Wednesday, July 22, 2020


শুদ্ধ ভক্ত আর শুদ্ধ ভক্তি
💐🌺🌹💐💐🌺🌹💐💐🌺🌹💐
শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ
সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার দণ্ডবৎ প্রণাম I
''হরি - গুরু - বৈষ্ণব তিনিহেঁ স্মরণ।
তিনেহেঁ স্মরণ হইতে বিঘ্ন বিনাশন।।
অনায়াসে হয় নিজ বাঞ্ছিত পূরণ ।।‘’

শুদ্ধ ভক্তের লক্ষণ কি?
শ্রীমদ্ভাগবতে  বর্ণনা আছে যে,- পরম ভক্ত শ্রীউদ্ভবজী যখন ভগবদভক্তি সম্মন্ধে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিকট জিজ্ঞাসা করেন,তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই কথা বলেন,-
''আদরঃপরিচর্যায়ং সর্বাংগেরভিবন্দনম।
মদ্ভক্তপূজাভ্যধিকা সর্বভিতেষু মন্মতীঃ।।
মদার্থেষ্বঙচেষ্টা চ বচসা মদগুনেরনম।
ময্যর্পণঞ্জ মনসঃ সর্বকামবিবর্জনম।।''

অর্থাৎ,- ১) সর্বাঙ্গের দ্বারা আমার অভিনন্দন করা।
২)বিশেষ ভাবে আমার ভক্তের পূজা করা।
৩)সমস্থ জীবকে আমার সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করা।
৪) আদরের সঙ্গে আমার পরিচর্যা করা।
৫)দেহের সমস্ত ক্ষমতা দিয়ে আমার সেবা করা।
৬)বাক্যের দ্বারা আমার মহিমা কীর্ত্তন করা।
৭)মনকে আমাতে অর্পণ করা এবং
৮)সব রকম জড় ভোগবাসনা পরিত্যাগ করা।

এই আট রকম লক্ষণ যাঁর মধ্যে প্রতিফলিত দেখতে পাওয়া যায়, সেই হলেন যথার্থ ভক্ত এবং আদর্শ শুদ্ধভক্ত। এই কলিযুগে ভক্তি বিনে মুক্তি নেই। তাই সবার নিকট বিনীত নিবেদন, আমরা যেটুকু ভগবানের নামজপ বা কীর্ত্তনাদি করিনা কেনো, তা যেন ভক্তি সহকারে করার চেষ্টা করি। শ্রীভগবান হলেন ভাবগ্রাহী জনার্দন,তাই তিনি আমাদের বেশ নয়, আমাদের অন্তরের ভাব বোঝেন এবং সেই অনুসারেই ফলাফলও নির্দিষ্ট করেন।

মহাপ্রভু সেই সম্বন্ধে বলেছেন যে
''নাহং বিপ্রো নরপতির্নাপি বৈশ্যো শূদ্রো
নাহং বর্ণী গৃহপতির্নো বনস্থো যতির্বা।
কিন্তু প্রোদ্যন্নিখিলপরমানন্দপূর্ণামৃতাব্ধে-
র্গোপীভর্তুঃ পদকমলয়োর্দাসদাসানুদাসঃ।।''  (পদ্মাবলী ৭৪)
অর্থাৎ,- আমি ব্রাহ্মণ নই, ক্ষত্রিয় রাজা নই, বৈশ্য বা শুদ্র নই, ব্রহ্মচারী নই, গৃহস্থ নই, বানপ্রস্থ নই, সন্ন্যাসীও নই। আমার একমাত্র পরিচয় হচ্ছে গোপীভর্তা যে কৃষ্ণ, সেই গোপীজনবল্লভ শ্রীকৃষ্ণচন্দ্রের দাসের অনুদাসের দাস। আর সেটিই হল বৈষ্ণবের প্রকৃত পরিচয়।

শুদ্ধ ভক্তির লক্ষণ কি ???
শ্রীমদ্ভাগবতের তৃতীয় স্কন্ধে (/২৯/১২-১৩) ভগবান শ্রীকপিলদেব তাঁর মাতা দেবহূতিকে পারমার্থিক তত্ত্ব নির্দেশ দেবার সময় শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তির লক্ষণ বর্ণনা করে বলেছেন,- "হে মাতঃ, যাঁরা আমার শুদ্ধ ভক্ত এবং যাঁদের পার্থিব কোন লাভের বাসনা অথবা মনোধর্মপ্রসূত জ্ঞানের প্রতি কোন আসক্তি নেই, তাঁদের চিত্ত সর্বদাই আমার সেবায় এতই গভীরভাবে মগ্ন যে, তাঁরা আমার কাছ থেকে কিছুই প্রত্যাশা করেন না। এমন কি, তাঁরা আমার ধামে আমার সঙ্গে বাস করার সৌভাগ্য পর্যন্ত কামনা করেন না।" শ্রীমদ্ভাগবতে কপিলদেবের এই উক্তিতে শুদ্ধ ভক্তের যথার্থ মনোভাব বর্ণিত হয়েছে , এবং ভক্তির সামান্য লক্ষণও বর্ণিত হয়েছে।

শ্রীল রূপ গোস্বামী শাস্ত্র - প্রমাণের মাধ্যমে ভক্তির বিভিন্ন লক্ষণ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন যে, শুদ্ধ ভক্তির ছয়টি লক্ষণ আছে---

১।শুদ্ধ ভক্তি ক্লেশঘ্নী, অর্থাৎ সব রকম প্রাকৃতিক ক্লেশ তৎক্ষণাৎ নিবৃত্তি করে।
২।শুদ্ধ ভক্তি শুভদা, অর্থাৎ সর্বতোভাবে মঙ্গলময়।
৩।শুদ্ধ ভক্তি সান্দ্রানন্দবিশেষাত্মা, অর্থাৎ শুদ্ধ ভক্তি দিব্য আনন্দ প্রদান করে।
৪।শুদ্ধ ভক্তি সুদুর্লভা, অর্থাৎ শুদ্ধ ভক্তি লাভ করা সুদুর্লভ।
৫।শুদ্ধ ভক্তি মোক্ষলঘুতাকৃৎ, অর্থাৎ শুদ্ধ ভক্তি মোক্ষকেও তুচ্ছ করে দেয়।
৬।শুদ্ধ ভক্তি শ্রীকৃষ্ণাকর্ষিণী, অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণকে আকর্ষণ করার একমাত্র উপায়।

শ্রীকৃষ্ণ সর্বাকর্ষক, কিন্তু শুদ্ধ ভক্তি তাঁকেও আকর্ষণ করে। অর্থাৎ শুদ্ধ ভক্তি শ্রীকৃষ্ণের চেয়েও বলবতী, কারণ তিনি হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের অন্তরঙ্গা শক্তি।

মহাপ্রভু যখন উত্তরপ্রদেশে গিয়েছিলেন মধ্বাচার্যের যারা অনুগামী তত্ত্ববাদী তাদের সঙ্গে তাঁর যে আলোচনা হয়, তাতে তাদের বক্তব্য হল মুক্তিই হল ভক্তির একমাত্র লক্ষণ। এই মুক্তি মানে কৈবল্য বা সাযুজ্য মুক্তি নয়। তারা সামীপ্য, সারুপ্য, সালোক্য এবং সার্ষ্টি এই চার রকমের মুক্তি কামনা করে বৈকুন্ঠে ভগবানের কাছে ফিরে যেতে চায়। মহাপ্রভু সেই তত্ত্ববাদীদের যিনি আচার্য বা মহান্ত তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন,- শাস্ত্রে বলা হচ্ছে ভক্তকে মুক্তি দেওয়া হলেও সে মুক্তি চায় না। ভগবান কপিলদেব বলেছেন যে
''সালোক্যসার্ষ্টিসামীপ্যসারূপ্যৈকত্বমপ্যুত।
দীয়মানং গৃহ্নন্তি বিনা মৎসেবনং জনাঃ।।'' (ভাগবত /২৯/১৩)

অর্থাৎ,- মুক্তি পাঁচ রকমের যথা - সাযুজ্য বা ভগবানের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়া, সালোক্য বা ভগবানের লোকে বাস করা, সারূপ্য বা ভগবানের রূপ প্রাপ্ত হওয়া, সামীপ্য বা ভগবানের সান্নিধ্যে বাস করা এবং সাষ্টি বা ভগবানের সমান ঐশ্বর্য প্রাপ্ত হওয়া। ভগবদ্ভক্ত পার্থিব সুখভোগের কথা দূরে থাকুক , এই পাঁচটি মুক্তি থেকে কোনটিই কামনা করেন না। প্রীতি সহকারে ভগবানের সেবা করেই তিনি তৃপ্ত হন এটিই হচ্ছে শুদ্ধ ভক্তির লক্ষণ। তাহলে ভক্তকে ভগবানের সেবা ছাড়া যে কোন মুক্তি দিলেও সে যদি তা গ্রহণ না করে তাহলে সেই মুক্তি কেন আমাদের লক্ষ্য হবে?

মহাপ্রভু দ্বিতীয় শ্লোকে বললেন,-
''মুক্তি স্বয়ং মুকুলিতাঞ্জলি সেবতেহস্মান্।
ধর্মার্থকামগতয়ঃ সময়প্রতীক্ষাঃ (শ্রীকৃষ্ণকর্ণামৃত ১০৭ শ্লোক)

অর্থাৎ,- মুক্তিদেবী মুকুলতাঞ্জলি হয়ে ভক্তের কাছে প্রার্থনা করে তাকে যেন সেবা করার সুযোগ দান করা হয়। তাহলে এখানে মুক্তিদেবী করোজোড়ে যদি ভক্তের কাছে প্রার্থনা করেন, যে আমাকে সেবা করার সুযোগ দান করুন, তাহলে ভক্ত হয়ে সেই মুক্তি কেন গ্রহণ করবেন? মহাপ্রভু তাদের বোঝালেন তোমরা ভক্তির মাধ্যমে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা করছো, এটা প্রকৃতপক্ষে ভক্তির লক্ষণ নয়। তাহলে ভক্তির উদ্দেশ্য কি? ভক্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রেম।

ভগবানের প্রতি প্রেম অর্জন করাই হচ্ছে ভক্তির একমাত্র উদ্দেশ্য এবং সেই প্রেমভক্তি হচ্ছে শুদ্ধভক্তির চরম স্তর। তাহলে দেখা যাচ্ছে ভক্তি তিন রকমের। যথা কর্মমিশ্রা, জ্ঞানমিশ্রা শুদ্ধভক্তি এবং এই শুদ্ধভক্তির চরম স্তরই হল প্রেমভক্তি। এই প্রেমভক্তি দান করতেই মহাপ্রভু এসেছেন। প্রেমভক্তি লাভের উপায় হচ্ছে শুদ্ধ চিত্তে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ কীর্ত্তন করা।
''হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।''
এই শুদ্ধভক্তি অত্যন্ত অপূর্ব বস্তু এবং এই শুদ্ধভক্তি যে কোন ব্যক্তি লাভ করতে পারেন।
''যেই ভজে সেই বড় অভক্তহীন ছার।
কৃষ্ণভজনে নাহি জাতিকুলাদি বিচার।।'' (চৈঃ চঃ অন্ত /৬৭)
এখানে বলা হচ্ছে, যেই ভজে সেই বড়। এখানে কোন রকম উপাধির বিচার নেই।

শুদ্ধ ভক্তির লক্ষণগুলিঃ- অন্য বাঞ্ছা, অন্যপূজা, শুষ্ক জ্ঞান কৰ্ম্মের অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করে পবিত্রভাবে সকল ইন্দ্রিয়ের আনুকূল্যে হরিপ্রেমরস অনুশীলন করাই শুদ্ধ ভক্তি, একেই অহৈতুকী ভক্তি বলা যায়। পিশাচীতুল্য ভোগবাসনা মুক্তিস্পৃহা হৃদয়ে থাকলে বহু সাধনাতেও প্রেম উৎপন্ন হয় না। নারদ পঞ্চরাত্রে বলা হয়েছে,-
''সৰ্ব্বোপাধি বিনির্ম্মুক্তং তৎপরত্বেন নিৰ্ম্মলং।
হৃষীকেন হৃষীকেশ সেবনং ভক্তিরুচ্যতে।।''
অর্থাৎ,- অন্য বাঞ্ছা পরিত্যাগ করে একাগ্রচিত্তে পবিত্র ভাবে ইন্দ্রিয়াদির আনুকূল্যে ভগবৎ অনুশীলন করার নামই ভক্তি।

ভাগবতে লিখিত হয়েছে,-
"মদ গুণশ্রুতি মাত্রেণ ময়ি সৰ্ব্বগুহাশয়ে।
মনোগতিরবিচ্ছিন্না যথা গঙ্গাম্ভাসোহম্বুধৌ।। 
লক্ষণং ভক্তিযোগস্য নির্গুণস্য হ্যুদাহৃতং।
অহৈতুক্য ব্যবহিতা যা ভক্তিঃ পুরুষোত্তমে।।''
অর্থাৎ,- আমি সৰ্ব্বান্তৰ্য্যামী পুরুষোত্তম। আমার গুণ শ্রবণ মাত্র, সাগর অভিগামী গঙ্গাসলিলের ন্যায় আমাতে অবিচ্ছিন্না ফল - অভিসন্ধি - শূন্য এবং ভেদদর্শন - বর্জিত মনের যে গতি তাই নির্গুণ ভক্তিযোগের লক্ষণ বলে কথিত হয়েছে। এটিই অহৈতুকী অব্যবহিত ভক্তি।

ইক্ষুরস যেমন ক্রমশঃ ঘনীভূত হয়ে গুড় খণ্ডসার শর্করা মিছরি উত্তম মিছরি প্রস্তুত হয়, সেইভাবে সাধন ভক্তি থেকে রতির উদয় হয়। রতি গাঢ় হলে তাকে প্রেম বলা যায়। প্রেমের ক্রমশঃ বৃদ্ধিতে স্নেহ, মান, প্রণয়, রাগ, অনুরাগ, ভাব মহাভাব উৎপন্ন হয়ে থাকে।

জ্ঞান, কৰ্ম্ম, দেব, দেবী, বহু যতনেতে সেবি, প্রাপ্তফলে হৈলে তুচ্ছ জ্ঞান।
সাধুজন - সঙ্গাবেশে, কৃষ্ণকথার শেষে, বিশ্বাস  হয় বলবান ৷।

সেই  বিশ্বাসে ভাই, শ্রদ্ধা বলিসদা গাই, ভক্তিলতা - বীজ বলি তারে।
কৰ্ম্মি-জ্ঞানী জনে যারে, শ্রদ্ধা বলে বারে বারে, সেই বৃত্তি শ্রদ্ধা হইতে নারে।।

''নামের বিবাদ মাত্র, শুনিয়া  জ্বলে গাত্ৰ, লৌহে যদি বলহ কাঞ্চন।
তবু লৌহ, লৌহ রয়,  কাঞ্চন  কভু নয়, মণি -স্পর্শে নহে যতক্ষণ।।''
                                                               …. (শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর)

পৃথিবীর ধন জন সম্ভ্রম সম্পত্তি সুখ সৌভাগ্য সমস্তই অসার, বিষয়লিপ্সা পরিত্যাগ করিয়া নিশ্চিন্ত মানস হইয়া হরিচরণাশ্রয় করাই কেবল মানব জীবনের সার্থকতা শান্তিলাভের হেতু।
''হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।''

💐🌺💐জয় শ্রীরাধা💐🌹🌺🌹💐 জয় নিতাই জয় গৌরসুন্দর💐🌺💐

No comments:

Post a Comment

🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴🌴🌳 🌻🌼 শ্রীবলরামের রাসযাত্রা 🌹 শ্রীকৃষ্ণের বসন্তরাস 🌼🌻 🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴...