💐শ্রীল রুপগোস্বামী 💐

🍁তিরোভাব 🍁

হরে কৃষ্ণ, আগামী ৩১/০৭/২০২০ ইং রোজ - শুক্রবার পরম বৈষ্ণব পরম ভাগবত ষড় - গোস্বামীর মধ্যে প্রধান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর পূর্ণ কৃপাপাত্র শ্রীল রূপগোস্বামীর বিরহ তিথি। সকল ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে করবদ্ধ নিবেদন সবাই এই পরম শ্রীভক্তি সিদ্ধান্তাচার্য্য ব্রজপ্রেমলাভের অভিধেয় - জ্ঞান প্রদাতার পুৎ জীবনচরিত আত্মসাৎ করে নিজের দৈনন্দিন জীবনে আচরণ করবেন।

''শ্রীরূপমঞ্জরী খ্যাতা যাসীদ বৃন্দাবনে পুরা।

সাদ্য রূপাখ্যগোস্বমী ভূত্বা প্রকটতামিয়াৎ।।''

যিনি বৃন্দাবনে পূর্ব্বে রূপমঞ্জরী নাম খ্যাতা ছিলেন, তিনি অধুনা গৌরলীলা পুষ্টির জন্য রুপগোস্বামী রূপে প্রকটিত হইয়াছেন। রাধারাণীর অনুগতা সখীগণের মধ্যে প্রধানা ললিতা সখী, ললিতার অনুগতা মঞ্জরীগণের মধ্যে প্রধানা রূপমঞ্জরী। এইজন্য গৌরলীলাতে ষড় গোস্বামীর মধ্যে প্রধান রূপগোস্বামী। শ্রীআশুতোষ দেবের নূতন বাংলা অভিধানে রূপগোস্বামীর প্রকট কালের স্থিতি ১৪৮৯ খৃষ্টাব্দ হইতে ১৫৫৮ খৃষ্টাব্দ অথবা ১৪১০ শকাব্দ হইতে ১৪৭৯ শকাব্দ প্রদত্ত হইয়াছে। শ্রীরূপগোস্বামী ভৌমলীলায় ভরদ্বাজ গোত্রীয় কর্ণাটদেশীয় ব্রাহ্মণ - রাজবংশে আবির্ভূত হইয়াছিলেন। তাঁহার পিতৃদেব ছিলেন শ্রীকুমারদেব। শ্রীজননী দেবীর পরিচয় জানা যায় না। কুমারদেব বাকলা চন্দ্রদ্বীপে বাস করেন। 

শ্রীমন্মহাপ্রভু গৌড়দেশ হইতে বৃন্দাবন যাত্রাকালে  কানাইর নাটশালা হইতে প্রত্যাবর্ত্তন করিলেন। শ্রীমন্মহাপ্রভু মালদহে রামকেলি গ্রামে পৌঁছিলে তাঁহার সহিত শ্রীরূপসনাতনের প্রথম সাক্ষাৎকার হয়।শ্রীমন্মহাপ্রভুর সহিত অসংখ্য হিন্দু দেখিয়া যবনরাজ বাদশাহ প্রথমে সন্দেহ করিয়াছিলেন। বাদশাহ যাহাতে মহাপ্রভুর সহিত শত্রুতা না করে ক্ষত্রিয় কেশব বাদশাহকে সেইভাবে প্রবোধ দিলেন। শ্রীরুপগোস্বামীও মহাপ্রভুর মহিমা কীর্ত্তন করতঃ বাদশাহের সৌভাগ্যের কথা বলিয়া তাঁহাকে উৎসাহিত করিলেন। শ্রীরূপসনাতন যুক্তি করিয়া উভয়ে মহাপ্রভুর পাদপদ্মে উপনীত হইয়া অত্যন্ত দৈন্যার্ত্তি জ্ঞাপনপূর্ব্বক বলিলেন,-

''জগাই - মাধাই হইতে কোটি কোটি গুণ।

অধম পতিত পাপী আমি দুইজন।।

ম্লেচ্ছজাতি, ম্লেচ্ছসঙ্গী, করি ম্লেচ্ছকর্ম্ম।

গো - ব্রাহ্মণ - দ্রোহি - সঙ্গে আমার সঙ্গম।।

মোর কর্ম্ম, মোর হাতে - গলায় বান্ধিঞা।

কুবিষয়বিষ্ঠা - গর্ত্তে দিয়াছে ফেলিয়া।।

আমা উদ্ধারিতে বলী নাহি ত্রিভুবনে।

পতিতপাবন তুমি - সবে তোমা বিনে।।''  (চৈঃ চঃ মধ্য ১। ১৯৬ – ১৯৯)

''আপনে অযোগ্য দেখি' মানে পাঙ ক্ষোভ।

তথাপি তোমার গুণে উপজায় লোভ।।

বামন হঞা চাঁদ ধরিতে ইচ্ছা করে।

তৈছে মোর এই বাঞ্ছা উঠয়ে অন্তরে।।''  (চৈঃ চঃ মধ্য ১। ২০৪ – ২০৫)

শ্রীমন্মহাপ্রভু রূপ - সনাতনের দৈন্যার্ত্তি শুনিয়া কৃপার্দ্রচিত্ত হইয়া বলিলেন,- ''তোমরা আমার পুরাতন দাস, আজি হইতে তোমাদের নাম 'রূপ' ও 'সনাতন'। গৌড়ে রামকেলিগ্রামে আমি আসিয়াছি তোমাদের সহিত মিলিবার জন্য। অচিরেই কৃষ্ণ তোমাদিগকে উদ্ধার করিবেন। শ্রীকৃষ্ণলীলায় পার্ষদদ্বয় শ্রীরূপ - সনাতন শ্রীগৌরলীলার পুষ্টির জন্য অবতীর্ণ হইয়া সাধক লীলাভিনয় কালে রামকেলিতে শ্রীমন্মহাপ্রভুর দর্শন লাভের পরে তীব্র বৈরাগ্য ও ব্যাকুলতা প্রকট করিলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পাদপদ্ম শীঘ্র লাভের আশায় তাঁহারা কৃষ্ণমন্ত্রে দুইটি পুরশ্চরণ (প্ৰাতঃ মধ্যাহ্ন ও সায়াহ্ন,- ''এই ত্রিকালে নিত্য পূজা, নিত্য জপ্, নিত্য তর্পণ, নিত্য হোম ও নিত্য ব্রাহ্মণ ভোজন'' -  এই পঞ্চাঙ্গকে পুরশ্চরণ বলে।) করাইলেন।

রূপ সনাতনের কঠোর বৈরাগ্য ও ভগবৎনিষ্ঠার বিষয় শ্রবণ করিলে স্বার্থান্ধ ঘোর বিষয়ী ব্যক্তিরও মোহনিদ্রা ভাঙ্গিয়া যায়।শ্রীরূপ গোস্বামী চাকুরী হইতে অবসর গ্রহণ করিয়া সনাতন গোস্বামীর জন্য গৌড়দেশে মুদিখানায় দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা রাখিয়া নিজের সহিত সঞ্চিত সমস্ত ধন লইয়া বাকলা চন্দ্রদ্বীপে গেলেন, ব্রাহ্মণ, বৈষ্ণব ও কুটুম্বগণকে অর্থ বন্টন করিয়া দিলেন। শ্রীমন্মহাপ্রভু বনপথে বৃন্দাবন যাত্রা করিয়াছেন সংবাদ পাইয়া শ্রীরূপ গোস্বামী ছোট ভাই অনুপম মল্লিকে সঙ্গে লইয়া বৃন্দাবনাভিমুখে  যাত্রা করিলেন এবং যে কোনও প্রকারে কারাগার হইতে মুক্ত হইয়া আসিবার জন্য সঙ্কেতে লিখিয়া সনাতন গোস্বামীর নিকট পত্র পাঠাইলেন।

এদিকে গৌরচন্দ্র প্রয়াগতীর্থে উপনীত হইয়াছেন । বিন্দুমাধব দেবদর্শনে বহির্গত হইয়াছেন, শত শত লোক তাঁহার অনুগামী হইয়াছে। দেবমূর্তি দর্শন করিয়া গৌরের ভাবসিন্ধু উথলিয়া উঠিয়াছে । প্রেমাবেশে হরিধ্বনি করিয়া উৰ্দ্ধবাহু হইয়া নৃত্য করিতেছেন। সহস্র সহস্ৰ নরনারী প্রেমে বিগলিত হইয়া নাম সংকীৰ্ত্তনে যোগ দিয়াছে। প্রেম ভক্তির মহাভাবোচ্ছ্বাস হইয়াছে। প্রমত্ত ভক্তগণের নাম কোলাহল গভীর হরিধ্বনি ও প্রেমোচ্ছ্বাসের প্রচণ্ড বন্যাতে যেন প্রয়াগ নগর ডুবিয়া যাইতেছে।

এই সময়ে শ্রীরূপ ও অনুপম প্রয়াগে উপনীত হইলেন । কীৰ্ত্তনানন্দে উন্মত্ত বিপুল জনস্রোতে তাঁহারা কোথায় ভাসিয়া গেলেন । তারপর দাক্ষিণাত্য বাসী এক বিপ্ৰগৃহে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়া চৈতন্যচন্দ্র নিভৃতে উপবিষ্ট আছেন, এমন সময়ে তৃণগুচ্ছ দন্তে করিয়া দীনহীন অকিঞ্চন বেশে শ্রীরূপ ও বল্লভ আসিয়া উপস্থিত হইলেন। গৌরসুন্দরের প্রেমরঞ্জিত রূপমাধুরী নিরীক্ষণ করিয়া তাঁহারা প্রেমে পুলকিত হইয়া দূর হইতে দণ্ডবৎ প্রণাম করিলেন।

বিষয়পাশ মুক্ত ব্যাকুলহৃদয় বৈরাগী শ্ৰী রূপকে দর্শন করিয়া চৈতন্যের মন প্রসন্ন হইল । আইস আইস বলিয়া সম্বৰ্দ্ধনা করিলেন এবং

“ন মে ভক্তশ্চতুৰ্ব্বেদী মদ্ভক্তঃ শ্বপচঃ প্ৰিয়ঃ I

তস্মৈ দেয়ং ততোগ্রাহ্যং স চ পূজ্যো যথাহ্যহং I I’’ এই শ্লোক পাঠ করিয়া দুই ভাইকে প্রেমালিঙ্গন দান করিলেন।

শ্রীচৈতন্য রূপ ও বল্লভকে আলিঙ্গন করিয়া নিকটে বসাইলেন এবং সনাতনের সংবাদ জিজ্ঞাসা করিলেন । রূপ বলিলেন, তিনি রাজদ্বারে বন্দীদশায় রহিয়াছেন, আপনি যদি উদ্ধার করেন, তবেই তিনি উদ্ধার হইবেন । চৈতন্য বলিলেন সনাতন কারাবাস হইতে মুক্তি লাভ করিয়াছেন, অচিরাৎ তাঁহার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হইবে । শ্রীরূপ ও অনুপম প্রয়াগেই রহিলেন। প্রেমরসে অভিষিক্ত হইয়া ভক্তগোষ্ঠী সহ ধৰ্ম্মপ্রসঙ্গে অতি সুখে কালযাপন করিতে লাগিলেন। তৎকালে আম্বুলী গ্রামে বল্লভ ভট্ট নামা একজন জ্ঞানী ভক্ত ব্রাহ্মণ বাস করিতেন। তিনি চৈতন্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া তাঁহাকে নিমন্ত্রণ করিয়া লইয়া গেলেন । চৈতন্য রূপ ও অনুপমের সঙ্গে বল্লভ ভট্টের পরিচয় করিয়া দিলেন । তাঁহারা ভট্টাচাৰ্য্যকে প্রণাম করিলেন । ভট্টাচার্য অালিঙ্গন করিতে অগ্রসর হইলে “আমরা অস্পৃশ্য পামর — আমাদিগকে স্পর্শ করিবেন না” এই বলিয়া রূপ ও অনুপম দূরে সরিয়া পড়িলেন । এই ব্যবহারে ভট্টাচাৰ্য্য বিস্মিত হইলেন ; কিন্তু দৈন্য- বিনয় দেখিয়া চৈতন্য হর্ষে পুলকিত হইয়া ভঙ্গি করিয়া বলিলেন — ভট্টাচাৰ্য্য, তুমি একজন প্রবীণ কুলীন এবং বৈদিক যাজ্ঞিক ব্রাহ্মণ, তুমি ইহাদিগকে স্পর্শ করিও না, ইহ়ারা অতি হীন জাতি। চৈতন্যের ইঙ্গিত বুঝিতে পারিয়া ভট্ট বলিলেন, ইঁহাদের মুখে যখন নিরন্তর হরিনাম নৃত্য করিতেছে তখন ইঁহারা যে সৰ্ব্বশ্ৰেষ্ঠ তাহাতে তাঁর সন্দেহ নাই ।

আম্বুলী গ্রামের পাদদেশ বিধৌত করিয়া প্রসন্ন সলিলা যমুনা প্রবাহিতা । ভক্তবৃন্দের সঙ্গে নিরন্তর ধৰ্ম্মপ্রসঙ্গ এবং যমুনার সুচিক্কন শ্যামল বারিধারা সন্দর্শন করিয়া চৈতন্য প্রেমাবেশে বিহ্বল হইয়া পড়িলেন । প্রেমোন্মত্ত নিমাইচন্দ্রের অদ্ভুত ভক্তিভাবের কথা শ্রবণ করিয়া দলে দলে দর্শকগণ অাসিতে লাগিল। ব্রাহ্মণেরা তাঁহাকে আপনাদের গৃহে নিমন্ত্রণ করিতে লাগিলেন । এখানে থাকিলে প্রেমভরে বাহ্য জ্ঞানশূন্য হইয়া কখন বা মধ্য যমুনাতে পড়িয়া যান, এই ভয়ে ভট্ট তাঁহাকে প্রয়াগে রাখিয়া আসিলেন । 

প্রয়াগে অবস্থানকালে চৈতন্য রূপ গোস্বামীকে শক্তি সঞ্চার করিয়া কৃষ্ণতত্ত্ব ভক্তিতত্ত্ব রসতত্ত্ব প্রভৃতি সমুদায় ভাগবত সিদ্ধান্ত শিক্ষা দিতে লাগিলেন । রায় রামানন্দের নিকট যে সকল প্রেমভক্তির গূঢ় সিদ্ধান্ত শ্রবণ করিয়াছিলেন , কৃপা করিয়া শ্রীরূপকে সে সমুদায় শিক্ষা দিলেন । শিবানন্দের পুত্র কবিকর্ণপুর স্বপ্রণীত সংস্কৃত “চৈতন্য চন্দ্রোদয় ” নাটকে চৈতন্যের সহিত রূপ গোস্বামীর মিলন বৃত্তান্ত বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করিয়াছেন ।

রূপ গোস্বামীকে দশ দিন ধরিয়া শ্রীগৌরাঙ্গ পরমার্থতত্ত্ব শিক্ষা দিলেন । গৌর বলিলেন, রূপ ! তোমাকে সংক্ষেপে ভক্তি রসের লক্ষণ বলিতেছি শ্রবণ কর । ভক্তিরসসিন্ধু পারাবার শূন্য অনন্ত গম্ভীর, তোমাকে তার বিন্দু মাত্র কহিতেছি। কেশাগ্র শতভাগ করিয়া পুনঃ শত ভাগ করিলে যাহা হয়, জীবের স্বরূপ তদনুরূপ সূক্ষ্ম । জলস্থলময় স্থাবর জঙ্গমাত্মক জগতে মনুষ্য অতি অল্প । মনুষ্যের মধ্যে ম্লেচ্ছ পুলিন্দ বৌদ্ধ শবর অধিকাংশ । বেদনিষ্ঠদিগের মধ্যে অৰ্দ্ধেক লোক মৌখিক বেদনিষ্ঠ মাত্র। ধৰ্ম্ম অগ্রাহ্য করিয়া বেদনিষিদ্ধ পাপ কৰ্ম্মে তাহারা রত রহিয়াছে । ধৰ্ম্মাচারী লোকদিগের মধ্যে কৰ্ম্মনিষ্ঠ লোক অধিকতর , কোটি কৰ্ম্মনিষ্ঠের মধ্যে একজন জ্ঞানী। কোটি জ্ঞানীর মধ্যে একজন মুক্ত , কোটি মুক্ত পুরুষের মধ্যে একজন হরিভক্ত সাধু অতি দুর্লভ । হরিভক্তেরা কামনাশূন্য এইজন্য শান্ত, ভক্তিতেই যথার্থ শান্তি । মুক্ত সিদ্ধ ও ফলকামীরা অশান্ত।

ভাগবতে কথিত হইয়াছে,-
“মুক্তানামপি সিদ্ধানাং নারায়ণপরায়ণঃ I
সুদুর্ল্লভঃ প্রশান্তাত্মা কোটিষপি মহামুনে I I’’

হে মুনিশ্রেষ্ঠ শুকদেব ! যে সকল ব্যক্তি মুক্তি লাভ করিয়া সিদ্ধ হইয়াছেন, তাহাদিগের কোটির মধ্যে বিষ্ণু ভক্তিপরায়ণ প্রশান্তাত্মা অতি দুর্ল্লভ । 

শ্রীচৈতন্য কহিলেন ,— হে শ্রীরূপ ! গুরু এবং ভগবানের কৃপাতে ভাগ্যবান মানব ভক্তিলতা- বীজ লাভ করেন । শ্রবণ কীৰ্ত্তনরূপ জলে উক্ত বীজ সেচন করিলে তাহা হইতে ভক্তিলতা অঙ্কুরিত হইয়া ব্রহ্মাণ্ড ভেদ করত সেই লতা গোলোক বৃন্দাবন ধামে হরিচরণ কল্পবৃক্ষে আরোহণ করে, এবং তা হইতে প্রেমফল প্রসূত হয়। বৈষ্ণবাপরাধ - রূপ হস্তী যদি মস্তকোত্তোলন করে, তাহা হইলে ভক্তিলতা উৎপাটিত ও চ্ছিন্ন হইয়া যায়। ভক্তিলতার সঙ্গে যদি ভোগবাসনা স্বৰ্গকামনা মুক্তিবাঞ্ছা- লাভ প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি উপশাখা মিলিত হয় , তাহা হইলে সেচজল পাইয়া উপশাখাগণই বৰ্দ্ধিত হয়, মূলশাখা অর্থাৎ ভক্তিলতা আর বাড়িতে পায় না । এই জন্য প্রথমেই উপশাখা ছেদন করা কর্তব্য। অর্থাৎ হরিভক্তি লাভ করিতে হইলে প্রথমতঃ ভুক্তি মুক্তি ও স্বৰ্গভোগ প্রভৃতি সমুদায় ফলাভিসন্ধি পরিত্যাগ করিয়া, কেবল হরিচরণাশ্রয় না করিলে শ্রবণ কীৰ্ত্তনাদি সকল প্রকার সাধন ভজন বৃথা হইয়া যায়। এই ভক্তিলতা অবলম্বন করিয়া সাধক কল্পবৃক্ষ লাভ করেন এবং পরম সুখে সুপক্ক প্রেমফল-রস আস্বাদন করেন । এই ভগবৎ প্রেম- রসাস্বাদনই পরম ফল — পরম পুরুষার্থ। ইহার নিকট চারি পুরুষাৰ্থ তৃণ তুল্য । শুদ্ধ ভক্তি হইতে প্রেম উৎপন্ন হয় ।
শুদ্ধ ভক্তির লক্ষণ শ্রবণ কর । অন্য বাঞ্ছা, অন্যপূজা, শুষ্ক জ্ঞান কৰ্ম্মের অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করিয়া পবিত্রভাবে সকল ইন্দ্রিয়ের আনুকূল্যে হরিপ্রেম - রসানুশীলন করাই শুদ্ধ ভক্তি, ইহাকেই অহৈতুকী ভক্তি বলা যায় । পিশাচীতুল্য ভোগবাসনা ও মুক্তিস্পৃহা হৃদয়ে অবস্থিতি করিলে বহু সাধনাতেও প্রেম উৎপন্ন হয় না। নারদ পঞ্চরাত্রে কথিত হইয়াছে,—

“সৰ্ব্বোপাধি বিনির্ম্মুক্তং তৎপরত্বেন নিৰ্ম্মলং ।
হৃষীকেন হৃষীকেশ সেবনং ভক্তিরুচ্যতে ॥”

“সর্বোপাধি বিনির্মুক্ত কি না অন্য বাঞ্ছা পরিত্যাগপূর্বক একাগ্রচিত্তে পবিত্র ভাবে ইন্দ্রিয়াদির আনুকূল্যে ভগবৎ অনুশীলন করার নামই ভক্তি ।

ইক্ষুরস যেমন ক্রমশঃ ঘনীভূত হইয়া গুড় খণ্ডসার শর্করা মিছরি ও উত্তম মিছরি প্রস্তুত হয়, সেইরূপ সাধন ভক্তি হইতে রতির উদয় হয় । রতি গাঢ় হইলে তাহাকে প্রেম বলা যায় । প্রেমের ক্রমশঃ বৃদ্ধিতে স্নেহ মান প্রণয় রাগ অনুরাগ ভাব মহাভাব উৎপন্ন হইয়া থাকে। এই সমুদায় ভক্তি রসের স্থায়ী ভাব, ইহার সহিত বিভাব অনুভাব অর্থাৎ উদ্দীপনা ও মনের পূর্ণ একাগ্রতা মিলিত হইলে ভক্তিরস অমৃত মধুর হইয়া থাকে। ভক্তের প্রকৃতি ভেদে রতিভেদ পাঁচ প্রকার । শান্ত দাস্য সখ্য বাৎসল্য ও মাধুৰ্য্য এই পাঁচ প্রকার রতি ভেদে হরিভক্তিরস পাঁচ প্রকার হয় । ভক্তিরস মধ্যে এই পাঁচটিই প্রধান । হাস্য অদ্ভুত বীর করুণ রৌদ্র ভয়ানক এবং বীভৎস এই সাতটি গৌণ রস । যে ব্যক্তি যে রসের ভক্ত তাহার হৃদয়ে সেই প্রধান রস স্থায়ী ভাবে অবস্থিতি করে । সাধন ভজনে অগ্রসর হইলে আগন্তুক কারণ যোগে গৌণ রসেরও সঞ্চার হয় 

এই প্রকারে প্রেমভক্তি তত্ত্বের ব্যাখ্যা করিতে করিতে প্রেমনিধি চৈতন্যচন্দ্রের ভাবসিন্ধু উচ্ছসিত হইয়া উঠিল, প্রেমময় পরমেশ্বরের জ্বলন্ত প্রকাশ প্রাণে উপলব্ধি করিয়া বিহ্বল হইয়া পড়িলেন । প্রেমরসে পরিপ্লাবিত হইয়া রূপ গোস্বামীকে আলিঙ্গন করিলেন, এবং বলিলেন, রূপ ! ভগবানের কৃপাই মূল, তাহার কৃপা হইলে সামান্য মূর্খেরাও ভক্তি সমুদ্র উত্তরণ করিতে পারে ।

শ্রীরূপকে ভক্তিতত্ত্ব উপদেশ করিয়া গৌরাঙ্গ বারাণসী গমন করিতে উদ্যত হইলে, রূপ বলিলেন, অনুমতি করেন ত আমিও আপনার সঙ্গী হই । আপনার বিরহ আমি সহ্য করিতে পারিবনা। গৌর বলিলেন, বৃন্দাবনের এত নিকটে যখন আসিয়াছ, তখন বৃন্দাবন ধাম দর্শনার্থ যাত্রা কর । তথা হইতে গৌড়দেশ হইয়া নীলাদ্রিতে আমার সহিত মিলিত হইও । চৈতন্যের আদেশে শ্রীরূপ ও বল্লভ বৃন্দাবন অভিমুখে যাত্রা করিলেন । 

ক্রমশঃ…