🏵️💐সত্সঙ্গমহিমা💐🏵️

🍁🦚💐🏵️🌺🌹🌺🏵️💐🦚🍁

শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ

সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম I

‘’হরি - গুরু - বৈষ্ণব তিনিহেঁ স্মরণ।

তিনেহেঁ স্মরণ হইতে বিঘ্ন বিনাশন।।

অনায়াসে হয় নিজ বাঞ্ছিত পূরণ ।।‘’

নমস্ত্রিকাল - সত্যায় জগন্নাথ সুতায় চ।

স - ভৃত্যায় স -পুত্রায় স - কলত্রায় তে নমঃ।।

সাধু কাকে বলে ? যে কেউ কি সাধু হইতে পারে?

পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের কাছে সাধুর সংজ্ঞা নিরূপন করেছেন,

"অপি চেৎসুদুরাচারো ভজতে মামন্যভাক্।

সাধুরেব স মন্তব্যঃ সম্যগ্ ব্যবস্থিত হিসঃ।।''

অর্থাৎ,- অতি দুরাচারী ব্যক্তিও যদি অনন্যভক্তি সহকারে আমার ভজনা করেন, তাকেও  ‘’সাধু’’ বলে মনে করতে হবে, কারণ তিনি যথার্থ মার্গে অবস্থিত । (গীতা ৯/৩০ ) কৃষ্ণভক্তিই জীবের সহজাত অধিকার। 'জীবের স্বরূপ হয় নিত্যকৃষ্ণ দাস'। তাই ঐকান্তিক কৃষ্ণভজনাকারী জন  সাধু। যে কেউ সাধু হতে পারে।

শ্রীপদ্মপুরাণে বিস্তৃত ও সুন্দরভাবে সাধুর সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে-

"কৃষ্ণার্পিত-প্রাণ-শরীর-বুদ্ধিঃ শান্তেন্দ্রিয় - স্ত্রী - সুত - সম্পদাদিঃ

আসক্তচিত্তঃ শ্রবণাদি ভত্তির্যস্যেহ সাধু সততং হরের্যঃ।।''

অর্থাৎ,- ‘’যিনি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মে প্রাণ, বুদ্ধি সমস্তই সমর্পণ করেছেন, যিনি ইন্দ্রিয়, স্ত্রীপুত্র, বিষয়াদি সমস্ত ভোগবিলাস থেকে বিরত হয়েছেন, যিনি শ্রীহরির প্রতি সদা সর্বদা আসক্ত চিত্ত এবং যিনি শ্রীকৃষ্ণ - কথা শ্রবণ, শ্রীকৃষ্ণমহিমা কীর্ত্তন ইত্যাদি ভক্তি - অঙ্গ সমূহের যাজন পরায়ণ, এই জগতে তিনিই সাধু।

''ন রোধয়তি মাং যোগ, ন সাঙ্খ্যং ধর্ম এব চ।

ন সাধ্যায়স্তপস্ত্যাগো নেষ্টাপুর্ত্তের্ন দক্ষিনা ।।

ব্রতানি যজ্ঞশ্ছন্দাংসি তীর্থানি নিয়মা যমাঃ।

যথাবরুন্ধে সত্সঙ্গঃ সর্ব সঙ্গাপহোহি মাম্।।  (ভা. ১১ /১২ /১ - ২)

অর্থাৎ,- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধব কে পূর্বোক্ত উপদেশমালা প্রদান করিয়া শ্রুতি স্মৃতি বর্ণিত ধর্ম অধর্ম পরিত্যাগ পূর্বক ভগবানকে লাভের জন্য তার শরণ গ্রহণ করিতে উপদেশ করিতেছেন।

শ্রীভগবান বলিলেন,- হে উদ্ধব! সৎসঙ্গ সর্ববিষয়ের আসক্তি বিনাশক বলিয়া উহা আমাকে যেরূপ বশীভূত করে, যোগ, সাংখ্য, অহিংসাদি সাধারণ ধর্মানুষ্ঠান, স্বাধ্যায়, তপঃ, সন্ন্যাস, যাগাদি ইষ্টকর্ম, কূপখননাদি পূর্তকর্ম, দক্ষিণা, ব্রত, দেবপূজা, সরহস্যমন্ত্র, তীর্থ নিয়ম অথবা যম- এই সকল তাদৃশ বশীভূত করিতে পারেনা।

শ্রীলবিশ্বনাথ চক্রবর্তী টীকার অনুবাদ:- এখানে সাধুসঙ্গের মহিমা বলা হইয়াছে এবং সংশয় ছেদন পূর্বক ব্রজবাসীগণের প্রেমের সর্বোৎকৃষ্ট মহামহিমা সূচিত হইয়াছে। হে উদ্ধব! আসন প্রানায়ামাদি অষ্টাঙ্গ যোগ আত্মা অনাত্মার পার্থক্য জ্ঞানরূপ সাঙ্খ্য, অহিংসাদি ধর্ম, বেদপাঠ, কৃচ্ছ্রাদি তপস্যা, সন্ন্যাস রূপ ত্যাগ, অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞ ইষ্ট, কূপ আরামাদি নির্মাণ পূর্ত, দান, চাতুর্মাস্যাদি ব্রতসমূহ, দেবপুজারূপ যজ্ঞ, ছন্দসমূহ অর্থাৎ রহস্যমন্ত্র এই সকল আমাকে বশীভূত করতে পারেনা।রুধ ধাতুর অর্থ বশীকরণ।রোধয়তি- অতএব যোগাদি আমায় বশীকরণ করতে পারে না, অর্থাৎ অষ্টাঙ্গযোগী আদি আমাকে বশীভূত করতে পারে না । তাহারা আমাকে প্রাপ্ত হয় না। ফলকথা, আমাকে যোগ সাধন করিতে পারেনা। শ্রীভগবান বলিলেন,- ''হে উদ্ধব! ভক্তি যেমন বলবতী আমার সাধন। আমি একমাত্র ভক্তি দ্বারাই গ্রহণীয় হই।'' এই সকল পরবর্তী বাক্যের সহিত একার্থ হেতু যোগাদি আমার প্রাপ্তির উপায় নহে। এই কারণে পূর্ব উক্ত *"ভক্তি বিনা অন্য কোন উপায় নাই"* এই বাক্য ই দৃঢ়ীকৃত হইল।

"সত্সঙ্গ যেভাবে আমাকে বশীভূত করে" ইহা বহু প্রয়োগ দ্বারাই সৎসঙ্গ রূপা ভক্তি উৎপত্তির পূর্বেও ঐ সাধনই স্বয়ং আমাকে বশীভূত করে, ভক্তি জন্মাইয়া যে আমাকে বশীভূত করিবে ইহা আর কি বলিব। *আমি একমাত্র ভক্তিদ্বারাই গ্রহণীয় হই, এই অগ্রিম বাক্য দ্বারাই ইহা সিদ্ধ হয়। যোগাদিঘর ও ভক্তিমিশ্র থাকায় কিঞ্চিৎ বশীকারিতা আছেই, এজন্য *যথা* শব্দ সার্থক হয়, ইহা কেহ বলেন। সর্বসঙ্গাপহ অর্থাত্ এই সাধুসঙ্গ সার্বত্রিক আসক্তি নিবারক । এই কারণে আমাকে বশীকরণের  কারণ।     (ভা ১-২)

ধর্ম স্বনুষ্ঠিত পুংসাং বিষ্বকসেন কথাসু যঃ।

নোত্পাদয়েত্ যদি রতিং শ্রম এবহি কেবলম্ ।।

তস্মিন মহন্মুখরিতা মধুভিশ্চরিত্র,

পিযুষশেষ সরিতঃ পরিতঃ স্রবন্তি।

তা যে পিবন্তি অবিতৃষো নৃপ গাঢ় কর্ণৈ-

স্তান্ ন স্পৃশন্ত্যশন তৃড়্ ভয় শোক মোহাঃ ।।    (ভা. ৪ / ২৯ / ৪০)

অর্থাৎ,- ধর্মের অনুষ্ঠান করলেও যদি ভগবানের কথায় রুচি না জন্মে, তবে তার সমস্ত পরিশ্রমই বৃথা। তাই যেখানে ভগবানের ভক্ত ভগবানের গুন কীর্তন করেন, সেখানে গিয়ে যে অত্যন্ত আসক্তির সহিত, উত্কণ্ঠিত হৃদয়ে ভগবানের মধুময় কথা শ্রবণ করেন। তাকে আর ক্ষুধা-তৃষ্ণা, ভয়, মোহ আদি স্পর্শ করতে পারে না।

জ্ঞানে প্রয়াস মুদপাস্য নমন্ত এব,

জীবন্তি সন্মুখরিতাং ভবদীয় বার্ত্তাম্।

স্থানে স্থিতাঃ শ্রুতি গতাং তনুবাঙ্মনোভি,

র্যে প্রায়শোজিত জিতোহপ্যসি তৈস্ত্রিলোক্যাম্ ।।    (ভা ১০ / ১৪ / ৩)

ভাবার্থ:- জ্ঞানের অর্থাৎ অক্ষজ(প্রাকৃত ইন্দ্রিয় জাত) জ্ঞান দ্বারা ভগবত স্বরূপ ঐশ্বর্য ও মহিমা বিচারের প্রয়াস সর্বতোভাবে পরিত্যাগ পূর্বক নিজ নিজ আশ্রমে বা সাধু - সন্নিধানে অবস্থিত হইয়া যাহারা সাধুগণের মুখে স্বতঃ উচ্চারিত এবং তৎ সান্নিধ্য মাত্র আপনা হতেই শ্রবণ পথে প্রবিষ্ট ভবদীয় নাম- রূপ - গুণ - লীলা,পর- বাক্য  শরীর মন ও বাক্যের দ্বারা সৎকার করিতে করিতে জীবন ধারণ করেন তারা অন্য কোন কর্ম না করুন তথাপি ত্রিলোকে অন্যান্য ব্যক্তির অজিত, আপনি তাদের দ্বারা জিত অর্থাৎ বশীভূত হন।।

শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী পাদের টীকার অনুবাদ:- যদি বলেন- দেখুন, *" ত্বমেব বিদিত্বা অতিমৃত্যুমেতি"* অর্থাৎ সেই পরমেশ্বরকে জানিলেই জীব মৃত্যু অতিক্রম করতে পারে। এই শ্রুতিবাক্য অনুসারে জ্ঞান ব্যাতিত লোকে কি প্রকারে সংসার( জন্ম-মৃত্যু প্রবাহ) হতে উত্তীর্ণ হইবে? তদুত্তরে বলিতেছেন- *জ্ঞানে প্রয়াসম্ উদপাস্য* জ্ঞানের নিমিত্ত কিছুমাত্র প্রয়াস না করিয়া (কিংবা ভবদীয় স্বরূপৈশ্বর্য্য-বিচারে বা জ্ঞান ও যোগ উপাসনায় পরিশ্রম পরিত্যাগ করিয়া), *সন্মুখরিতাং ভবদীয় বার্ত্তাম্,*  সাধু ভক্তগণ মৌনশালী হলেও স্বমাধুর্যবশতঃ যাহা তাহাদিগকে মুখরীকৃত করিয়াছেন। সেই ভবদীয় চরিত্র বার্তা, অথবা তোমার নিত্য পরিকর প্রভৃতির কথাকে, *স্থানে স্থিতা* সাধুগণের নিবাস স্থলে অবস্থিত হইয়া, *শ্রুতিগতাং*  শ্রুতি পথে প্রবিষ্ট কথাকে কায়মনোবাক্যে আরম্ভ হতে পরিসমাপ্তি পর্যন্ত যাহারা সৎকার করেন, শ্রবন করেন। তন্মধ্যে কায় বলিতে হস্তদ্বয়ের সহিত মস্তকের দ্বারা ভূমি স্পর্শ পূর্বক (পঞ্চাঙ্গ বা সাষ্টাঙ্গ) প্রণাম, শ্রীকৃষ্ণ কথার উদ্দেশ্যে *সকল বৈষ্ণবগণকে প্রনাম*

এইরূপ বাক্যের দ্বারা, এবং মনে তার নিশ্চয়তা বুদ্ধির দ্বারা সৎকার পূর্বক যাহারা জীবন ধারণ করেন। তারা যদিও অন্য কর্ম না করেন, তথাপি-হে অজিত! তুমি ত্রিলোক মধ্যে অন্যান্য সকলের দ্বারা অজিত হইলেও তাহাদিগের দ্বারা প্রায়ই জিত বা বশীভূত হইয়া থাক।পরন্তু জ্ঞানের দ্বারা যাহারা মুক্তি প্রাপ্ত হন। তাহাদিগের কর্তৃক তুমি বশীভূত হও না, ইহাতে তোমার কথা শ্রবণকারী গনের সংসারতরণ আশ্চর্য কি? অতএব তোমার কথার একদেশ- জ্ঞানই সেই জ্ঞান, যার দ্বারা লোকে সংসারও উত্তীর্ণ হয়, ইহাতে পূর্বোক্ত শ্রুতির অর্থও জ্ঞাপিত হইল - এই ভাবার্থ।

শ্রেয়ঃ সৃতিং ভক্তিমুদস্যতেবিভো,   ক্লিশ্যন্তি যে কেবল বোধ লব্ধয়ে ।

তেষামসৌ ক্লেশল এব শিষ্যতে,   নান্যদ্ যথা স্থূলতুষাবঘাতীনাম্ ।।   

অর্থাৎ,- হে প্রভো, যে সকল জ্ঞানমার্গ অবলম্বী ব্যক্তি নিজের মঙ্গল লাভের পথস্বরূপ ভগবদ্ভক্তি পরিত্যাগ করিয়া কেবল অর্থাৎ ভক্তি শূন্য জ্ঞান লাভের জন্য ক্লেশ স্বীকার করেন। তাহাদের অন্তঃসারশূন্য স্থূল তূষ অবঘাতির ন্যায় ক্লেশমাত্রই লাভ হইয়া থাকে। তদ্ব্যাতিত আর কিছুই লাভ হয় না।।   ---  (ভা.১০ / ১৪ / ৪)   

*শ্রীমদবিশ্বনাথ চক্রবর্তী পাদের* টীকার বঙ্গানুবাদ :- শ্রবন-কীর্ত্তনাদি ভক্তি অঙ্গ সমূহের মধ্যে একাঙ্গ ভক্তি সাধনের দ্বারাই জীব কৃত - কৃতার্থ হইয়া থাকে। যাহা ক্রয় করিতে হয় না, পত্র পুষ্প, ফল, জল সর্বদা উপস্থিত থাকিতে এবং পুরাণ পুরুষ একমাত্র ভক্তি দ্বারা সুলভ্য হলে, কি জন্য লোকে মুক্তির জন্য চেষ্টা করে? তথাপি যাহারা সেই ভক্তিকে পরিত্যাগ করিয়া কেবল জ্ঞান লাভের জন্য ক্লেশ স্বীকার করেন, তাহাদের দুঃখই লাভ হয়। ভক্তি অনাদর করিয়া যাহারা কেবল জ্ঞান লাভের নিমিত্ত প্রয়াস করেন, এ বিষয়ে দৃষ্টান্ত:- স্থূল....অল্প পরিমাণ চাউল পরিত্যাগ পূর্বক অতিকষ্টে আনিত পর্বত প্রমাণ তূষ (ধানের বর্জিত অংশ) সংগ্রহ করিয়া অবঘাত করিলে যেমন সে কেবলমাত্র হস্তবেদনা মাত্র ফল প্রদান করিয়া থাকে অন্য কোন ফল হয় না (তদ্রুপ একাঙ্গ হইলেও ভক্তি কে তুচ্ছ করিয়া কেবল জ্ঞানপ্রাপ্তির নিমিত্ত যত্নকারী ব্যক্তি সকলের কিঞ্চিত মাত্র লাভ হয় না। কিন্তু ক্লেশ মাত্রই অবশিষ্ট হইয়া থাকে ।

ক্ষনমিহ সজ্জন সঙ্গতিরেকা, ভবতি ভবার্ণব তরণে নৌকা।। আচার্য শঙ্কর।।

তুলসী ইয়ে সংসার মে পাঁচ রতন হ্যাঁয় সার।

সাধুসঙ্গ, হরিকথা, দয়া, দীন, উপকার।।

বিনু সত্সঙ্গ বিবেক ন হোই।

রাম কৃপা বিনা সুলভ ন সোই।।

সাধুসঙ্গ সাধুসঙ্গ সর্ব শাস্ত্রে কয়।

লব মাত্রে সাধুসঙ্গে সর্ব সিদ্ধি হয়।।

সর্ব বৈষ্ণবের চরণে করি নমস্কার।

সবে পদধূলি দেহ মস্তকে আমার।।