🍁পরম ভাগবত শ্রীসনৎকুমার 🍁

🌷🌺🏵️🍁💞🌺🌸🌻🌸🌺💞🍁🏵️🌺🌷

বিশেষ পোষ্ট

শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ

সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম I

‘’হরি - গুরু - বৈষ্ণব তিনিহেঁ স্মরণ।

তিনেহেঁ স্মরণ হইতে বিঘ্ন বিনাশন।।

অনায়াসে হয় নিজ বাঞ্ছিত পূরণ ।।‘’

''স্বয়ম্ভুর্নারদঃ শম্ভুঃ কুমারঃ কপিলো মনুঃ।

প্রহ্লাদো জনকো ভীষ্মো বলিরব্যাসকির্বয়ম।।'' ---(শ্রীমদ্ভাগবত ৬/৩/২০)

 
পৃথু মহারাজের রাজত্বকালে ভূলোকের সমস্ত বস্তু নিষ্পাপ ছিল। ব্রহ্মার চারপুত্র বা চতুষ্কুমার তখন পৃথু মহারাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে মনস্থ করেন। সেই চারকুমার--- সনক, সনন্দ, সনাতন ও সনৎকুমারকে দর্শন করে পৃথু মহারাজ তাঁদেরকে স্বাগত জানাতে উদগ্রীব হয়েছিলেন। বিনীতভাবে তাঁদেরকে স্বর্ণসিংহাসনে বসিয়ে, তাঁদের পাদ ধৌত করে সেই জল রাজা নিজমস্তকে সিঞ্চন করলেন। তাঁদের যথাযথ সম্মান জানিয়ে সংযতভাবে পৃথু মহারাজ বলতে লাগলেন, হে মহর্ষিগণ, আপনারা সৌভাগ্যের মূর্ত বিগ্রহ। আপনাদের দর্শন যোগীদেরও দুর্লভ। জানি না কোন্ পুণ্যে আপনাদের দর্শন পেলাম। যদিও আপনারা সমস্ত লোকে বিচরণ করেন, তবুও কেউ আপনাদের দেখতে পায় না।

আপনারা যার গৃহে আসেন, সেই গৃহ ধন্য, সেই গৃহস্থ ধন্য। এমনকি গৃহী ব্যক্তি নির্ধন হলেও। আপনারা ব্রহ্মচর্যপরায়ণ, আপনারা সর্বদা ছোট্ট বালকের মতো রয়েছেন, আপনারা কত সুন্দর। কিন্তু গৃহীজীবন অমঙ্গলজনক ও বিপদসংকুল। পূর্বকৃত মন্দ কর্মফলে লোকে গৃহসংসারী হয়। তাদের কি মঙ্গলময় পারমার্থিক জীবন লাভের কোনও সৌভাগ্য সম্ভাবনা আছে? সর্বদা চিন্ময় আনন্দে মগ্ন আপনাদের মতো মহর্ষিরা সংসার-দাবানলে সন্তপ্ত ব্যক্তিদের একমাত্র সুহৃৎ। তাই আপনাদের কাছে আমার প্রশ্ন, কিভাবে আমরা অচিরেই এই জড় জগতে আমাদের জীবনের পরম উদ্দেশ্য সাধন করতে পারি। পৃথু মহারাজের বাক্যে চতুঃসন প্রসন্ন হয়েছিলেন। শ্রীসনৎকুমার বললেন, হে মহারাজ, আপনার এইরকম প্রশ্ন সমস্ত জীবের পক্ষে লাভপ্রদ। এই ধরনের আলোচনাও বক্তা ও শ্রোতা উভয়েরই অভিলষিত এবং মঙ্গলজনক ।

হে রাজন্, আপনি তো পরমেশ্বর ভগবানের পাদপদ্মের মহিমা কীর্ত্তনে ইতিমধ্যে যুক্ত আছেন। যে-কেউ যখন ভগবানের প্রতি অবিচলিত শ্রদ্ধা লাভ করে, তখন আপনা থেকেই তার অন্তরের সমস্ত জড় কামনা বাসনা বিধৌত হয়। শাস্ত্রে পূর্ণরূপে বিচারের দ্বার স্থিরীকৃত হয়েছে যে, মানব সমাজের কল্যাণের চরম লক্ষ্য হচ্ছে দেহাত্মবুদ্ধিতে আসক্ত না হয়ে পরমেশ্বর ভগবানের প্রতি গভীর অনুরাগ লাভ করা। যারা ভক্তি অনুশীলন করছে, ভগবানের আরাধনা করছে, ভগবানের কথা শ্রবণ কীর্ত্তন করছে, তাদের আসক্তি ভগবানের প্রতি বৃদ্ধি হচ্ছে। পারমার্থিক জীবনে উন্নতি সাধন করতে হলে, ইন্দ্রিয়তৃপ্তি পরায়ণ ও অর্থলোলুপ ব্যক্তিদের সঙ্গ ত্যাগ করতে হয়। মানুষের জীবনকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে শ্রীহরির মহিমামৃত পান না করে সে শান্তিতে থাকতে পারে না।
 
পারমার্থিক উন্নতি সাধনে যিনি আগ্রহী, যাঁরা ভগবদধামে ফিরে যেতে আগ্রহী, তাদের প্রথমে এই সব নিয়ম মেনে চলতে হবে যথা,-
(১) অহিংসা আচরণ করতে হবে।
(২) মহান আচার্যদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হবে।
(৩) সর্বদা শ্রীহরিকে স্মরণ করতে হবে। অর্থাৎ এমনভাবে জীবনযাপন করতে হবে যাতে শয়ন , ভোজন, চলন, কাজকর্ম করার সময় সর্বদা শ্রীকৃষ্ণের চিন্তায় মগ্ন থাকা যায়।
( ৪ ) শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধ পালন করতে হবে।
(৫) ইন্দ্রিয় সংযম অভ্যাস করতেই হয়।
(৬) অন্যের সমালোচনা করা উচিত নয়, অর্থাৎ, মানুষ যখন রজো ও তমাে গুণে প্রভাবিত থাকে, তখন তাদের ধর্মের পন্থাও সেই গুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়। ভগবদ্ভক্ত তাদেরকে যথার্থ ধর্ম অনুষ্ঠান করতে অনুপ্রাণিত করেন, যাতে ধীরে ধীরে মানুষ সাত্ত্বিক স্তরে উন্নীত হতে পারে। তা না করে ভক্ত কেবল যদি তাদের সমালোচনা করে, তা হলে ভক্তের নিজের মন ক্ষুব্ধ হবে, সেটি ভাল নয়।

(৭) সরল জীবন যাপন করতে হবে। ভোগী বিষয়ীরা আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন করতে চায়। ভক্তরা প্রয়ােজনের অতিরিক্ত আহার ও নিদ্রা গ্রহণ করে না। 
(৮) দ্বন্দ্বভাব সহ্য করতে হয়। অর্থাৎ এই জগৎ দ্বৈতভাব সমন্বিত। ঋতুর পরিবর্তন হয়। আধ্যাত্মিক-আধিভৌতিক-আধিদৈবিক দুঃখের দ্বারা দেহ-মন প্রভাবিত হলেও সেগুলি সহ্য করে কৃষ্ণস্মরণ করে চলতে হয়।
(৯) ভগবানের দিব্য গুণাবলী নিত্য শ্রবণ করতে হয়। তাতে ভক্তি বৃদ্ধি হয়।
(১০) শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রেমময়ী সেবা সম্পাদন করে চলতে হয়।

হে রাজন্ , পারমার্থিক শ্রীগুরুদেবের শরণাগত হয়ে তাঁর উপদেশ অনুসারে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আকৃষ্ট না হওয়া পর্যন্ত হৃদয়ের জড় পঞ্চ আবরণ থেকে মুক্ত হওয়া যায় না। আত্মা যখন এই জড় জগতে ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করতে চায়, তখন সে বিভিন্ন রকমের বাসনা সৃষ্টি করে এবং সেই কারণে সে জড় চেতনায় বেশি করে আবদ্ধ হয়েই থাকে। আত্মা যখন চিন্ময় আনন্দে স্থিত হয়, তখন ভগবৎ প্রীতি-সেবা ব্যতীত অন্য কর্মে তার রুচি থাকে না। মন যখন জড়সুখ ভোগের প্রতি আকৃষ্ট হয় তখন মন বিক্ষুব্ধ হয়। বিষয়ভোগ চিন্তা করার ফলে জীবের প্রকৃত চেতনা প্রায় বিলুপ্ত হয়। এভাবে চেতনাভ্রষ্ট জীব তার পূর্ব স্থিতি, তার বর্তমান স্থিতি কিছুই বুঝতে পারে না। তার আত্ম-উপলব্ধির ক্ষমতা হারিয়ে যায়।  

সর্বদা মানুষের জ্ঞান ও বিজ্ঞান নিয়ে থাকা উচিত। জ্ঞান হল সে স্বরূপে ভগবানের দাস এবং বিজ্ঞান হল তার স্বরূপের ব্যবহারিক প্রয়োগ অর্থাৎ কৃষ্ণভক্তি অনুশীলনে সংযুক্ত থাকা। মনুষ্য জীবনে শ্রীগুরুদেব ও শাস্ত্রের সাহায্যের মাধ্যমে যদি জীবনের এরকম সদ্ব্যবহার না করা হয়, কেবল দিন দিন অর্থ উপার্জন ও ইন্দ্রিয়তপণ চিন্তায় কাল-যাপিত হয়, তবে আসল স্বার্থ বিনাশ প্রাপ্ত হবে। জ্ঞানশূন্য ও ভক্তিশূন্য হওয়ার ফলে পরবর্তী জীবনে অবশ্যই স্থাবর যোনিতেই জন্ম নিতে হবে। পাহাড়, পর্বত, গাছপালা প্রভৃতি হচ্ছে স্থাবর জীব। হে রাজন; যারা অজ্ঞান-সমুদ্র উত্তীর্ণ হতে ঐকান্তিক ভাবে অভিলাষী, তাদের কখনও তমোগুণের সঙ্গ করা উচিত নয়। তমোগুণী ভোগবাদী কার্যকলাপে যুক্ত হওয়া উচিত নয়।

শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন, তমোগুণী ভোগবাদী কার্যকলাপ হচ্ছে, ধর্মীয় অনুশাসন বর্জিত কার্যকলাপ। যেমন কসাইখানা খুলে অর্থ উপার্জন করা, ইন্দ্রিয় তর্পণের জন্য নাইট ক্লাব বা বেশ্যাবৃত্তি, অর্থ উপার্জনের জন্য মদের কারবার প্রভৃতি নারকীয় পন্থা। জড়জাগতিক পুণ্যকর্ম, অর্থনৈতিক উন্নতি ও ইন্দ্রিয়সুখভোগের প্রতি বেশি গুরুত্ব না দিয়ে আমাদের ভগবদ্ধামে পৌঁছানোর চেষ্টা করা উচিত। সেটিই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা বিনাশশীল বস্তুতে আমাদের প্রকৃত সুখ আদৌ সম্ভব নয়। হে মহারাজ, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রেমময়ী সেবায় যুক্ত হোন।

অজ্ঞানের সমুদ্র পার হওয়া অত্যন্ত কঠিন, কারণ তা ভয়ংকর হাঙর ও তিমি সংকুল। অভক্তরা যদিও সেই সমুদ্র উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন ও তপস্যা করছে, তবুও আপনি সেই সমুদ্র উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য কেবলমাত্র পরমেশ্বর ভগবানের শ্রীপাদপদ্ম-রূপী নৌকার আশ্রয় অবলম্বন করুন। এই সমুদ্র যদিও অত্যন্ত দুস্তর, তবুও তাঁর শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় নিয়ে আপনি অনায়াসে সমস্ত দুর্বিপাক অতিক্রম করতে পারবেন।

পৃথু মহারাজ বললেন, হে ব্রাহ্মণ, আপনারা ভগবানের মতোই কৃপালু। আপনারা ভগবৎ আদেশ পূর্ণরূপে পালন করছেন। আপনাদেরকে আমার কিছু দান করা কর্তব্য, কিন্তু আমার বলে কিছু নেই, সবই সাধু-ব্রাহ্মণদের কৃপা স্বরূপ আমি ব্যবহার করছি। তবুও আমার রাজ্য, বল, ভূমি, রাজকোষ, গৃহসামগ্রী, আমার জীবন; সমস্তই আপনাদের চরণে নিবেদন করলাম। যেহেতু বৈদিক জ্ঞান সমন্বিত ব্যক্তিই সেনাপতি, রাজ্যশাসক, দণ্ডদাতা ও সমগ্র গ্রহলোকের অধিপতি হওয়ার যোগ্য, তাই তাঁদের কাছেই সব কিছু নিবেদন করা উচিত। সমস্ত মানব-সমাজের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বন্ধু ও উপকারক হচ্ছেন তিনি, যিনি মানুষদেরকে মূল ভগবৎ চেতনায় জাগরিত করেন।

চতুষ্কুমারের আশীর্বাদ নিয়ে রাজা পৃথু, যিনি ছিলেন একজন দায়িত্বশীল সম্রাট, তিনি একজন পরম ভক্ত রূপে তাঁর কর্তব্য সম্পাদন করতে লাগলেন। তাঁর সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধির ফলে অত্যন্ত ঐশ্বর্যশালী হয়েছিলেন। কোনও ঐশ্বর্য নিজ ইন্দ্রিয় তৃপ্তি সাধনের জন্য ব্যবহার করেননি। তিনি অনাসক্ত ছিলেন। তিনি গৃহস্থ ছিলেন। তাঁর পত্নী অর্চিদেবী। তাঁরা নিজভাবনার অনুরূপ পাঁচটি পুত্রসন্তান উৎপাদন করেছিলেন। অর্থাৎ সেই পুত্রদের জন্ম ঘটনাক্রমে বা খামখেয়ালীর বশে হয়নি। সমস্ত পবিত্র সংস্কার সাধন করে, পৃথিবীর ভবিষ্যৎ উপযুক্ত শাসকরূপে গড়ে তোলার মানসিকতা নিয়ে তাঁরা সন্তানের মাতাপিতা হতে যত্ন নিয়েছিলেন। পৃথু মহারাজের সমস্ত কর্মে, প্রত্যেক প্রজা প্রসন্ন থাকত। তিনি সৌন্দর্যে, বিক্রমে, বাৎসল্যে, নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতায় এবং সর্বোপরি ভগবদ্ভক্তিপূর্ণ জীবনযাপনে অতুলনীয় ছিলেন। তিনি শ্রীবিষ্ণু ও পরমবৈষ্ণব চতুষ্কুমারের কৃপাদৃষ্টি পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করতেন।

"হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে !

হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে !!"

🌺জয় শ্রীরাধাকৃষ্ণের জয় 🌺🌺জয় সকল ভক্তবৃন্দের জয়🌺