🍁সাধ্য সাধন তত্ত্ব🍁

🦚💐🏵️🌺🌹🌺🏵️💐🦚

🍇খুব গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়🍇

শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ

সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম I

‘’হরি - গুরু - বৈষ্ণব তিনিহেঁ স্মরণ।

তিনেহেঁ স্মরণ হইতে বিঘ্ন বিনাশন।।

অনায়াসে হয় নিজ বাঞ্ছিত পূরণ ।।‘’

নমস্ত্রিকাল - সত্যায় জগন্নাথ সুতায় চ।

স - ভৃত্যায় স -পুত্রায় স - কলত্রায় তে নমঃ।।

রায় রামানন্দের সঙ্গে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সাধ্য সাধন বিষয়ে কথোপকথন।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জীবন ও ধৰ্ম্ম বিষয়ে শ্রীবৃন্দাবন দাসের চৈতন্য ভাগবত, শ্রীলোচন দাসের চৈতন্য মঙ্গল এবং শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর লেখা চৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থগুলি রূপ, রস ও লীলা; এই তিন বিষয়ের মহা মূল্যবান আকর - স্বরূপ। চৈতন্য ভাগবতে চৈতন্য লীলা, চৈতন্য মঙ্গলে রূপ ও চৈতন্য চরিতামৃতে রস; অর্থাৎ প্রেম - ভক্তির গূঢ়তত্ত্ব ও শ্রীচৈতন্য - জীবনের জ্ঞাতব্য বিষয় সমূহ বিস্তারিত ভাবে বর্ণিত হয়েছে।

ফাল্গুন মাসে দোলযাত্রা দর্শন করে বৈশাখ মাসের শুরুতেই মহাপ্রভু দক্ষিণদেশে যেতে মনস্থ করে ভক্তদেরকে বললেন,- ‘’তোমরা আমার প্রাণের চেয়েও প্ৰিয়। তোমাদের বিচ্ছেদ আমার নিতান্ত অসহ্য হলেও আমার দাদা বিশ্বরূপের খোঁজ-খবর করবার জন্য আমি তোমাদের ছেড়ে দক্ষিণদেশে যেতে কৃতসঙ্কল্প হয়েছি। তোমরা সকলে প্ৰসন্ন চিত্তে আমাকে অনুমতি দাও।‘’ প্রভু দক্ষিণদেশে যেতে চান শুনে ভক্তগণ প্রভুর বিরহ চিন্তায় কাতর হলেন। কেউই সাহস করে কিছু বলতে পারলেন না। নিত্যানন্দ প্রভু বললেন,- ‘’শ্রীপাদ ! আপনি ইচ্ছাময়,যা ইচ্ছা হয় তাই করতে পারেন। এমন কে আছে যে আপনার ইচ্ছায় বাধা দেয় ? কিন্তু প্রভু, আমার বিবেচনায় আপনার একা যাওয়া সমীচীন হবেনা, দুই একজন ভক্তকে সঙ্গে নিন। আমি দক্ষিণ দেশের পথ ঘাট সবই জানি, ইচ্ছা হলে, আমাকেই সঙ্গে নিতে পারেন, অথবা আপনার পছন্দের কাউকে সঙ্গে নিন।‘’

প্ৰভু বলিলেন,- ‘’আমি সন্ন্যাস গ্রহণ করে শ্ৰীবৃন্দাবন যাচ্ছিলাম, তুমি কৌশল করে আমাকে ফিরিয়ে আনলে। পরে যখন নীলাচলে এলাম, তখন আমার দণ্ডটি ভেঙ্গে ফেলে দিলে ! তোমাদের অত্যধিক স্নেহে আমার কাৰ্য্যভঙ্গ হয়। এই জগদানন্দ আমাকে বিষয়ভোগ করাতে চায় ! মুকুন্দ আমার সন্ন্যাসধৰ্ম্ম দেখে দুঃখ পায় ! দামোদর সর্ব্বদা আমাকে শাসন করেন ! এইজন্যে তোমরা এই নীলাচলেই থাক, আমি যথাশীঘ্র সম্ভব সেতুবন্ধ পৰ্য্যন্ত ভ্ৰমণ করে ফিরে আসব। ততদিন পর্য্যন্ত এই নীলাচলেই অবস্থান কর।‘’ তখন নিত্যানন্দ প্রভু বললেন,- যদি একান্তই আমাদের কাউকে সঙ্গে নিতে ইচ্ছা না করেন, তবে এই কৃষ্ণদাসকে সঙ্গে নিন। এই ব্ৰাহ্মণ নিতান্ত সরলপ্রকৃতি, আপনার ইচ্ছামতই কাজ করবে, আপনার ইচ্ছায় কোন বাধা দেবে না। বরং আপনি পথে প্ৰেমাবেশে অচেতন থাকবেন, কৃষ্ণদাস আপনার সঙ্গে থাকলে অন্ততঃ জলপাত্র ও বহির্বাস রক্ষণাবেক্ষণে সাহায্য হবে।  নিত্যানন্দের এই শেষ কথাটি প্ৰভুর যুক্তিযুক্ত বলে মনে হল, তিনি কৃষ্ণ দাসকে সঙ্গে নিতে রাজী হলেন।

সার্বভৌম ভট্টাচাৰ্য্য প্রভুর দক্ষিণ -গমনের কথা শুনে প্রথমে বাধা দানের চেষ্টা করলেও, প্রভুর দৃঢ়সঙ্কল্প বুঝতে পেরে অগত্যা অনুমোদন করলেন। সার্বভৌম বললেন,- ‘’মহারাজা প্ৰতাপরুদ্র যুদ্ধের কারণে এখন বিজয়নগরে রয়েছেন। রাজধানীতে উপস্থিত থাকলে তিনি অবশ্যই আপনাকে এখান থেকে বিদায় দিতে চাইতেন না। যাই হোক, আপনার যাত্রাপথে দক্ষিণে গোদাবরী - তীরে বিদ্যানগরে রামানন্দ রায় নামে তাঁর একজন প্ৰতিনিধি শাসনকৰ্ত্তা আছেন। জাতিতে শূদ্র এবং বিষয়ী হলেও, তিনি একজন উচ্চ অধিকারী। আমার অনুরোধ, দাক্ষিণাত্য যাবার পথে তাঁকে একবার দর্শন দিয়ে যান। তাঁর বৈষয়িক বাহ্যাড়ম্বর দেখে তাঁকে অবজ্ঞা করবেন না। আমরা আগে তাঁকে বৈষ্ণব বলে অনেক পরিহাস করেছি, কিন্তু এখন আপনার কৃপায় বোধ হচ্ছে; প্রকৃতই তিনি একজন রসতত্ত্ববেত্তা পরম বৈষ্ণব।‘’ সার্ব্বভৌম ভট্টাচার্য্যের এই প্রস্তাবে প্রভু সম্মত হলেন।

''তবে সাৰ্ব্বভৌম কহে প্রভুর চরণে।

অবশ্য পালিবে প্ৰভু মোর নিবেদনে।।

রামানন্দ রায় আছে গোদাবরী তীরে।

অধিকারী হয়েন তিহোঁ বিদ্যা নগরে ৷।

শূদ্র বিষয়ী জ্ঞানে অপেক্ষা করিবে।

আমার বচনে তাঁরে অবশ্য মিলিবে।।

তোমার সঙ্গের যোগ্য তিহোঁ একজন।

পৃথিবীতে রসিক ভক্ত নাহি তার সম।। 

পাণ্ডিতা আর ভক্তিরস দুহের তিহোঁ সীমা।

সম্ভাষিলে জানিবে তুমি তাঁহার মহিমা।।''     ( চৈতন্য চরিতামৃত )

রামানন্দ একজন ধনাঢ্য, পণ্ডিত এবং প্রধান ভক্ত বলে পরিচিত। তাঁর জীবনে গভীর জ্ঞান ও ভগবদ্ভক্তি একাধারে মিলিত হয়েছিল। ভট্টাচার্য্যের মুখে রামানন্দের বৃত্তান্ত শ্রবণ করে প্রভু আনন্দিত হলেন।

প্রভাতে গাত্ৰোত্থান করে মহাপ্রভু প্রেমাবেশে যেতে লাগলেন, সেসময় তাঁর দিক বা বিদিক, দিন কি রাত্রি, কিছু মাত্র জ্ঞান ছিল না। নানাস্থান পরিভ্রমন করতে করতে যাত্রাপথে লোকেদের হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্রে দীক্ষিত করে কিছুদিনের মধ্যে গোদাবরী তীরে এসে উপস্থিত হলেন। গোদাবরী দর্শনে মহাপ্ৰভু সেই বনে কিছুক্ষণ নৃত্য - গীত করলেন, পরে গোদাবরী পার হয়ে নদীতে স্নান করলেন। অতঃপর ঘাটের থেকে কতক দূরে জলের কাছে বসে নাম সংকীর্ত্তন করতে লাগলেন ।

এমন সময়ে বাদ্য বাজিয়ে পালকী চড়ে রামানন্দ রায় স্নান করতে এলেন। তাঁর সঙ্গে অনেক বৈদিক ব্রাহ্মণ এসেছিলেন, তিনি যথাবিধি স্নান তৰ্পণ করছেন, এমন সময়ে মহাপ্রভু তাঁকে দেখে জানতে পারলেন এই ব্যক্তিই রামানন্দ রায়। অপূর্ব সন্ন্যাসি দর্শন করে রায় রামানন্দ মহাপ্রভুর নিকট এসে উপস্থিত হলেন। মহাপ্রভুর শত সূর্য্যের ন্যায় কান্তি, অরুণবসন, মনোহর সুদীর্ঘ শরীর ও কমল নয়ন দর্শন করে তিনি দণ্ডবৎ প্রণাম করলেন। তখন মহাপ্রভু - রামানন্দ রায়কে বললেন , ''উঠ উঠ, কৃষ্ণ বল, কৃষ্ণ বল, তুমি কি রামানন্দ রায় ?”

রামানন্দ বললেন,- ''আজ্ঞে, আমিই সেই দাস, শূদ্রজাতি ও মন্দ ব্যক্তি।''

‘’তথাপি পুছিল তুমি রায় রামানন্দ।

তিহোঁ কহে হঙ মুঞি দাস শূদ্র মন্দ I I’’  ( চৈতন্য চরিতামৃত )

মহাপ্রভু তাঁর বিনয় বচন শুনে তাঁকে দৃঢ়তর আলিঙ্গন করলেন । প্রেমাবেশে প্রভু - ভৃত্য দুই জনে অচেতন হলেন। স্বাভাবিক প্রেমাবেশে পরস্পর আলিঙ্গন করে দুই জনেই ভূমিতে পতিত হলেন, উভয়ের দেহে, স্তম্ভ, স্বেদ, অশ্রু, কম্প, পুলক ও বৈবর্ণ্য আদি সাত্ত্বিক ভাবের উদয় হতে লাগল।

ব্রাহ্মণেরা তা দেখে আশ্চর্য্য হয়ে মনে মনে বিচার করতে লাগলেন যে, ব্রহ্ম -সমান তেজদীপ্ত এই সন্ন্যাসী শূদ্রকে আলিঙ্গন করে কেন কাঁদছেন ? আর ইনি মহারাজের পাত্র, পণ্ডিত ও গম্ভীর, ইনিই বা সন্ন্যাসীর স্পর্শে মত্ত হয়ে অস্থির হলেন কেন ? ব্রাহ্মণেরা তাঁদের আন্তরিক ভক্তিভাব হৃদয়ঙ্গম করতে না পেরে নিজেদের সংস্কার অনুরূপ চিন্তা করতে লাগলেন। ভাব সম্বরণ হলে প্রভু ও রামানন্দ সেই স্থানে উপবেশন করলেন। মহাপ্রভু সহাস্য বদনে বললেন,- সাৰ্ব্বভৌম ভট্টাচাৰ্য্য তোমার গুণের কথা বলেছেন এবং তোমার সঙ্গে মিলিত হতে আমাকে বলেছেন। তাই তোমার সাথে দেখা করতে আমি এখানে এসেছি । ভালই হল, অনায়াসে তোমার দর্শন পেলাম।

একথা শুনে রায় বললেন,- সার্বভৌম আমাকে ভৃত্যজ্ঞান করেন এবং পরোক্ষেও আমার হিত কামনা করেন। তাঁর কৃপায় আপনার চরণ দর্শন করতে পেরে আজ আমার জন্ম সফল হল। সাৰ্ব্বভৌমের প্রতি আপনার যে কৃপা, তাঁর প্রেমাধীন হয়ে আমার মত অস্পৃশ্যকেও আপনি স্পর্শ করলেন ! কোথায় আপনি সাক্ষাৎ নারায়ণ এবং কোথায় আমি রাজসেবী বিষয়ী ও অধম শূদ্র ! আপনি সাক্ষাৎ ঈশ্বর, আপনার অভিপ্রায় কে বুঝতে পারে ? আমাকে নিস্তার করতে আপনার এস্থানে আগমন; আপনি কৃপা - পূর্বক আমাকে দর্শন দান দিলেন, মহান ব্যক্তিদের স্বভাবই এই যে, তাঁদের নিজেদের প্রয়োজন না থাকলেও পামর সকলকে উদ্ধার করবার জন্য তাদের গৃহে গমন করে থাকেন।'' আমার সঙ্গে ব্রাহ্মণাদি এক সহস্ৰ লোক আপনার দর্শনে তাদের মন দ্রবীভূত হয়েছে। এখন সকলের মুখে কৃষ্ণনাম শুনতে পাচ্ছি, এবং তাদের অঙ্গে পুলক ও নয়নে অশ্রুধারা প্রবাহিত হচ্ছে; আকৃতি ও প্রকৃতিতে আপনার ঈশ্বর লক্ষণ দেখছি, এই অপ্রাকৃত গুণ তো জীবে সম্ভব হয় না। ”

মহাপ্রভু তখন বললেন,- ''তুমি মহাভাগবত দের মধ্যে শ্ৰেষ্ঠ, তোমার দর্শনেই সকলের মন দ্রবীভূত হয়েছে, অন্যের কথা আর কি বলব। আমি মায়াবাদী সন্ন্যাসী, তোমার স্পর্শে আমিও প্রেমে ভাসতে লাগলাম। আমার কঠিন হৃদয় শোধন করার জন্যই সার্বভৌম তোমার সঙ্গে আমাকে মিলিত হতে বলেছেন।" এইভাবে দুইজনে দুই জনার গুণ কীৰ্ত্তন করতে লাগলেন, পরস্পর দর্শনে দুই জনের মন আনন্দিত হল। এমন সময়ে একজন বৈষ্ণব ব্রাহ্মণ দণ্ডবৎ প্রণাম করে প্রভুকে নিমন্ত্রন করলেন। তাঁর নিমন্ত্রণ স্বীকার করে ঈষৎ হাস্য বদনে প্রভু রামানন্দকে বললেন,- ''রায় ! তোমার মুখে কৃষ্ণ কথা শুনতে আমার বাসনা হচ্ছে, আবার যেন তোমার দর্শন পাই।'' এই কথা শুনে রায় বললেন, ''আপনি যখন পামর শোধন করেছেন, তখন আপনার দর্শনমাত্রে আমার চিত্ত শুদ্ধ হবে না। আপনি যদি পাঁচ সাত দিন থেকে আমাকে মার্জন করেন , তবে আমার এই দুষ্ট মন পবিত্র হয়।''

যদিও দুই জনের বিচ্ছেদ সহ্য হয় না, তবু দণ্ডবৎ প্রণাম করে রামানন্দ রায় গমন করলেন। তখন প্রভু সেই ব্রাহ্মণের গৃহে গিয়ে ভিক্ষা করলেন। সন্ধ্যাকালে রামানন্দ রায় এসে মহাপ্রভুকে দণ্ডবৎ করলে মহাপ্রভু তাঁকে, আলিঙ্গন করলেন এবং দুইজনে নির্জনে বসে কথা বলতে লাগলেন। এই সময় রামানন্দের সঙ্গে চৈতন্যের ভক্তিযোগ সম্বন্ধে অতি উচ্চমার্গের কথা হয়।

ক্রমশ…