Saturday, May 30, 2020


শ্রীগঙ্গামাতা গোস্বামিনী
আবির্ভাব
শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ
সকল সাধু, গুরু,বৈষ্ণব ভক্তবৃন্দের শ্রী চরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম ।
হরে কৃষ্ণ, আগামী ০১/০৬/২০২০ ইং রোজ - সোমবার শ্রীগঙ্গামাতা গোস্বামিনীর শুভ আবির্ভাব তিথি। শ্রীজগন্নাথ ধাম পুরীতে শ্রী গঙ্গা নদীর অবতরণ। ( শ্বেত গঙ্গা)

শ্রীগৌরশক্তি শ্রীগদাধর পণ্ডিত গোস্বামীর শিষ্য পরম্পরায় শ্রীহরিদাস পণ্ডিত গোস্বামীর দীক্ষিতা শ্রীচরণাশ্রিতা শিষ্যা শ্রীগঙ্গামাতা গোস্বামিনী। শ্রীগঙ্গামাতা - গোস্বামিনীর পুত জীবনচরিত - বিষয়ে 'শ্রীগৌড়ীয় বৈষ্ণব অভিধানে' সংক্ষিপ্তভাবে এবং শ্রীমদ সুন্দরানন্দ বিদ্যাবিনোদ রচিত 'শ্রীক্ষেত্রে' কিছুটা বিস্তৃতভাবে জানা যায়।

শ্রীগঙ্গামাতা - গোস্বামিনীর পূর্ব্ব পিতৃপ্রদত্ত নাম শ্রীশচীদেবী।বঙ্গদেশে (বর্ত্তমান বাংলাদেশে) রাজসাহী জেলার পুঁটিয়ার রাজা শ্রীনরেশ নারায়ণের কন্যা ছিলেন শ্রীশচীদেবী। শচীদেবী শিশু কাল হইতে সংসার বিরক্ত পরমা ভক্তিপরায়ণা ছিলেন। শচীদেবীর পিতামাতা শচীদেবীকে বিবাহ দিবার জন্য ব্যস্ত হইলে শচীদেবী বলিলেন,- তিনি কোনও মরণশীল ব্যক্তিকে পতিরূপে গ্রহণ করিবেন না।

রাজা নরেশ নারায়ণ তাঁর পত্নী বেশিদিন জগতে ছিলেন না। অল্পদিনের মধ্যে তাদের লোকান্তর হলে শচীদেবী রাজসুখ-বৈভব পরিত্যাগ করে তীর্থভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। প্রথমে শ্রীক্ষেত্র পুরীধামে উপনীত হন। জগন্নাথের চরণপ্রান্তে বেশ কিছুদিন অতিবাহিত করার পর তাঁর মনে শ্রীব্রজমণ্ডল দর্শনের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়। তারপর শ্রীবৃন্দাবন ধামে পৌঁছে তিনি জীবনের পরম লক্ষ্য সাধনের পথ খুঁজে পান।
বৃন্দাবনের শ্রীগোবিন্দদেবের সেবাধ্যক্ষ শ্রীল হরিদাস পণ্ডিত গোস্বামী বৈষ্ণবগণের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর একান্ত পার্ষদ ছিলেন শ্রীগদাধর পণ্ডিত। শ্রীল হরিদাস পণ্ডিত ছিলেন শ্রীগদাধর পণ্ডিত গোস্বামী প্রভুর শিষ্য শ্রীল অনন্তাচার্যের শিষ্য।

তীর্থভ্রমণকালে পুঠিয়ার রাজকন্যা শ্রীশচীদেবী শ্রীধাম বৃন্দাবনের শ্রীহরিদাস পণ্ডিতের কাছে কৃপা প্রার্থনা করেন। শ্রীল হরিদাস পণ্ডিত গোস্বামী শ্রীশচীদেবীর পক্ষে কঠোর বৈরাগ্যপূর্ণ ভজন সম্ভব হবে না ভেবে তাঁকে গৃহে ফিরে যেতে বলেন। ভক্তিজীবনের পথ কোটি কণ্টকময়, তার মতো অপরিমেয় বিত্তবৈভবে লালিত একজন রাজকন্যা কীভাবে পথে চলবেন? শ্রীল হরিদাস পণ্ডিতজি তাঁকে পুনরায় পরীক্ষার জন্য সম্ভ্রম পরিত্যাগ করে বৃন্দাবনের গৃহে গৃহে মাধুকরী ভিক্ষা করার আদেশ দিলেন। শ্রীশচীদেবী সমস্ত দেহস্মৃতি ভুলে ব্রজের কুঞ্জে কুঞ্জে ভিক্ষার ছলে শ্রীকৃষ্ণ অনুসন্ধানের আবেশে আবিষ্ট হলেন। তাঁর কঠোর বৈরাগ্য দেখে বৈষ্ণবগণ চমৎকৃত হতেন। দেহসুখ ভুলে শচীদেবী নিয়মিত যমুনা স্নান, মন্দির মার্জন, পরিক্রমা, ভাগবত কথা শ্রবণ মাধুকরীর ভিক্ষা করে জীবন নির্বাহ করতে লাগলেন। তা দেখে শ্রীল হরিদাস গোস্বামী শ্রীশচীদেবীর প্রতি প্রীত হয়ে অশেষ আশীর্বাদ দান করলেন। চৈত্রমাসের শুক্লা ত্রয়োদশী তিথি, বুধবার শ্রীগোবিন্দজি মন্দিরে তিনি শচীদেবীকে অষ্টাদশাক্ষর মন্ত্রে দীক্ষা প্রদান করলেন।

শ্রীশচীদেবী বৃন্দাবনে সংবৎসরকাল এবং তৎপরে শ্রীগুরুদেবের নির্দ্দেশ ক্রমে তাঁহার জ্যেষ্ঠা গুরুভগ্নী ভজনপরায়ণা পরমাবৈষ্ণবী শ্রীলক্ষ্মীপ্রিয়াদেবীর সহিত (যিনি প্রত্যহ তিন লক্ষ হরিনাম করিতেন) শ্রীরাধাকুণ্ডে অবস্থান করিয়া ভজনাদর্শ প্রদর্শন করিয়াছিলেন। তাঁহারা প্রত্যহ গিরিরাজ গোবর্দ্ধন পরিক্রমা করিতেন।

লুপ্ততীর্থ উদ্ধার
 এভাবে বেশ কয়েক বছর শচীদেবী একান্তভাবে শ্রীরাধাকুণ্ডে ভজন করার পর ভজনপ্রৌঢ়া হলে শ্রীহরিদাস পণ্ডিত তাঁকে শ্রীক্ষেত্রে গমনের আজ্ঞা দিয়ে বললেন- “সার্বভৌম ভট্টাচার্যের অঙ্গনসেবা লুপ্ত হতে চলেছে। তুমি শ্রীপুরুষোত্তম ক্ষেত্রে যাও। শ্রীগৌরনিত্যানন্দের বাণী আপামর জীবের কাছে প্রচার করো।শচীদেবী শ্রীমন্মহাপ্রভুর লীলাস্থল শ্রীসার্বভৌম ভট্টাচার্যের ভবনে নিত্যসেবা প্রকাশের গুরু-আজ্ঞা শিরোধার্য করে শ্রীধাম বৃন্দাবন থেকে শ্রীক্ষেত্র পুরীধামে আগমন করেন। তিনি শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের মন্দিরের কাছে শ্রীসার্বভৌম ভট্টাচার্যের বাসভবনের সন্ধান পেলেন। ভট্টাচার্য মহাশয়ের শ্রীগৃহ তখন লুপ্তপ্রায়। একটি জরাজীর্ণ মন্দিরে সার্বভৌম ভট্টাচার্যের পূজিত শ্রীশ্রীরাধা-দামোদর শিলা ছাড়া তেমন কিছুই সেখানে ছিল না।

শ্রীশচীদেবী গৃহে অবস্থানকালেই শাস্ত্রপাঠে অনুরক্ত ছিলেন। শ্রীরাধাকুণ্ডে অবস্থানকালেও তিনি বৈষ্ণবগণের সাথে নিত্য শ্রীমদ্ভাগবত আলোচনা করতেন। শ্রীক্ষেত্রেও নিত্য শ্রীমদ্ভাগবত ব্যাখা করতেন। হরিভক্তিপরায়ণা শচীদেবীর কাছে পুরীবাসীগণ শ্রীমদ্ভাগবতের অপূর্ব ব্যাখ্যা শ্রবণ করে এতই মুগ্ধ হতেন I শ্রীশচীদেবীর ভাগবত পাঠের যশ এতই বিস্তৃত হলো যে, তা তৎকালীন পুরীর রাজা শ্রীমুকুন্দদেবও  শচীদেবীর কাছে এসে শ্রীমদ্ভাগবতের ব্যাখ্যা শ্রবণ করে মুগ্ধ হলেন একদিন তিনি স্বপ্নে শ্বেতগঙ্গার কাছের সেই স্থানটি শচীদেবীকে প্রদানের জন্য শ্রীজগন্নাথের আদেশ প্রাপ্ত হলেন। পরদিন সকালেই তিনি শচীদেবীর কাছে বার্তা প্রেরণ করে সেই স্থানটি তাঁকে লিখে দেয়ার প্রস্তাব করলেন। শচীদেবী লুপ্ততীর্থ উদ্ধারের জন্য গুরুপ্রদত্ত আদেশ স্মরণ করে রাজার কাছ থেকে জায়গাটি গ্রহণ করলেন এবং ভিক্ষা করে তিনি সেখানে বিগ্রহসেবা চালিয়ে যেতে লাগলেন।

একদিন মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে মহাবারুণী স্নান উপলক্ষ্যে অনেক কে গঙ্গার উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে দেখলে শচীদেবীরও গঙ্গা স্নানের বাসনা হলো। কিন্তু গুরুদেবের নির্দেশ ছিল শ্রীপুরুষোত্তম ক্ষেত্রেই তাঁকে অবস্থান করতে হবে। তাই তিনি আর গঙ্গায় গেলেন না। সেদিন স্বপ্নে শ্রীশ্রী জগন্নাথদেব তাঁকে আজ্ঞা দিলেন, “যেদিন গঙ্গা স্নানের তিথি উপস্থিত হবে, তুমি শ্বেতগঙ্গায় স্নান করবে। ‘’স্বপ্নে আদেশ পেয়ে তিনি সকলের অজ্ঞাতে মধ্যরাতে শ্বেতগঙ্গায় অবগাহন করলেন এবং তৎক্ষণাৎ গঙ্গাদেবী সেখানে উপস্থিত হয়ে তাঁকে স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন। শ্রীজগন্নাথদেবের চরণ নিঃসৃতা গঙ্গার পুত বারিধারা শচীদেবীকে শ্রীমন্দিরের অভ্যন্তরে নিয়ে গেল। সেখানে শ্রীক্ষেত্রবাসী সকলকে সানন্দে স্নান করতে দেখে জগন্নাথদেব নিজেও আনন্দে  স্নান করলেন। ভক্তগণের আনন্দকোলাহলে দ্বার-রক্ষীদের নিদ্রাভঙ্গ হলো। তারা পাণ্ডাদের জাগালেন।

পাণ্ডারা রাজাকে কোলাহলের কথা অবগত করলে, রাজা শ্রীমন্দিরের দ্বার খোলার আজ্ঞা করলেন। মন্দির খোলামাত্র গঙ্গাদেবীসহ সবাই অন্তর্হিত হলেন এবং সকলেই তখন কেবল শচীদেবীকে সেখানে একাকী দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন।  তখন অধিকাংশ পাণ্ডার মনে সন্দেহ হলো যে, শচীদেবী শ্রীজগন্নাথের ধনসম্পদ অপহরণ করার জন্য মন্দিরের দ্বার বন্ধের আগেই মন্দিরে লুকিয়ে ছিলেন। তখন রাজা তাঁকে কারাগারে প্রেরণ করলেন। এদিকে মহাভাগবতের প্রতি এমন অপরাধের ফলে পাণ্ডাগণ নানা রোগ-শোকে আক্রান্ত হতে লাগলেন। তখন শ্রীশ্রীজগন্নাথদেব  রাজাকে স্বপ্নে বললেন, “ত্রয়োদশীর রাতে যাঁকে মন্দিরে দেখেছ, তিনি আমার প্রতি অনুরক্তা পরমভাগবত। আমি তাঁর স্নান করবার জন্য নিজ শ্রীচরণ থেকে গঙ্গাকে নিঃসৃত করে তাঁকে শ্রীমন্দিরে নিয়ে আসি। যদি তুমি মঙ্গল চাও, তবে সমস্ত পাণ্ডাদের সঙ্গে নিয়ে সেই মহাভাগবতের শ্রীচরণে উপনীত হয়ে অপরাধের জন্য ক্ষমা ভিক্ষা করো এবং তাঁর কাছ থেকে মন্ত্রদীক্ষা গ্রহণ করো; নতুবা আমি তোমাদের মতো বৈষ্ণব-অপরাধীর সেবা গ্রহণ করব না।‘’  

রাজা মুকুন্দদেব তখন পাণ্ডাদের  ডেকে জগন্নাথদেবের স্বপ্নাদেশের কথা জানিয়ে সবাইকে নিয়ে শ্রীশচীদেবীর শ্রীচরণে ক্ষমাভিক্ষা করলেন। তাঁরা সবাই শচীদেবীর কাছে মন্ত্রদীক্ষা প্রার্থনা করিলেও তিনি শ্রীজগন্নাথের আজ্ঞা পালনের জন্য কেবল মাত্র শ্রীমুকুন্দ দেবকে দীক্ষা প্রদান করিলেন। সেদিন থেকে শ্রীশচীদেবী শ্রীগঙ্গামাতা গোস্বামিনী নামে বিখ্যাত হলেন।  রাজা মুকুন্দদেব গঙ্গামাতাকে গুরুদক্ষিণা প্রদান করতে চাইলে তিনি বললেন, “শ্রীকৃষ্ণচরণে তোমার ভক্তি লাভ হোক, আমি এইমাত্র ভিক্ষা করি; আমি অন্যকোনো দক্ষিণা গ্রহণের অধিকারিণী নই।‘’ রাজার বারংবার কাতর প্রার্থনায় অবশেষে শ্রীগঙ্গামাতা বৈষ্ণবসেবার জন্য দুই ভাণ্ড মহাপ্রসাদ, একভাণ্ড  তরকারী, একটি প্রসাদী বস্ত্র দুই পণ কপর্দিকা (১৬০ পয়সা) প্রত্যহ মধ্যাহ্ণকালীন ধূপের পর মঠে প্রেরণের অনুমতি দিলেন। এখনো একইভাবে জগন্নাথের রাজভোগ প্রসাদ নিয়মিত শ্রীগঙ্গামাতা মঠে প্রেরিত হয় এবং শ্রীগঙ্গামাতার সমাধিতে অর্পিত হয়। মহীধর শর্মা নামে একজন স্মার্ত ব্রাহ্মণও  শ্রীগঙ্গামাতার চরণে আত্মসমর্পণ করে কৃপা লাভ করিয়া ধন্য হইয়াছিলেন।

শ্রীগঙ্গামাতা মঠে পাঁচটি যুগলমূর্ত্তি বিরাজিত আছেন যথা,- শ্রীশ্রীরাধা - রসিকরায়,শ্রীশ্রীরাধা - শ্যামসুন্দর,শ্রীশ্রীরাধা - মদনমোহন, শ্রীশ্রীরাধা - বিনোদ শ্রীশ্রীরাধারমণ। এতদ্ব্যতীত সার্ব্বভৌম ভট্টাচার্য্যের সেবিত শ্রীদামোদর শালগ্রাম,নৃত্যরত শ্রীগৌরমূর্ত্তি নাড়ুগোপাল বিগ্রহগণও তথায় সিংহাসনে সেবিত হইতেন।

গঙ্গামাতা মঠের প্রদত্ত বিবৃতি অনুসারে জানা যায় শ্রীগঙ্গামাতা ইং ১৬০১ খৃষ্টাব্দে জ্যেষ্ঠ মাসের শুক্লা দশমী তিথিতে আবির্ভূত হইয়া ১৭২১ খৃষ্টাব্দে নিত্যলীলায় প্রবেশ করেন। পুরীতে হাবেলী মঠ, গোপালমঠ কটক জেলায় টাঙ্গী নামক স্থানে শ্রীগোপালমঠ গঙ্গামাতা মঠের শাখা।

No comments:

Post a Comment

💐🏵️💞🌺🌷🌺💞🏵️💐 🌷বৈষ্ণবের ব্যাস পূজা🌷 💐🏵️💞🌺🌷🌺💞🏵️💐 শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ সকল সাধু, গুরু, বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দ...