💐শ্রীজগন্নাথদেবের লীলা💐

🍁🌴🌳🌺🌷💞🌻🍁🌻💞🌷🌺🌳🌴🍁

বিশেষ পোষ্ট

শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ

সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম I

''হরি - গুরু - বৈষ্ণব তিনিহেঁ স্মরণ।

তিনেহেঁ স্মরণ হইতে বিঘ্ন বিনাশন।।

অনায়াসে হয় নিজ বাঞ্ছিত পূরণ ।।‘’

🌻শ্রীজগন্নাথদেবের লীলাকথামৃত (পর্ব- ৩)

নীলমণিময় বিগ্রহের বর্ণনা

ব্রাহ্মণ বিদ্যাপতি বর্ণনা করে চললেন, "আমি নীলাচল ধামে শ্রীবিষ্ণুর মন্দিরে সন্ধ্যাবেলা পৌঁছাই। সেইসময় মৃদুমন্দ শীতল বায়ু প্রবাহিত হচ্ছিল। শ্রীবিষ্ণুর এই সৌন্দর্যমণ্ডিত আবাসস্থানের চতুর্দিকে অরণ্য পরিবেষ্টিত, এবং সুরম্য শ্রীমন্দিরের চতুর্দিকের গাত্র মূল্যবান মণিরত্ন-খচিত ও সুশোভিত। মন্দির-অভ্যন্তরে ইন্দ্রনীলমণিময়-বিগ্রহ শ্রীবিষ্ণু তাঁর ভক্তদের দর্শন দান করেছেন। ভগবান তাঁর চতুর্ভূজে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম ধারণ করে বিরাজমান। তাঁর এই মণিময় শ্রীমূর্তি একাশি আঙুল পরিমাণ উচ্চতা বিশিষ্টি এবং এক সুন্দর স্বর্ণকমলের উপর স্থিত। মনোভিরাম এই শ্রীবিগ্রহের স্মিত হাসৌদ্ভাসিত মুখপদ্ম জড়জগতের সকল ক্লেশ বিদূরিত করে। ভগবানের নাসিকা কোমল তিল পুষ্পের মতো সুচারু ও সু-উন্নত। তাঁর সুন্দর কর্ণযুগল মকরকুণ্ডলে শোভিত।

"ভগবানের স্কন্ধদ্বয় সুদৃঢ় ও সুবিস্তৃত। তাঁর চার হস্ত আজানুলম্বিত। তাঁর বক্ষস্থল কৌস্তুভ মণি দ্বারা বিভূষিত এবং তাঁর গলদেশে শোভিত মুক্তাহার কটিদেশ অবধি বিস্তৃত। তাঁর গভীর নাভিপদ্ম সূক্ষ্ম ও কোমল রোমাবলী দ্বারা শোভিত। তাঁর উরুদ্বয় দুটি অটল স্তম্ভের মতো। যে কেউ তাঁকে প্রণিপাতপূর্বক ভক্তিসহকারে দর্শন করে, সে জড়বন্ধন হইতে মুক্তি লাভ করে।"

বিদ্যাপতি সসম্ভ্রমে তাঁর করজোড়ে বলতে থাকেনঃ "লক্ষ্মীদেবী তাঁর বাম পার্শ্বে উপবেশন করে অনুক্ষণ তাঁর চারু মুখকমল নিরীক্ষণ করছেন। তাঁর শ্রীমূর্তি সকল ধরণের মণিরত্ন দ্বারা সুশোভিত ও সকল সৌন্দর্যের নিলয় স্বরূপ। এইভাবে নীলগিরির শিখরে জগৎ-পিতা ও জগন্মাতা উভয়ে বিরাজ করছেন। আমি সেখানে তাঁদের উভয়কেই দর্শন করেছি। তাঁরা সেখানে নিঃশব্দে উপবেশন করে আছেন এবং যে তাঁদের দর্শন করেছেন, তাঁরা তাঁকে তাঁদের শুভ আশিস প্রদান করছেন।

"তাঁদের পেছনে ভগবান অনন্ত শেষ বিরাজিত। তিনি তাঁদের উপরে ছত্রের মতো তাঁর ফণা ধারণ করে রয়েছেন। তাঁদের সামনে সুদর্শন চক্র প্রতীক্ষমান। সুদর্শনরের পেছনে গরুড়দেব সেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষারত।" বিদ্যাপতি এখানে তাঁর বর্ণনায় বিরতি দিয়ে রাজার প্রত্যুত্তরের প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। রাজা বললেন, "শ্রীভগবান এবং তাঁর নীলাচল ধামের মহিমা শ্রবণ করে আমি এখন পরিশুদ্ধ হলাম। আমি সেখানে যাব এবং সেখানে মহা ঐশ্বর্যমণ্ডিত এক নগর প্রতিষ্ঠা করব। ভগবৎ-প্রীতিবিধানের জন্য আমি সেখানে একশত অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পাদন করব এবং শতসহস্র পূজার দ্বারা ভগবানের সেবা করব। ব্রত, উপবাস ও শাস্ত্রোক্ত বিধিনিয়ম পালনের দ্বারা আমি ভগবানের প্রীতি সম্পাদন করব। ভগবান শ্রীনারায়ণ পতিত জীবদের প্রতি অত্যন্ত করুণাপরায়ণ।" ঠিক তখন, শ্রীনারায়ণের ত্রিভুবন-প্রসিদ্ধ ভক্ত দেবর্ষি নারদ রাজপ্রাসাদে উপনীত হলেন।

রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে অতিথি শ্রীনারদমুনিকে পরম আদরে অভ্যর্থনা করলেন। তিনি তাঁর পাদপ্রক্ষালন করে উপবেশনের জন্য একটি উত্তম আসন প্রদান করলেন। তিনি এই মহা ঋষিকে ধূপ, পুষ্প দ্বারা পূজা করলেন এবং নিম্নোক্ত কথাগুলি বললেন, "আজ আমার সকল যজ্ঞ ও দানব্রতাদি কর্ম সার্থক হয়েছে কেননা শ্রীনারদমুনি আজ আমার গৃহে সমাগত হয়েছেন। হে দেবর্ষি, অনুগ্রহ করে বলুন আপনার প্রীতিসাধনের জন্য আমি কি করতে পারি? আমার প্রতি কি আপনার কোন আজ্ঞা আছে যা আমাকে পালন করতে হবে? কৃপাপূর্বক আপনার আগমনের হেতু আমাকে বলুন," রাজা বিনম্র চিত্তে তাঁকে বললেন।

রাজার আতিথ্যে নারদমুনি প্রীত হয়ে বললেন, "মহারাজ! ব্রহ্মা সহ সকল দেবগণ আপনার ভক্তিসূচক গুণাবলীতে আপনার প্রতি অত্যন্ত প্রীত হয়েছেন। নীলাচলে আপনার নগর প্রতিষ্ঠার সঙ্কল্পও তাঁদের দ্বারা অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছে। সহস্র সহস্র জন্মের প্রচেষ্টায় ভগবান শ্রীমাধবের প্রতি ভক্তি লাভ করা যায়, যিনি নীলাচলের একটি গুহায় বিরাজ করছেন। এই জগদীশ্বরের আরাধনার পরই কেবল ব্রহ্মা এই ব্রহ্মাণ্ড রচনা করেন। আপনি যেহেতু ব্রহ্মার বংশে জন্মলাভ করেছেন, সেজন্য স্পষ্টতঃই সেই জগদীশ্বরের প্রতি আপনার অচল ভক্তি রয়েছে। এই জড়জগত দুঃখ দুর্দশায় পূর্ণ এবং এখানে প্রতি পদক্ষেপে বিপদ। ভগবান শ্রীহরির প্রতি ভক্তিই হচ্ছে সুরক্ষিত হবার একমাত্র উপায়।" নারদমুনির মধুর বাক্য উপস্থিত সকলের চিত্তকে তৎক্ষণাৎ নির্মল করে তুলল।

রাজপ্রাসাদের সকলের চিত্তমন অবর্ণনীয় সুখে পূর্ণ হল। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন তাঁর সুখাতিশষ্য সংগোপন না করে বললেন, "হে দেবর্ষি, আপনার পবিত্র সঙ্গ-প্রভাবে আমি অজ্ঞান-তমসা হইতে বিমুক্ত হয়েছি। আমার চিত্তে ভগবান শ্রীনীলমাধবের আরাধনার ব্যাকুলতা তীব্র হয়ে উঠেছে। আসুন, আমার উভয়ে রথে আরোহণ করে শ্রীনীলমাধব দর্শনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। আপনি যদি অনুগ্রহ করে আমাকে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে নিয়ে যান এবং ধামের মাহাত্ম্য প্রকাশ করেন, তাহলে আমার জীবন সার্থক হবে।" শ্রীনারদমুনি বললেন, "এটি আমার জন্য অত্যন্ত আনন্দের বিষয় যে  আমি ঐ স্থানের মাহাত্ম্য আপনাকে বলব। আপনি সর্বশুভময় নীলাচল ধামে শ্রীজগন্নাথকে প্রত্যক্ষভাবে, মুখোমুখি দর্শন করবেন।"

নারদমুনির নির্দ্দেশ অনুযায়ী রাজা, রাজজ্যােতিষীকে ডেকে নীলাচল ধামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার সবচেয়ে শুভ সময় নির্ধারণ করতে বললেন। বহু পুঁথি, তথ্যপঞ্জী দেখার পর জ্যােতিষী ঘোষণা করলেন যে জৈষ্ঠ্য মাসের পঞ্চমী তিথি সেই উপযুক্ত সময়, শুভ তিথি। রাজপ্রাসাদে দ্বিতীয় রাজাদেশ ঘোষিত হলঃ রাজার সকল ভ্রাতৃবর্গ ও নাগরিকগণকে তাঁদের জীবনকাল পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে অতিবাহিত করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। তাঁরা ছাড়াও সকল রাণী, মন্ত্রী, পরিষদবর্গ ও তাঁদের সকল ঘোড়া এবং সৈনগণ শ্রীধাম যাত্রীদলে অন্তর্ভূক্ত হল। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন যাত্রারম্ভের সকল বিধিনির্দিষ্ট শুভ মাঙ্গলিক ক্রিয়াদি সুসম্পন্ন করলেন। তিনি ও নারদ মুনি শ্রীবিষ্ণু ও দূর্গাদেবীর মন্দির পরিদর্শন করে তাঁদের আশীর্বাদ প্রার্থনা করলেন। যখন সেই শুভ তিথি সমাগত হল, রাজা শ্রীনারায়ণকে প্রণতি ও প্রার্থনা নিবেদন করে রথে আরোহণ করলেন।

নারদ মুনি তাঁর পাশে একটি উচ্চতর আসনে উপবেশন করলেন। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের রথকে অন্যান্য প্রদেশের রাজন্যবর্গের শত শত রথ অনুসরণ করছিল। সমস্ত রথগুলি বিভিন্ন অস্ত্র দ্বারা সুরক্ষিত এবং উজ্জ্বল রঙে পতাকায় শোভিত ছিল। নাগরিকগণ হাতী, ঘোড়া, উট-প্রভৃতি প্রাণীদের পিঠে আরোহণ করে রাজার অনুগমন করলেন। সেই মহিমাময় শোভাযাত্রার দৃশ্য দর্শন করে শুভানুধ্যায়ী ও দর্শকগণ উল্লাসধ্বনি করতে লাগলেন। সেই রাজকীয় অভিযাত্রীদল অপরাহ্নে মহানদীর তীরে উপনীত হল। রাত্রের আশ্রয়ের জন্য তাঁবুর শিবিরের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। রাজা নদীতে স্নান করলেন, আর পুরোহিত ও অন্যান্য ব্রাহ্মণগণ বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ ও পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করতে লাগলেন। স্নান সমাপনের পর রাজা শ্রীবিষ্ণুর পূজা করলেন এবং নারদ মুনির সঙ্গে প্রসাদ গ্রহণ করতে উপবেশন করলেন। তিনি নারদ মুনির নিকট ভগবান শ্রীহরির সুমধুর লীলা বর্ণনার জন্য অনুরোধ করলেন।

রাজা যখন হরিকথা শ্রবণে নিমগ্ন, সে-সময় দ্বাররক্ষী জানাল যে একজন বার্তাবাহক এসেছে। সে জানাল, “রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের সঙ্গে অবিলম্বে সাক্ষাতে রসময় দানের জন্য উৎকল রাজা অনুরোধ জানিয়েছেন।” রাজা সম্মতি দিলেন। উৎকলের পূণ্যবান রাজা সাক্ষাৎ-স্থানে সমাগত হয়ে মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন ও দেবর্ষি নারদকে প্রণাম নিবেদন করলেন। মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন তাঁকে যথাযথভাবে অভ্যর্থনা করলেন এবং তাঁকে আলিঙ্গন করে বললেন, “হে উৎকলরাজ, আপনার পরিশুদ্ধ বুদ্ধি শ্রীবিষ্ণুর শ্রীচরণকমলে নিবদ্ধ রয়েছে তো? আপনার সার্বিক কুশল তো?”

উৎকলরাজ উত্তরে বললেন, “আপনার শ্রীপাদপদ্মের কৃপায় সবকিছুই শুভ। তবুও আমি আপনাকে কিছু সমাচার জানাব যা আপনার কিছু উদ্বেগ এমনকি দুঃখ দিতে পারে। আমি আপনার ভগবান শ্রীমাধবের দর্শন লাভের অভিপ্রায় অবগত রয়েছি।” ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজার নিকট থেকে বার্তা শ্রবণের জন্য যখন কিছুটা সামনে ঝুঁকলেন, কক্ষের আবহাওয়া হঠাৎই যেন খুব ভারী হয়ে উঠল। “ভগবানের ধাম এক আকস্মিক তীব্র ঝড়ে পুরু বালুস্তরে আবৃত হয়ে গেছে। এখন আমার এই উৎকলদেশ সকল ধরণের দুর্বিপাকে সঙ্কুলিত হয়েছে, বহু মানুষ মৃত এবং অনেকেই শুভাগমন করেছেন এবং আমি নিশ্চিত যে আপনার উপস্থিতির সম্বন্ধে আলোচনার পর উৎকলের রাজা বিদায় গ্রহণ করলেন।”

রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন অন্তরে কিছুটা বিচলিত বোধ করলেন। তিনি এই ভেবে অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হলেন যে তাঁর ভগবান শ্রীনীলমাধবের দর্শনলাভের আন্তরিক অভিলাষ হয়ত বিফল হতে চলেছে। রাজা সদুত্তরের জন্য নারদমুনিকে তাঁর উদ্বেগ জ্ঞাপন করলেন। “হে রাজন্, আপনি এ-বিষয়ে বিচলিত হবেন না।” দেবর্ষি তাঁকে আশ্বস্ত করলেন। “আপনি একজন মহান বৈষ্ণব এবং একজন বৈষ্ণবের অভিলাষ কখনই বিফল হয় না। আপনি নিশ্চিতভাবেই পরমপুরুষ ভগবানের দর্শন প্রাপ্ত হবেন। তিনি কেবল আপনাকে তাঁর শুভ দর্শন দানের জন্য এই ধরণীতে আবির্ভূত হবেন।

সমগ্র সৃষ্টি তাঁর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তিনি কারও দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নন। তিনি ভক্তবৎসল ভক্তপরবশ।

বিষ্ণুভক্তি জীবনের চারটি লক্ষ্য-চতুর্বর্গের মূল স্বরূপ। শ্রীব্রহ্মা স্বয়ং আমাকে আপনার এই কার্যে সহায়তা করার জন্য নিয়োজিত করেছেন। একবার আমরা যখন পুরুষোত্তম ধামে পৌঁছাব, তখনই সবকিছুই সবিস্তারে জানাব। এখন রাত্রি তৃতীয় প্রহর। এখন সকল রাজন্যবর্গকে তাঁদের নিজ নিজ শিবিরে গিয়ে বিশ্রাম গ্রহণ করার অনুমতি দিন। আপনিও অবশ্যই বিশ্রাম গ্রহণ করুন।” নারদমুনির পরামর্শে রাজার মন শান্ত হল। পরদিন প্রভাতে, তাঁর দৈনন্দিন প্রাতঃকালীন কর্তব্যকর্মাদি সমাপন করে রাজা শ্রীজগন্নাথের পূজা করলেন, তারপর নীলাচল ধামে গমনের উদ্দেশ্যে মহানদী অতিক্রম করলেন। নদীর অপরপারে পৌঁছিয়ে রাজা শঙ্খধ্বনি শুনতে পেলেন।

‘’হে রাজন, এটি একটি অত্যন্ত বিরল স্থান, যা ভগবান শ্রীবিষ্ণু কর্তৃক সংগুপ্ত রয়েছেন।‘’ নারদমুনি ব্যাখ্যা করলেন। “এখান থেকে অনতিদূরে মহাদেব শিবের স্থান। এখান থেকে তিন যোজন (২৪ মেইল) দূরে নীলগিরি অবস্থিত। দেবাদিদেব সৃষ্টির আদি কারণ ভগবান শ্রীপুরুষোত্তমের নিকট তাঁর প্রার্থনা নিবেদন করেছিলেন। তাঁর প্রার্থনায় প্রীত হয়ে শ্রীবিষ্ণু তাঁর নিকট আবির্ভূত হন এবং তাঁকে বলেন, ‘দক্ষিণ সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ও নীলপর্বত দ্বারা শোভিত একটি ভূমিখন্ড রয়েছে। এই ভূমির উত্তরভাগে একাম্র কানন নামক একটি অতি সুন্দর বন আছে। আপনার নিত্য-লীলাসঙ্গিনী পার্বতীদেবী সহ আপনার সেখানে বাস করা কর্তব্য। আমার আজ্ঞায় ব্রহ্মা সেখানে আপনাকে কোটিলিঙ্গেশ্বর রূপে প্রতিষ্ঠা করবেন।‘  তখন থেকে শ্রীশিব ঐস্থানে বিরাজ করছেন। এখন চলুন আমরা ঐ স্থানে গমন করে শ্রীশিবের দর্শন লাভ করি।”

রাজা বিন্দুসরোবরে স্নান করলেন; এই সরোবরে সর্বতীর্থের জল বিদ্যমান। তারপর তিনি ভগবান শ্রীভুবনেশ্বরের পূজা করলেন। তাঁর পূজায় প্রীত হয়ে মহাদেব শিব রাজাকে বললেন যে শীঘ্রই তাঁর অভিলাষ পূর্ণ হবে। শিব নারদমুনিকে একান্তে ডেকে বললেন, "হে মহাত্মন! এই ব্যক্তির মাধ্যমে ব্রহ্মাজীর আজ্ঞা পূরণ করুন। শ্রীবিষ্ণুর সন্তুষ্টিবিধানের জন্য রাজা অবশ্যই একশত অশ্বমেধ যজ্ঞ করবেন। পরিশেষে অসহায় পতিত জীবকূলকে উদ্ধারের জন্য ভগবান স্বয়ং দারুব্রহ্ম রূপে প্রকটিত হবেন। ধাম ভগবান হইতে অভিন্ন। ঐ স্থান সুরক্ষিত রাখার জন্য ভগবান বিষ্ণু আমাকে আটটি ভিন্ন ভিন্ন রূপে নিয়োজিত করেছেন। আমি নীলকন্ঠ নামে বিদিত এবং আমি দূর্গাদেবীর সঙ্গে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের প্রবেশদ্বারে অবস্থান করছি। রাজাকে ঐ স্থানে নিয়ে চলুন।” শ্রীশিব গম্ভীরভাবে এইসব নির্দেশ প্রদান করলেন, তারপর তিনি অন্তর্হিত হলেন।

নারদমুনি শ্রীশিবের উপদেশ স্মরণ করে পরিক্রমা দলকে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের দিকে নিয়ে চললেন। রাজা ও তাঁর অনুবর্তী দল প্রশান্ত চিত্তে দেবর্ষির অনুগমন করতে লাগলেন- এই জেনে যে তাঁদের এই অভিযাত্রার প্ররিসমাপ্তি হবে ভগবান শ্রীবিষ্ণুর শ্রীচরণকমলের সেবালাভের মধ্য দিয়ে। অভিযাত্রী দল অকস্মাৎ একটি অগুরু বৃক্ষের নিচে বিরাজিত ভগবান শ্রীনৃসিংহদেবের শ্রীবিগ্রহ দর্শন করলেন। “এই দেববিগ্রহের দর্শনমাত্র কোটি ব্রাহ্মণহত্যার পাপ হইতে বিমুক্ত হওয়া যায়। ভগবানের দিব্য অপ্রাকৃত রূপ সকল বিপদ ও ভয় বিদূরিত করে।” নারদমুনি বললেন।

শ্রীনৃসিংহদেবের শ্রীমুখে তীক্ষ্ণ দন্তরাজি প্রকাশ পাচ্ছিল। তাঁর স্কন্ধ স্বর্ণাভ কেশরে আবৃত ছিল তাঁর মদনমণ্ডলকে পরিবেষ্টিত করেছিল। তিনি ছিলেন ত্রিনেত্র বিশিষ্ট এবং তাঁকে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল। তাঁর তীক্ষ্ণ নখররাজি অসুররাজ হিরণ্যকশিপুর বক্ষ বিদীর্ণ করছিল। তাঁর শ্রীহস্তে শঙ্খ ও চক্র ঝলকিত হচ্ছিল। ভগবানের মস্তকে শোভিত কিরীটি কোটি সূর্যের মতো প্রভা বিকিরণ করছিল। তাঁর নেত্র হইতে সর্বদিকে দীপ্তি বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। রাজা ও তাঁর অনুবর্তী যাত্রীদল সকলে শ্রীনৃসিংহদেবের এই উগ্ররূপকে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত নিবেদন করলেন। অবশেষে সকল মুনিগণের শিরোমণি দেবর্ষি নারদ রাজাকে সেই পবিত্র স্থানে নিয়ে এলেন যেখানে শ্রীনীলমাধব বিরাজ করছিলেন। কিন্তু সেই সময়ে শ্রীবিগ্রহ স্বর্ণাভ বালুকার নিচে আবৃত হয়ে পড়েছিল।

নারদ মুনি রাজার কাছে ভগবানের পরিকল্পনা প্রকাশ করলেন, যিনি কার্যত শোকে অচেতন হয়ে পড়েছিলেন। “সেই ভগবান নীলমাধব এখন চার-রূপে আপনার নিকট আবির্ভূত হবেন।” যে-স্থানকে নারদমুনি শ্রীজগন্নাথদেবের নিত্য লীলাস্থান বলে নির্দেশ করলেন, সেই স্থানে রাজা সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করলেন। রাজার আঁখিদ্বয় হইতে অপ্রতিরুদ্ধভাবে অশ্রুপাত হচ্ছিল। তখন একটি নেপথ্য কন্ঠের নির্ঘোষ ধ্বনিত হলঃ “হে রাজন্, উদ্বিগ্ন হয়ো না আমি অবশ্যই তোমাকে দর্শন দেব। তোমাকে অবশ্যই ব্রহ্মাজীর নির্দেশ অনুসারে সবকিছু সম্পাদন করতে হবে, যা আমার ভক্ত নারদমুনির মাধ্যমে তোমাকে জ্ঞাপন করা হয়েছে।” রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন তৎক্ষণাৎ দণ্ডায়মান হয়ে স্তোত্র-গীত দ্বারা ভগবানের মহিমা কীর্ত্তন করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি একটি নির্জন স্থানে উপবেশন করে ভগবানের আজ্ঞা অনুধাবন করতে লাগলেন। তিনি তাঁর প্রিয় প্রভুর পবিত্র আজ্ঞা পালন করার জন্য নিজেকে যত্ন সহকারে প্রস্তুত করলেন।

আগামী পর্বে থাকছে---

♦শ্রীনৃসিংহদেব-বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা♦

💞জয় পতিতপাবন পরম করুণাময় শ্রীজগন্নাথদেবের জয়💞