🍁পরম ভাগবত শ্রী ভীষ্মদেব🍁

🌺🏵️🍁💞🌺🌸🌻🌸🌺💞🍁🏵️🌺

বিশেষ পোষ্ট

শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ

সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম I

‘’হরি - গুরু - বৈষ্ণব তিনিহেঁ স্মরণ।

তিনেহেঁ স্মরণ হইতে বিঘ্ন বিনাশন।।

অনায়াসে হয় নিজ বাঞ্ছিত পূরণ ।।‘’

''স্বয়ম্ভুর্নারদঃ শম্ভুঃ কুমারঃ কপিলো মনুঃ।

প্রহ্লাদো জনকো ভীষ্মো বলিরব্যাসকির্বয়ম।।'' ---(শ্রীমদ্ভাগবত ৬/৩/২০)

একদিন যুধিষ্টির মহারাজ পঞ্চপাণ্ডব কে সাথ দ্রৌপদীকে নিয়ে, যুদ্ধক্ষেত্রে সরশয্যায় শায়িত ভীষ্ম পিতামহের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন,-  হে পিতামহ! লোকে  কিরকম আচার সম্পন্ন হয়ে ইহলোক ও পরলোক শ্রেয়ো লাভ করতে পারে, তা আমার কাছে বলুন। গঙ্গাপুত্র ভীষ্মদেব বললেন, বৎস! কায়-মনো-বাক্যে পাপাচার পরিত্যাগ করলে মানুষ উভয়লোকে শ্রেয়ো লাভ করতে পারে। যুধিষ্ঠির প্রশ্ন করলেন, কায়-মনো-বাক্যে পাপাচার কি রকম?

ভীষ্মদেব বললেন, তিন রকমের পাপ- (১) কায়িক পাপ, (২) বাচিক পাপ ও (৩) মানসিক পাপ।

১। কায়িক বা শারীরিক পাপ  তিন  রকমের,-

(১) পরহিংসা,-  জীবহত্যা, অপরের শরীরে আঘাত করা, শারীরিকভাবে নিপীড়ন করা।
(২) চৌর্য,-  অন্যের দ্রব্য চুরি করা।
(৩) পরস্ত্রী উপভোগ,- পরনারী হরণ, পরস্ত্রীসঙ্গ, বেশ্যালয় গমন।

২। বাচিক পাপ চার রকমের,-

(১) অসৎ প্রলাপ,-  গ্রাম্য কথা, সাংসারিক গল্প করা।
(২) নিষ্ঠুরবাক্য প্রয়োগ,- অন্যের প্রতি মর্মদাহী বাক্য নিক্ষেপ করা।
(৩) পরদোষ প্রকাশ,-  অন্যের গুণ না দেখে দোষগুলিকেই কীর্ত্তন করা।
(৪) মিথ্যা কথন,-  সত্যকে গোপন রেখে মিথ্যাটাকেই সত্য বলে ঘোষণা করা।

৩। মানসিক পাপ তিন রকমের,-

(১) পরদ্রব্য অভিলাষ,- যা নিজের নয়, পরের বলে জানি, সেটিই পাওয়ার ইচ্ছা।
(২) পরের অনিষ্ট চিন্তা,-  লোকের মঙ্গল চিন্তা না করে, লোকের কি করে ক্ষতি হয়, সেই চিন্তা করা।
(৩) বেদবাক্যে অশ্রদ্ধা,-  বৈদিক শাস্ত্র কথা শ্রবণ করলে, আমরা নিজেদের সংশোধন করতেও পারি, কিন্তু বৈদিক হিতোপদেশের প্রতি অনীহা বা অশ্রদ্ধা মনোভাব পোষণ করা।

হে যুধিষ্ঠির, এই তিন রকমের পাপ পরিত্যাগ করলে, কি ইহলোকে কি পরলোকে শ্রেয়ো  লাভ হয়। অন্যথায় পাপকর্মফলে উভয়লোকে অশুভ পরিস্থিতি যাতনাকষ্ট ভোগ করতে হয়। যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, ইহলোকে মাংসলোলুপ নৃশংস ব্যক্তিরা রাক্ষসের মতো। তারা ভগবৎ নির্দিষ্ট কেবল শাকসবজি ফলমূল বা ঘৃত শর্করা ইত্যাদি সুস্বাদু  ভক্ষ্যদ্রব্যের প্রতি প্রীত হয় না। ভীষ্মদেব বললেন,-  ধর্মরাজ, যে ব্যক্তি অন্যের মাংস দ্বারা নিজ মাংস বর্ধিত করতে চায়, সে নিষ্ঠুর। মানুষের নিজের মতো অন্যের প্রিয় প্রাণ সংহার করতে কখনও প্রবৃত্ত হওয়া উচিত নয়। শুক্র থেকে মাংস উৎপন্ন হয়, সেই মাংস ভক্ষণ করা নিৰ্ঘৃণের কর্ম। বৈদিক যজ্ঞবিধান অনুসারে মাংস ভক্ষণে দোষ ছিল না, কিন্তু সাধারণ ক্ষেত্রে এটি অবশ্যই হিংসাকর্ম। মৃত্যু সমস্ত প্রাণীরই অপ্রীতিকর, মৃত্যুকাল উপস্থিত হলে সবারই শরীর কম্পিত হয়।

এই সংসার মধ্যে প্রাণীরা জন্ম ও জরাজনিত দুঃখে নিরন্তর ক্লিষ্ট হয়। পরিশেষে আবার মৃত্যু এসে তাদেরকে যারপরনাই যাতনা প্রদান করে থাকে। যারা মাংস ভক্ষণ করছে, তারা,-

(১) প্রথমে কুম্ভীপাক নামক নরককুণ্ডে যাতনা ভোগ করবে।
(২) তারপর তির্যক জাতির গর্ভে অবস্থান করবে এবং ক্ষার, অন্ন, কটু রস এবং মুত্র, শ্লেষ্মা ও মল দ্বারা সিক্ত ও ক্লিষ্ট হবে।
(৩) তারপর ভূমিষ্ঠ হয়ে অন্যের বশীভূত হবে এবং ভয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে থাকতে হবে।
(৪) বারংবার অন্যদের দ্বারা আক্রান্ত ও নিহত হতে হবে। যে দুরাত্মা জীবিত প্রিয় জীব-জন্তুর মাংস ভক্ষণ করে, তারা পরজন্মে সেই সমস্ত নিহত জীবজন্তু কর্তৃক আবার ভক্ষিত হয়, সন্দেহ নেই। যারা পশু হত্যা করে, পরজন্মে তারা আগে এবং যারা সেই পশুর মাংস খায়, তারা তার পরেই সেই একই পশু কর্তৃক বিনষ্ট হয়ে থাকে।

এই জীবনে যে ব্যক্তি অন্যের প্রতি আক্রোশ প্রকাশ করে, তাকে পরজীবনে অন্য কর্তৃক আক্রুষ্ট হতে হয়। এই জীবনে যে অন্যের প্রতি দ্বেষ প্রকাশ করে, তাকে তার দ্বারা দ্বিষ্ট হতে হয়। যে ব্যক্তি যে অবস্থায় যে কার্য করে, তাকে সেই অবস্থাতেই সেই কার্যের ফল ভোগ করতে হয়, সন্দেহ নেই। ফলতঃ অহিংসাই মানুষের পরম ধর্ম, পরম দান, পরম তপস্যা, পরম জ্ঞান। অহিংসক ব্যক্তিরা সবার পিতামাতা স্বরূপ।

যারা পরের প্রতি বিদ্রোহাচরণ প্রভৃতি অসৎ কর্ম করে, তারা পাপী বলে নির্দিষ্ট হয়। পাপাচারী ব্যক্তি, পাপ-পুণ্য বলে কিছু নেই;  এই মনে করে।

যুধিষ্ঠির মহারাজ প্রশ্ন করলেন, হে পিতামহ, কোনটি ধর্ম, কোটি অধর্ম,  তা ক্ষেত্র বিশেষে বুঝে ওঠা অত্যন্ত দায় হয়ে পড়ে। আপনি বলুন, যথার্থ ধর্ম জ্ঞানে কার নির্দেশ মেনে চলব? বা কি করব? উত্তরে ভীষ্মদেব বলেন,-  হে যুধিষ্ঠির মহারাজ, বসুদেব  নন্দন শ্রীকৃষ্ণ যে নির্দ্দেশ দিচ্ছেন সেই নির্দ্দেশ মতো চলাটাই একমাত্র ধর্ম। যিনি সঠিকভাবে বেদ অধ্যয়ন করেছেন, যিনি পারমার্থিক জীবন সম্বন্ধে যথার্থই অবগত, তিনি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে অনুসরণ করাকেই জীবের সনাতন ধর্ম বলে বর্ণনা করেন। যুধিষ্ঠির বললেন, হে পিতামহ, লোকে  মোক্ষলাভই চরম পুরুষার্থ বলে। তাই আপনি উৎকৃষ্ট মোক্ষলাভের বিষয়টি দয়া করে বলুন। ভীষ্মদেব বললেন, চার বেদেরও গুহ্য ও সর্বশাস্ত্রসার সেই মোক্ষযোগের কথা বলছি, মন দিয়ে শ্রবণ করো।

এই বসুদেবনন্দন শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন বিশ্বসংসার ও বেদের আদি। তিনিই সনাতন পুরুষ, তিনিই সত্য, জ্ঞান, তিতিক্ষা, যজ্ঞ ও সরলতা স্বরূপ। শ্রীকৃষ্ণই  শাশ্বত পরমব্রহ্ম। শ্রীকৃষ্ণই  সাক্ষাৎ কালচক্র, অনাদি ও অনন্ত। এই ত্রিলোক তাঁর মধ্যেই চক্রের মতো  পরিবর্তিত হচ্ছে। বুদ্ধিমান লোক তাঁকেই অবিনাশী অব্যক্ত ও নিত্য বলে কীর্ত্তন করে থাকেন। সেই শ্রীকৃষ্ণ থেকেই পিতৃ, দেব, ঋষি, যক্ষ, রাক্ষস, নাগ, অসুর ও মানুষদের সৃষ্টি হচ্ছে। শ্রীকৃষ্ণই  যুগপ্রারম্ভে বেদশাস্ত্র, শাশ্বত  লোকধৰ্ম ও প্রকৃতির সৃষ্টি করে থাকেন। সমস্ত শাস্ত্রের মূল জ্ঞাতব্য বিষয় হচ্ছে সেই শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণ পাদপদ্ম লাভই পরম গতি।

দ্রৌপদীদেবী যখন রাজসভামধ্যে দুর্যোধন, দুঃশাসনাদির দ্বারা লাঞ্ছিত হচ্ছিলেন তখন দ্রৌপদীর প্রশ্ন ছিল, রাজপুত্র যুধিষ্ঠির তাঁর পত্নীকে বাজী রেখে খেলা করেছেন, খেলায় পরাজিত হওয়ার আগে না পরে? দুরাত্মা দ্যূতপ্রিয়দের কপট খেলায় কুরুপাণ্ডবাগ্রগণ্য  যুধিষ্ঠির কিভাবে প্ররোচিত হয়ে মূঢ়দের দ্বারা পরাজিত হয়েছেন, তা তিনি নিজে বুঝতে পেরেছেন। এই সভামধ্যে অনেক কুরুবংশীয় ব্যক্তি বিরাজ করছেন, যাঁরা পুত্র ও পুত্রবধুগণের প্রভু ও পরিচালক। তাঁদের কাছ থেকে আমার প্রশ্নের উত্তর চাই যে, সভামধ্যে ধর্মতঃ এই নির্লজ্জদের দ্বারা আমার লাঞ্ছিত হওয়া আবশ্যক কি না?

তখন বয়োজ্যেষ্ঠ ভীষ্মদেব মর্মাহত হয়ে উত্তর দিয়েছিলেন,- হে সুভগে! এদিকে পরবশ ব্যক্তি পরের ধন পণ রাখতে পারে না। ওদিকে স্ত্রী স্বামীর অধীন। এই উভয় পক্ষই তুল্যবল বোধ হওয়াতে তোমার প্রশ্নের যথার্থ উত্তর বিবেচনায় অসমর্থ হয়েছি। ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির ধর্মের জন্য সমগ্র পৃথিবী পরিত্যাগ করতে পারেন, কিন্তু ধর্ম থেকে এক পাও বিচলিত হতে পারেন না। বিশেষত তিনি নিজ মুখে স্বীকার করেছেন, 'আমি পরাজিত হয়েছি, তাই তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না।'  শকুনি দ্যূতক্রীড়ায় দক্ষ। যুধিষ্ঠির তার সঙ্গে ক্রীড়া করতে অভিলাষী, তিনি স্বয়ং তোমার  অবমাননা উপেক্ষা করে রয়েছেন, সেই জন্য আমি তোমার  প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি না।”

দ্রৌপদী বললেন, আমি ধর্মপরায়ণা কুলবধু। আমাকে এই সভামধ্যে নির্যাতন করতে আনা হল, এখন আপনাদের মতো পরিচালকদের সনাতন ধর্ম কোথায় থাকল? আমি পাণ্ডবদের সহধর্মিনী, পার্ষতের ভগ্নী, কৃষের প্রিয়সখী দ্রৌপদী। আমাকে যখন একবস্ত্রা অবস্থায় সভামধ্যে লাঞ্ছিত করতে আনা হয়েছে, তা হলে অবশ্যই এই কুরুবংশের পূর্বপুরুষদের পরম্পরাগত নিত্যধর্ম বিনষ্ট হল। হে ক্ষিতিপালগণ আমার প্রশ্ন, আমি যা হই, আপনাদের নিত্যধর্ম কোথায়? উত্তর দিন। ভীষ্মদেব বললেন,- কল্যাণি! সেই ধর্ম আজ অভিভূত হয়ে অধর্মকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। কৌরবরা আজ লোভে ও মোহের বশীভূত। অতএব এটিই পরিষ্কার বোধ হচ্ছে যে, অচিরেই কুরুবংশ বিলুপ্ত হবে। দ্রোণাচার্য কৃপাচার্য আদি ধর্মবেত্তাগণও অভিভূত হয়ে চুপ রয়েছেন, তোমার প্রশ্নের উত্তর নির্ধারণ করুন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির, তিনিই বলুন, তুমি জিতা না অজিতা।

সেই দ্রৌপদী যখন একদিন শরশয্যায় শায়িত সদুপদেশদাতা সত্যবাদী ভীষ্মদেবকে জিজ্ঞাসা করলেন,-  হে ধর্মপ্রাণ পিতামহ! আজ আপনি আমাদের ধর্ম উপদেশ দান করছেন, কিন্তু আমাকে যেদিন অন্যায়ভাবে বস্ত্রহরণ করছিল দুঃশাসনেরা, তখন আপনি প্রতিবাদ করেননি কেন?

উত্তরে ভীষ্মদেব বলেন,- হে পাঞ্চালী, দুরাত্মা দুর্যোধনের অন্নে পালিত হয়ে আমি কলুষিত হয়ে পড়েছিলাম। সেজন্য আমি কোনও কথা বলতে পারছিলাম না। রণাঙ্গনে অর্জুনের শরাঘাতে আমার শরীর থেকে সেই কলুষিত রক্ত নিঃসৃত হয়ে গেছে, তাই আজ আমি ধর্ম উপদেশ দিচ্ছি। বিষয়ী, ভোগাকাঙক্ষীর অন্ন খেলে মন মলিন হয়। জগতে সাধুব্যক্তির সঙ্গ অত্যন্ত প্রয়োজন।

শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু বলেন-👇👇👇

"বিষয়ীর হাতে অন্ন খাইলে মলিন হয় মন।

মলিন মন হৈতে নহে কৃষ্ণের স্মরন।।"

অর্থাৎ,- বিষয়ী বা মাছ মাংস ভোজী, তিনি যদি পিতা- মাতাও হন, তার হাতে রান্না করা খাবার খেলে, ভক্তের মন কুলষিত হয়, ফলে তিনি স্বাভাবিকভাবে শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করতে পারেন না।- শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত, অন্ত্য. ৬/২৭৮।

"হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে !

হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে !!"

🌺জয় শ্রীরাধাকৃষ্ণের জয় 🌺🌺জয় সকল ভক্তবৃন্দের জয়🌺