🙏শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ🙏

আজ ১৬ ই ডিসেম্বর,৪ ঠা নারায়ণ, ২৯ অগ্রহায়ণ সচ্চিদানন্দ শ্রীল ভক্তি বিনোদ ঠাকুরের পুত্র , পরম ভাগবতবর শ্রীল গৌরকিশোর দাস বাবাজী মহারাজের একমাত্র শিষ্য,বিশ্বব্যাপী শ্রী চৈতন্য মঠ ও তৎশাখা ৬৪ টি গৌড়ীয় মঠ সমূহের প্রতিষ্ঠাতা, গৌড়ীয় সিংহ পুরুষ খ্যাত মহা তেজস্বী বৈষ্ণব মহাজন , গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের নবজাগরণের পথিকৃৎ , গৌড়ীয় বৈষ্ণব গগণের উজ্জ্বল নক্ষত্রমণি, সিংহগুরু,সিদ্ধান্তসার, চিন্ময় ধামে নয়ন মঞ্জরী রূপে অধিষ্ঠিত জগৎ গুরু  নিত্যলীলা প্রবিষ্ট ওঁ বিষ্ণুপাদ পরিব্রাজকাচার্য্য ত্রিদন্ডী স্বামী ১০৮ শ্রী - শ্রীল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর প্রভুপাদের ৮৩ তম তিরোভাব তিথি ও বিরহ মহোৎসব I

গৌড়ীয় সিংহপুরুষখ্যাত এই মহান আচার্যের জীবনী জানার জন্য পড়ুন নিচের বিশেষ লেখাটি .......

শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর মহাশয় এবং তাঁর কার্যক্রম সম্পর্কে বুঝতে হলে আমাদেরকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাবের উদ্দেশ্য এবং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সংকীর্ত্তন আন্দোলনের ব্যাপ্তি সম্পর্কে অবগত হতে হবে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাব ছিল একটি অসাধারণ বিষয়। তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন এই পৃথিবীকে কৃষ্ণভাবনামৃতের প্লাবনে ভাসানোর জন্য এবং তিনি তাই করেছেনও। তিনি সমগ্র ভারতবর্ষকে কৃষ্ণপ্রেমের প্লাবনে ভাসিয়েছেন।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এমন এক সময়ে অবতরণ করেছিলেন যখন এই সমগ্র পৃথিবী চরম অধঃপতিত হয়ে পড়েছিল। যদিও সেটি ছিল কলিযুগের প্রারম্ভ মাত্র কিন্তু তখন ভারতবর্ষ ছিল পারমার্থিকতাহীন অধঃপতিত। তার কারণ হল ঃ রাক্ষসিম কলিম আশ্রিত জয়ন্তে ব্রহ্মযোনীসূ- অসুরগণ কলিযুগের সুযোগ নিয়ে ব্রাক্ষণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করবে এবং বৈদিক সংস্কৃতিকে আক্রমণ করবে। তাঁদের বৈদিক শাস্ত্রের উপর সম্পূর্ণ আধিপত্য বিরাজমান থাকবে এবং তারা বৈদিক সংস্কৃতিকে ধ্বংস করবে। তাই এই কলিযুগে এটিই হল স্বাভাবিক প্রবণতা। কিন্তু পরবর্তীতে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কলির কল্মনাশ ও ধর্ম প্রতিস্থাপনের জন্য আসেন। কেননা ধর্মসংস্থাপনই হল পরমেশ্বর ভগবানের অঙ্গিকার ঃ

‘’যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।

অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ॥‘’

অন্যযুগে মানুষ বৈধিভক্তি অনুশীলনের মাধ্যমে বৈকুন্ঠ পর্যন্ত গমনের সুযোগ লাভ করত। কিন্তু অন্যযুগে গোলকবৃন্দাবনে প্রবেশের সুযোগ ছিল না। তাই এই যুগে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু অবতীর্ণ হয়ে ভগবানের পবিত্র নাম জপের পন্থা আমাদের দিয়েছেন এবং চিদাকাশের সর্ব্বোচ্চ লোকে গমনের অপূর্ব সুযোগ দান করেছেন।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যৌবনে মাত্র ৪৮ বছর বয়সে জগৎ থেকে অন্তর্হিত হন। যদিও তাঁর পার্ষদ এবং দৃঢ়চেতা পরম্পরা আচার্যগণ, মহান বৈষ্ণবগণ এই অভিযান এগিয়ে নিয়ে গেছেন, কিন্তু একসময় কিছুকাল পরে মহাপ্রভুর সংকীর্ত্তন আন্দোলন অন্তর্হিত হয়। মহাপ্রভুর শিক্ষা, মহাপ্রভুর নিদের্শনা এবং মহাপ্রভুর ধাম এই জগৎ থেকে অন্তর্হিত হয় এবং তদস্থলে সকল অপসম্প্রদায় গুলো আবির্ভূত হয়ে এমন শিক্ষার বিস্তার ঘটালো যা সম্পূর্ণরূপে মহাপ্রভুর শিক্ষার বিপরীত। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা সম্পূর্ণরূপে পবিত্র ধর্মের নীতির ভিত্তিতে গঠিত, কিন্তু তাদের সেই ক্রিয়াকর্মগুলো ছিল সম্পূর্ণ অধার্মিক।

এটি কলিযুগের আরেকটি চরিত্র। এই যুগ অধর্মের, তাই অধর্মীয় নীতিসমূহের ব্যাপক প্রসার ঘটবে এবং ধার্মিক নীতিসমূহ উপেক্ষিত হবে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অন্তর্ধানের পরে তা ঘটেছিল। 

অল্পকথায় বলতে গেলে, তাঁরা চৈতন্য মহাপ্রভুর নামে ধর্মের স্তম্ভস্বরূপ ৪টি বিধিনিষেধ ভঙ্গ করেছিলেন । শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষায় অধর্মের চারটি পা প্রবেশ করিয়ে ছদ্মভাবে উপস্থাপনা করা হল এবং তাঁরা সম্পূর্ণরূপে নিরামিষ খাদ্য গ্রহণ নীতি পরিত্যাগ করে, নেশায় মগ্ন থেকে , অবৈধ যৌনসঙ্গ এবং দ্যূতক্রিয়ায় লিপ্ত হয়েছিল। প্রকৃত শিক্ষার পরিবর্তে অপশিক্ষার প্রাদুর্ভাব বেড়েই চলল। এগুলোই অপসম্প্রদায়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ। ক্ষুদ্রতর কিংবা বৃহত্তর মাত্রায় তারা ভক্তিযোগের প্রসারের পরিবর্তে নির্বিশেষে মায়াবাদী ভাষ্য প্রচার করেছিল। এই প্রচার প্রায় দুই শত বছর যাবৎ চলেছিল। ভারতবর্ষ পুরোপুরি এইসকল অপসম্প্রদায়ের খপ্পরে পতিত হয়েছিল । 

ভারতবর্ষের বাইরে অপসম্প্রদায়গুলোর প্রদুর্ভাব তেমন বেশি নয়, কিন্তু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর লীলাবিলাস স্থান মায়াপুর, নবদ্বীপ এবং বৃন্দাবনে মহাপ্রভুর নামে এইসব অপকর্মের প্রাদুর্ভাব প্রচন্ডভাবে বেড়েই চলেছিল।

তারপর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এইসব অপচেষ্টা নাশ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বৃন্দাবনে তাঁর অন্যতম পার্ষদ, একজন মঞ্জরী, শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরকে পাঠালেন। এরপর তিনি তাঁর পুত্ররূপে শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরকে পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। ভক্তিবিনোদ ঠাকুর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষার পুনঃস্থাপন করলেন। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষাকে অঝোরে প্রসারিত করলেন গ্রন্থ প্রকাশনার মাধ্যমে। তিনি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষার গভীর, মহিমান্বিত এবং সম্পূর্ণ নিষ্কলুষ ব্যাখ্যা প্রদান করলেন। তিনি ছিলেন একজন সরকারী কর্মকর্তা। তাঁর সময়গুলো যাতে শুধুমাত্র সরকারী কাজের কারণে ব্যবহৃত না হয় তা তিনি সেই প্রচেষ্ঠা করতেন। যদিও তার বিন্দুমাত্র সময় ছিল না। তিনি একাকী হয়তোবা কৃষ্ণভাবনামৃত, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা কার্যকরীভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন না। তাই তিনি ভগবান জগন্নাথের নিকট প্রার্থনা করলেন একজন যোগ্য সঙ্গি প্রেরণের উদ্দেশ্যে।

ভগবান জগন্নাথের প্রসাদরূপে পরম করুণাময়ী শ্রীমতি রাধারাণীর নির্দেশ ক্রমে শ্রীনয়নমনিমঞ্জরীসখি নিত্য গোলকবৃন্দাবন অন্তর্গত নিভৃত নিকুঞ্জIভ্যন্তরে শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণযুগলকিশোরের নিত্যসেবাসুখানন্দ ছাড়িয়া অভাগা জীবের চিরন্তনদুঃখে  দুঃখীত ও ব্যথায় ব্যথিত হইয়া শ্রীমন্মহাপ্রভু  যে অসমোর্দ্ধ প্রেমভক্তি মাধুর্য্যসম্পত্তি যেথায় রাখিয়া গিয়াছিলেন 'হ্যুৎকলেপুরুষোত্তমাৎ' শ্রীভগবান বেদব্যাসের দিব্যবাণীর সার্থককল্পে শ্রীপুরুষোত্তমধামে শ্রীজগন্নাথদেবের সান্নিধ্যে ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দের (১৭৯৫ শকাব্দ,১২৮০ বঙ্গাব্দ ২৫শে মাঘ )৬ই ফেব্রুয়ারী শুক্রবার  মাঘী কৃষ্ণাপঞ্চমী তিথিতে অপরাহ্ন ৩ ঘটিকায় পুরী শ্রীজগন্নাথমন্দিরের সন্নিকটে গ্রাণ্ড - রোডের পার্শ্বে নারায়ণছত্র নামক স্থানে শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর আবির্ভূত হন। ভক্তিবিনোদ ঠাকুর তাঁর নাম রাখলেন বিমলাপ্রসাদ; বিমলা দেবীর প্রসাদ। বিমলা দেবীর প্রসাদ মূলত ভগবান জগন্নাথের প্রসাদ কেননা জগন্নাথের প্রসাদ অন্নপূর্ণা তথা বিমলা দেবীকে অর্পন করা হয়।

ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর স্বভাবতই অত্যন্ত মেধাবী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি কোন সাধারণ ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন শুদ্ধ ভক্ত। তিনি চিন্ময় জগৎ থেকে এসেছিলেন তাঁর পিতা শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের প্রচারে সহায়তা করতেন। ভক্তিবিনোদ ঠাকুর তাঁকে সুন্দরভাবে পরিচালিত করেন, প্রশিক্ষিত করেন এবং গড়ে তোলেন। যখন তাঁর বয়স মাত্র ৬ বছর তখন ভক্তিবিনোদ ঠাকুর তাঁকে নৃসিংহ মন্ত্র প্রদান করেন। যখন তার বয়স আট, তখন কূর্মদেবের পূজার্চনা পদ্ধতি শেখান, কূর্ম মন্ত্র প্রদান করেন। কেন তিনি তা করলেন তা বিস্তারিতভাবে আমি বলতে চাই না, কিন্তু সাধারণভাবে আমরা বুঝতে পারি যে ভক্তিবিঘ্নবিনাশক নৃসিংহদেব ভক্তিযুক্ত সেবার বিপরীতে উৎপন্ন সকল প্রতিবন্ধকতা বিনাশ করেন। তাই তিনি তাকে এই মন্ত্র দিলেন যেন তিনি ভক্তিপথের সকল বাধা দূর করতে পারেন।

১৮৮৫ সনে তাঁর লিখিত গ্রন্থসমূহ প্রকাশনার জন্য একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ১১ বছর বয়সে ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর তাঁর রচনাসমূহ সম্পাদনা করতেন। সেই ১১ বছর বয়সেই তিনি সম্পাদনা, ভুল সংশোধন এবং সেই অপ্রাকৃত গ্রন্থসমূহ ছাপানোর কাজে তাঁর পিতা ভক্তিবিনোদ ঠাকুরকে সাহায্য করতে শুরু করলেন। ১৯৮১ সনে ১৭ বছর Sবয়সে তিনি ‘‘দি অগাস্ট এ্যাসেম্বলী’’ নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। অগাস্ট এ্যাসেম্বলীর উদ্দেশ্য ছিল তরুণ কিশোরদের একত্রিত করা যাতে তারা আজীবন ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করতে পারে। সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে সেই অল্প বয়সেই তিনি অতি উচ্চতর ধারণার বশবর্তী ছিলেন। তিনি সেই ব্রহ্মচারীদের সমাবেশ তথা অগাস্ট এ্যাসেম্বলী শুরু করেছিলেন কিন্তু কেবলমাত্র একজনই সমগ্র জীবন ব্রহ্মচর্য্য পালনের প্রতিজ্ঞা পালনে সক্ষম হয়েছিলেন, তিনি হলেন ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর। ১৭ বছর বয়সে অগাস্ট এ্যাসেম্বলী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি ব্রহ্মচর্য্য  ব্রত পালনের যে সংকল্প করেছিলেন তা তিনি সমগ্র জীবন ব্যাপি পালন করেছিলেন।

১৮৯৯ সালে শ্রীলভক্তিবিনোদ ঠাকুর ''স্বানন্দ - সুখদ - কুঞ্জ'' প্রতিষ্ঠা করেন যা ছিল তাঁর বাসস্থান এবং ভজন কুটির। এটি ছিল অত্যন্ত সুন্দর আবাসগৃহ। ১৮৯৮ সনে ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর শ্রীল গৌরকিশোর দাস বাবাজী মহারাজের সাক্ষাৎ লাভ করেন। তিনি তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্বে আকৃষ্ট হন।

১৯০০ সালে বহু প্রচেষ্ঠা এবং অনেক বাধা অতিক্রম করে তিনি শ্রীল গৌরকিশোর দাস বাবাজী মহারাজের নিকট দীক্ষা প্রাপ্ত হন।

১৯০১ সালে মার্চ মাসে শ্রীল ঠাকুর শ্রীসরস্বতী ঠাকুরকে লইয়া পুরীতে অবস্থান করেন I ১৯০২ সালে হরিদাস ঠাকুরের সমাধির সন্নিকটে 'ভক্তিকুটির' নির্মাণ কার্য্য আরম্ভ হয় I ১৯০৩ সালে ভক্তিকুটিরে  শ্রীল ঠাকুরের নিকট শ্রীলসরস্বতীঠাকুর নিয়মিত ভাবে শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত পাঠ ও ব্যাখ্যা করিতেন,সেই সময় ঠাকুরের সহিত শ্রীচরণদাস বাবাজীর সাক্ষাৎকার এবং শুদ্ধভক্তিসিদ্ধান্ত বিষয় আলোচনা হয় I

১৯০৫ সালে শ্রীল সরস্বতীঠাকুর ভারতের বিভিন্ন স্থান দর্শন করিয়া কলিকাতা ও তৎপরে মায়াপুরে আগমন করেন I পরে নিজ মনে বিচার করিলেন এই বিরাট বিশ্ব মাঝে আমি একা কি বা করিব,তাহা অপেক্ষা পূর্ব্বের ষড়গোস্বামীগণের পথানুশরণে শ্রীধামবৃন্দাবনে ভজন করিয়া এই জীবন অতিবাহিত করিয়া দিব I এই স্থির করিয়া তিনি শ্রীধামবৃন্দাবনে যাত্রা করিলেন এবং বৃন্দাবনে পৌঁছিয়া প্রগাঢ় ভক্তি ভরে দ্বাদশবন আদি চৌরাশী ক্রোশ ব্রজমণ্ডল দর্শন করিয়া শ্রীরাধাকুন্ডের তীরে তীব্র ভজন করিতে থাকিলেন I একদিন একটি বৃক্ষতলায় বসিয়া শ্রীহরিনাম কীর্ত্তন করিতেছেন, ''ঠিক পূর্ব্বাহ্নে চারিদিক উদ্ভাসিত করিয়া দিব্য জ্যোতির্ময়ী একটি ছোট বালিকারূপে শ্রীমতীরাধারানী দর্শন দান করিলেন'' I  

শ্রীমতীরাধারানী বলিলেন ''তুই কেবল একা ভজন করিয়া নিজেই উদ্ধার হইবার জন্য জগতে এসেছিস? তোকে কি জন্য জগতে পাঠাইয়াছি ?তোর অনেক কাজ পড়িয়া আছে’’I 

বৃন্দাবন এই ব্রজমণ্ডলের বাহিরে জগতের জীব বহু কষ্ট - দুঃখ পাইতেছে I তাহাদের উদ্ধারের পথ দেখাইতে হইবে I আমার কথা,শ্রীকৃষ্ণের কথা,ব্রজের কথা,শ্রীমন্মহাপ্রভুর শিক্ষার কথা,ভজন আদর্শের কথা,যুক্ত বৈরাগ্যের কথা,বিশুদ্ধ নির্মল প্রেমভক্তির কথা এইসব জগতে মায়ার শাসিত অভাগা জীবের উদ্ধারের জন্য মানব সমাজের কাছে প্রচার করিতে হইবে I কলিযুগের জীবের একমাত্র মুক্তির পথ শ্রীমন্মহাপ্রভুর দেওয়া ''হরিনাম সংকীর্ত্তনযজ্ঞ'' I ইহাই এই যুগে জীবের ''সাধন  ও  সাধ্য'' এই সব কথা জগতের মানুষকে বোঝাইতে হইবে I শ্রীমন্মহাপ্রভুর নবদ্বীপ লীলার সব কিছু লুপ্ত হইয়াছে I তাহাকে পূর্ণরূপে প্রকাশ করিতে  হইবে I এখানে তোকে একা ভজন করিতে হইবে না,নবদ্বীপে ফিরিয়া যা I বঙ্গ - বিহার - ওড়িশা সহ পৃথিবীর মানুষের কাছে শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের যুগল ভজনের কথা হরিনাম  ও  মহাপ্রভুর পরম মঙ্গলময়ী দিব্য বাণী পৌঁছাইয়া দিবার ব্যবস্থা কর I সেই সঙ্গে গোস্বামী গনের লুপ্ত গ্রন্থের পুনঃ প্রকাশ করিয়া জগতের দুয়ারে পৌঁছাইয়া দিবার ব্যবস্থা কর I শ্রীলপ্রভুপাদকে এই সব কথা বলিয়া শ্রীমতীরাধারানী নিজ স্বরূপ দর্শন দান করিলেন I 

শ্রীলাপ্রভুপাদ শ্রীমতীর সেই অচিন্তনীয় দিব্য রূপ মাধুরী দর্শন করিয়া প্রচুর অশ্রু বিসর্জ্জন করিতে করিতে শ্রীমতীরাধারাণীর শ্রীচরণে সষ্টাঙ্গে দণ্ডবৎ প্রণাম করিয়া ক্ষমা ভিক্ষা করিলেন I তৎক্ষণাৎ শ্রীমতীরাধারানী শ্রীলপ্রভুপাদকে কৃপাশীর্বাদ করিয়া অন্তর্ধ্যান হইলেন I

মহাভাব স্বরূপা জগৎজননী শ্রীমতীরাধারাণীর আদেশ প্রাপ্ত হইয়া শ্রীলপ্রভুপাদ শ্রীধামনবদ্বীপে ফিরিয়া শ্রীমন্মহাপ্রভুর আবির্ভাবস্থলী মহাযোগপীঠে অবস্থান পূর্ব্বক মনে সিদ্ধান্ত স্থির করিয়া সংকল্প করিলেন,প্রথমে একান্তে শতকোটি নামযজ্ঞ পূর্ণ করিয়া তারপর সকল  কার্য্য করিব I এইভাবে সংকল্প করিয়া শ্রীনামাচার্য্য হরিদাস ঠাকুরের পথানুগমনে কোনও প্রকারে মাত্র জীবন ধারণ করিয়া প্রত্যহ  অপতিত ভাবে চাতুর্মাস্যব্রতের সহিত হরিনাম মহামন্ত্র কীর্ত্তন করিয়া শতকোটি শ্রীহরিনাম মহামন্ত্র সংকীর্ত্তন যজ্ঞ সম্পূর্ণ করিলেন I পুনরায় আবার নিজকে খুবই অসমর্থ,অসহায় মানে করিলেন I কেবল ভাবিতে লাগিলেন আমি একা  কেমন করিয়া শ্রীমতীর কৃপাদেশ পালন করিব I এইরূপে শ্রীমতীরাধারাণীর চরণ চিন্তায় সমাধিস্থ হইলে দেখিলেন -  ''শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য,শ্রীনিত্যানন্দ,শ্রীঅদ্বেত,শ্রীগদাধর,ও শ্রীবাস আদি পঞ্চতত্বরূপে মহাপ্রভু দর্শন দান করিয়া বলিলেন, ''সিদ্ধান্তসরস্বতী! তুই প্রচার কার্য্য শুরু কর I আমার কথা সমস্ত পৃথিবীর মানুষের কাছে পৌঁছাইয়া দিবার ব্যবস্থা কর I কেন চিন্তা করছিস !''  তখন শ্রীল সরস্বতীঠাকুর শ্রীমন্মহাপ্রভুর চরণে নিবেদন করিলেন, ''আপনারা তো সকলে আমাকে প্রচার করিতে বলিতেছেন,কিন্তু আমার না আছে কোন লোকবল এবং না আছে কোন অর্থবল,আমি কি দিয়ে প্রচার করিব ? আমি একা কেমন করিয়া প্রচার কার্য্য করিব ? উত্তরে পঞ্চতত্বরূপে মহাপ্রভু বলিলেন - ''তুই কোন চিন্তা করিস না I তুই প্রচার কার্য্য শুরু কর I তোকে অর্থের কাছে যাইতে হইবে না, অর্থ তোর দরজায় আসিবে I আমার নিজের লোককে তোকে সাহায্য করিবার জন্য পাঠাইয়া দিব I’’এই বলিয়া পঞ্চতত্বরূপে মহাপ্রভু অন্তর্ধ্যান হইলেন I 

১৯০৫ সাল হইতে শ্রীলপ্রভুপাদ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যমহাপ্রভুর বাণী প্রচারের কার্য্য আরম্ভ করেন I তারপর ১৯১৮ সাল থেকে, তিনি তার প্রচারের মিশন শুরু করেন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন নবদ্বীপের মায়াপুরে থেকে যাবেন এবং কলকাতায় গিয়ে প্রচার শুরু করবেন, কেননা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাকে পাঠিয়েছিলেন সারাবিশ্বকে কৃষ্ণভাবনার জোয়ারে প্লাবিত করতে। তিনি কলকাতা গিয়েছিলেন, আমি শুনেছি যে, যখন তিনি কলকাতা যাওয়ার ইচ্ছা পোষন করেন, তখন গৌর কিশোর দাস বাবাজী মহারাজ কিছুটা উদ্বিগ্ন হন। তিনি বলেছিলেন, “না, কলকাতায় যেও না, সেটি কলির আস্থানা।’ তখন ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর বলেছিলেন, “আপনার শ্রী পাদপদ্ম আমার মস্তকে ধারণ করে, আমি কলির যে কোনো আক্রমণ প্রতিহত করতে পারব এবং এভাবে তিনি কলি বা কলির প্রভাবকে সম্পূর্ণরূপে বিনাশ করব।” এভাবে তিনি তার প্রচার মিশনে অগ্রসর হয়েছিলেন। ই তিমধ্যে, গৌরকিশোর দাস বাবাজী মহারাজ এবং ভক্তিবিনোদ ঠাকুর উভয়ই অপ্রকট হলেন, ভক্তিবিনোদ ঠাকুর অপ্রকট হন ১৯১৪ সালে এবং গৌরকিশোর দাস বাবাজী মহারাজ অপ্রকট হন ১৯১৫ সালে I 

১৯১৮ সালে, শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর তার প্রচার আন্দোলন শুরু করেন। তিনি কলকাতায় যান। আপনারা সবাই জানেন যে, তার প্রথম মঠ বা প্রচার কেন্দ্র স্থাপিত হয় এক উল্টোদঙ্গ প্রধান সড়কে। যেখানে শ্রীল প্রভুপাদ ১৯২২ সালে তার সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। সেসময় ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর শ্রীল প্রভুপাদকে তার প্রথম নির্দেশ প্রদানের মাধ্যমে উজ্জীবিত করেছিলেন। “শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা ইংরেজি ভাষায় সারাবিশ্বে প্রচার কর”, এই ছিল তার নির্দেশ। তখন প্রভুপাদের বয়স ছিল ২৬ বছর। তিনি ছিলেন একজন গৃহস্থ এবং তার একটি পুত্র সন্তান ছিল। কিন্তু এখানেও আমরা আরেকটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করব। প্রথম সাক্ষাতে দেওয়া তার প্রথম নির্দেশেই শ্রীল প্রভুপাদের সমগ্র জীবনের আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়। শ্রীল প্রভুপাদ তার চাকুরী এবং অন্যান্য কর্তব্য পরিত্যাগ করেন। সারা বিশ্বে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারে ব্রতী হন। যদিও দৃশ্যত প্রভুপাদ সে সময় তার ব্যবসা চালিয়ে যান, কিন্তু তা সত্ত্বেও তার হৃদয় ছিল শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা প্রচারের জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর এভাবে ১৯১৮ সালে তার প্রচার মিশন শুরু করেছিলেন। তিনি ১৯২৩ সাল পর্যন্ত খুব সুন্দরভাবে কৃষ্ণভাবনা প্রচার করেছিলেন। 

ভারতজুড়ে শ্রীলপ্রভুপাদ প্রতিষ্ঠা করেন ৬৪টি মঠ এবং সে সময়ের কাজ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তিনি প্রভাবিত করেন। তিনি তাদেরকে ভাল বাস্তেন I তিনি কৃষ্ণভাবনা প্রচারের এক বিশেষ ও অদ্বিতীয় পন্থার সূচনা করেছিলেন। কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের এই নীল নকশাটি প্রদান করেছিলেন ভক্তিবিনোদ ঠাকুর। প্রচার আন্দোলনের ক্ষেত্রে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মূল লক্ষ্যটি ছিল: কৃষ্ণভাবনাকে প্রতিষ্ঠা করা এবং এই কলিযুগে অধর্মের প্রভাব চিরতরে নির্মূল করা। অতএব আমরা দেখি যে, ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর সংকীর্ত্তন আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটি ভিন্ন মাত্রা সংযোজন করেছিলেন। সাধারণভাবে সংকীর্ত্তনের অর্থ হল সম্মিলিত কীর্তন। কিন্তু এখানে তার সংকীর্ত্তন আন্দোলন মানে ছিল গ্রন্থ ছাপানো এবং বিতরণ। এই সংকীর্ত্তন আন্দোলনে মৃদঙ্গ হল বৃহৎমৃদঙ্গ। কৃষ্ণভাবনা প্রচারের ক্ষেত্রে তার সংযোজিত এই নতুন মাত্রাটি ছিল অদ্বিতীয়। শুধু তাই নয়, তিনি আরেকটি অত্যন্ত অদ্বিতীয় একটি মাত্রা প্রদান করে গেছেন। প্রথমদিকে তিনি উল্টাদঙ্গ প্রধান সড়কে একটি দো-তলা ঘরে থাকতেন। তখন কিছু ধনী লোক তার প্রচারে আকর্ষিত হয়ে নিজেদেরকে তার কাছে উৎসর্গ করেছিলেন। তাদের একজন বাঘ বাজারে একটি বড় মন্দির তৈরি করেন। তাই তিনি উল্টাদঙ্গ থেকে বাঘ বাজার গৌড়ীয় মঠে প্রস্থান করেন সেখানে বিগ্রহ অভিষেকের সময় তিনি একটি গান গেয়েছিলেন। গানটি ছিল

‘’পুজালা রাগ-পঠ গৌরব ভঙ্গে মাতাল সাধু-জন বিশ্ব-রঙ্গে।‘’

‘গৌরব’ অর্থ শ্রদ্ধা এবং ভক্তি।

‘গৌরব ভঙ্গে’ অর্থ শ্রদ্ধা ও ভক্তির এই পন্থা পরিত্যাগ করে রাগ-মার্গ গ্রহণ করলেন । রাগ-মার্গ পূজিত এবং প্রতিষ্ঠিত হল। তার ফল সাধু ব্যক্তিগন বিশ্ব রঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। যা দৃশ্যত জড় কার্যকলাপ বলে প্রতিভাত হয়।

শ্রীল প্রভুপাদ কৃষ্ণভাবনা প্রচারের উদ্দেশ্যে  মাইক্রোফোন, টেলিফোন, টেপ রেকর্ডার, কম্পিউটার, এরোপ্ল্যান সহ আরো অনেককিছুকে নিয়োজিত করেছিলেন। প্রভুপাদ এমনকি বলেছিলেন যে,

যদি প্রয়োজন হয় কৃষ্ণভাবনা বিস্তৃত করার জন্য আমরা পারমানবিক বোমা পর্যন্ত ব্যবহার করতে প্রস্তুত (হাসি !)।

শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর, মহাপ্রভুর সংকীর্ত্তন আন্দোলনের প্রকৃত উদ্দেশ্যটি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন এবং অত্যন্ত যথাযথভাবে শ্রীল প্রভুপাদ সেটিকে বহন করেছিলেন এবং সারাবিশ্বে তা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

‘’১৯৩৭ সালের ১লা জানুয়ারি প্রাতঃ ৫/২৫ মিঃ শ্রীগৌর গদাধর,শ্রীশ্রীলরাধাগোবিন্দের নিশান্ত লীলায় প্রবেশ করিলেন I’’