💐শ্রীকৃষ্ণের শারদীয় রাসযাত্রা💐

🌻🌺💞🍁💐🏵️💐🍁💞🌺🌻

শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ

সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম I হরে কৃষ্ণ, আগামী ১৪ই কার্ত্তিক, ৩১অক্টোবর ইং রোজ - শনিবার পরাৎ পরব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণের শারদীয় রাসযাত্রা। যিনি ভক্তিপূর্বক এই রাসলীলার বিষয় পাঠ ও শ্রবণ করেন, তাঁর ইহলোকে সুখসম্পদ প্রাপ্তি ও অন্তে বিষ্ণুলোকে গতি হয় এবং ভগবানে পরমাভক্তি লাভ করে থাকেন।

 

💐শ্রীশ্রীরাসলীলা💐

💞🍁💐🏵️💐🍁💞 দ্বিতীয় পর্ব্ব

কোন কোন গোপী পতিপুত্ৰগণ কর্তৃক নিবারিত হয়ে সেখানে যেতে পারলেন না, তখন তাঁরা ঈষৎ নিমীলিত লোচনে শ্ৰীকৃষ্ণকে চিন্তা করলেন । শ্ৰীকৃষ্ণের নিকট যেতে না পেরে তাঁদের ইহজগতে দৈহিক সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন হল। কিন্তু তাঁরা বাইরে শ্রীকৃষ্ণকে না পেলেও মনোমধ্যে ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণকে প্রাপ্ত হয়ে তাঁরই চরণে মনোনিবেশ করলেন এবং প্রাণ পরিত্যাগ করে মুক্তিলাভ করলেন । দর্শনাদি শাস্ত্রে মীমাংসিত হয়েছে যে, পাপ-পুণ্যের ধ্বংস না হলে মুক্তি হতে পারে না, এই সকল গোপীদের পাপ-পুণ্যের ধ্বংস না হওয়ায় মুক্তি কিভাবে হবে ? যাঁদের এরূপ সংশয় হয়, তাঁরা একটু মনোনিবেশ সহকারে দেখলেই দেখতে পাবেন যে, এই গোপাঙ্গনাদের পাপপুণ্য ধ্বংস হয়েই তাঁদের মুক্তি হয়েছিল ।

 

এই গোপাঙ্গনাদের চিত্ত পূৰ্ব্ব হতেই একমাত্র শ্ৰীকৃষ্ণের প্রতি অনুরক্ত ছিল । এখন তাঁরা সেখানে যেতে না পেরে তাঁরই বিষয় কেবল চিন্তা করতে লাগলেন । তখন তাঁদের প্রিয়তমের দুঃসহ বিরহানলে যে সন্তাপ জন্মাল, তাতেই এই গোপিকাদের অশুভ ক্ষয় পেল, সুতরাং পাপের ভোগ হয়ে গেল, এবং পরে তাঁরা চিন্তাযোগে ভগবান অচ্যুতকে প্রাপ্ত হয়ে যে আলিঙ্গন করায় যে সুখসম্ভোগ হল , তাতেই তাঁদের সব পূণ্যের নাশ হল । যদিও তাঁদের শ্রীকৃষ্ণে উপপতি বোধ ছিল, তবুও সেই পরমাত্মাকে প্রাপ্ত হওয়ায় তখনকার সুখদুঃখ দ্বারা অশেষ কর্ম্মক্ষয় হয়ে দেহত্যাগ করা মাত্রই তাঁদের মুক্তি হল । গোপীগণ কৃষ্ণকে পরমকান্ত বলে জানলেও তাঁকে ব্ৰহ্ম বলে তাঁদের জ্ঞান ছিল না। তবে কিভাবে তাঁদের সংসার- বিরতি হল ? এরূপ সংশয়েরও নিরাকরণ হয়েছে।

 

ভগবান কৃষ্ণে, শত্রুমিত্র যে যে রূপে তন্ময়তা প্রাপ্ত হতে পারে, তাদের তাতেই কাৰ্য্য সিদ্ধি হয়ে থাকে। শিশুপাল প্রভৃতি ভগবানের শত্রুতা করে যখন মুক্ত হয়েছিল, তখন যারা তাঁর প্রিয়, তাদের কথা আর কি বলা যেতে পারে ? দলে দলে ব্রজাঙ্গনাগণ শ্ৰীকৃষ্ণের নিকট উপস্থিত হলে ভগবান কৃষ্ণ তাঁদেরকে বাকচাতুরীতে বিমোহিত করে বললেন, “হে মহাভাগ সকল ! তোমাদের সুখে আগমন হয়েছে তো ? আমি তোমাদের কি ইষ্টসাধন করব, ব্রজের সমুদয় মঙ্গল তো ? এই রজনী অতিঘোরা, ভয়ঙ্কর হিংস্র প্রাণীগণ ইতস্ততঃ বিচরণ করছে, অতএব সত্বর তোমরা ব্ৰজে ফিরে যাও, এস্থানে অবস্থান করা তোমাদের উচিত নয় । তোমাদের মাতা, পিতা, পুত্র ও স্বামী তোমাদেরকে না দেখতে পেয়ে অন্বেষণ করছেন, শীঘ্র তোমরা গৃহে ফিরে যাও ।

 

গোপিকারা তখন ঈষৎ প্রণয়কোপে অন্যদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লাগলেন । ভগবান কৃষ্ণ তাঁদের এরূপ ভাব দেখে তাঁদেরকে বলতে লাগলেন, “ কুসুমিত কানন পূর্ণচন্দ্রের রজত কিরণে রঞ্জিত হয়েছে, যমুনানিলের লীলাগতিদ্বারা কম্পমান তরুপল্লব গুলিতে তা শোভা পাচ্ছে । তোমরা যদি সেই শোভা দেখতে এসে থাক, তাহলে এখন তোমাদের তা দেখা হয়েছে , গোকুলে ফিরে যাও। তোমরা সতী , ঘরে গিয়ে নিজ নিজ পতির সেবা কর । তোমাদের শিশুরা রোদন করছে, তাদেরকে দুগ্ধপান করাও। আর যদি তোমরা আমার প্রতি স্নেহে চিত্ত বশীভূত হওয়াতেই এসে থাক, তাতেও দোষ নেই । এখন গৃহে গমন কর।

 

হে কল্যাণীগণ, তোমরা জেনো, অকপটে স্বামীর ও স্বামিবন্ধুগণের সেবা এবং সন্তানপোষণই রমণীগণের গার্হস্থ্যধর্ম। স্বামী দুঃশীল হোন, দুর্ভগ, বৃদ্ধ বা নিধর্ম হোন, সদ্গতি কামনা কারিণী নারীগণের তাকে ত্যাগ করা উচিত নয় । কুলকামিনীদের জার সেবন ধর্মচ্যূতির প্রধান কারণ। এটি ভয়াবহ এবং সর্ব্বত্র নিন্দিত। আমার নামশ্রবণ, আমাকে ধ্যান ও আমার গুণকীৰ্ত্তন করলে আমার যেমন প্রীতি জন্মে, আমার নিকটে থাকলে তেমন জন্মে না । অতএব তোমরা ঘরে ফিরে যাও । গোপাঙ্গনারা শ্রীকৃষ্ণের এই অপ্রিয়বাক্য শুনে ভগ্ন মনোরথ ও বিষন্নমনে দুৰ্ব্বার চিন্তায় নিমগ্ন হলেন । শোকে তাঁদের ঘন ঘন নিশ্বাস বইতে লাগল, কারো বিম্বাধর শুকিয়ে গেল ।

 

যাঁরা স্বামিপুত্র আদি সৰ্ব্বস্ব পরিত্যাগ করে এসে শ্ৰীকৃষ্ণের সঙ্গলাভে সমুৎসুক হয়েছিলেন, তাঁরা যখন শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে শত্রুর মত এইরকম অপ্রিয় কথা শুনলেন, তখন ঈষৎ কুপিত হয়ে তাঁদের কণ্ঠরোধ হল। তাঁরা অশ্রুসিক্ত- লোচন মার্জন করে গদগদ বাক্যে বলতে লাগলেন, " হে কৃষ্ণ! এমন নিষ্ঠুর বাক্য বলা তোমার উচিত হয়নি। আমরা সমস্ত বিষয়বিভব পরিত্যাগ করে তোমার পদতল আশ্রয় করেছি। যেমন আদিপুরুষ মুমুক্ষুদেরকে গ্রহণ করে থাকেন, তেমনি তুমিও আমাদেরকে গ্ৰহণ কর। পতি, পুত্র ও বন্ধুর সেবা করাই স্ত্রীলোকের স্বধৰ্ম্ম, তুমি যে এই উপদেশ দিয়েছ, আমরা তাই করি ; কারণ আমরা তোমাকে সেবা করলেই আমাদের পতিপুত্রদের সেবা করা হবে । কারণ তুমিই শরীরীদের প্রিয়তমবন্ধু, আত্মা ও নিত্যপ্রিয় । শাস্ত্রকুশল ব্যক্তিরা তোমাতেই প্রেম করে থাকেন ।

 

পতিপুত্রাদি দুঃখদায়ক, আমরা তাদেরকে নিয়ে কি করব ? হে পরমেশ্বর! আমাদের প্রতি প্ৰসন্ন হও । অনেক দিন থেকে যে আশা হৃদয়ে পোষণ করে আসছি, তা ছেদন করনা । আমাদের যে চিত্ত, যে করদ্বয় এতকাল স্বচ্ছন্দে গৃহকার্য্যে রত ছিল, তুমি তা হরণ করেছ। তোমার পাদমূল ছেড়ে যেতে আমাদের একপাও চলে না । অতএব ব্রজে ফিরে গিয়ে কি করব ? যদি তুমি আমাদের প্রতি প্রসন্ন না হও, তাহা হলে  ধ্যানযোগে আমরা তোমার পাদমূল প্রাপ্ত হব । হে অম্বুজাক্ষ ! তোমার পদতল কমলার আনন্দ উৎপাদন করে, তোমার সেই পদতল আমরা যে অবধি স্পর্শ করেছি এবং অরণ্যের মধ্যে তুমি যে অবধি আমাদেরকে আনন্দিত করেছ, সেই অবধি আমরা অন্যের কাছে থাকতে পারি না ।

 

আমরা তোমার উপাসনা করব বলে এসেছি। তোমার সুন্দর হাসি নিরীক্ষণ করে আমাদের তীব্ৰ কামাগ্নি উদ্দীপিত হয়েছে । হে পুরুষশ্ৰী ! আমাদেরকে দাসী হতে দাও । ত্রিলোকের মধ্যে এমন কোন কামিনী আছে যে, তোমার মধুর পদরূপ অমৃতময় বেণুগীতে মোহিত হয়ে বিচলিত না হয় । তোমার এই ত্ৰৈলোক্য মোহনরূপ নিরীক্ষণ করে গো, পক্ষী, বৃক্ষ এবং মৃগগণেরও রোমাঞ্চ হয়ে থাকে। যেমন আদিপুরুষ দেবলোকের রক্ষক হয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তুমি তেমনি ব্রজের পীড়া - অপহারী হয়ে জন্মগ্রহণ করেছ। আমাদেরকে ত্যাগ করনা, আমরা তোমার বিরহে ক্ষণকালও জীবিত থাকব না ।" ভগবান কৃষ্ণ ব্রজাঙ্গনাদের এরূপ কাতরোক্তি শুনে তাঁদেরকে নিয়ে ক্রীড়া করাতে লাগলেন । তখন ভগবান কৃষ্ণ এই ব্রজাঙ্গনাদের মধ্যে তারকামণ্ডলী পরিবৃত শশধরের ন্যায় শোভা পেতে লাগলেন।

 

শ্ৰীকৃষ্ণ শতবনিতার মধ্যে যুথপতি হয়ে কখনো স্বয়ং গান, কখনো বা গানশ্রবণ, কখনো বা বৈজয়ন্তীমালা ধারণ করে অরণ্যানী শোভিত করে বিচরণ করতে লাগলেন। কালিন্দীর সেই জ্যোৎস্নান্বিত- পুলিন, শীতল বালুকারাশিতে পরিপূর্ণ ছিল, কুমুদগন্ধ সুশীতল গন্ধবহ সেখানে মন্দ মন্দ ভাবে প্রবহমাণ । শ্ৰীকৃষ্ণ সেই মনোহর পুলিনে প্রবেশ করে গোপাঙ্গনাদের সঙ্গে  বাহু প্রসারণ করে আলিঙ্গন, এবং কর, অলক, উরু, নীবি, ও স্তনস্পর্শ করলেন, এবং তাঁদের সঙ্গে পরিহাস, তাঁদের অঙ্গে নখাগ্রপাত, ক্রীড়া, কটাক্ষ বিক্ষেপ ও হস্ত দ্বারা মদন উদ্বোধিত করে তাঁদেরকে বিহার করাতে লাগলেন । তখন অনাসক্তচিত্ত ভগবানের কাছে এইরকম মান লাভ করে গোপিকারা অতিশয় মানিনী হয়ে উঠলেন এবং নিজেদেরকে পৃথিবীর যাবতীয় স্ত্রীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ বোধ করতে লাগলেন।

 

দর্পহারী ভগবান তাঁদের সেই সৌভাগ্যগৰ্ব্ব ও অভিমান দর্শন করে তা খৰ্ব্ব ও শাস্তি বিধান করবার জন্য সেই স্থানেই তিরোহিত হলেন । গোপিকাগণ  সহসা শ্রীকৃষ্ণকে অস্তৰ্হিত হতে দেখে যুথপতির অদর্শনে করিণীগণ যেরূপ ব্যাকুল হয়, সেইরূপ ব্যাকুল হয়ে তাঁর অন্বেষণ করতে লাগলেন। গতি, অনুরাগ, হাস্য, বিভ্ৰমদৃষ্টি, মনোরম আলাপ, বিলাস ও বিভ্রম দ্বারা প্রমদাগণের চিত্ত আকৃষ্ট হওয়াতে তাঁরা তাদাত্ম্য প্রাপ্ত হয়েছিলেন। এখন তাঁরা শ্ৰীকৃষ্ণকে না পেয়ে ভগবান কৃষ্ণের বিবিধ চেষ্টা অনুকরণ করতে লাগলেন । প্রিয়ের গতি, অনুরাগ হাস্য, বিলোকন ও আলাপ আদিতে প্রিয় সকলের মূৰ্ত্তি আবিষ্ট হয়েছিল, অতএব তাঁদের বিহার ও বিভ্রম শ্রীকৃষ্ণের মতই হল। সুতরাং সকলেই কৃষ্ণাত্মিকা হয়ে পরস্পর আমিই এই ‘কৃষ্ণ' এই রকম বলতে লাগলেন।

 

নবদূর্বাদল শ্যামকে খুঁজতে খুঁজতে তাঁরা একসময় দেখতে পেলেন শ্রীকৃষ্ণের পদচিহ্ন। কৃষ্ণের পদচিহ্নের পাশে পাশে এ কোন রমণীর পায়ের ছাপ! এ তো শ্রীরাধিকা! আমাদের শ্যাম তবে রাধাকে নিয়ে অন্তর্হিত হয়েছেন? শ্রীকৃষ্ণ রাধারাণীকে নিয়ে গভীর বনমধ্যে কোথায় হারিয়ে গেলেন? পরম সৌভাগ্যবতী রাধা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে একাই রাসলীলার আনন্দ উপভোগ করলেন? কৃষ্ণকে একা পেয়ে রাধার মনেও বড় অহংকার হল। আমি তাহলে অন্য গোপীদের চাইতেও সৌভাগ্যবতী যে শ্যামকে একা পেলাম! তাই শ্রীরাধিকা শ্যামকে বললেন, ‘’ওগো শ্যাম, আমার প্রাণাধিক, এতখানি হেঁটে এসে আমি বড় ক্লান্ত। আমার পা আর চলছে না। দয়া করে আমাকে তোমার কাঁধে তুলে নাও।‘’

 

 শ্যাম এবার মুচকি হাসলেন। '‘এসো রাধে’' বলে রাধাকে কোলে তুলে নিলেন। এবার পথিমধ্যে রইল শুধু শ্যামের পদচিহ্ন কিন্তু সে চিহ্ন যেন অধিক গভীর। হবেই তো, কানাই যে রাধাকে কোলে তুলে নিয়েছে! কিন্তু এ সুখ রাধার কপালে সইল না। কিছুদূর এভাবে যাওয়ার পর শ্যাম আবার অন্তর্হিত হলেন। ‘’শ্যাম, শ্যাম, তুমি আমায় ফেলে কোথায় গেলে?’’— রাধারাণী এ শোক সইতে না পেরে জ্ঞান হারালেন। সেই মূহুর্তে গোপীরা খুঁজতে খুঁজতে রাধাকে একা অচৈতন্য অবস্থায় পেয়ে অবাক হয়ে গেলেন। রাধার জ্ঞান ফিরলে তাঁরা সকলে মিলে রোদন করতে করতে ফিরে গেলেন যমুনার তীরে। কৃষ্ণের ধ্যান করতে করতে তাঁরা গাইতে লাগলেন "গোপিকা গীত"।

ক্রমশ…