🏵️💐🌺🏵️💐💞🏵️💐🌺🏵️💐💞🏵️💐🌺🏵️
🌷🌻💖🍁🌺রথযাত্রা লীলা 🌻🌺🍁💖🌻🌷
🏵️💐🌺🏵️💐💞🏵️💐🌺🏵️💐💞🏵️💐🌺🏵️
বিশেষ পোষ্ট
🌷🌻💖🍁🌺রথযাত্রা লীলা 🌻🌺🍁💖🌻🌷
🏵️💐🌺🏵️💐💞🏵️💐🌺🏵️💐💞🏵️💐🌺🏵️
বিশেষ পোষ্ট
শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ
সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম I শ্রীজগন্নাথদেবের বিশ্বপ্রসিদ্ধ রথযাত্রা পর্বের অগ্রীম প্রীতিশুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
হরে কৃষ্ণ, আগামী ২৩/০৬/২০২০ ইং রোজ - মঙ্গল বার শ্রীজগন্নাথদেবের বিশ্বপ্রসিদ্ধ রথযাত্রা।
“ স জীয়াৎ কৃষ্ণচৈতন্যঃ শ্রীরথাগ্রে ননর্ত্ত যঃ I
যেনাসিজজগতাম চিত্রং জগন্নাথঃ অপি বিস্মিতঃ I I’’S
শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্যের জয় হোক , যিনি রথযাত্রা কালে রথের সম্মুখে নৃত্য করতে করতে যাচ্ছিলেন , যা দেখে জগৎবাসী সকল ব্যক্তি এবং স্বয়ং জগন্নাথদেবও বিস্মিত হয়েছিলেন ।
প্রভু জগন্নাথের রথের সম্মুখে শ্রীমৎ মহাপ্রভুর দিব্য-নৃত্য সকল দর্শনার্থীদের বিস্মিত ও মুগ্ধ করেছিল । এই নৃত্য এতই ঐশ্বরিক যে, কোন পার্থিব নৃত্যের সঙ্গেই এর তুলনা চলেনা । রথযাত্রাকালে গুণ্ডিচা মার্জন, ভক্তসঙ্গে রথাগ্রে নৃত্য- কীর্তন ও অলৌকিক লীলা প্রদর্শনের মাধ্যমে শ্রীজগন্নাথদেব ও শ্রীক্ষেত্রের মাহাত্ম্যকে অত্যুজ্জ্বলভাবে প্রকাশ করে গিয়েছেন।
সমগ্র দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারত পরিব্রাজন করে মহাপ্রভু নীলাচলে ফিরে এলে তাঁর আগমনের বার্তা পেয়ে গৌড়ভক্তবৃন্দের হৃদয়ে গৌর দর্শনেচ্ছা প্রবল হয়ে উঠল। রথযাত্রাকে উপলক্ষ করে শ্রীঅদ্বৈত আচার্য সহ প্রায় তিনশত ভক্ত নীলাচলে এলেন। তাঁদের মিলিত সংকীর্তনে আকাশ- বাতাস মুখরিত হয়ে উঠল। নীলাচলবাসী সকলেই এই কীর্তন রঙ্গ দেখতে চললেন। রাজা প্রতাপরুদ্র আর স্থির থাকতে না পেরে গোপীনাথ আচার্য ও সার্বভৌমকে সঙ্গে নিয়ে সৌধশিখর হতে আগত বৈষ্ণবদের কীর্তন শোভাযাত্রা দর্শন করে ব্যাকুল হলেন । বিস্ময়ে তিনি বলে উঠলেন,-
‘‘কোটি সূর্য সম সবার উজ্জ্বল বরণ।
কভু নাহি শুনি এই মধুর কীর্তন।
ঐছে প্রেম ঐছে নৃত্য ঐছে হরিধ্বনি।
কাঁহা নাহি দেখি ঐছে কাঁহা নাহি শুনি।।’’
শ্রীজগন্নাথ দেবের রথযাত্রার দিন যথাসময়ে ভক্তগণকে সঙ্গে নিয়ে গোরা রায় জগন্নাথের অতি পবিত্র অনুষ্ঠান ‘পাণ্ডুবিজয়’ দর্শনার্থে মন্দিরে গেলেন। (রথে আরোহনের জন্য শ্রীমন্দির থেকে ধরাধরি করে জগন্নাথ দেবের নির্গমনকে পাণ্ডুবিজয় বলে ।
দুইদিকে দয়িতাগণ জয়ধ্বনি সহকারে জগন্নাথ দেবের কটিদেশ ধারণ করে তাঁকে রথারোহণ করালেন।
“ মহাপ্রভু ‘ মণিমা মণিমা’ করে ধ্বনি ।
নানা বাদ্য কোলাহল কিছুই না শুনি ।।”
[ মণিমা — সর্ব্বেশ্বর । এই শব্দটি উৎকল ভাষায় অত্যন্ত সম্মানসূচক ]
“ তবে প্রতাপরুদ্র করে আপনে সেবন।
সুবর্ণ মার্জ্জনী লঞা করে পথ সম্মার্জ্জন । ।
চন্দন জলেতে করে পথ নিষিঞ্চনে ।
তুচ্ছ সেবা করে বৈসে রাজসিংহাসনে ।।”
রাজা প্রতাপরুদ্র স্বয়ং স্বর্ণ খড়িকা দিয়ে জগন্নাথের যাত্রাপথ পরিষ্কার করে চন্দন জলের সিঞ্চন করছেন। মহাপ্রভু শ্রীহস্তে নিজ ভক্তগণকে মালা-চন্দন দিলেন । ভক্তগণকে মহাপ্রভু সাতটি সম্প্রদায়ে ভাগ করলেন। চার সম্প্রদায় রথের সামনে, দু’টি দল দু’পার্শ্বে ও আর এক দল পিছনে। প্রত্যেক দলে গায়ন, বাদন ও নৃত্যের দায়িত্ব বণ্টন করে দিলেন । প্রতি সম্প্রদায়ে দুটি করে মাদল বা খোল হিসাবে চোদ্দো মাদল বেজে উঠল। শুরু হল মহাভাবের নর্তন কীর্তন। বৈষ্ণবেরা যেন মেঘ , — মেঘের বাদল বা বৃষ্টি- বর্ষণের মত বৈষ্ণবদের সঙ্কীর্ত্তনরূপ অমৃত বর্ষিত হতে থাকল । শক্তিসম্পন্ন ভক্তগণ কীর্তন নৃত্যে ভাবোন্মত্ত শ্রীচৈতন্য প্রভুকে দেখছেন সাত সম্প্রদায়ের মধ্যেই।
“ আর এক শক্তি প্রভু করিলা প্রকাশ।
এক কালে সাত ঠাঁই করিল বিলাস।।
সবে কহে প্রভূ আছে মোর সম্প্রদায় ।
অন্য ঠাঁই নাহি যান আমার দয়ায় ।। ”
রাসলীলা কালে প্রত্যেক গোপীকাই যেমন মনে মনে ভেবেছিলেন যে, শ্রীকৃষ্ণ তাঁর কাছে আছেন , ভক্তরাও প্রত্যেকেই জানলেন যে প্রভু তাঁর সন্নিকটেই রয়েছেন I
মহাপ্রভুর দৃষ্টিতে রথযাত্রা হচ্ছে দ্বারকা থেকে শ্রীকৃষ্ণের ব্রজে, অর্থাৎ ঐশ্বর্য্যের ধাম থেকে মাধুর্যের আলয়ে আগমন ।
“ কৃষ্ণ লইয়া ব্রজে যাই এ ভাব অন্তর।”
তাই রাধারাণীর মহাভাবে বিভোর হয়ে তাঁর হৃদয়নাথের সম্মুখে দাঁড়িয়ে গৌরসুন্দর করজোড়ে নত হয়ে প্রার্থনা করছিলেন,-
‘‘নাহং বিপ্রো ন চ নরপতির্নাপি- বৈশ্যো ন শূদ্রো নাহং বর্নী ন চ গৃহপতির্নো- বনস্তোযতির্বা।
কিন্তু প্রোদ্যন্নিখিল - পরমানন্দ - পূর্ণামৃতাব্দ্ধে- র্গোপীভর্তুঃ - পদ- কমলয়োর্দা - সদাসানুদাসঃ।।’'
আমি ব্রাহ্মণ নই, রাজা নই, বৈশ্য নই বা শূদ্রও নই। আমি ব্রহ্মচারী, গৃহস্থ, বানপ্রস্থ নই বা আমি সতীও নই (কারণ যতিধর্মে প্রেমধর্মের প্রকাশ নেই )। আমি কেবল উন্মীলিত পরমানন্দপূর্ণ সুধাসাগর রূপ গোপীনাথ শ্রীকৃষ্ণের চরণপদ্মের সেবকেরও সেবক , তারও সেবক।
“এত পড়ি পুনরপি করিল প্রণাম ।
যোড় হস্তে ভক্তগণ বন্দে ভগবান ।। ”
রথ পরিক্রমণ করতে করতে প্রভু নৃত্য করতে লাগলেন । শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ বর্ণনা করেছেন , প্রভু জগন্নাথের রথের চতুর্পার্শ্বে মহাপ্রভুর নৃত্য কিভাবে একটি ঘূর্ণায়মান আগুনের বলয় বলে দৃশ্যমান হচ্ছিল ।
“ উদ্দণ্ড নৃত্যে প্রভু করিয়া হুঙ্কার ।
চক্র-ভ্রমি ভ্রমে যৈছে অলাত-আকার I I’’
অলাত — জ্বলন্ত অঙ্গার । জ্বলন্ত অঙ্গার চক্রাকারে বেগে ঘুরালে যেমন সেটি চক্ররূপেই সকল দিক থেকে দেখা যায় , মহাপ্রভুর চক্রাকারে উদ্দণ্ড নৃত্যও তেমনি সকলেই সব দিক থেকে দেখতে পাচ্ছিল I নৃত্য করতে করতে এত দ্রুতগতিতে তিনি রথকে প্রদক্ষিণ করছিলেন যে, সেই স্বর্ণাভ অগ্নি-বলয়ের প্রতিটি বিন্দুতেই তিনি যুগবৎ প্রতীয়মান হচ্ছিলেন । মহাপ্রভু ভাবাবেশে উন্মত্ত হয়ে নৃত্য করতে লাগলেন। অদ্বৈতাচার্য মহাপ্রভুর পিছনে গিয়ে ‘হরিবোল! হরিবোল!’ বলে হুঙ্কার করে চিৎকার করছিলেন। মহাপ্রভুর ভাবনৃত্যের যাতে ব্যাঘাত না হয়, সেজন্য ভক্তগণ তিনটি মণ্ডলাকারে সজ্জিত হয়ে মহাপ্রভুকে ঘিরে রাখলেন। প্রভুর নৃত্য দেখে সকলেই বিমোহিত হলেন।
‘’প্রভুর নৃত্য দেখি’ লোকে হৈল চমৎকার।
অন্য আছুক্ জগন্নাথের আনন্দ অপার ॥
রথ স্থির হইল আগে না করে গমন।
অনিমিষ নেত্রে করে নৃত্য দরশন ॥
সুভদ্রা বলরামের হৃদয়ে উল্লাস।
নৃত্য দেখি দুইজনার শ্রীমুখেতে হাস ॥
উদ্দণ্ড নৃত্যে প্রভুর অদ্ভূত বিকার।
অষ্ট সাত্ত্বিক ভাব উদয় হয় সমকাল” ॥
উদ্দণ্ড নৃত্য করতে করতে মহাপ্রভুর একই কালে স্তম্ভ , স্বেদ , রোমাঞ্চ ,স্বরভেদ , কম্প, বৈবর্ণ, অশ্রু ও প্রলয় — এই অষ্টসাত্তিক ভাবের উদয় হল ।
“ এইমত তাণ্ডব নৃত্য কৈল কতক্ষণ ।
ভাব বিশেষে প্রভুর প্রবেশিল মন ।।
তাণ্ডব নৃত্য ছাড়ি স্বরূপেরে আজ্ঞা দিল ।
হৃদয় জানিয়া স্বরূপ গাইতে লাগিল ।। ”
ভাব বিশেষ — কুরুক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণমিলনের সময়ে শ্রীরাধিকার ভাব । প্রকৃতপক্ষে মহাপ্রভু মহাভাব- স্বরূপিনী শ্রীরাধিকার ভাবে পুরাপুরি ভাবিত হয়েছিলেন ।
প্রভুর মনের ভাব জেনে স্বরূপ দামোদর গাইতে লাগলেন —
“ সেই ত পরাণ-নাথ পাইনু।
যাহা লাগি মদন-দহনে ঝুরি’ গেনু ॥
এই ধুয়া উচ্চৈস্বরে গায় দামোদর ।
আনন্দে মধুর নৃত্য করেন ঈশ্বর ।। ”
‘’আমার যে প্রাণনাথের (শ্রীকৃষ্ণের ) বিরহে মদনরূপ অগ্ধিতে দগ্ধ হচ্ছিলাম , এখন সেই তো তাকেই পেয়েছি ।‘’ দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর কুরুক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হয়ে শ্রীরাধার উক্তি I শ্রীজগন্নাথকে দর্শন করে মহাপ্রভু এই মহাভাবে বিভাবিত হয়ে মধুর নৃত্য করতে করতে এই গানে মত্ত হয়ে রইলেন l রথ ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। মহাপ্রভু সহ ভক্তগণ আনন্দে নৃত্য-গীতে মত্ত হয়ে রথের অনুবর্তন করছিলেন। মহাপ্রভুর হৃদয় ও নয়ন নিবিড়ভাবে শ্রীজগন্নাথে নিমগ্ন ছিল। মহাপ্রভু পিছনে পরলে রথ দাঁড়িয়ে পরছিল, আবার মহাপ্রভু সামনে আসলে রথ ধীরে ধীরে চলছিল।
“ গৌর যদি পাছে চলে শ্যাম হয় স্থিরে ।
গৌর আগে চলে শ্যাম চলে ধীরে ধীরে ।।
এই মতে গৌর শ্যাম দুঁহে ঠেলাঠেলি ।
স্বরথে শ্যামেরে রাখে গৌর মহাবলী ”।।
এ যেন শ্রীজগন্নাথে ও মহাপ্রভুতে , কে আগে যাবে , তাই নিয়ে ঠেলাঠেলি চলছে এবং শেষে অধিক শক্তিশালী বিধায় গৌরের কাছে শ্যাম হার মানলেন অর্থাৎ গৌরকেই আগে যেতে দিলেন । নৃত্য করতে করতে পুনরায় মহাপ্রভুর মনে অন্য ভাবের উদয় হল । উচ্চকণ্ঠে তিনি একটি শ্লোক বার বার আবৃত্তি করতে লাগলেন ,-
“ স জীয়াৎ কৃষ্ণচৈতন্যঃ শ্রীরথাগ্রে ননর্ত্ত যঃ I
যেনাসিজজগতাম চিত্রং জগন্নাথঃ অপি বিস্মিতঃ I I’’S
শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্যের জয় হোক , যিনি রথযাত্রা কালে রথের সম্মুখে নৃত্য করতে করতে যাচ্ছিলেন , যা দেখে জগৎবাসী সকল ব্যক্তি এবং স্বয়ং জগন্নাথদেবও বিস্মিত হয়েছিলেন ।
প্রভু জগন্নাথের রথের সম্মুখে শ্রীমৎ মহাপ্রভুর দিব্য-নৃত্য সকল দর্শনার্থীদের বিস্মিত ও মুগ্ধ করেছিল । এই নৃত্য এতই ঐশ্বরিক যে, কোন পার্থিব নৃত্যের সঙ্গেই এর তুলনা চলেনা । রথযাত্রাকালে গুণ্ডিচা মার্জন, ভক্তসঙ্গে রথাগ্রে নৃত্য- কীর্তন ও অলৌকিক লীলা প্রদর্শনের মাধ্যমে শ্রীজগন্নাথদেব ও শ্রীক্ষেত্রের মাহাত্ম্যকে অত্যুজ্জ্বলভাবে প্রকাশ করে গিয়েছেন।
সমগ্র দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারত পরিব্রাজন করে মহাপ্রভু নীলাচলে ফিরে এলে তাঁর আগমনের বার্তা পেয়ে গৌড়ভক্তবৃন্দের হৃদয়ে গৌর দর্শনেচ্ছা প্রবল হয়ে উঠল। রথযাত্রাকে উপলক্ষ করে শ্রীঅদ্বৈত আচার্য সহ প্রায় তিনশত ভক্ত নীলাচলে এলেন। তাঁদের মিলিত সংকীর্তনে আকাশ- বাতাস মুখরিত হয়ে উঠল। নীলাচলবাসী সকলেই এই কীর্তন রঙ্গ দেখতে চললেন। রাজা প্রতাপরুদ্র আর স্থির থাকতে না পেরে গোপীনাথ আচার্য ও সার্বভৌমকে সঙ্গে নিয়ে সৌধশিখর হতে আগত বৈষ্ণবদের কীর্তন শোভাযাত্রা দর্শন করে ব্যাকুল হলেন । বিস্ময়ে তিনি বলে উঠলেন,-
‘‘কোটি সূর্য সম সবার উজ্জ্বল বরণ।
কভু নাহি শুনি এই মধুর কীর্তন।
ঐছে প্রেম ঐছে নৃত্য ঐছে হরিধ্বনি।
কাঁহা নাহি দেখি ঐছে কাঁহা নাহি শুনি।।’’
শ্রীজগন্নাথ দেবের রথযাত্রার দিন যথাসময়ে ভক্তগণকে সঙ্গে নিয়ে গোরা রায় জগন্নাথের অতি পবিত্র অনুষ্ঠান ‘পাণ্ডুবিজয়’ দর্শনার্থে মন্দিরে গেলেন। (রথে আরোহনের জন্য শ্রীমন্দির থেকে ধরাধরি করে জগন্নাথ দেবের নির্গমনকে পাণ্ডুবিজয় বলে ।
দুইদিকে দয়িতাগণ জয়ধ্বনি সহকারে জগন্নাথ দেবের কটিদেশ ধারণ করে তাঁকে রথারোহণ করালেন।
“ মহাপ্রভু ‘ মণিমা মণিমা’ করে ধ্বনি ।
নানা বাদ্য কোলাহল কিছুই না শুনি ।।”
[ মণিমা — সর্ব্বেশ্বর । এই শব্দটি উৎকল ভাষায় অত্যন্ত সম্মানসূচক ]
“ তবে প্রতাপরুদ্র করে আপনে সেবন।
সুবর্ণ মার্জ্জনী লঞা করে পথ সম্মার্জ্জন । ।
চন্দন জলেতে করে পথ নিষিঞ্চনে ।
তুচ্ছ সেবা করে বৈসে রাজসিংহাসনে ।।”
রাজা প্রতাপরুদ্র স্বয়ং স্বর্ণ খড়িকা দিয়ে জগন্নাথের যাত্রাপথ পরিষ্কার করে চন্দন জলের সিঞ্চন করছেন। মহাপ্রভু শ্রীহস্তে নিজ ভক্তগণকে মালা-চন্দন দিলেন । ভক্তগণকে মহাপ্রভু সাতটি সম্প্রদায়ে ভাগ করলেন। চার সম্প্রদায় রথের সামনে, দু’টি দল দু’পার্শ্বে ও আর এক দল পিছনে। প্রত্যেক দলে গায়ন, বাদন ও নৃত্যের দায়িত্ব বণ্টন করে দিলেন । প্রতি সম্প্রদায়ে দুটি করে মাদল বা খোল হিসাবে চোদ্দো মাদল বেজে উঠল। শুরু হল মহাভাবের নর্তন কীর্তন। বৈষ্ণবেরা যেন মেঘ , — মেঘের বাদল বা বৃষ্টি- বর্ষণের মত বৈষ্ণবদের সঙ্কীর্ত্তনরূপ অমৃত বর্ষিত হতে থাকল । শক্তিসম্পন্ন ভক্তগণ কীর্তন নৃত্যে ভাবোন্মত্ত শ্রীচৈতন্য প্রভুকে দেখছেন সাত সম্প্রদায়ের মধ্যেই।
“ আর এক শক্তি প্রভু করিলা প্রকাশ।
এক কালে সাত ঠাঁই করিল বিলাস।।
সবে কহে প্রভূ আছে মোর সম্প্রদায় ।
অন্য ঠাঁই নাহি যান আমার দয়ায় ।। ”
রাসলীলা কালে প্রত্যেক গোপীকাই যেমন মনে মনে ভেবেছিলেন যে, শ্রীকৃষ্ণ তাঁর কাছে আছেন , ভক্তরাও প্রত্যেকেই জানলেন যে প্রভু তাঁর সন্নিকটেই রয়েছেন I
মহাপ্রভুর দৃষ্টিতে রথযাত্রা হচ্ছে দ্বারকা থেকে শ্রীকৃষ্ণের ব্রজে, অর্থাৎ ঐশ্বর্য্যের ধাম থেকে মাধুর্যের আলয়ে আগমন ।
“ কৃষ্ণ লইয়া ব্রজে যাই এ ভাব অন্তর।”
তাই রাধারাণীর মহাভাবে বিভোর হয়ে তাঁর হৃদয়নাথের সম্মুখে দাঁড়িয়ে গৌরসুন্দর করজোড়ে নত হয়ে প্রার্থনা করছিলেন,-
‘‘নাহং বিপ্রো ন চ নরপতির্নাপি- বৈশ্যো ন শূদ্রো নাহং বর্নী ন চ গৃহপতির্নো- বনস্তোযতির্বা।
কিন্তু প্রোদ্যন্নিখিল - পরমানন্দ - পূর্ণামৃতাব্দ্ধে- র্গোপীভর্তুঃ - পদ- কমলয়োর্দা - সদাসানুদাসঃ।।’'
আমি ব্রাহ্মণ নই, রাজা নই, বৈশ্য নই বা শূদ্রও নই। আমি ব্রহ্মচারী, গৃহস্থ, বানপ্রস্থ নই বা আমি সতীও নই (কারণ যতিধর্মে প্রেমধর্মের প্রকাশ নেই )। আমি কেবল উন্মীলিত পরমানন্দপূর্ণ সুধাসাগর রূপ গোপীনাথ শ্রীকৃষ্ণের চরণপদ্মের সেবকেরও সেবক , তারও সেবক।
“এত পড়ি পুনরপি করিল প্রণাম ।
যোড় হস্তে ভক্তগণ বন্দে ভগবান ।। ”
রথ পরিক্রমণ করতে করতে প্রভু নৃত্য করতে লাগলেন । শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ বর্ণনা করেছেন , প্রভু জগন্নাথের রথের চতুর্পার্শ্বে মহাপ্রভুর নৃত্য কিভাবে একটি ঘূর্ণায়মান আগুনের বলয় বলে দৃশ্যমান হচ্ছিল ।
“ উদ্দণ্ড নৃত্যে প্রভু করিয়া হুঙ্কার ।
চক্র-ভ্রমি ভ্রমে যৈছে অলাত-আকার I I’’
অলাত — জ্বলন্ত অঙ্গার । জ্বলন্ত অঙ্গার চক্রাকারে বেগে ঘুরালে যেমন সেটি চক্ররূপেই সকল দিক থেকে দেখা যায় , মহাপ্রভুর চক্রাকারে উদ্দণ্ড নৃত্যও তেমনি সকলেই সব দিক থেকে দেখতে পাচ্ছিল I নৃত্য করতে করতে এত দ্রুতগতিতে তিনি রথকে প্রদক্ষিণ করছিলেন যে, সেই স্বর্ণাভ অগ্নি-বলয়ের প্রতিটি বিন্দুতেই তিনি যুগবৎ প্রতীয়মান হচ্ছিলেন । মহাপ্রভু ভাবাবেশে উন্মত্ত হয়ে নৃত্য করতে লাগলেন। অদ্বৈতাচার্য মহাপ্রভুর পিছনে গিয়ে ‘হরিবোল! হরিবোল!’ বলে হুঙ্কার করে চিৎকার করছিলেন। মহাপ্রভুর ভাবনৃত্যের যাতে ব্যাঘাত না হয়, সেজন্য ভক্তগণ তিনটি মণ্ডলাকারে সজ্জিত হয়ে মহাপ্রভুকে ঘিরে রাখলেন। প্রভুর নৃত্য দেখে সকলেই বিমোহিত হলেন।
‘’প্রভুর নৃত্য দেখি’ লোকে হৈল চমৎকার।
অন্য আছুক্ জগন্নাথের আনন্দ অপার ॥
রথ স্থির হইল আগে না করে গমন।
অনিমিষ নেত্রে করে নৃত্য দরশন ॥
সুভদ্রা বলরামের হৃদয়ে উল্লাস।
নৃত্য দেখি দুইজনার শ্রীমুখেতে হাস ॥
উদ্দণ্ড নৃত্যে প্রভুর অদ্ভূত বিকার।
অষ্ট সাত্ত্বিক ভাব উদয় হয় সমকাল” ॥
উদ্দণ্ড নৃত্য করতে করতে মহাপ্রভুর একই কালে স্তম্ভ , স্বেদ , রোমাঞ্চ ,স্বরভেদ , কম্প, বৈবর্ণ, অশ্রু ও প্রলয় — এই অষ্টসাত্তিক ভাবের উদয় হল ।
“ এইমত তাণ্ডব নৃত্য কৈল কতক্ষণ ।
ভাব বিশেষে প্রভুর প্রবেশিল মন ।।
তাণ্ডব নৃত্য ছাড়ি স্বরূপেরে আজ্ঞা দিল ।
হৃদয় জানিয়া স্বরূপ গাইতে লাগিল ।। ”
ভাব বিশেষ — কুরুক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণমিলনের সময়ে শ্রীরাধিকার ভাব । প্রকৃতপক্ষে মহাপ্রভু মহাভাব- স্বরূপিনী শ্রীরাধিকার ভাবে পুরাপুরি ভাবিত হয়েছিলেন ।
প্রভুর মনের ভাব জেনে স্বরূপ দামোদর গাইতে লাগলেন —
“ সেই ত পরাণ-নাথ পাইনু।
যাহা লাগি মদন-দহনে ঝুরি’ গেনু ॥
এই ধুয়া উচ্চৈস্বরে গায় দামোদর ।
আনন্দে মধুর নৃত্য করেন ঈশ্বর ।। ”
‘’আমার যে প্রাণনাথের (শ্রীকৃষ্ণের ) বিরহে মদনরূপ অগ্ধিতে দগ্ধ হচ্ছিলাম , এখন সেই তো তাকেই পেয়েছি ।‘’ দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর কুরুক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হয়ে শ্রীরাধার উক্তি I শ্রীজগন্নাথকে দর্শন করে মহাপ্রভু এই মহাভাবে বিভাবিত হয়ে মধুর নৃত্য করতে করতে এই গানে মত্ত হয়ে রইলেন l রথ ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। মহাপ্রভু সহ ভক্তগণ আনন্দে নৃত্য-গীতে মত্ত হয়ে রথের অনুবর্তন করছিলেন। মহাপ্রভুর হৃদয় ও নয়ন নিবিড়ভাবে শ্রীজগন্নাথে নিমগ্ন ছিল। মহাপ্রভু পিছনে পরলে রথ দাঁড়িয়ে পরছিল, আবার মহাপ্রভু সামনে আসলে রথ ধীরে ধীরে চলছিল।
“ গৌর যদি পাছে চলে শ্যাম হয় স্থিরে ।
গৌর আগে চলে শ্যাম চলে ধীরে ধীরে ।।
এই মতে গৌর শ্যাম দুঁহে ঠেলাঠেলি ।
স্বরথে শ্যামেরে রাখে গৌর মহাবলী ”।।
এ যেন শ্রীজগন্নাথে ও মহাপ্রভুতে , কে আগে যাবে , তাই নিয়ে ঠেলাঠেলি চলছে এবং শেষে অধিক শক্তিশালী বিধায় গৌরের কাছে শ্যাম হার মানলেন অর্থাৎ গৌরকেই আগে যেতে দিলেন । নৃত্য করতে করতে পুনরায় মহাপ্রভুর মনে অন্য ভাবের উদয় হল । উচ্চকণ্ঠে তিনি একটি শ্লোক বার বার আবৃত্তি করতে লাগলেন ,-
“ যঃ কৌমার হরঃ স এবহি বরস্তা এব চৈত্রক্ষপান্তে চোন্মীলিত মালতী সুরভ যঃ প্রৌঢ়াঃ কদম্বানিলাঃ ।
সা চৈবাস্মি তথাপি তত্র সুরতব্যাপার লীলাবিধৌ রেবারোধসি বেতসী তরুতলে চেতঃ সমুৎকণ্ঠতে ।। ”
“ এই শ্লোক মহাপ্রভু পড়ে বার বার ।
স্বরূপ বিনা অর্থ কেহ নাহি জানে আর ”।।
‘কাব্য প্রকাশ’ গ্রন্থে কোনও নায়িকার সঙ্গিনীর কাছে আক্ষেপ বাক্য — ‘ যিনি আমার কৌমার্য্য হরণ করেছিলেন , এখন তিনিই আমার পতি । সেই চৈত্রের রজনীও আছে, সেই উন্মীলিত মালতী ফুলের হাওয়া ভেসে আসছে । এমনকী আমিও তো সেই আমিই আছি। তথাপি প্রথম দিনের সেই রেবানদীর তীরলগ্ন বেতসী তরুর তলে লীলার স্মৃতিতেই আমার মন সমুৎকণ্ঠিত হয়ে আছে ’ ।
“ শ্লোকের ভাবার্থ করি সংক্ষেপে ব্যাখ্যান ।।
পূর্বে যৈছে কুরুক্ষেত্রে সব গোপীগণ ।
কৃষ্ণের দর্শন পাইয়া আনন্দিত মন ।।
জগন্নাথ দেখি প্রভু সে ভাব উঠিলা ।
সেই ভাবাবিষ্ট হইয়া ধুয়া গাওয়াইলা ।।
অবশেষ রাধা করে কৃষ্ণে নিবেদন —
সেই তুমি সেই আমি সেই নবসঙ্গম ।।
তথাপি আমার মন করে বৃন্দাবন ।
বৃন্দাবনে উদয় করাও আপন চরণ ।।
এথা লোকারণ্য হাতী ঘোড়া রথধ্বনি ।
সেথা পুষ্পারণ্য ভৃঙ্গ পিকনাদ শুনি ।।
এই রাজবেশ সঙ্গে সব ক্ষত্রিয়গণ ।
তাঁহা গোপবেশ সঙ্গে মুরলী- বদন ।।
ব্রজে তোমা সঙ্গে যেই সুখ আস্বাদন ।
সেই সুখ-সমুদ্রের ইঁহা নাহি এক কণ।।
আমা লইয়া পুনঃ লীলা কর বৃন্দাবনে ।
তবে মোর মনোবাঞ্ছা হয়ত পূরণে ।। ”
এটি ভাগবতে বর্ণিত শ্রীরাধিকার উক্তি — শ্রীকৃষ্ণের সাথে বৃন্দাবনে পুনর্মিলনের আকাঙ্ক্ষা বা বাসনারূপ ভাব । রাধারাণীর সেই মহাভাব মহাপ্রভুর হৃদয়ে উদ্বেলিত হয়েছে ।
রথ এগিয়ে চলেছে লক্ষ কণ্ঠের জয়ধ্বনিতে । মহাতেজঃ পুঞ্জশালী মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণ - চৈতন্যদেব অষ্টসাত্ত্বিকভাবে বিভাবিত হয়ে এক অভাবনীয় ঐশ্বর্য প্রকাশ করে চলেছেন। তাঁর নয়নযুগল হতে পিচকারীর মতো জল প্রবাহিত হল। সেই কমনীয় কান্তি ও মধুর প্রেম দর্শন করে রাজা প্রতাপরুদ্রও আত্মহারা , নীলাচল বাসীগণও মোহিত । সময়ে সময়ে ভক্তগণ উৎসাহবর্ধক উচ্চ হরিধ্বনি করছেন। সমবেত অগণিত দর্শনার্থী পবিত্র রথের দড়ি স্পর্শ করে ধন্য হল । এর মধ্যে একসময় জগন্নাথের রথের গতি স্তব্ধ হয়ে গেল। এবার রথের দড়িতে সজোরে টান দেওয়া হল। কিন্তু রথ পূর্ববৎ অচলের ন্যায় অটল থাকল। বড় বড় হস্তীকে আনিয়ে রথে জুড়ে দেওয়া হল। মাহুতদের অঙ্কুশাঘাতে হস্তীগণ আর্তনাদ করতে করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করল। কিন্তু সকল প্রয়াসই বিফল হল। তখন ভক্তগণ করজোড়ে মহাপ্রভুর শরণাপন্ন হলেন ।
“ তবে মহাপ্রভু রথ প্রদক্ষিণ হঞা ।
রথ পাছে যাই ঠেলে রথে মাথা দিয়া ।।
ঠেলিতে চলিল রথ হড় হড় করি ।
চতুর্দ্দিকে লোক সব বলে হরি হরি ।। ”
বিশাল জনতা মহাপ্রভুর মহিমা দর্শন করে জয় জগন্নাথ, জয়গৌর রবে দিক্ দিগন্ত মাতিয়ে তুলল।
“তবে প্রভু নিজ ভক্তগণ লঞা সঙ্গে ।
বলদেব সুভদ্রাগ্রে নৃত্য করে রঙ্গে ।।
তাঁহা নৃত্য করি জগন্নাথ- আগে আইলা ।
জগন্নাথ আগে নৃত্য করিতে লাগিলা ।।
চলিয়া আইলা রথ বলগুণ্ডি স্থানে । "
শ্রদ্ধাবালু ও অর্ধাসনীদেবীর মধ্যবর্তী “বলগুণ্ডি” নামকস্থানে জগন্নাথদেবের মৌসীমা গুণ্ডিচা দেবীর নিকেতন । এই স্থানে পিঠা পানা না খেয়ে ঠাকুর গুণ্ডিচা মন্দিরে গমন করেন না । এখানে রাজা , রাজমহিষীবৃন্দ , নীলাচলবাসী , দেশী বিদেশী এবং ছোট বড় সকলেই নিজ নিজ ভোগ সমর্পণ করেন । দুই পার্শ্বের উদ্যানের বনে লোকে ভোগ লাগায় I
“ নৃত্য পরিশ্রমে প্রভুর দেহে ঘর্ম্ম ঘন।
সুগন্ধি শীতল বায়ু করেন সেবন ।।
এইত কহিল প্রভু মহাসংকীর্ত্তন ।
জগন্নাথের আগে যৈছে করিলা নর্ত্তন ।।‘’
💐জয় প্রভু জগন্নাথ 💐 জয় বলভদ্র দেব 💐 জয় দেবী সুভদ্রা 💐 জয় শ্রী গৌরহরি 💐
No comments:
Post a Comment