🍁সাধ্য সাধন তত্ত্ব🍁

🦚💐🏵️🌺🌹🌺🏵️💐🦚

🍇খুব গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়🍇

শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ

সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম I

‘’হরি - গুরু - বৈষ্ণব তিনিহেঁ স্মরণ।

তিনেহেঁ স্মরণ হইতে বিঘ্ন বিনাশন।।

অনায়াসে হয় নিজ বাঞ্ছিত পূরণ ।।‘’

 

নমস্ত্রিকাল - সত্যায় জগন্নাথ সুতায় চ।

স - ভৃত্যায় স -পুত্রায় স - কলত্রায় তে নমঃ।।

রায় রামানন্দের সঙ্গে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সাধ্য সাধন বিষয়ে কথোপকথন।

🍁 তৃতীয় পর্ব্ব 🍁

ক্ষিতি (পৃথিবী), অপ্ (জল ), তেজ (অগ্নি ), মরুৎ (বায়ু ) ও ব্যোম ( আকাশ ) , এই পঞ্চভূতে রূপ , রস , শব্দ , গন্ধ ও স্পর্শ এই পঞ্চ তন্মাত্রার অস্তিত্ব কিভাবে আছে , তার বিশ্লেষণ প্রয়োজন:-

ব্যোমের একগুণ — শব্দ ।

মরুতে আছে দুইটি গুণ — শব্দ ও স্পর্শ । অর্থাৎ ব্যোমের ‘শব্দ ’ গুণটি মরুতেও আছে ।

অগ্নিতে আছে তিনটি গুণ — রূপ , শব্দ ও স্পর্শ । মরুতের শব্দ ও স্পর্শ গুণ দুইটি অগ্নিতেও বিদ্যমান ।

তেমনি জলের চারটি মাত্রা —রূপ, রস , শব্দ ও স্পর্শ । আগুনের গুণগুলি জলেও আছে ।

ক্ষিতি বা মাটিতে জলের চারটি মাত্রার ( রূপ রস শব্দ ও স্পর্শ) সাথে যুক্ত হয়েছে পঞ্চম একটি মাত্রা — ‘ গন্ধ ’ ।

সুতরাং পঞ্চভূতের মধ্যে ক্ষিতিই শ্রেষ্ঠ , কারন ক্ষিতিতে অন্য চারটি ভূতের উপাদান গুলিও বর্ত্তমান।

সেইরকম ‘শান্ত’, ‘দাস্য’ , ‘সখ্য’ , ‘বাৎসল্য’ ও ‘মধুর’ — এই পঞ্চ প্রকারের রসের স্থায়ীভাব পরস্পর রসে আছে । যেমন দাস্যে শান্তর ভাব , সখ্যরসে শান্ত ও দাস্যের ভাব আছে । বাৎসল্যে আছে শান্ত, দাস্য ও সখ্যের ভাব । আর মধুর রসে শান্ত দাস্য সখ্য ও মধুর — এই চারটি ভাবই আছে ।

সুতরাং সর্ব্ব- রসাশ্রয়ী মধুর- রসে কৃষ্ণ- প্রেমই শ্রেষ্ঠ প্রেম। এই মধুর রসাশ্রয়ী প্রেমই কান্তাপ্রেম । মহাশাস্ত্র শ্রীমদ্ভাগবতে সেইজন্য কৃষ্ণকে কান্তাপ্রেমের বশীভূত বলা হয়েছে।

‘এহ বাহ্য ’ — কথাটির অর্থ — ইহাও বাইরের কথা বা তুচ্ছ কথা। অর্থাৎ কথাটিতে কোন বিশেষত্ব নেই, আরও নিগূঢ় কিছু থাকে, তবে বলো।

মহাপ্রভুর বক্তব্যঃ—

১) যদিও বর্ণাশ্রমধর্ম প্রকৃতপক্ষে ভক্তি নয়, তথাপি বিষ্ণু উপাসনার জন্য ভক্তি পদবাচ্য হতেও পারে। তবে এটাতে কোন বিশেষত্ব নেই।

২) কৃষ্ণে কর্মার্পণ — এটাও তুচ্ছকথা, কারণ শ্রীকৃষ্ণের প্রতি সকল কর্মের ফল অর্পণের চেয়ে মূল কর্মকেই তাঁতে অর্পণ করা এমন বিরাট কিছু নয়।

৩) স্বধর্ম ত্যাগ করে শ্রীকৃষ্ণের শরণ নেওয়ার পশ্চাতে পাপমুক্তি বা ভবযন্ত্রণা হতে মুক্তির বাসনা থেকে যাওয়ায় এই ত্যাগ এমন কিছু মহান ত্যাগ নয়। সুতরাং এটাও উপেক্ষনীয়।

৪) ব্রহ্মজ্ঞানী ব্যক্তি, অর্থাৎ যিনি সর্ব্বজীবে সমদর্শী হয়ে ঈশ্বরে পরমা ভক্তি লাভ করেন, তাঁর সেই ভক্তি ( জ্ঞানমিশ্রা ভক্তি ) যত মহানই হোক , তা উত্তমা ভক্তি নয়। কারণ এই ভক্তির মূলে জ্ঞানের সর্ত থেকে যায়।

৫) জ্ঞানশূন্য ভক্তি — প্রভু কহে “এহো হয়” । হ্যাঁ, জ্ঞানের ইচ্ছা পর্য্যন্ত পরিত্যাগ করে সকল বিবেচনা বিরহিত হয়ে সহজাত প্রবৃত্তিবশে ভগবানের গুণমুগ্ধ ভক্তের ভক্তিতে ভগবৎ প্রাপ্তি সম্ভব হতে পারে।

৬) জ্ঞানশূন্য ভক্তির চেয়ে প্রেমভক্তিতে কৃষ্ণনিষ্ঠা -রূপ প্রেম থাকে। সুতরাং এই ভক্তিতেও ঈশ্বরলাভ সম্ভব হতে পারে।

৭) দাস্যপ্রেমেও কৃষ্ণলাভ হয়, তবে দাস্যপ্রেমও উত্তম সাধ্য নয়। কারণ সেবাময় হলেও দাস্যপ্রেম সঙ্কোচহীন হতে পারেনা।

৮) দাস্যপ্রেম থেকে সখ্যপ্রেম উত্তম। কারণ সখ্যপ্রেমে ঈশ্বরের বিরাটত্ব- বোধক সঙ্কোচ থাকেনা, সমতাবোধ থাকে ।

৯) সখ্যপ্রেম হতে বাৎসল্য প্রেম উত্তম। কারণ বাৎসল্য প্রেমে ঈশ্বরকে নিজ অপেক্ষা কনিষ্ঠ জ্ঞানে তাড়ন, ভর্ৎসন ইত্যাদি করতেও কোন বাধা থাকেনা। 

চৈতন্য বললেন,- “হে রামানন্দ ! কান্তাভাব শ্রেষ্ঠ সাধন নিশ্চয় বুঝলাম, যদি এর থেকেও উচ্চ সাধন থাকে, আমাকে অনুগ্রহ করে বল”।

রায় বললেন,-  “এর থেকেও উচ্চ সাধন জানতে ইচ্ছা করে, এই রকম লোক পৃথিবীতে আছে বলে জানতাম না । কান্তাভাবে গোপীদের মধ্যে শ্রীরাধার প্রেমই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ।”

“প্ৰভু কহে এই সাধ্যাবধি সুনিশ্চয় ।

কৃপা করি কহ যদি আগে কিছু হয় ৷।

রায় কহে ইহার আগে পুছে হেন জনে।

এতদিন নাহি জানি আছয়ে ভুবনে ৷।

ইহার মধ্যে রাধার প্রেম সাধ্য শিরোমণি ।

যাঁহার মহিমা সর্ব্বশাস্ত্রেতে বাখানি ।। ”

রায় বললেন,-  “মহাভাব প্রেমলীলা সাধনার চরম। এর থেকে আর শ্রেষ্ঠ সাধন নাই । ”

চৈতন্য বললেন,-  “তোমার মুখে অপূর্ব্ব অমৃত - ধারা প্রবাহিত হচ্ছে । আমি যে কারণে তোমার কাছে এসেছিলাম, তা সফল হয়েছে । আরও কিছু বল আমি শুনি । রাধাকৃষ্ণের স্বরূপ কি, এবং কাকে কোন রস কোন প্রেম বলে, এই সব তত্ত্ব তুমি বিস্তারিত ভাবে বল , আমি শুনে সুখী হই । "

“প্ৰভু কহে আগে কহ শুনিতে পাই সুখে ।

অপূৰ্ব্ব অমৃত নদী বহে তোমার মুখে ॥

 “প্রভু কহে যে লাগি আইলাম তোমা স্থানে ।

সেই সব তত্ত্ব বস্তু হইল মোর জ্ঞানে ॥

এবে জানিল সেবা সাধন নির্ণয় ।

আগে আর আছে কিছু শুনিতে মন হয় ॥

কৃষ্ণের স্বরূপ কহ রাধার স্বরূপ।

রস কোন তত্ব, প্রেম কোন তত্ত্বরূপ ॥

কৃপা করি এই তত্ত্ব কহত আমারে ।

তোমা বিনা কেহ ইহা নিরূপিতে নারে ॥”

রায় বললেন,- " সৎ চিৎ আনন্দই কৃষ্ণের স্বরূপ। তিনি সকল কারণের মূল কারণ, অনাদি পুরুষ, সৰ্ব্বৈশ্বৰ্য্য -পরিপূর্ণ, সৰ্ব্ব- শক্তিমান, এবং সর্ব্বরস- স্বরূপ । "

“সচ্চিদানন্দ তনু  ব্রজেন্দ্র নন্দন ।

সৰ্ব্বৈশ্বৰ্য্য সৰ্ব্বশক্তি  সৰ্ব্ব রসপুর্ণ ॥

সচ্চিদানন্দময় কৃষ্ণের স্বরূপ ।

অতএব স্বরূপ শক্তি হয় তিনরূপ ॥”

সচ্চিদানন্দ কৃষ্ণের স্বরূপ, তাঁহার স্বরূপ- শক্তিও তিন প্রকার। হ্লাদিনী, সন্ধিনী ও সম্বিৎ ।

“আনন্দাংশে হ্লাদিনী সদংশে সন্ধিনী ।

চিদংশে সম্বিৎ যারে জ্ঞান করি মানি ॥”

যে শক্তিতে ভক্তচিত্তে আনন্দ বিধান করেন, তাহার নাম হ্লাদিনী শক্তি । এই হ্লাদিনীর নাম প্রেম, প্রেমের সার মহাভাব , এই মহাভাবই শ্রীরাধিকার স্বরূপ ।

“কৃষ্ণকে আহ্লাদে তাতে নাম আহ্লাদিনী ।

সেইশক্তি দ্বারে সুখ আস্বাদে আপনি ॥

সুখরূপ কৃষ্ণ করে সুখ আস্বাদন ।

ভক্তগণে সুখ দিতে হ্লাদিনী কারণ ॥

হ্লাদিনীর সার অংশ তার প্রেম নাম ।

আনন্দ চিন্ময়রূপ রসের আখ্যান ॥  

প্রেমের পরম সার মহাভাব জানি ।

সেই মহাভাব- রূপা রাধা ঠাকুরাণী ॥”

এই মহাভাবময়ী রাধিকার প্রতি ভগবানের স্নেহ সুগন্ধি দ্রব্যের ন্যায়। এই ভগবৎ স্নেহরূপ সুগন্ধি দ্রব্যের সুঘ্রাণ রাধিকার অঙ্গের উজ্জ্বল বর্ণ। এই সুগন্ধিপূর্ণ উজ্জ্বল -দেহ ভগবৎ- কৃপারূপ অমৃতরসে স্নাত হয়, পরে হরির লাবণ্যামৃত রস তার উপরে বর্ষিত হয়।

এই ভাবে মহাভাব- রূপা রাধিকা সচ্চিদানন্দ- ময় রূপরসে যখন অভিষিক্ত হলেন , অর্থাৎ পরস্পরের দর্শনে প্রেম উচ্ছসিত হয়ে লজ্জা এসে মহাভাবকে আচ্ছাদিত করল, এই লজ্জাই রাধিকার পট্টবসন।

তাঁর অঙ্গবিলেপন হল আপন সৌন্দর্য্য রূপ কুঙ্কুম , সখীদের প্রণয়রূপ চন্দন এবং আপন স্মিত হাসির কর্পূর । তাঁর অঙ্গ বিচিত্রিত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণের মধুর উজ্জ্বলরস কস্তূরীতে ।

কুঞ্চিত কেশদাম যেমন খোঁপায় বিন্যস্ত করলে গুপ্ত হয়ে থাকে, তেমনই শ্রীরাধার প্রচ্ছন্ন মান তাঁর খোঁপার বিন্যাস। প্রণয়মান বক্ষ আচ্ছাদিনী কঞ্চুলিকা। অনুরাগ অধরের তাম্বুলরাগ, হর্ষ পুলকাদি সাত্বিক ও সঞ্চারী গুণ সকল দেহের ভূষণ।

এই ভাবভূষণে ভূষিতা, গুণশ্রেণীরূপ পুষ্পমালা ও সৌভাগ্যরূপ তিলক ধারিণী প্রেমের সার মহাভাবরূপ রাধিকা হরিলীলার অনুকূল মনোবৃত্তি রূপা সখীগণ দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে নিজ অঙ্গের সৌরভালয়ে , গর্বের পর্য্যঙ্কে উপবিষ্ট হয়ে সৰ্ব্বদা - হরিসঙ্গ লাভ চিন্তাতে মগ্ন আছেন। প্রাণনাথের নাম গুণ যশ মহিমা শ্রবণ কীৰ্ত্তনই তাঁর কাজ । তিনি বিশুদ্ধ প্রেম রত্নাকর হৃদয়েশ্বরকে প্রেমরূপ সোমরস পান করিয়ে তাঁর সকল কামনা পূর্ণ করেন ।

ক্রমশ…