🌷উদ্ধব সংবাদ🌷

💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐

🍇বিশেষ পোষ্ট🍇

শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ

সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম I

''হরি - গুরু - বৈষ্ণব তিনিহেঁ স্মরণ।

তিনেহেঁ স্মরণ হইতে বিঘ্ন বিনাশন।।

অনায়াসে হয় নিজ বাঞ্ছিত পূরণ ।।''

 

যৎকীর্ত্তনং যৎস্মরণং যদীক্ষণং

যদ্বন্দনং যচ্ছ্রবনং যদর্হণম্ । 

লোকস্য সদ্যো বিধুনোতি কল্মষং

তস্মৈ সুভদ্রশ্রবসে নমো নমঃ ।।  (ভাগবত ২/৪/১৫)

অর্থাৎ,- আমি সেই সর্ব মঙ্গলময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করি; যাঁর যশগাথা কীর্ত্তন, স্মরণ, দর্শন, বন্দন, শ্রবণ ও পূজনের ফলে সমস্ত পাপরাশি অচিরেই ধৌত হয়।

 

শ্রীকৃষ্ণের কৃষ্ণাষ্টক শ্লোক

কথিত আছে, এই শ্লোক নিত্য পাঠ করলে কোটি জন্মের পাপ বিনষ্ট হয়।

 

☞বসুদেব সুতং দেবং কংস চাণূর মর্দনম।

দেবকী পরমানন্দং কৃষ্ণং বন্দে জগদ্গুরুম।। ১।।

অতসী পুষ্প সঙ্কাশং হার নূপুর শোভিতম |

রত্ন কঙ্কণ কেয়ূরং কৃষ্ণং বন্দে জগদ্গুরুম ||২॥

কুটিলালক সংয়ুক্তং পূর্ণচংদ্র নিভাননম।

বিলসত কুংডলধরং কৃষ্ণং বন্দে জগদ্গুরম ||৩॥

মংদার গংধ সংয়ুক্তং চারুহাসং চতুর্ভুজম।

বর্হি পিংছাব চূডাঙ্গং কৃষ্ণং বন্দে জগদ্গুরুম ||৪॥

উত্ফুল্ল পদ্মপত্রাক্ষং নীল জীমূত সন্নিভম।

য়াদবানাং শিরোরত্নং কৃষ্ণং বন্দে জগদ্গুরুম ||৫॥

রুক্মিণী কেলি সংয়ুক্তং পীতাংবর সুশোভিতম।

অবাপ্ত তুলসী গংধং কৃষ্ণং বন্দে জগদ্গুরুম ||৬॥

গোপিকানাং কুচদ্বংদ কুংকুমাঙ্কিত বক্ষসম।

শ্রীনিকেতং মহেষ্বাসং কৃষ্ণং বন্দে জগদ্গুরুম ||৭॥

শ্রীবত্সাঙ্কং মহোরস্কং বনমালা বিরাজিতম।

শঙ্খচক্র ধরং দেবং কৃষ্ণং বন্দে জগদ্গুরুম ||৮॥

 

কৃষ্ণাষ্টক মিদং পুণ্য়ং প্রাতরুত্থায় য়ঃ পঠেত।

কোটিজন্ম কৃতং পাপং স্মরণেন বিনশ্য়তি।।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আজ্ঞাবহ হয়ে উদ্ধবের ব্রজপুরে আগমন I

প্রথম - পর্ব্ব

উদ্ধব বৃষ্ণিকুলের শ্রেষ্ঠ মন্ত্রী, বৃহস্পতির শিষ্য, অতিশয় মেধাবী ও বাগ্মী এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরম ভক্ত । একদিন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধবকে ডেকে তাঁর হাতে হাত রেখে বললেন, — ” হে সৌম্য! তুমি শীঘ্র ব্রজপুরে যাও। সেখানে আমার পিতা-মাতা রয়েছেন। আমার বিরহে তাঁরা কাতর হয়েছেন। আমার সংবাদ প্রদান করে তাঁদের আনন্দ উৎপাদন কর। "

— "আমার অদর্শনে গোপীদের মনঃপীড়ার সৃষ্টি হয়েছে। আমার সংবাদ শ্রবণ করিয়ে তাদেরও বেদনা নাশ কর। গোপীগণ আমার প্রাণ, তাদের মন আমাতেই অর্পিত । তারা আমার জন্য স্ত্রী-পুত্রাদি ত্যাগ করেছে। আমিই তাদের প্রাণ, আমিই তাদের দয়িত, শ্রেষ্ঠ ও আত্মা। তারা মনোদ্বারা আমাকে প্রাপ্ত হয়েছে। যে সকল ব্যক্তি তাদের ঐহিক ও পারত্রিক সুখ বিসর্জন দিয়েছে আমি তাদেরকে পালন করি। উদ্ধব ! গোপীরা প্রিয়তম যাবতীয় বস্তুর মধ্যে আমাকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসে। আমি দূরে অবস্থান করায় সকল গোপীগণ আমাকে স্মরণ করে আমার বিরহজনিত উৎকন্ঠায় কাতর হচ্ছে। আমি যে আবার ফিরে আসব বলেছিলাম , এ কথা স্মরণ করে নিশ্চয়ই তারা অতিকষ্টে কোনরূপে জীবন ধারণ করে আছে।” 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিকট হতে সন্দেশ বাক্য শ্রবণ করে উদ্ধব রথে আরোহন করে নন্দের গোকুলে যাত্রা করলেন। তিনি যখন ব্রজপুরে আগতপ্রায়, তখন সূর্য পশ্চিমদিকে অস্ত যাচ্ছে । গোষ্ঠ থেকে গাভীদের নিয়ে গোপ বালকেরা ঘরে ফিরে আসছে । গাভীদের খুরের দ্বারা উত্থিত ধূলিতে চারিদিক আচ্ছন্ন হচ্ছে। পুষ্পবতী গাভীদেরকে দেখে ব্রজের মত্ত বৃষগণ যুদ্ধ করছে। উদর ভারাক্রান্ত গাভীগণ বৎস পালকদের নিকট দৌড়ে আসছে। শুভ্র গো-বৎসেরা ইতস্ততঃ ছুটাছুটি করে ব্রজভূমির শোভা বর্ধন করছে। চারিদিকে গো-দোহনের শব্দ হচ্ছে, তার মধ্যে “ত্যাগ কর, আনো, কর, দাও” ইত্যাদি শব্দ শোনা যাচ্ছিল। 

সুসজ্জিত গোপ-গোপীগণ রাম ও কৃষ্ণের গুণগাথা গাইছে এবং ব্রজভূমি তাদের দ্বারা শোভিত হচ্ছে। অগ্নি, সূর্য, অতিথি, গো, ব্রাহ্মণ, পিতৃ ও দেবগণ গোপদের ঘরে ঘরে অর্চিত হচ্ছেন। তাদের গৃহগুলি ধূপ-দীপে অপরূপ শোভা ধারণ করেছিল। ব্রজের চারিদিকের পুষ্পিত বন হতে কুসুমের সৌরভ ছড়াচ্ছে। পাখীরা ও ভ্রমরগণ সেখানে খেলা করছে। পদ্মবনে সন্তরনরত হংস ও সারসেরা সমধিক শোভা বিস্তার করছিল। 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অনুচর উদ্ধবকে আসতে দেখে শ্রীনন্দরাজ আনন্দে তাঁর নিকটে গেলেন এবং আলিঙ্গন করে শ্রীকৃষ্ণ জ্ঞানেই তাঁকে অর্চন করলেন। তারপর নন্দ উদ্ধবকে গৃহে নিয়ে গিয়ে পরমান্ন ভোজন করালেন। ভোজনের পর পাদসম্বাহন দ্ধারা উদ্ধবের শ্রম দূরীভূত হলে নন্দ বললেন,“ — হে মহাভাগ! আমার সখা বসুদেব কারামুক্ত হয়ে পুত্র এবং সুহৃদগণ সহ কুশলে আছেন তো? পাপাত্মা কংস সর্বদাই সাধুগণকে ও যদুগণের প্রতি দ্বেষ করত। ভাগ্যক্রমে সে দূরাত্মা নিজ পাপে অনুচরগণ সহ নিহত হয়েছে। হে উদ্ধব! শ্রীকৃষ্ণ কি আমাদেরকে এবং তার মাতাকে স্মরণ করেন ? তার সুহৃদ-সখা গোপগণকে কি স্মরণ করেন ? তিনি নিজে যার নাথ সেই ব্রজ, গাভী, বৃন্দাবন ও গোবর্দ্ধন কি তাঁর মনে পড়ে?"

"হে উদ্ধব ! বাসুদেব কি একবার স্বজনদের দর্শন করার জন্য গোকুলে আসবেন? তাঁর সুন্দর নাসিকাযুক্ত সহাস্য বদন আমরা দেখতে পাব কি? মহাত্মা শ্রীকৃষ্ণ আমাদেরকে দাবানল, প্রবল বাত্যা, বর্ষা, বৃষ, সর্প এবং অন্যান্য দুরতিক্রমণীয় মৃত্যু হতে রক্ষা করেছেন। শ্রীকৃষ্ণের সেই সকল বিবিধ বীর্য, লীলাসমূহ, বক্রদৃষ্টি, হাস্য ও বাক্য স্মরণ করলে আমাদের যাবতীয় কার্য নিস্তেজ হয়ে আসে। গোবিন্দের পদচিহ্নিত স্থানসমূহ দর্শন করলে আমাদের মন তন্ময় হয়ে উঠে। গর্গমুনির বচন শ্রবণে এই মনে হয় যে, রাম-কৃষ্ণ দুজনেই শ্রেষ্ঠ দেবতা।"

নন্দ মহারাজ বলছেন, "হে সৌম্য ! গর্গ মুনি বলেছেন যে, দেবগণের মহাপ্রয়োজন সিদ্ধ করার জন্য শ্রীকৃষ্ণ ধরাতলে অবতীর্ণ হয়েছেন। পশুরাজ সিংহ যেমনভাবে পশুদেরকে বধ করে, রাম-কৃষ্ণ তেমনিভাবে অবলীলাক্রমে দশ সহস্র মত্ত হস্তীর বলশালী কংসকে এবং প্রখ্যাত দুই মল্লকে এবং গজপতিকে, নিহত করলেন। গজরাজ যেমন অনায়াসে যষ্টি ভঙ্গ করে তেমনি কংসের তালবৃক্ষ সম (প্রায় সত্তর হাত লম্বা) সুকঠিন ধনু ভঙ্গ করেন। যখন ব্রজনগরী বৃষ্টির কারণে বিধ্বস্ত হচ্ছিল, তখন শ্রীকৃষ্ণ সপ্তাহকাল ব্যাপী এক হাতে প্রকাণ্ড গিরি পর্বত ধারণ করে রেখেছিলেন। প্রলম্ব, ধেনুক, অরিষ্ট, তৃণাবর্ত্ত, বক প্রভৃতি বিখ্যাত দৈত্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের হাতে নিহত হয়েছে।"

কৃষ্ণের এ সকল বীরত্বগাথা কাহিনী স্মরণ করে, আবেগ আপ্লুত হয়ে কৃষ্ণগত- প্রাণ নন্দরাজের কন্ঠ জড়িত হয়ে আসছিল, চোখ অশ্রুপূর্ণ হয়ে উঠছিল। পুত্রের বিচিত্র চরিত্র শ্রবণ করে মা যশোদার নয়নও অশ্রুপূর্ণ হলো এবং পুত্রস্নেহে তাঁর স্তন হতে দুগ্ধক্ষরণ হতে লাগল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি নন্দ-যশোদার এইরকম গাঢ় অনুরাগ দেখে উদ্ধব আনন্দে বললেন,- “হে নন্দরাজ ! ইহলোকে তোমরা দুজনেই ঈর্শনীয় কারণ অখিলগুরু নারায়ণে তোমাদের এত মতি রয়েছে। রাম ও কৃষ্ণ পরম পুরুষ ও প্রকৃতি; বিশ্বের বীজ; অনাদি। ভূতগণে প্রবিষ্ট হয়ে তদুপহিত বিবিধ ভেদ ও জীবের নিয়ন্তা তাঁরাই। লোকে প্রাণত্যাগ কালে ক্ষণকাল মাত্র যাঁর প্রতি বিশুদ্ধ ও অবিশুদ্ধ মন সমাবেশিত করে কর্মবাসনা অগ্নিতে আহুতি দিয়ে স্বরূপজ্ঞানবান ও শুদ্ধসত্ত্বমূর্তি হয়ে পরাগতি প্রাপ্ত হতে পারে, যিনি অখিলের আত্মা ও কারণ এবং প্রয়োজনবশে যিনি অবতাররূপ গ্রহণ করেন, তোমরা দুজনেই সেই ভগবান নারায়ণে একান্ত ভক্তি করছ, অতএব তোমাদের নিজ কার্যের আর কি অবশিষ্ট আছে ?

হে গোপরাজ ! ভগবান যাদবপতি শ্রীকৃষ্ণ শীঘ্রই ব্রজে আসবেন এবং পিতামাতার প্রিয় সাধন করবেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তোমাদের কাছে যা বলেছিলেন, তা তিনি সত্য করবেন। তোমরা দুঃখ কোর না, অচিরেই তিনি ব্রজে আসবেন। কাষ্ঠের মধ্যে অগ্নির ন্যায় তিনি সকলের অন্তরে বিরাজ করেন। তিনি সকলের প্রতি সমদর্শী, তিনি অভিমানশূন্য, কেউ তাঁর প্রিয় বা অপ্রিয় নয়, কেউ তাঁর উত্তম নয় বা অধম নয়। তাঁর পিতা, মাতা, ভার্যা, পুত্রাদি, অথবা আত্মীয়-অনাত্মীয়, দেহ, জন্ম কিছুই নেই। তাঁর কোন কর্মও নেই। তিনি জন্মরহিত হয়েও ক্রীড়াবশে সাধুগণের রক্ষার্থে সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক যোনিতে অথবা দেবতা, মৎস্যাদি ও নৃসিংহাদি যোনিতে আবির্ভূত হয়ে থাকেন। তিনি ক্রীড়াতীত ও গুণাতীত হয়েও ক্রীড়া করে সত্ত্ব, রজঃ ও তম গুণের ভজনা করেন এবং সে গুণ দ্বারাই সৃজন, পালন ও ধ্বংস করেন। কুম্ভকারের ঘূর্ণায়মান চক্রে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে যেমন সমস্ত ভূমিই ঘুরছে বলে মনে হয় তেমনি চিত্ত কর্তা হলেও অহংদৃষ্টির কারণে মানব আত্মাকেই কর্তা বলে মনে করে থাকে। ভগবান হরি কেবল তোমাদেরই পুত্র নয়; তিনি সকলেরই পুত্র, আত্মা, পিতা, মাতা এবং তিনিই ঈশ্বর। ভূত, ভবিষ্যৎ , বর্তমান, স্থাবর, জঙ্গম, বড় ছোট যা কিছু দৃষ্ট ও শ্রুত হয় একমাত্র অচ্যুত ব্যতিরেকে কোন বস্তুই নেই, তিনিই ঐ সকল, তিনিই পরমাত্মাস্বরূপ।" এইভাবে নন্দ ও উদ্ধবের আলাপ চারিতায় রজনী অতিবাহিত হলো। 

ক্রমশ…