Monday, May 11, 2020


রায় রামানন্দ
তিরোভাব
শ্রীমন্মহাপ্রভুর সাড়ে তিন জন অন্তরঙ্গ ভক্তের মধ্যে রায়  রামানন্দ অন্যতম  ছিলেন I  
''প্রভু লেখা করে যারে - রাধিকার গণ।
জগতের মধ্যে পাত্র - সাড়ে তিনজন।।
স্বরূপ গোসাঞি, আর রায় রামানন্দ।
শিখি মাহিতি - তিন, তাঁর ভগিনী - অর্দ্ধজন।।''

কৃষ্ণলীলায় যিনি 'ললিতা' তিনিই গৌরলীলা পুষ্টির জন্য রায় রামানন্দরূপে প্রকটিত হইয়াছেন, আবার কেহ বলেন তিনি অভিন্ন 'বিশাখা' স্বরূপ। ''রাধাকৃষ্ণের বিশাখা সখীর প্রতি বিশাখা সখীর রাধাকৃষ্ণের প্রতি যে স্বাভাবিক প্রেম, তাহাই উদিত হইল।'' শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর রায় রামানন্দকে অভিন্ন 'বিশাখা' সখী স্বরূপে দর্শন করিয়াছেন।

রায় রামানন্দের পিতার নাম রায় ভবানন্দ। রায় ভবানন্দ শৌক্র - করণ কুলে আবির্ভূত হইয়াছিলেন। পূর্ব্ব পরিচয়ে ইনি পাণ্ডুরাজা ছিলেন।ইহার পাঁচ পুত্রের মধ্যে রায় রামানন্দ জ্যেষ্ঠপুত্র। অপর চার পুত্রের নাম,- গোপীনাথ পট্টনায়ক, কলানিধি, সুধানিধি বাণীনাথ পট্টনায়ক।
''সাক্ষাৎ পাণ্ডু তুমি, তোমার পত্নী কুন্তী।
পঞ্চপাণ্ডব তোমার পঞ্চপুত্র মহামতি।।''
পুরী হইতে পশ্চিমে ছয়ক্রোশ দূরে ব্রহ্মগিরি বা আলালনাথে রায় ভবানন্দের নিবাস ছিল। রায় রামানন্দ রাজা প্রতাপরুদ্রের অধীনে বিদ্যানগরের অধিকারী বা প্রধান কর্ম্মচারী ছিলেন। কাহারও মতে রায় রামানন্দ রাজা প্রতাপরুদ্রের মন্ত্রী ছিলেন।

মাঘ মাসের শুক্লপক্ষে মহাপ্রভু সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়া শান্তিপুর হইয়া ফাল্গুন মাসে নীলাচলে গিয়াছিলেন। নীলাচলে দোলযাত্রা দর্শনের পর চৈত্র মাসে সার্ব্বভৌম উদ্ধারলীলা হয়। বৈশাখ মাসে মহাপ্রভু দক্ষিণ যাত্রা করিয়াছিলেন।দক্ষিণ  ভ্রমণে একাকী যাইতে স্থির করিলে নিত্যানন্দ প্রভু 'কৃষ্ণদাস' বিপ্রকে সঙ্গে দিলেন। দক্ষিণে  যাত্রাকালে সার্ব্বভৌম ভট্টাচার্য্য মহাপ্রভুকে চারিটি কৌপীন - বহির্বাস দিয়া রায় রামানন্দের সহিত গোদাবরী তীরে সাক্ষাৎ করিতে অনুরোধ করিলেন।
''তবে সার্ব্বভৌম কহে প্রভুর চরণে।
অবশ্য পালিবে, প্রভু, মোর নিবেদনে।।
রামানন্দ রায় আছে গোদাবরী তীরে।
অধিকারী হয়েন তেঁহো বিদ্যানগরে।।
শূদ্র বিষয়ী - জ্ঞানে উপেক্ষা না করিবে।
আমার বচনে তাঁরে অবশ্য মিলিবে।।
তোমার সঙ্গের যোগ্য তেঁহো একজন।
পৃথিবীতে রসিক ভক্ত নাহি তাঁর সম।।
পাণ্ডিত্য আর ভক্তিরস, -  দুঁহের তেঁহো সীমা।
সম্ভাষিলে জানিবে তুমি তাঁহার মহিমা।।
অলৌকিক বাক্য চেষ্টা তাঁর না বুঝিয়া।
পরিহাস করিয়াছি তাঁরে 'বৈষ্ণব' বলিয়া।।
তোমার প্রসাদে এবে জানিলু তাঁর তত্ত্ব।
সম্ভাষিলে জানিবে তাঁর যেমন মহত্ত্ব।।''
''শ্রী রায় রামানন্দ বহির্দৃষ্টিতে কৌপীন বিশিষ্ট সন্ন্যাসী নহেন, তজ্জন্য লৌকিক দৃষ্টিতে রাজভৃত্য বিষয়ী, বস্তুতঃ তিনি বিদ্বৎ বা নরোত্তম - সন্ন্যাসী ছিলেন। সার্ব্বভৌম ভট্টাচার্য্য পূর্ব্বে বৈষ্ণব না থাকিলেও রামানন্দ রায়ের নৈসর্গিক বৈষ্ণবতা উপলব্ধি করিয়াছিলেন। আবার মহাপ্রভুর কৃপায় ভক্ত  হইবার পর রামানন্দের কথা আলোচনা করিয়া তাঁহাকে 'অধিকারী রসিকভক্ত' বলিয়া বুঝিয়াছিলেন।‘’

শ্রীমন্মহাপ্রভু কৃষ্ণভক্তি প্রদানমুখে দাক্ষিণাত্য বাসীকে বৈষ্ণব করতঃ কূর্ম্মস্থানে কূর্ম্মদেবের দর্শন, কূর্ম্ম - বিপ্রকে কৃপা ও সর্ব্বত্র কৃষ্ণভক্তি প্রচারের আদেশ,গলিতকুষ্ঠ বাসুদেব বিপ্রের উদ্ধার, সিংহাচলমে জিয়ড়নৃসিংহের অগ্রে নৃত্যকীর্ত্তন, তৎপরে গোদাবরী তীরে আসিয়া প্রেমবিভাবিত নেত্রে গোদাবরীকে যমুনা এবং তত্তটবর্ত্তী বনকে বৃন্দাবন দর্শন করিয়া আনন্দ লাভ করিলেন। গোদাবরী পার হইয়া কভুরে রায় রামানন্দ সহিত মিলনাকাঙ্ক্ষায় স্নানকার্য্য সমাপন করতঃ শ্রীমন্মহাপ্রভু অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। এমন সময় রায় রামানন্দ বাদ্যাদি সহযোগে তথায় আসিয়া মহাপ্রভুর দিব্যরূপ দর্শনে আকৃষ্ট হইয়া পাল্কী হইতে নামিয়া প্রণাম করিলেন। মহাপ্রভু তাঁহাকে চিনিয়াও তাঁহার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলে রায় রামানন্দ নিজেকে দাস শূদ্র মন্দ বলিয়া পরিচয় দিলেন। মহাপ্রভু রায় রামানন্দের দৈন্যোক্তি শুনিয়া তৎক্ষণাৎ আলিঙ্গন করিলে প্রভু - ভৃত্যের স্বাভাবিক প্রেমের উদয় হইল। তাঁহাদের অষ্টসাত্বিক প্রেমবিকার দেখিয়া ব্রাহ্মণগণ বিস্মিত হইয়া বিচার করিলেন,-
''এই ত সন্ন্যাসীর তেজ দেখি ব্রহ্মসম। 
শূদ্রে আলিঙ্গিয়া কেনে করেন ক্রন্দন।।
এই মহারাজ - মহাপণ্ডিত গম্ভীর।
সন্ন্যাসীর  স্পর্শে মত্ত হইলা অস্থির।।''

বিজাতীয় লোক দেখিয়া মহাপ্রভু নিজভাবকে সম্বরণ করিলেন। মহাপ্রভু রায় রামানন্দকে তাঁহার সহিত মিলনের জন্য বাসুদেব সার্ব্বভৌমের অনুরোধ কথা জানাইলে। মহাপ্রভু ভক্তের মহিমা বর্দ্ধনের জন্য বলিলেন,-
''প্রভু কহে, তুমি মহা - ভাগবতোত্তম।
তোমার দর্শনে সবার দ্রব হইল মন।।
অন্যের কি কথা, আমি - মায়াবাদী সন্ন্যাসী'।
আমিহ তোমার স্পর্শে কৃষ্ণপ্রেমে ভাসি।।

মহাপ্রভু রায় রামানন্দের নিকট কৃষ্ণকথা শুনিতে ইচ্ছা করিলে রামানন্দ রায় মহাপ্রভুকে অনুরোধ করিলেন ৫/৭ দিন অবস্থান করতঃ তাঁহার দুষ্ট চিত্তকে মার্জ্জনের জন্য।পরে উভয়ে নিজ নিজ কৃত্য  সমাপনের পর সন্ধ্যার সময় আসিয়া পুনঃ সেই স্থানে মিলিত হইলেন।সাধারণতঃ দেখা যায় ভক্ত প্রশ্ন করেন ভগবান উত্তর দেন,কিন্তু এখানে তদ্বিপরীত।মহাপ্রভু প্রশ্নকর্ত্তা, রায় রামানন্দউত্তরদাতা। মহাপ্রভুর শক্তিতেই রায় উত্তর দিতেছেন। দুজনে ধীরে ধীরে ভাবের অন্তঃপুরে প্রবেশ করতে লাগলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বললেন, ''হে রায় কি সাধ্যের নির্নয়ে কৃষ্ণভক্তি হয়''?।

রায় কহে, ''প্রথমতঃ বর্নাশ্রম ধর্ম পালনে কৃষ্ণভক্তি হয়''।
তারপর কৃষ্ণ কর্মার্পণ, নিস্কাম কর্ম, জ্ঞানমিশ্রা ভক্তি, জ্ঞানশুন্য ও শুদ্ধাভক্তির কথা বললেন। কিন্তু মহাপ্রভু সন্তুষ্ট হলেন না। বললেন, ''রায় আগে কহ''।  
এরপর রায়, কৃষ্ণরতির দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর রতিতে শ্রীমতি রাধাঠাকুরাণীর অসাধারণ ভাবের কথা এবং কৃষ্ণের স্বরূপ, রাধার স্বরূপ বললেন।

ভক্তের নিকট ভগবানের স্বরূপ লুক্কায়িত থাকে না। রায় রামানন্দ মহাপ্রভুর স্বরূপ উপলব্ধি করিয়া বলিলেন,-
''পহিলে দেখিলুঁ তোমার সন্ন্যাসী - স্বরূপ। 
এবে তোমা দেখি' মুঞি শ্যাম - গোপরূপ।।
তোমার সম্মুখে দেখি কাঞ্চন - পঞ্চালিকা।
তাঁর গৌরকান্ত্যে তোমার সর্ব্ব অঙ্গে ঢাকা।।''
মহাপ্রভু, রায় রামানন্দ মহাভাগবৎ এইজন্য ঐরূপ দেখিতেছেন বলিয়া আত্মগোপনের চেষ্টা করিলে রায় রামানন্দ মহাপ্রভুর আবির্ভাবের মুখ্য কারণের কথা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করিলেন। মহাপ্রভু প্রসন্ন হইয়া রসরাজ শ্রীকৃষ্ণ মহাভাবরূপা শ্রীমতী রাধারাণীর মিলিত নিজ - স্বরূপ দেখাইলে রায় রামানন্দ মূর্চ্ছিত হইয়া ভূমিতে পতিত হইলেন। মহাপ্রভুর স্পর্শে রায় রামানন্দের চেতন হইল। দশরাত্রি রায় রামানন্দের সহিত সুখে অবস্থানের পর মহাপ্রভু তীর্থ পৰ্য্যটনান্তে নীলাচলে ফিরিবেন এইকথা বলিয়া রায় রামানন্দকে বিষয়কার্য্য পরিত্যাগ করিয়া নীলাচলে মিলিত হইবার জন্য আদেশ প্রদান করিলেন।

''সুবল যৈছে পূর্ব্বে কৃষ্ণসুখের সহায়।
গৌরসুখদান - হেতু তৈছে রামরায়।।''
প্রভুর দিব্যোন্মাদের দশ দশায় রায় রামানন্দ ভাবোপযোগী কালোচিত শ্লোক পাঠ করিয়া মহাপ্রভুকে সুখ দিতেন।
''রামানন্দের কৃষ্ণকথা, স্বরূপের গান।
বিরহ - বেদনায় প্রভুর রাখযে পরাণ।।''
''এত কহি' গৌরহরি  দুইজনার কণ্ঠ ধরি',
কহে - 'শুন স্বরূপ - রামরায়।
কাঁহা কঁরো কাঁহা জাউ, কাঁহা গেলে কৃষ্ণ পাউ,
দুহেঁ মোরে কহ সে উপায়।

''চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি, রায়ের নাটক - গতি,
কর্ণামৃত,  শ্রীগীতগোবিন্দ।
স্বরূপ - রামানন্দ - সনে,  মহাপ্রভু রাত্রি - দিনে,
গায়, শুনে - পরম আনন্দ।।''

রায় রামানন্দের ভজনস্থান 'শ্রীজগন্নাথ - বল্লভ - উদ্যান' মহাপ্রভুর অত্যন্ত প্রিয় ছিল।
জগন্নাথ - বল্লভ - উদ্যানে প্রবেশ করিয়া মহাপ্রভু মহাভাবাবিষ্ট হইয়া পড়িতেন। একদিন মহাপ্রভু উদ্যানে অশোক বৃক্ষের তলে কৃষ্ণ দর্শন তৎপরে কৃষ্ণ অদর্শন হেতু মূর্চ্ছিত হওয়ার লীলা করিয়াছিলেন।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু স্বরূপদামোদর রায় রামানন্দের মাধ্যমেই জানাইয়াছিলেন কলিযুগে কৃষ্ণপ্রেম লাভের শ্রেষ্ঠ উপায় শ্রীনাম - সংকীর্ত্তন। 
''হর্সে প্রভু কহেন - ''শুন স্বরূপ - রামরায় !
নামসংকীর্ত্তন - কলৌ পরম উপায়।।''
রায় রামানন্দ রাঘবেন্দ্র পুরীর শিষ্য এবং রাঘবেন্দ্র পুরী মাধবেন্দ্রা পুরীর শিষ্য এইরূপ উক্তি 'ভজন - নির্ণয় গ্রন্থে পাওয়া যায়।

বৈশাখ কৃষ্ণা - পঞ্চমী তিথিতে শ্রীরায় রামানন্দের তিরোধান লীলা হয়।

No comments:

Post a Comment

💐🏵️💞🌺🌷🌺💞🏵️💐 🌷বৈষ্ণবের ব্যাস পূজা🌷 💐🏵️💞🌺🌷🌺💞🏵️💐 শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ সকল সাধু, গুরু, বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দ...