🍁সাধ্য সাধন তত্ত্ব🍁

🦚💐🏵️🌺🌹🌺🏵️💐🦚

🍇খুব গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়🍇

শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ

সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম I

‘’হরি - গুরু - বৈষ্ণব তিনিহেঁ স্মরণ।

তিনেহেঁ স্মরণ হইতে বিঘ্ন বিনাশন।।

অনায়াসে হয় নিজ বাঞ্ছিত পূরণ ।।‘’

 

নমস্ত্রিকাল - সত্যায় জগন্নাথ সুতায় চ।

স - ভৃত্যায় স -পুত্রায় স - কলত্রায় তে নমঃ।।

‘’অনর্পিতচরীং চিরাৎ করুণয়াবতীর্ণঃ কলৌ 
সমর্পয়িতুং উন্নতোজ্জ্বলরসাং স্বভক্তিশ্রিয়ং। 
হরিঃ পুরটসুন্দর দ্যুতিকদম্ব সন্দীপিতঃ 
সদা হৃদয়কন্দরে স্ফুরতু যঃ শচীনন্দন I I’’     (বিদগ্ধ মাধব )
অর্থাৎ,- যে উন্নতোজ্জ্বল মধুর রস জগতে কখন অর্পিত হয় নাই, সেই স্বীয় ভক্তিসম্পদ প্রদান করিবার জন্য যিনি করুণা করিয়া এই কলিযুগে অবতীর্ণ হইয়াছেন ; যাঁহার দেহদ্যুতি কনককান্তি হইতেও অতি উজ্জ্বল শোভাযুক্ত, সেই শচীনন্দন হরি (সিংহ) তোমাদের হৃদয়কন্দরে সর্বদা প্রকাশিত থাকুন। 

রায় রামানন্দের সঙ্গে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সাধ্য সাধন বিষয়ে কথোপকথন।

🍁 চতুর্থ পর্ব্ব 🍁

 ''ললিতাদি সখী তার কায়ব্যুহ রূপ।।

রাধা প্রতি কৃষ্ণস্নেহ সুগন্ধি উদ্বর্ত্তন।

তাহে সুগন্ধ দেহ উজ্জল বরণ।।''

''লাবণ্যামৃত রাধার তদুপরি স্নান।

নিজ লজ্জা শ্যাম পট্টসাটি পরিধান।। 

সৌন্দর্য্য কুঙ্কুম সখী প্রণয় চন্দন।

স্মিতকান্তি কৰ্পূর অঙ্গে বিলেপন।।

কৃষ্ণের উজ্জল রস মৃগমদ ভর।

সেই মৃগমদে বিচিত্র কলেবর।।''

''ধীরাধাপাত্মক গুণ অঙ্গে পট্রবাস।।

রাগ তাম্বুল রাগে অধর উজ্জ্বল।

প্রেম কৌটিল্য নেত্রযুগলে কজ্জল।। 

সুদীপ্ত সাত্বিক ভাব হর্ষাদি সঞ্চারী।

এই সব ভাব ভূষণ সব অঙ্গে ভরি।।

''গুণ শ্রেণি পুষ্পমালা সৰ্ব্বাঙ্গে পূরিত।।

সৌভাগ্য তিলক চারু ললাটে উজ্জ্বল।

প্রেম বৈচিত্র রত্ন হৃদয় তরল।।

''কৃষ্ণ লীলা মনোবৃত্তি সখী আশ পাশ।। 

নিজাঙ্গ সৌরভালয়ে গৰ্ব্ব পর্যঙ্ক।

তাতে বসি আছে সদা চিন্তে কৃষ্ণসঙ্গ।।

কৃষ্ণকে করায় সোমরস মধুপান।

নিরন্তর পূর্ণ করে কৃষ্ণের সর্বকাম।। 

কৃষ্ণের বিশুদ্ধ প্রেম রত্বের আকার। 

অনুপম গুণগণ পূর্ণ কলেবর।।''      ( চৈতন্য চরিতামৃত )

রাধা কৃষ্ণের স্বরূপ ও প্রেমরসাদির ব্যাখ্যা শ্রবণ করে চৈতন্য বললেন,- ''রাধাকৃষ্ণের প্রেমতত্ত্ব অবগত হলাম, এখন তাঁদের বিলাস মহত্ত্ব বর্ণনা কর। রামানন্দের কথা শেষ হলে চৈতন্য আবার জিজ্ঞাসা করলেন,-

''প্রভু কহে এই হয়, আগে কহ আর।

রায় কহে এই বই বুদ্ধি নাই আর।। 

যেবা প্রেম বিলাস বিবৰ্ত্ত এক হয়।

তাহা শুনি তোমার সুখ হয় কি না হয়।।''

রামানন্দ বললেন,- ''হে প্রভু ! শুধু একটি কথা মনে পড়ছে, সেই কথাটি বললেই আমার বলার শেষ হয়, কিন্ত সন্দেহ হয়, তাতে আপনার চিত্ত - বিনোদন হবে কি না।''

মহাপ্ৰভু ব্যগ্ৰ হয়ে বললেন,- রামরায় ! বল বল, সেই রাধা কৃষ্ণের বিলাস - বিবৰ্ত্তের কথা শুনতে আমার প্রাণ বড় ব্যাকুল হয়ে আছে। রামানন্দ তখন প্রেমভক্তি রসপূর্ণ স্বরচিত এক গান করতে লাগলেন। সাপ যেমন ফণা তুলে বাঁশীর তালে তালে দোলে, মহাপ্ৰভুও তেমনি ভাবে দুলে দুলে গান শুনছেন,-

''পহিলহি রাগ নয়ন ভঙ্গ ভেল।

অনুদিন বাঢ়ল অবধি না গেল।।

না সো রমণ না হম রমণী।

দুহুঁ মন মনোভাব পেশল জানি।।

এ সখী ! সো সব প্রেম কাহিনী।

কানুঠানে কহবি বিছুরহ জানি।।

না খোজলুঁ দুতী না খোজলুঁ আন ।

দুহুঁকো মিলনে মধ্যে পাঁচ বাণ।।

অব সোই বিরাগ তুহুঁ ভেলি দুতী।

সুপুরুখ প্রেম ঐছন রীতি।।

অর্থাৎ,- ''চোখের পলক পতন মুহূর্ত্তে পূর্ব্বরাগ জন্মাল। দিনে দিনে অনুরাগ বেড়ে গেল, তার সীমা রইল না। হে সখী ! সেই শ্রীকৃষ্ণ যে নায়ক এবং আমি যে নায়িকা; এই ভেদবুদ্ধি তখন তিরোহিত হয়ে গিয়েছিল। কারণ একে অপরের প্রীতি সম্পাদনের ইচ্ছা এমনই অবস্থায় এসে সমান হয়ে গিয়েছিল যে সেখানে নারী বা পুরুষের রাগ বিশেষত্ব ছিলনা ”-----ইত্যাদি।বেশীক্ষণ গান শোনার আনন্দে যদি মোহ উপস্থিত হয়ে শ্রুতিকর আলোচনার সুখে বাধা দেয়, সেই জন্য প্রভু রায় রামানন্দের মুখে হাত চাপা দিয়ে গান করতে দিলেন না। চৈতন্য বললেন,- ''সাধ্য বস্তু সমুদায় তো জানলাম, সাধন বিনা তা লাভ হয় না, লাভ করবার উপায় বলে দাও ।‘’

রামানন্দ বললেন,- সখীভাবই সাধনার সার। সখীভাব ভিন্ন আর কোন উপায়েই তা লভ্য হয় না। সখীভাবের স্থূল তাৎপর্য্য এই যে, সখীগণের প্রেম হল নিঃস্বার্থ প্রেম। সখীগণ রাধিকাকে কৃষ্ণসঙ্গ করিয়ে সন্তুষ্ট হয়। অর্থাৎ মনোবৃত্তি - রূপা সখীগণ প্রেমাধার হৃদয়কে পবিত্রস্বরূপ ঈশ্বরের মিলন করতে দিয়ে নিজেরা পরস্পর বিশুদ্ধ প্রেমে পরিপুষ্ট হয়। ঈশ্বরপ্রেম কল্পলতা সদৃশ, দয়া শ্রদ্ধা অনুরাগ আদি মনোবৃত্তি গুলি পল্লব পুষ্পলতা স্বরূপ। লতার মূলে জলসিঞ্চন করলে যেমন পুষ্পপত্র প্রফুল্লিত হয়, সেই রকম প্রাণ যখন বিশুদ্ধ প্রেমযোগে প্রেমস্বরূপ পরমেশ্বরে মিলিত হয়, তখন বুদ্ধি জ্ঞান শ্রদ্ধা ভক্তি প্রভৃতি মানসিক বৃত্তিগুলি অধ্যাত্মভাবে পরিপূর্ণ হয়ে উঠে। এই ভাবে নিস্পৃহ স্বার্থশূন্য হয়ে স্বাভাবিক অনুরাগ ভরে ভাবরসে মগ্ন থেকে যে পবিত্র স্বরূপ ঈশ্বরের শরণাপন্ন হয়, তার মনোবৃত্তিগুলি ধৰ্ম্মের অনুকূল হয়, সমস্ত ইন্দ্রিয় মধুময় ও পবিত্র হয়ে যায়। পবিত্র স্বরূপ ভগবানের সংস্পর্শে মনোবৃত্তিগুলি পবিত্র হয়ে বিশুদ্ধ প্রেমে পরমাত্মাতে রমণ করে । এই হল সখীভাবের তাৎপর্য্য। 

যা ইন্দ্রিয় বিকার জনক তা বিশুদ্ধভাব নয়। রাধাকৃষ্ণের প্রেম অপ্রাকৃত ও ঐশ্বরিক প্রেম। শ্রীরাধাকৃষ্ণের পরস্পরের প্রতি রাগ ''মঞ্জিষ্ঠারাগ'' নামে অভিহিত । মঞ্জিষ্ঠার রং জলে নষ্ট হয়না, তেমনই এই রাগও সঞ্চারিত ভাব ইত্যাদিতে নষ্ট হয়না। ঈশ্বরকে হৃদয়স্বামী রূপে প্রেমভক্তি দ্বারা উপাসনা করাই মাধুর্য্যভাবে উপাসনা। রাধিকা সাধক, কৃষ্ণ উপাস্য, এটাই রাধাকৃষ্ণের মূলভাব । কিন্তু বর্ণনা বাহুল্য ও ভ্রান্ত উপদেশে সাধনায় বিকৃতি ঘটে। চৈতন্য চরিতামৃত স্পষ্ট বলেছে,-

"সহজে গোপীর প্রেম নহে প্রাকৃত কাম।"

✿ ✿ ✿ ✿ ✿ ✿ সমাপ্ত ✿ ✿ ✿ ✿ ✿ ✿ ✿