💐স্নান যাত্রা💐

💞শুভ স্নান পূর্ণিমা💞💞শুভ স্নান পূর্ণিমা💞

বিশেষ পোষ্ট

শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ

সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম I

শ্রীজগন্নাথদেবের শুভ আবির্ভাব তিথি 'স্নান যাত্রা' মহা পর্বের সবাইকে জানাই কৃষ্ণপ্রীতিশুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

''হরি - গুরু - বৈষ্ণব তিনিহেঁ স্মরণ।

তিনেহেঁ স্মরণ হইতে বিঘ্ন বিনাশন।।

অনায়াসে হয় নিজ বাঞ্ছিত পূরণ ।।‘’

স্নান যাত্রা কি?

জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রার মাহাত্ম্য কি?

স্নানপুর্ণিমার মাহাত্ম্য

জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমা তিথিকে দেবস্নান পূর্ণিমা ও বলা হয়ে থাকে। জগন্নাথ ভক্তদের কাছে এদিন একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। জ্যৈষ্ঠমাসের পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা মহোৎসব। একশো আটটি সোনার কলসের সুশীতল জলে মহাস্নান করেন শ্রীজগন্নাথ দেব।

স্কন্দপুরাণ অনুসারে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন এই উৎসবের সূচনা করেছিলেন, এই শুভদিনে দেবতাদের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন| এই তিথিকে তাই জগন্নাথের জন্মতিথি হিসাবে পালন করা হয়ে থাকে। সেই থেকে পালিত হয়ে আসছে স্নান যাত্রা। হিন্দু পৌরাণিক উৎসবে মিলেমিশে যায় মানুষ ও দেবতা। তাই মানবিক, জাগতিক সুখ দুঃখ থেকে দেবতাও দূরে থাকেন না। প্রখর গ্রীষ্মে স্নান করে যে তৃপ্তি পাওয়া যায় তা অন্য কিছুতে বিরল। ভক্তদের বিশ্বাস স্নানযাত্রার সময় দারুব্রহ্ম দর্শনে পাপমোচন ঘটে, তাই জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমায় কয়েক লক্ষ ভক্তের ভিড় উপচে পড়ে পুরীতে। সমস্ত ভক্তগণ  জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা উৎসব দেখতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে মহারাজা শ্রীইন্দ্রদ্যুম্ন স্নানযাত্রাকালে স্নানবেদির চারদিকে মূল্যবান রত্নশোভিত চাঁদোয়া ও আবরণবস্ত্র আচ্ছাদিত করে দিতেন। স্নানবেদি কালের নিয়মে জীর্ণ হয়ে যায়। বর্তমানের স্নানবেদি নির্মাণ করে দেন মহারাজা শ্রীঅনঙ্গভীম দেব।

স্নানযাত্রা মহোৎসবের জন্য গর্ভগৃহ থেকে জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রা এবং সুদর্শন ও মদনমোহন এই পাঁচ দেববিগ্রহ স্নানবেদিতে ‘পহণ্ডি বিজয়' বা পাল্কিতে করে বিশাল শোভাযাত্রা করে আনা হয়। জয় শব্দ ভরা নানা স্তবস্তুতির মাধ্যমে বন্দনা করা হয় প্রভু জগন্নাথকে। তারপর লেপন করা হয় তুলসি পাতা, চন্দন, ঘি ও অন্যান্য উপাচার। যথাবিধি নিয়ম মেনে ১০৮ ঘড়া জলে স্নান করানো হয়। স্নানের নিমিত্তে শ্রী মন্দিরের উত্তর দ্বার বা হস্তীদ্বারের ভিতরে উত্তর দিকে একটি কূপ বা কুয়া আছে। তাকে সুনা কুয়া অথবা সোনার কুয়া ও বলা যায়। স্নানযাত্রার সময়ে এই কুয়ার থেকে সোনার কলসীতে করে জল আনা হয়। জগন্নাথ দেবকে ৩৫ কলসী, বলভদ্র দেবকে ৩৩ কলসী, ও সুভদ্রা দেবীকে ২২ কলসী এবং সুদর্শন দেবকে ১৮ কলসী জলে স্নান করানো হয়। সেই জল সুগন্ধ দ্রব্যে সুবাসিত করে ‘পাবমানী’ মন্ত্রে সোনার কলস পরিপূর্ণ ও অধিবাস করেন। এই কুয়া থেকে বছরে একবারই জল তোলা হয়। তারপর ঘড়ায় করে ওই জল আনা হয় ভোগমণ্ডপে।  জল আনার সময়ে সেবকেরা মুখে কাপড় বেঁধে রাখে যাতে মুখ নিসৃত কিছু জল অপবিত্র না করে। দয়িতারা সেই জল পরিশুদ্ধ করেন। জলে মেশানো হয় হলুদ, আতপ চাল, চন্দন, ফুল ও অন্যান্য সুগন্ধি। এরপর ওই ১০৮ ঘড়া জল শোভাযাত্রা করে নিয়ে আসা হয় স্নানবেদীতে। তারপর বৈদিক মন্ত্রপাঠ ও শঙ্খধ্বনির সঙ্গে হয় শ্রীবিগ্রহগণের জলাভিষেক। স্নানের পরে বলভদ্র জগন্নাথ দেবের 'হাতীবেশ' অথবা 'গজবেশ' হয়ে থাকে। সুভদ্রাকে পরানো হয় পদ্মবেশ।

জগন্নাথদেবের গজবেশ

জগন্নাথদেবের স্নানের পর গজবেশ ধারণ নিয়ে একটি পৌরাণিক কাহিনী আছে। একবার গণেশের একজন মহান ভক্ত কর্ণাট দেশের কানিয়ারী গ্রামের গজপতি ভট্ট পুরীর রাজাকে পরিদর্শন করতে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি শ্রীজগন্নাথের মন্দির পরিদর্শনে অনিচ্ছুক ছিলেন, কেননা তার নীতি ছিল কেবল গণেশের আরাধনা করা। শ্রীজগন্নাথ সকল দেবদেবীর উৎস শ্রীবিষ্ণু হতে অভিন্ন, রাজা তাকে বোঝালেন। রাজার নানা যুক্তিতে অবশেষে তিনি মন্দির পরিদর্শনে সম্মত হলেন। সেদিন ছিল স্নান যাত্রার দিন । তিনি বিগ্রহগণের সামনে দাড়িয়ে বললেন, ‘’আপনি যদি এরা যা বলছেন সত্যিই তাই হন, দারুব্রম্ম, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাকে আমার আরাধ্যদেব শ্রীগণেশের রুপ প্রদর্শন করান।‘’  তার অহৈতুকী কৃপা প্রদর্শনের সংকল্প করে শ্রীজগন্নাথ নিজেকে গণেশ রুপে পরিবর্তীত করেন। শুণ্ড যুক্ত সহাস্য বদন জগন্নাথকে দর্শন করে সেই ভক্ত যুগপৎ মহাবিস্ময় ও মহা আনন্দে আবির্ভূত হন। সেই থেকেই এই প্রথা চলে এসেছে যে স্নানযাত্রা মহোৎসবে স্নানের পরেই জগন্নাথদেব ও বলভদ্রদেবকে গজবেশ ও দেবি সুভদ্রা কে পদ্মবেশ করানো হয়।

জগন্নাথদেব স্বপ্নাআদেশ দিয়েছিলেন মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্নকে, ‘মহাস্নানের পর পনেরো দিন ভগবানের অঙ্গরাগবিহীন রূপ যেন কেউ কখন না দর্শন করে। ফলে স্নানের পর প্রভু জগন্নাথের মন্দিরে প্রবেশ হলে মন্দিরের দ্বার বন্ধ থাকে পনেরো দিন। এই সময় দর্শন হয় না বলে বলা হয়, ‘অনবসরকাল’। দেবতারা তখন অবস্থান করেন মন্দিরে জগমোহনের পাশে ‘খটশেষগৃহে’ বা ‘নিরোধনগৃহে’। এই সময় প্রভুর 'জ্বরলীলা' হয়।

প্রকৃতপক্ষে ১০৮ ঘড়া জলে সিক্ত বিগ্রহের রঙ নষ্ট হয়ে যায়। তাই এই সময়ের মধ্যে রং করে আবার আগের উজ্জ্বলতা ফিরিয়ে এনে বিগ্রহদের স্থাপন করা হয়।

স্নানযাত্রার পর জ্বর হয় বলে এই সময় তাঁকে রাজবৈদ্যের চিকিৎসাধীনে রাখা হয়। জগন্নাথের এই অসুস্থতার পর্যায়টি 'অনসর' নামে পরিচিত। এই সময় ভক্তেরা দেবতার দর্শন পান না। তাঁদের দর্শনের জন্য বিগ্রহের পরিবর্তে মূল মন্দিরে তিনটি পটচিত্র রাখা হয়। এই সময় ভক্তেরা ব্রহ্মগিরিতে অলরনাথ মন্দিরে যান। তাঁরা বিশ্বাস করেন, অনসর পর্যায়ে জগন্নাথ অলরনাথ রূপে অবস্থান করেন। কথিত আছে, রাজবৈদ্যের আয়ুর্বৈদিক 'পাঁচন' খেয়ে 'একপক্ষ' কালের মধ্যে সুস্থ হয়ে ওঠেন শ্রীজগন্নাথদেব। তারপর ভক্তেরা আবার তাঁকে দর্শন করতে পারেন।

শ্রীক্ষেত্র পুরী হল মর্ত্যের বৈকুন্ঠধাম। পুরী মন্দিরের চারটা দরজা যথা,- অশ্ব,হস্তি, ব্যাঘ্র, সিংহ। 'অশ্ব - অর্থ', 'হস্তি - মোক্ষ','ব্যাঘ্র - কাম', 'সিংহ - ধর্ম'। জগন্নাথ সিংহ দরজা দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করেন। মহাপ্রভুও এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেন জগন্নাথ দর্শনে। হস্তি দরজা বন্ধ থাকে সবসময়, শুধু জগন্নাথ সমাধিতে যায় এই দরজা দিয়ে।

স্নান যাত্রার মূল তত্ত্ব

একবার দেবকী, বাসুদেবের বাসনা হল তীর্থ স্নান করবে। শ্রীকৃষ্ণ বললেন কুরুক্ষেত্রে অমাবস্যায় সূর্যগ্রহণের সময় স্নান করলে মোক্ষ লাভ হয়। কুরুক্ষেত্রে একুশবার ক্ষত্রিয়দের বিনাশ করেছিলন শ্রীপরশুরাম। তাদের রক্ত থেকে এই সরোবর। আবার পরশুরাম ওখানে তর্পন করে ঐ ক্ষত্রিয়দের। ঐ সরোবর পূর্ণ তীর্থে পরিণত হয়। এই স্থানে সবাইকে নিয়ে এসেছেন দ্বারিকাধীশ  শ্রীকৃষ্ণ। মা দেবকী, বাসুদেব, সঙ্গে সুভদ্রা মাতা, কৃষ্ণের আট জন মহাপটরাণী, সঙ্গে বলরাম তার সাথে বারূণী, রেবতী যাচ্ছেন। অনেক সৈন্য, অনেক বাদ্যযন্ত্র বাজছে।

নারদজী ভাবছেন, শ্রীকৃষ্ণ এসেছেন কুরুক্ষেত্রে এই কথা ব্রজবাসীদের বলতে হবে। নারদজী বীণায় কৃষ্ণ নাম করতে করতে চললেন ব্রজে। একমাসের বেশীসময় কৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রে থাকবে এই খবর দিতে চললেন নারদজী ব্রজে। ব্রজে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তার অঙ্গে জ্বলতে লাগল। যোগ ধ্যানে বসলেন নারদজী কেন তার অঙ্গ জ্বলছে। বিরহ তাপে অঙ্গ জ্বলছে ব্রজধামের, যমুনার, স্থাবর-জঙ্গম, গোবৎস, গাভী, গোপ গোপী,মা যশোদা নন্দবাবা। কৃষ্ণবিরহে সবাই কাঁদছে। নারদজী দেখলেন ব্রজে নন্দালয়ে যশোদা ননী নিয়ে গোপাল গোপাল করে কাঁদছে। শ্রীদাম পটে আঁকা কৃষ্ণের ছবি দেখে কেঁদে কেঁদে বলছে, কানাইয়া দেখ মিষ্টি ফল আনেছি। এঁটো ফল দিই নি রে, এঁটো ফল দিলাম বলে তুই আমাকে ছেড়ে চলে গেলি এই বলে কাঁদতে লাগল।

এদিকে রাধা কাঁদে সখীদের গলা ধরে। নারদজী বললেন তোমাদের নয়নাভিরাম কুরুক্ষেত্রে। চল তোমরা দর্শন করবে তোমাদের প্রাণ গোবিন্দকে। রাধাকে বলল ললিতা চল সখী তোকে সাজিয়ে দিই। রাধারাণী বলল আমি সেজে বসে আছি। নয়ন সেজেছে শ্যামের রূপ দর্শনে, হাত সেজেছে শ্যামের পদসেবনে,কানের ভূষণ আমার শ্যামের নাম শ্রবণে।

সবাই চল কুরুক্ষেত্রে। বিরহিণী গোপীরা এক কুঞ্জে শ্যাম আছে শুনে দর্শনে ব্যাকুলতা নিয়ে গেল। দেখল যে বনমালী, যে গোপালকে ওরা ভালবাসত সে কৃষ্ণ নয়। কোথায় বনমালা কোথায় চূড়া, এ রাজার বেশে কৃষ্ণকে ভালবাসে না ওরা। দেখা না করে চলল রাধা। যোগমায়া দেখলেন রাধারাণী কৃষ্ণ দর্শন না করে চলে যাচ্ছেন। রাধারাণী চলে গেছে শুনে শ্যামের মনে বিরহ হল রাধা বিরহ। এদিকে যোগমায়া অপূর্ব কুঞ্জ রচনা করলেন রাধা আর প্রিয় সখীদের জন্য। কৃষ্ণ আসবেন রাধার সেই অপূর্ব কুঞ্জে। কিন্তু এর জন্য রুক্মিণীকে মানে লক্ষীকে রাজি করাতে হবে। রুক্মিণী তো রাজি হয় না কিছু তেই । কিছুতে যেতে দেবে না তাকে, এই নিয়ে দুইজনের রাগ। তাইতো রাগ করে লক্ষী রান্না করে না। তখন কৃষ্ণ বলে আমার দাদা বলরাম কি দোষ করল,ও কেন না খেয়ে থাকবে। তাই শুধু পাচন রান্না করেন।

কুরুক্ষেত্রে এই স্নান হল জগন্নাথের স্নান যাত্রা। এই যোগমায়ার কুঞ্জ হল গুঁড়িচা মন্দির, যা যোগমায়া তৈরি করলেন। জগন্নাথের জ্বর হল রাধার বিরহ জ্বর। জগন্নাথ যাবে রথে করে ভক্ত দর্শনে। রাধার কুঞ্জে গুঁড়িচা মন্দিরে যাবে রথে করে, কিন্তু লক্ষী যেতে দেবে না। জগন্নাথের সাথে বলরাম সঙ্গে সুভদ্রা তাতে রাজি হলেন মা লক্ষী। তাই রথে আগে বলরাম, পরে সুভদ্রা তারপর জগন্নাথ।

💐💞 জয় স্নান পূর্ণিমার জয় 💐💞 💐 জয় ভক্তবৎসল শ্রীজগন্নাথদেবের জয় 💐💞