💐শ্রীজগন্নাথদেবের লীলা💐

🍁🌴🌳🌺🌷💞🌻🍁🌻💞🌷🌺🌳🌴🍁

বিশেষ পোষ্ট

শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ

সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম I

''হরি - গুরু - বৈষ্ণব তিনিহেঁ স্মরণ।

তিনেহেঁ স্মরণ হইতে বিঘ্ন বিনাশন।।

অনায়াসে হয় নিজ বাঞ্ছিত পূরণ ।।‘’

🌻শ্রীজগন্নাথদেবের লীলাকথামৃত (শেষ পর্ব ) 

শ্রীনৃসিংহদেব-বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা

নারদ মুনি রাজার প্রশান্ত মুখমণ্ডল দর্শন করে প্রীত হলেন। আসুন আমরা ভগবান নীলকণ্ঠ শিবের আবাস স্থানের দিকে গমন করি, রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের হাত ধরে নারদ মুনি বললেন। সেখানে আমরা সকল অশুভ ও বিঘ্ন বিনাশক ভগবান শ্রীনৃসিংহদেবের শ্রীবিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করব। এই বিগ্রহ পশ্চিমাভিমুখী হয়ে অবস্থান করবেন। ভগবান শ্রীবিষ্ণু শ্রীনৃসিংহ-মূর্তি রূপে আবির্ভূত হবেন। রাজা দেবর্ষির নিকট থেকে নানা উপদেশ-নির্দেশ প্রাপ্ত হলেন। "শ্রীনৃসিংহদেবের সামনে সম্পাদিত যজ্ঞ অত্যন্ত ফলপ্রদ হবে। অনুগ্রহপূর্বক এখানে পূর্বামুখী করে মন্দির নির্মাণ করুন। শ্রীনীলকণ্ঠদেব-বিগ্রহের দক্ষিণে একটি চন্দনবৃক্ষ বৃদ্ধি পাচ্ছে, এই বৃক্ষের পশ্চিম দিক যজ্ঞ করার একটি উপযুক্ত স্থান। আপনি অবশ্যই সেখানে এক সহস্র যজ্ঞ সম্পাদন করার জন্য আয়োজন করবেন।

পূর্ণ শ্রদ্ধা ও ভক্তিপ্লুত চিত্তে শ্রীনৃসিংহদেবের পূজা-আরাধনা করুন এবং তাঁকে তাঁর বিগ্রহরূপে প্রকটিত হবার জন্য অনুরোধ করুন। তারপর আমি সেই বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করব।" রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে প্রদত্ত নারদমুনির নির্দেশানুসারে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার পুত্র সুঘট একটি সুন্দর মন্দির নির্মাণ করলেন। চারদিনেই মন্দিরের নির্মানকার্য সুসম্পন্ন হল। পঞ্চম দিনে রাজা মন্দির উদ্বোধনের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করলেন এবং নারদমুনির পৌঁছানোর প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। তিনি অনতিদূরে নারদ মুনির অনুবর্তী সংকীর্ত্তন - শোভাযাত্রা থেকে আগত কীর্ত্তন - ধ্বনি শুনতে পেলেন। শীঘ্রই নারদ মুনি শ্রীনৃসিংহদেবের বিগ্রহ-সহ মন্দিরে উপনীত হলেন।শ্রীবিগ্রহ সূক্ষ্ম রেশমবস্ত্র পরিহিত ছিল এবং একটি সুন্দর সুরভিত পুষ্পমালা তাঁর জোতির্ময় শ্রীদেহে শোভিত ছিল। তাঁর অপ্রাকৃত শ্রীমূর্তি সুগন্ধিত চন্দন দ্বারা প্রলিপ্ত ছিল।

রাজা শ্রীবিগ্রহকে পরিক্রমা করলেন এবং সাষ্টাঙ্গ প্রণতি নিবেদন করলেন। নারদমুনির আদেশে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন একটি সুন্দর মণিরত্নখচিত বেদীতে শ্রীনৃসিংহদেবের শ্রীমূর্তি স্থাপন করলেন। ভূদেবী ও লক্ষ্মীদেবীর মূর্তিও প্রতিষ্ঠা করা হল। সমবেত ভক্তগণ ভগবানের দিব্যনাম কীর্ত্তন  করতে লাগলেন এবং আনন্দোচ্ছ্বাস সহকারে নৃত্য করতে লাগলেন। মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন এক সহস্র অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পাদন করলেন। অশ্বমেধ যজ্ঞগুলি প্রত্যক্ষ করার জন্য রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন সকল দেবগণকে আমন্ত্রণ করেছিলেন। বহু ঋষি, মুনি ও বৈষ্ণবগণ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এক সুবিশাল সভাগৃহে যজ্ঞ সম্পাদনের আয়োজন করা হয়েছিল এবং ঐ গৃহের দীর্ঘ ছাদ তিন মাইল পরিমাণ বিস্তৃত ছিল। ঐ গৃহের তলদেশ বা মেঝে মূল্যবান মণিরত্ন দ্বারা প্রস্তুত করা হয়েছিল এবং তার চারপাশ সোনা ও রূপা দিয়ে বাঁধানোছিল।

রাজা সমবেত সকলের মধ্যে জ্যেষ্ঠ দেবরাজ, শচীপতি ইন্দ্রের পূজা করলেন এবং বৈষ্ণবগণকে প্রণাম করলেন। রাজা স্বর্গাধিপতি ইন্দ্রদেবের নিকট প্রার্থনা করলেন, “হে দেবেশ্বর! আমি অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পাদনের মাধ্যমে যজ্ঞপুরুষ ভগবান শ্রীবিষ্ণুর আরাধনা করার সঙ্কল্প করেছি। আমি আবেদন রাখছি যে আপনি এবং অন্যান্য সকল দেবগণ যেন যজ্ঞ সমাপন পর্যন্ত এখানে অবস্থান করেন। আপনি শ্রীনীলমাধবের অনুগ্রহপূর্ণ দর্শন লাভ করেছেন, কিন্তু এখন সেই শ্রীবিগ্রহ স্বর্ণবালুকার নীচে সমাবৃত। তিনি যদি পুনরায় আবির্ভূত হন, তাহলে আপনিও উপকৃত হবেন।"

রাজার অনুরোধ শ্রবণ করে ইন্দ্রদেব উত্তর দিলেন, “হে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন, আপনি একজন মহাত্মা। আমি আপনার ভবিষ্যৎ কর্মসূচীর কথা ইতিমধ্যেই অবগত আছি। এই শুভ যজ্ঞ ত্রিভূবনকে পবিত্র করবে। আমি অবশ্যই আপনার এই শুভকর্ম সম্পাদনে সহায়তা করব। এখন আপনার এই ভগবদারাধনা-কৰ্ম আরম্ভ করুন।‘’ ইন্দ্রদেবের আশীর্বাদ গ্রহণ করে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন মহান ঋষিবর্গের তত্ত্বাবধানে অশ্বমেধ যজ্ঞ আরম্ভ করলেন। কোনরকম দোষ-ত্রুটি ভ্রান্তি ছাড়াই সব কিছু খুব সুন্দর ও পূর্ণাঙ্গরূপে সম্পাদিত হতে লাগল।

এক হাজার অশ্বমেধ যজ্ঞ সুসম্পন্ন করার পর, রাজা তাঁর মনকে পরমেশ্বর ভগবানের ধ্যানে নিবন্ধ করলেন এবং ধ্যানে তিনি শ্বেতদ্বীপ দর্শন করলেন। এই দ্বীপ ছিল স্বটিকে নির্মিত এবং এক চতুর্দিক পরিবেষ্টন করে ছিল দুগ্ধসাগর। নানা প্রভাময় মণিরত্ন বিজড়িত প্রশস্ত পাদপীঠের উপরে একটি স্বর্ণ সিংহাসন ছিল, যার উপর চতুর্ভূজ শ্রীবিষ্ণু উপবিষ্টরূপে শোভা পাচ্ছিলেন। তাঁর দক্ষিণভাগে ধরণীধর অনন্তশেষ ভগবানের শ্রীমস্তকের উপর চক্রের ন্যায় ফণা বিস্তার করে বিরাজিত ছিলেন। শ্রীবিষ্ণুর অঙ্গকান্তি ছিল মেঘের মতো নীলাভ এবং তাঁর গলদেশে ছিল একটি সুদীর্ঘ পুষ্পমালা। ভগবানের বামভাগে লক্ষ্মীদেবী বিরাজ করছিলেন।

ধ্যানভঙ্গের পর রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন সমস্ত ইতিবৃত্ত নারদ মুনিকে জানালেন। নারদ মুনি বললেন ভগবান যে নিজেকে প্রকটিত করবেন এটি তারই নির্দেশক লক্ষণ। তিনি আরও বললেন, “শ্রীবিষ্ণুর শ্রীদেহের রোম এই ধরণীতে পতিত হয়েছে এবং একটি বৃক্ষরূপে পরিগ্রহ করেছে। তিনি দারুরূপে, ব্ৰহ্মপুর বৃক্ষরূপে প্রকটিত হয়েছেন।" নারদ মুনি রাজাকে সেই বৃক্ষের কাছে নিয়ে গেলেন। ভক্তিমান রাজা প্রণামপূর্বক বৃক্ষের পূজা করলেন। নারদ মুনি তখন প্রকাশ করলেন যে ঐ দিব্য দারু ভগবান শ্রীবিষ্ণু স্বয়ং, এবং দারু থেকে শ্রীমূর্তি নির্মাণ করতে হবে।

রাজার নয়ন বিস্ময়ে বিস্ফোরিত হল। ‘’প্রিয় নারদ মুনি, কি ধরণের মূর্তি নির্মাণ করতে হবে? কে নির্মাণ করবেন?" নারদ স্মিত হাস্য করে উত্তর দিলেন, "ভগবানের লীলা অপ্রাকৃত। তিনি কিভাবে প্রকটিত হবেন কে বলতে পারে।" যখন তারা এইরকম বাক্যালাপ করছিলেন, অদৃশ্য এক দৈববাণীতে এই বার্তা ধ্বনিত হলঃ "শ্রীবিষ্ণুর অবতরণের রহস্য সংগুপ্ত রাখা হবে। এই দারুম্নখণ্ড  পনেরো দিন আবৃত রেখে দিন। এর থেকে শ্রীমূর্তিসমূহ খোদাই করার জন্য এক প্রবীণ সূত্রধর এখানে আসবেন। এসময় পনের দিন কক্ষের দ্বার রুদ্ধ রাখুন এবং দ্বারের সামনে নিরন্তর মৃদঙ্গ-ঢোল ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র বাজানোর ব্যবস্থা করুন। এইটি নিশ্চিত করবেন, যে কেউ যেমন   খােদাইয়ের শব্দ শুনতে না পায়। কেউ যদি সেই শব্দ শোনে, তবে নিশ্চিয়ই সে বধির হয়ে যাবে। এই সময় কেউই কক্ষের ভিতর প্রবেশ করার প্রয়াস করবে না, করলে সে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে অন্ধ হয়ে যাবে।"

রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ব সম্পূর্ণ যথাযথরূপে ঐ নির্দেশগুলি পালন করলেন। পনের দিন পর ভগবান শ্রীজগন্নাথ, শ্রীবলদেব ও সুভদ্রাদেবী এবং সুদর্শন চক্রের মূর্তিসমূহ প্রকটিত হলে। পুনরায় এক অদৃশ্য কণ্ঠে নেপথ্য যোষিৎ হলঃ “হে রাজন্, এই চতুর্থমূর্তি একটি বস্ত্রে আবৃত করুন এবং প্রাকৃত রঞ্জক দ্বারা বিগ্রহসমূহ রঙ করুন। প্রতি বছর পূর্বের রঙ স্নান হলে পুনরায় শ্রীমূর্তিসমূহ রঙ করবেন। বস্ত্রাদি-শূন্য উন্মুক্ত দারুমূর্তি কেউ যেন দর্শন না করে।

হে রাজা, করুণাময় প্রভু আপনাকে ও তাঁর দর্শনকারী সকল জীবকে তাঁর কৃপাশিস প্রদানের জন্য এখানে আবির্ভূত হয়েছেন। এখন আপনি অবশ্যই ৬৬৬ হাত (এক হাজার ফুট) পরিমিত উচ্চতাবিশিষ্ট একটি সুরম্য মন্দির নির্মাণ করবেন এবং এই মূর্তিসমূহ সেখানে স্থাপন করবেন।" রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন পূর্ণ নিষ্ঠাসহকারে সেই আদেশ অনুসারে তাঁর সকল কর্তব্য সুসম্পন্ন করলেন। হাজার হাজার বছর পরও সেই শ্রীমন্দির সকল মন্দিরের শিরোমণিস্বরূপ হয়ে বিরাজ করছে, উৎকলদেশকে শোভিত  করছে।

💞জয় পতিতপাবন পরম করুণাময় শ্রীজগন্নাথদেবের জয়💞