🍁সাধ্য সাধন তত্ত্ব🍁

🦚💐🏵️🌺🌹🌺🏵️💐🦚

🍇খুব গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়🍇

শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ

সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম I

‘’হরি - গুরু - বৈষ্ণব তিনিহেঁ স্মরণ।

তিনেহেঁ স্মরণ হইতে বিঘ্ন বিনাশন।।

অনায়াসে হয় নিজ বাঞ্ছিত পূরণ ।।‘’

নমস্ত্রিকাল - সত্যায় জগন্নাথ সুতায় চ।

স - ভৃত্যায় স -পুত্রায় স - কলত্রায় তে নমঃ।।

রায় রামানন্দের সঙ্গে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সাধ্য সাধন বিষয়ে কথোপকথন।

🍁 দ্বিতীয় পর্ব্ব 🍁

চৈতন্য বললেন,- ''হে রামানন্দ ! ভক্তি প্রেম এবং সাধন বিষয়ে কিছু বল, আমি শুনি।''

‘’প্রভু কহে পড় শ্লোক সাধ্যের নির্ণয়।

রায় কহে স্বধৰ্ম্মাচরণ বিষ্ণুভক্তি হয়।।''

অর্থাৎ,- বিষ্ণুভক্তিই শ্রেষ্ঠ । বিষ্ণুপুরাণে বলা হয়েছে, বর্ণাশ্রম - আচার - বিশিষ্ট ব্যক্তিই পরম পুরুষ বিষ্ণুর আরাধনা করতে পারেন, বিষ্ণুপ্রীতির অন্য পথ নেই। চৈতন্য বললেন, এ তো বাইরের কথা, আরও আগে বল।

‘’প্ৰভূ কহে এই বাহ্য আগে কহ আর ।

রায় কহে কৃষ্ণ কর্ম্মার্পণ সৰ্ব্ব সাধ্যসার।।''

রামানন্দ বললেন,- ঈশ্বরে সমুদায় সমর্পণ করাই শ্রেষ্ঠ। ভগবদ্গীতাতে শ্ৰীকৃষ্ণের উক্তি,- ‘’যৎ করোষি যৎ অস্নাসি যৎ জুহোসি দদাসি যৎ।

যৎ তপস্যসি কৌন্তেয় তৎ কুরুস্ব মৎ অৰ্পণং।।‘’

অর্থাৎ,- ‘’হে অৰ্জুন ! তুমি যা কিছু অনুষ্ঠান কর এবং যা কিছু আহার, হোম, দান এবং তপস্যা করে থাক, সেই সমস্ত আমাতে অর্পণ কর।‘’

তখন চৈতন্য বললেন,- এটাও বাইরের কথা, আরও শ্রেষ্ঠ সাধন বল।

রামানন্দ বলিলেন,- শাস্ত্রবিহিত সমুদায় ধৰ্ম্মানুষ্ঠান পরিত্যাগ করে কেবল ভক্তি সাধন করাই সার । শ্ৰীকৃষ্ণ গীতাতে বলেছেন,-

‘’সৰ্ব্বধৰ্ম্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ ।

অহং ত্বাং সৰ্ব্ব পাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচ।।‘’

অর্থাৎ,- শাস্ত্রবিধি বিহিত ধৰ্ম্মাচরণ পরিত্যাগ করে আমার শরণাপন্ন হও, আমি তোমাকে সমুদায় পাপ থেকে মুক্ত করব।

একথা শ্রবণ করে,-

‘’প্রভু কহে এহো বাহ্য, আগে কহ আর।

রায় কহে জ্ঞানমিশ্রা ভক্তি সাধ্য সার।।‘’

মহাপ্রভু বললেন,- বর্ণাশ্রমধর্ম্ম ( স্বধর্ম্ম ) ত্যাগ করে একমাত্র শ্রীকৃষ্ণের শরণ নেবার পিছনে পাপমুক্তি বা ভবযন্ত্রণা হতে মুক্তির বাসনা থেকে যায়। তাই এই ত্যাগ এমন কিছু মহান ত্যাগ নয় । সুতরাং এটাও উপেক্ষণীয় ।

রামানন্দ বললেন,- জ্ঞানমিশ্র ভক্তিই শ্রেষ্ঠ । কারণ গীতাতে বলা হয়েছে,-

‘’ব্রহ্মভুতঃ প্রসন্নাত্মা ন শোচতি ন কাঙ্ক্ষতি ।

সমঃ সৰ্ব্বেষু ভূতেষু মদ্ভক্তিং লভতে পরাম।।‘’

অর্থাৎ,- যিনি নিজেকে ব্রহ্মস্বরূপ জেনেছেন এবং শম-দম আদি সাধনের দ্বারা চিত্তশুদ্ধি লাভ করে প্রসন্নাত্মা, যিনি শোকে উদ্বিগ্ন হননা ও কোন প্রকার আকাঙ্ক্ষা করেন না , এবং যিনি সর্ব্বভূতে সমদর্শী ( অর্থাৎ তৃণ থেকে শুরু করে ব্রহ্ম পর্য্যন্ত আত্মদৃষ্টি- বশতঃ সকলই যাঁর কাছে সমান ) , তিনিই আমার পরাভক্তি ( ভক্তি, কর্ম্ম, উপাসনা ও জ্ঞানরূপ সাধন সমূহের পরিণাম- ফলস্বরূপ ভক্তি ) লাভ করে থাকেন।

চৈতন্যঃ — এহো বাহ্য, আরও শ্রেষ্ঠ সাধন থাকে তো বল।

রামানন্দঃ — ‘’তবে জ্ঞানশূন্য ভক্তিই উত্তম সাধন।‘’ কেননা ভাগবতে আছে, “জ্ঞানচর্চা না করে যাঁরা কেবল শ্রীকৃষ্ণের গুণ- কীৰ্ত্তনে রত থাকেন, তাঁরা ত্ৰিলোক বিজয়ী হন। স্বধৰ্ম্মাচরণ, স্বধৰ্ম্মত্যাগ, জ্ঞানমিশ্র ভক্তি ইত্যাদি সমুদায় সাধন বহিরঙ্গ- কথা, চৈতন্যের ভক্তিময় প্রাণ তাতে শান্ত হল না। শুষ্ক জ্ঞানালোচনা পরিত্যাগ করে কেবল হরি গুণকীৰ্ত্তনের কথা শুনবা মাত্র প্রভু বললেন,-

“প্ৰভু কহে, এই হয় আগে কহ আর ।”

ইহাও হয়, কিন্তু আরও উচ্চ সাধন বল ।

জ্ঞান ও ভক্তির সামঞ্জস্যই পূর্ণধৰ্ম্ম । নিৰ্ম্মল জ্ঞানের অবস্থাই মুক্তির অবস্থা । জ্ঞান শূন্য অন্ধ ভক্তিতে ধৰ্ম্ম -জীবনে নানা বিকৃতি ঘটার ফলে অনর্থ উপস্থিত হয় ।

রামানন্দ বললেন, প্রেমভক্তি উত্তম সাধন ।

“রায় কহে প্রেমভক্তি সৰ্ব্বসাধ্য সার ।”

যে পর্য্যন্ত উদরে বলবতি ক্ষুধা ও তৃষ্ণা বিদ্যমান থাকে, সে পর্য্যন্তই ভক্ষ্যবস্তু ও পানীয় সুখকর বলে বোধ হয়। ক্ষুধা-তৃষ্ণা থাকলে যেমন সামান্য আহার্য্যও অত্যন্ত তৃপ্তিদায়ক হয়, তেমনই বিবিধ উপচারে শ্রীকৃষ্ণের পূজা হলেও ভক্তের মন কেবল প্রেমানন্দেই দ্রবীভূত হয়ে থাকে । কিন্তু হৃদয়ে প্রেমভক্তি থাকলে কোন উপচার ছাড়া কেবল প্রেমভক্তি দিয়েই শ্রীকৃষ্ণকে পূজা করে ভক্ত প্রীতিলাভ করতে পারে ।

‘‘ভক্তিরস ভাবিতা মতি I’’ অর্থাৎ ভক্তি রসসিক্ত চিত্ত যদি কোথাও পাও ক্রয় কর, একমাত্র লালসাই তার মূল্য । কোটি জন্মের সুকৃতির দ্বারাও তা পাওয়া যায় না ।”

শ্রবণ করে চৈতন্য বললেন, “এহো হয় , আরও উপরের সাধন বল ।

রায় বললেন, দাস্য প্রেম উত্তম । শ্রীমদ্ভাগবতে অম্বরীশের প্রতি দুৰ্ব্বসার উক্তি এই ,  যাঁহার নাম শ্রবণ মাত্রেতে জীব নির্ম্মল পবিত্র হয় , তাঁর দাসদিগের আর কি অবশেষ থাকে ?  

চৈতন্য বললেন ,-  “একটু আগে বল।”

রায়ঃ— “ তবে সখ্য প্রেম সাধনার সার। ”

প্রভুঃ—“ এহো উত্তম, আর একটু উচ্চ সাধন বল ।”

রায়ঃ— “বাৎসল্য প্রেমই শ্রেষ্ঠ ”।

প্রভু বললেন ,“ ইহাও উত্তম, আরও একটু আগে বল ।”

রায় বললেন , “কান্তাভাব সাধনার সার ”।

“রায় কহে কান্তাভাব প্রেম সাধ্যসার ।”

ঈশ্বর প্রাপ্তির উপায় অনেক, যার পক্ষে যে উপায় উপযুক্ত তার পক্ষে তাই শ্ৰেষ্ঠ । পূর্ব পূর্ব রস অর্থাৎ শান্ত , দাস্য , সখ্য , বাৎসল্য রসের গুণ কান্তাভাব মাধুর্য্য রসে মিলিত হচ্ছে । ক্ষিতি, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ; এই পঞ্চভূতের গুণ যেমন পরস্পর মিলনের দ্বারা মৃত্তিকাতে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে অর্থাং শব্দ স্পর্শ রূপ রস গন্ধ এই পাঁচগুণ ক্ষিতিতে একাধারে মিলিত হয়েছে, সেইরূপ শান্ত , দাস্য , সখ্য বাৎসল্য এই চারি রস কান্তাভাবে সন্নিবিষ্ট হওয়ায় একে মাধুর্য্য রস নামে অভিহিত করা হয়েছে ।

সতী যেমন প্রাণ পতির প্রতি একান্ত অনুরাগিণী, মানব হৃদয় যখন সেই প্রকার একনিষ্ঠ হয়ে ঈশ্বরের ভজনা করে, তখন তার জীবন সার্থক হয়। এইভাবের উপাসনাকেই বৈষ্ণবগণ মাধুর্য্যভাব বলেছেন ।

“কৃষ্ণ প্রাপ্তির উপায় বহুবিধ হয়।

কৃষ্ণ প্রাপ্তি তারতম্য বহুত আছয় ॥

কিন্তু যার যেই রস সেই সৰ্ব্বোত্তম ।

তটস্থ হয়ে বিচারিলে আছে তারতম্য ॥

পূৰ্ব্ব পূৰ্ব্ব রসের গুণ পরে পরে হয় ।

এক দুই গণনে পঞ্চ পর্য্যন্ত বাঢ়য় ॥

গুণাধিক্য মাধুর্য্যাধিক্য বাড়ে সৰ্ব্বরসে ।

শান্ত দাস্য সখ্য বাৎসল্যের গুণ মধুরেতে বৈসে ।।

আকাশাদির গুণ যেন পর পর ভূতে ।

দুই ভিন গণনে বাঢ়ে পঞ্চ পৃথিবীতে ॥

পরিপূর্ণ কৃষ্ণ প্রাপ্তি এই প্রেম হইতে ।

এই প্রেমার বশ কৃষ্ণ কহে ভাগবতে ।।

ক্রমশ…

 

কে আনিল রে কোথায় ছিল রে মধুমাখা হরিনাম।।
নদীয়া নগরে শচীমাতার ঘরে,
                                     উদয় হলো নিমাই চাঁদ I I
কে আনিল রে কোথায় ছিল রে মধুমাখা হরিনাম।।

হরি নাম ভজ নাম জপ নাম করো সার I
হরিনামে ভাসাও তরী হয়ে যাবে পার।।

হরিনামে মাতোয়ারা ও ……. ও
হরিনামে মাতোয়ারা সারা ব্রজধাম।
কে আনিল রে কোথায় ছিল রে মধু মাখা হরিনাম।।

 

যতো পাপী-তাপী তরে গেল এই হরিনামে I
মুখে বলো হরিনাম শ্রবণ করো কানে।।

হরিনামে আছে সুধা ও ……… ও
হরিনামে আছে সুধা অমৃত সমান।
কে আনিল রে কোথায় ছিল রে মধুমাখা হরিনাম।।

 

বিজয় ধীবর বলছে হরিনাম ছাড়া গতি নাই I
প্রেমানন্দে বাহু তুলে হরি বলো ভাই।।

হরি নামের জলে ডুব দিলে ও ……… ও
হরি নামের জলে ডুব দিলে জুড়ায় মনপ্রাণ
কে আনিল রে কোথায় ছিল রে মধুমাখা হরিনাম।।

নদীয়া নগরে শচীমাতার ঘরে,
                                    উদয় হলো নিমাই চাঁদ I I
কে আনিল রে কোথায় ছিল রে,
                                            মধু মাখা হরিনাম।।