''সাধু/বৈষ্ণব''
বিশেষ পোষ্ট
শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ
সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম I
‘’হরি - গুরু - বৈষ্ণব তিনিহেঁ স্মরণ।
তিনেহেঁ স্মরণ হইতে বিঘ্ন বিনাশন।।
অনায়াসে হয় নিজ বাঞ্ছিত পূরণ । I’’
সাধু কাকে বলে ? যে কেউ কি সাধু হইতে পারে???
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের কাছে সাধুর সংজ্ঞা নিরূপন করেছেন,
অপি চেৎসুদুরাচারো ভজতে মামন্যভাক্।
সাধুরেব স মন্তব্যঃ সম্যগ্ ব্যবস্থিত হিসঃ।। (গীতা ৯/৩০)
অর্থাৎ,- অতি দুরাচারী ব্যক্তিও যদি অনন্যভক্তি সহকারে আমার ভজনা করেন, তাকেও ‘’সাধু’’ বলে মনে করতে হবে, কারণ তিনি যথার্থ মার্গে অবস্থিত।
ক্ষিপ্রং ভবতি ধর্মাত্মা শশ্বচ্ছান্তিং নিগচ্ছতি।
কৌন্তেয় প্রতিজানীহি ন মে ভক্তঃ প্রণশ্যতি।। (গীতা ৯/৩১)
অর্থাৎ,- তিনি শীঘ্রই ধর্মাত্মায় পরিণত হন এবং নিত্য শান্তি লাভ করেন। হে কৌন্তেয়! তুমি দীপ্ত কন্ঠে ঘোষণা কর যে, আমার ভক্ত কখনও বিনষ্ট হয় না।
কৃষ্ণভক্তিই জীবের সহজাত অধিকার। 'জীবের স্বরূপ হয় নিত্যকৃষ্ণ দাস'। তাই ঐকান্তিক কৃষ্ণভজনাকারী জন সাধু।
কোটিজ্ঞানী-মধ্যে হয় একজন ‘মুক্ত’।
কোটিমুক্ত-মধ্যে ‘দুর্লভ’ এক কৃষ্ণভক্ত।।
যে কেউ সাধু হইতে পারে, শ্রীপদ্মপুরাণে বিস্তৃত ও সুন্দরভাবে সাধুর সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে-
"কৃষ্ণার্পিত-প্রাণ-শরীর-বুদ্ধিঃ শান্তেন্দ্রিয় - স্ত্রী - সুত - সম্পদাদিঃ।
আসক্তচিত্তঃ শ্রবণাদি ভত্তির্যস্যেহ সাধু সততং হরের্যঃ।।''
অর্থাৎ,- “যিনি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মে প্রাণ, বুদ্ধি সমস্তই সমর্পণ করেছেন, যিনি ইন্দ্রিয়, স্ত্রীপুত্র, বিষয়াদি সমস্ত ভোগবিলাস থেকে বিরত হয়েছেন, যিনি শ্রীহরির প্রতি সদা সর্বদা আসক্ত চিত্ত এবং যিনি শ্রীকৃষ্ণ - কথা শ্রবণ, শ্রীকৃষ্ণমহিমা কীর্ত্তন ইত্যাদি ভক্তি - অঙ্গ সমূহের যাজন পরায়ণ, এই জগতে তিনিই সাধু।
বৈষ্ণবের প্রত্যহিক কৃত্য বা করনীয়।
বৈষ্ণব বা ভক্ত মাত্রই সদাচার অবশ্য পালনীয়। শ্রীপাদ রুপ গোস্বামী সাধকের যে ছয়টি গুণের কথা উল্লেখ করিয়াছেন তাহার মধ্যে সদাচার বা সাধুবৃত্তি অন্যতম। হরিভক্তি বিলাস গ্রন্থে সাধকের সদাচার সমূহ উল্লেখ আছে। গৌড়ীয় গুরুবর্গগণ সাধকের যে সকল আচার, আচরণ শিক্ষা দিয়াছেন বা তাহাদের অনুগত বৈষ্ণবগণের মধ্যে আমরা যেসকল আচরণ দেখিতে পাই সকল গৃহিভক্ত তাহা অনুসরণ করিবেন। বিশেষ করিয়া গৌড়ীয়মঠে সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত যে সকল নিয়ম ব্যক্তিগত ভাবে বা সমষ্টিগত ভাবে পালন করা যাইয়া থাকে ভক্তগণ তাহা অনুসরণ করিবেন। ভক্তিসাধকের বা বৈষ্ণবগণের প্রত্যহিক কৃত্য বিষয়ে বা সদাচারের মুখ্য মুখ্য কয়েকটি উল্লেখ করা হইলোঃ--
(১) ব্রহ্মমূহুর্তে শয্যাত্যাগ।
(২) শৌচাদি ক্রিয়া।
(৩) দ্বাদশ অঙ্গে তিলক ধারণ।
(৪) মন্ত্রজপ
(৫) বিগ্রহ জাগরণ।
(৬) মঙ্গল আরতী
(৭) তুলসী আরতী
(৮) বিগ্রহ অর্চন
(৯) তুলসী সেবা ও তুলসী চয়ন
(১০) শ্রীমন্দির পরিক্রমা
(১১) সাধুসঙ্গ।
(১২) অতিথি সেবা।
(১৩) হরিনাম জপ
(১৪) ভক্তি গ্রন্থপাঠ।
(১৬) শ্রীহরিনাম কীর্ত্তন
(১৭) বৈষ্ণব ব্রতাদি পালন।
(১৮) বৈষ্ণব সেবা।
(১৯)অসৎ সঙ্গ ত্যাগ
(২০) আহার শুদ্ধি।
(২১) মঠ সেবা।
(২২) প্রকৃত বন্ধু নির্ণয় করে তার সঙ্গ করা।
(২৩) অপরাধ বিষয়ে সতর্কতা
(ক) বৈষ্ণব অপরাধ,
খ) সেবা অপরাধ
(২৪) দেবদেবীর উপাসনা ত্যাগ
(২৫) স্মার্ত্ত বিধানাবলী ত্যাগ।
প্রধান প্রধান কয়েকটি মাত্র আলোচনা করা হইল।
বৈষ্ণবের একটি গুণ হচ্ছে যে, তিনি অদোষদর্শী, তিনি কখনো কারো দোষ দেখেন না। প্রতিটি মানুষের অবশ্য গুণ ও দোষ দুটি রয়েছে । তাই বলা হয় সজ্জনা গুণম ইচ্ছন্তি দোষং ইচ্ছন্তি পামরাঃ । সকলের মধ্যেই দোষ ও গুণ দুটি রয়েছে । কিন্তু বৈষ্ণব ও সাধু সজ্জনগণ মানুষের গুণটিই দর্শন করেন আর পামরেরা শুধু দোষ দর্শন করেন। মাছি ঘা খোঁজে আর মৌমাছি মধু খোঁজে ।।
"কলিকালে নামরুপে কৃষ্ণ অবতার ।
নাম হৈতে হয় সর্বজগত্ নিস্তার ।।"
- চৈঃ চঃ ১৭/২২
অর্থাৎ,- এই কলিযুগে ভগবানের দিব্যনাম হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের অবতার। কেবলমাত্র এই দিব্যনাম গ্রহণ করার ফলে, যে কোন মানুষ সরাসরিভাবে ভগবানের সঙ্গ লাভ করতে পারেন। যিনি তা করেন, তিনি অবশ্যই উদ্ধার লাভ করেন।এই নামের প্রভাবেই কেবল সমস্ত জগত্ নিস্তার পেতে পারে। গুনঙ্গ সারগ্রাহী মহাত্মারা কলিযুগকে এই জন্য ধন্য বলেন, কেন না কলিযুগে কেবল হরিনাম সংকীর্তনের ফলেই সর্বসিদ্ধি লাভ হয়।
ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণবের অপ্রাকৃত গুনাবলী বৈষ্ণব সর্বশ্রেষ্ঠ।
শ্রীমদ্ভগবদগীতায় শুদ্ধ ব্রাহ্মণের নয়টি গুনাবলী বর্ণনা করা হয়েছে।
শমো দমস্তপঃ শৌচং ক্ষান্তিরার্জবমেব চ।
জ্ঞানং বিজ্ঞানমাস্তিক্যং ব্রহ্মকর্ম স্বভাবজম্।। -(গীতা ১৮/৪২)
অর্থাৎ,- শম, দম, তপ, শৌচ, ক্ষান্তি, সরলতা, জ্ঞান, বিজ্ঞান ও আস্তিক্য-এগুলি ব্রাহ্মণদের স্বভাবজাত কর্ম।
১) শম - ( মন সংযম)
২) দম - ( ইন্দ্রিয় সংযম )
৩) তপস্যা
৪) শৌচ
৫) ক্ষান্তি বা ক্ষমাশীলতা
৬) আর্জবম্ বা সরলতা
৭) জ্ঞান
৮) বিজ্ঞান
৯) আস্তিক্যম
কিন্তু গীতায় (৬/৪৭) ও (১২/২) এই শ্লোক গুলিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার শরণাগত ভক্তকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলেছেন।
যোগিনামপি সর্বেষাং মদগতেনান্তরাত্মনা।
শ্রদ্ধাবান্ ভজতে যো মাং স মে যুক্ততমো মতঃ।। (গীতা ৬/৪৭)
অর্থাৎ,- যিনি শ্রদ্ধা সহকারে মদগত চিত্তে আমার ভজনা করেন, তিনিই সবচেয়ে অন্তরঙ্গভাবে আমার সঙ্গে যুক্ত এবং তিনিই সমস্ত যোগীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। সেটিই আমার অভিমত।
ময্যাবেশ্য মনো যে মাং নিত্যযুুক্তা উপাসতে।
শ্রদ্ধয়া পরয়োপেতাস্তে মে যুক্ততমা মতাঃ।। (গীতা ১২/২)
অর্থাৎ,- শ্রীভগবান বললেন-যাঁরা তাঁদের মনকে আমার সবিশেষ রূপে নিবিষ্ট করনে এবং অপ্রাকৃত শ্রদ্ধা সহকারে নিরন্তর আমার উপাসনা করেন, আমার মতে তাঁরাই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী।
শ্রী চৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থে শুদ্ধভক্তকে ব্রাহ্মণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে এবং বৈষ্ণবের ২৬ টি অপ্রাকৃত গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে।
"সর্ব মহাগুণ- গণ বৈষ্ণব শরীরে।
কৃষ্ণভক্তে কৃষ্ণের গুণ সকল সঞ্চারে।।"
‘’তিতিক্ষবঃ কারুণিকাঃ সুহৃদঃ সর্বদেহিনাম্ ।
অজাতশত্রবঃ শান্তাঃ সাধবঃ সাধুভূষণাঃ ।।‘’ (ভাগবত ৩/২৫/২১)
অজাতশত্রবঃ শান্তাঃ সাধবঃ সাধুভূষণাঃ ।।‘’ (ভাগবত ৩/২৫/২১)
অর্থাৎ,- ভগবদ্ভক্ত সর্বদাই সহিষ্ণু, অত্যন্ত কৃপা পরায়ণ, সর্বজীবের সুহৃদ, শাস্ত্রানুগ, অজাতশত্রু, শান্ত - এই সকল গুণাবলী সাধুর ভূষণস্বরূপ I
১) কৃপালু
২) অকৃতদ্রোহ
৩) সত্যসার
৪) সম
৫) নির্দোষ
৬) বদান্য
৭) মৃদু
৮) শুচি
৯) অকিঞ্চন
১০) সর্বোপকারক
১১) শান্ত
১২) কৃষ্ণৈকশরণ
১৩) অকাম
১৪) নিরীহ
১৫) স্থির
১৬) বিজিত- ষড়্ গুণ (ক্ষুদা, পিপাসা, লোভ, মোহ, জরা ও মৃত্যু)
১৭) মিতভুক্
১৮) অপ্রমত্ত
১৯) মানদ
২০) অমানী
২১) গম্ভীর
২২) করুণ
২৩) মৈত্র
২৪) কবি
২৫) দক্ষ, ও
২৬) মৌনী
No comments:
Post a Comment