি যেমন পু্ষ্পের মধু নিঃশেষিত করে পুষ্পকে ত্যাগ কর, তেমনি যদুপতি একবার মাত্র তাঁর মোহিনী অধরসুধা পান করিয়ে আমাদেরকে ত্যাগ করেছেন। স্বয়ং লক্ষ্মী যার চরণরেণুর উপাসনা করেন, আমরা তাঁর কে? কিন্তু যিনি দুঃখীর প্রতি দয়াশীল ‘উত্তমঃ শ্লোক’ শব্দটি তার প্রতিই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ‘’হে ভ্রমর! তুমি আমার চরণে তোমার মাথা রেখো না। তুমি শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে দৌত্য কর্ম ও প্রিয় বচন দ্বারা প্রার্থনা করতে খুবই চতুর। তোমার সকল বিষয়ই জানলাম, তুমিও কৃষ্ণের মত অবিশ্বাসী। যাঁর জন্য আমরা গৃহ, পতি-পুত্র সবই ত্যাগ করেছি, তাঁর সাথে আবার সন্ধি কিসের?

 

হে ভ্রমর! তাঁর হৃদয় ব্যাধের ন্যায় কঠোর, ব্যাধ যেমন বিনা অপরাধে পক্ষীকে হত্যা করে, তেমনি তিনি রামাবতারে বনবাসী হয়ে অঙ্গদকে উপলক্ষ করে বালীকে হত্যা করেন। স্ত্রীর বশবর্তী হয়ে ( অর্থাৎ সীতার অনুরোধে )সুর্পণখার কর্ণ ও নাসিকা কর্তন করেছিলেন। বলি রাজার উপহার গ্রহণ করেও কাকের মত আচরণে তাঁকে পাতালবাসী করেছিলেন। সেই কৃষ্ণবর্ণের সাথে আমাদের সখ্যতার প্রয়োজন নেই। যাঁর কথা অমৃত স্বরূপ, তাঁর কণিকামাত্র একবার পান করলে বা শ্রবণ করলে রাগ-দ্বেষ দ্বন্দ্ব মোহ বিনষ্ট হয়ে যায়; কত যোগী ব্যক্তি তাঁর অমৃতকথা একবার মাত্র শ্রবণ করে কুটম্বগণকে পরিত্যাগ করে অরণ্যচারী পাখির মত ভিক্ষা করে কোনরকমে জীবন ধারণ করেন । কিন্তু আমরা যে নিরুপায়, আমরা কি করব?

 

আমরা যে কৃষ্ণবর্ণ মানুষটির কথা স্মরণ না করে থাকতে পারি না। সে হরিকথা যে এমন সর্বনাশী তা জেনেও আমরা তা ছাড়তে পারছি না। যেমন কৃষ্ণসার হরিণীরা ব্যাধের মধুর গীতে মুগ্ধ হয়ে শর বিদ্ধ হয়ে যাতনা ভোগ করে, তেমনি আমরাও সেই নিষ্ঠুরের (শ্রীকৃষ্ণের ) বাক্য সত্য মনে করে, প্রণয়কথা স্মরণ করে বার বার মদনব্যথা সহ্য করছি। সুতরাং হে দূত! তুমি কৃষ্ণালাপ ব্যতীত অন্য কথা বলো।

হে ভ্রমর! তুমি আবার কোথায় চলে গেলে? তোমার সখা শ্রীকৃষ্ণ কি তোমাকে আবার আমাদের কাছে প্রেরণ করেছেন? দেখ, তুমি আমাদের পূজনীয়। আমাদেরকে বলো, কি তোমার অভিলাষ? তুমি কি আমাদেরকে মধুপুরে কৃষ্ণসঙ্গ লাভের জন্য নিয়ে যেতে চাও? কিন্তু সেখানে কেন আমাদেরকে নিয়ে যাবে? তিনি তো অপর নারীর সংসর্গ ছাড়া কখনই একা থাকতে পারেন না। লক্ষ্মী তো সতত তাঁর বক্ষস্থলে বিরাজমানা ।"

এ সকল কথা বলে উক্ত গোপীনি কিছুটা অপ্রকৃতস্থ হয়ে সরলভাবে গাম্ভীর্য ও দীনতার সাথে উদ্ধবকে বললেন,- ‘’হে সৌম্য! আর্যপুত্র শ্রীকৃষ্ণ কি এখনও মধুপুরে আছেন। তিনি কি পিতৃগৃহ ও গোপদেরকে স্মরণ করেন? আমরা তাঁর দাসী ছিলাম, তিনি কি আমাদের কথা স্মরণ করেন ? তিনি তাঁর অগুরু-সুগন্ধি বাহু কবে আমাদের মস্তকে স্থাপন করবেন?" উদ্ধব কৃষ্ণগত প্রাণ ব্রজনারীদের এ সকল কথা শ্রবণ করে কৃষ্ণদর্শনে অভিলাষিণী গোপিগণকে সান্তনা দিতে দিতে বললেন,- ‘’অহো! এ জগত সংসারে তোমরা লোকপূজিতা এবং কৃতার্থ হয়েছে। কারণ তোমাদের মনপ্রাণ সম্পূর্ণভাবে ভগবান বাসুদেবে অর্পিত হয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। হে অবলাগণ! দান, ব্রত, তপস্যা, জপ, হোম, বেদ অধ্যয়ন, ইন্দ্রিয়নিগ্রহ এবং অন্যান্য যে কোন পবিত্র কর্মের অনুষ্ঠান দ্বারা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ভক্তি সাধনেরই পথ। সৌভাগ্যবশতঃ তমরা সেই উত্তমঃ শ্লোকের প্রতি মুনিগণের দুর্লভ অত্যুৎকৃষ্ট যে ভক্তি , তাই লাভ করেছ। কারণ পতি, পুত্র, দেহ, স্বজন ও গৃহাদি বিসর্জন করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তোমরা যেভাবে আত্মসমর্পণ করেছ তোমাদের পক্ষে এর থেকে সৌভাগ্যের বিষয় আর কি হতে পারে?

ক্রমশ…

 

রাধিকা - চরণরেণু,             ভূষণ করিয়া তনু,

অনায়াসে পাবে গিরিধারী।

রাধিকা - চরণাশ্রয়,            যে করে সে মহাশয়,

তাঁ'রে মুঞি যাঁও বলিহারী।।

জয় জয় 'রাধা' নাম,           বৃন্দাবন যাঁর ধাম,

কৃষ্ণসুখ - বিলাসের নিধি।

হেন রাধা - গুণগান,           না শুনিল মোর কান,

বঞ্চিত করিল মোরে বিধি।।

তাঁ'র ভক্ত - সঙ্গে সদা,        রসলীলা প্রেমকথা,

যে করে সে পায় ঘনশ্যাম।

ইহাতে বিমুখ  যেই,             তা'র কভু সিদ্ধি নাই,

নাহি যেন শুনি তা'র নাম।।

কৃষ্ণনাম - গানে ভাই,         রাধিকা - চরণ পাই,

রাধানাম - গানে কৃষ্ণচন্দ্র।

সংক্ষেপে কহিনু কথা,        ঘুচাও মনের ব্যথা,

দুঃখময় অন্য কথা - দ্বন্দ্ব।