🌻💖🍁সেই ত পরাণনাথ পাইনু🍁💖🌻

🏵️💐🌺🏵️💐💞🏵️💐🌺🏵️💐💞🏵️

 বিশেষ পোষ্ট

শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ

সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব ও গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার অনন্ত কোটি সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম I শ্রীজগন্নাথদেবের বিশ্বপ্রসিদ্ধ রথযাত্রা পর্বের সবাইকে জানাই কৃষ্ণপ্রীতি শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

শেষ আর যেই রহে দ্বাদশ বৎসর। 

কৃষ্ণের বিরহ লীলা প্রভুর অন্তর।।

নিরন্তর রাত্রিদিন বিরহ উন্মাদে।

হাঁসে কান্দে নাচে গায় পরম বিষাদে ৷।

জীবনের শেষ পর্বে চৈতন্যদেব ভক্তিরসে আপ্লুত হয়ে হরিনাম সংকীর্ত্তন করতেন এবং অধিকাংশ সময়েই ভাব - সমাধিস্থ থাকতেন। শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরা গমন করলে শ্রীরাধিকা যেমন উন্মাদিনী হয়ে যান, তেমনই শ্রীরাধার ভাবে বিভাবিত মহাপ্রভু তাঁর জীবনের শেষ বার বৎসর শ্রীকৃষ্ণবিরহে দিব্যোন্মাদ অবস্থা প্রাপ্ত হন।

জননী শচীদেবীর অনুরোধে মহাপ্রভু নীলাচল ক্ষেত্রে রয়ে গেলেন, পরে তিনি বৃন্দাবনে গেছেন বটে, কিন্তু স্থায়ী আবাস শ্রীক্ষেত্র। পুরীতে থাকার ফলে তাঁর মধ্যে সেই চিরন্তন বিরহ-দশা রয়েই গেল। ভাবটা এই যে জগন্নাথের মধ্যে সেই শ্যামসুন্দরকে পেলাম বটে, কিন্তু বৃন্দাবনের মধুর রমণ-বসতিতে তাঁকে পেলাম না। প্রভূ জগন্নাথের রথ উৎসব উপলক্ষে গৌড়দেশ থেকে অগণিত ভক্ত এসেছেন সচল মহাপ্রভুর সঙ্গে অচল জগন্নাথ মহাপ্রভুর দর্শন করবেন বলে। প্রভুর যত উড়িয়া ও গৌড়িয়া ভক্ত আজ নেমে এসেছেন রথের সামনে। রথের উপর স্থাপিত হয়েছেন প্রভু জগন্নাথ। সমস্ত জনারণ্যের মাঝে শুধু জয়ধ্বনি শোনা যাচ্ছে, জয় জগন্নাথ ! জয় মহাপ্রভু !নীলাচল নাথ !

রথের সম্মুখে উড়িয়া- গৌড়িয়াদের সংকীর্ত্তন চলছে। হঠাৎই চৈতন্যদেব একটি সংস্কৃত শ্লোক উচ্চারণ করলেন সকলের সামনে। মধুর যে ছন্দোময়ী বাণী মহাপ্রভুর মুখ থেকে নির্গত হল, তার ভাবরস সবটাই একেবারে প্রাকৃত সাধারণ নায়কনায়িকার প্রেমের বিষয়,-

যে কালে করেন জগন্নাথ দরশন।

মনে ভাবে কুরুক্ষেত্রে পাঞাছি মিলন।।

রথযাত্রায় আগে যবে করেন নর্ত্তন ৷

তাঁহা এই পদমাত্র করয়ে গায়ন।। 

''যঃ কৌমারহরঃ স এবহি বরস্তা এব চৈত্রক্ষপাস্তে। 

চোণ্মীলিত মালতী সুরভয়ঃ প্রৌঢ়াঃ কদম্বানিলাঃ।। 

সা চৈবাস্মি তথাপি তত্ৰ সুরত ব্যাপার লীলাবিধৌ,

রেবারোধসি বেতসী তরুতলে চেতঃ সমুৎকণ্ঠতে ।।''

অর্থাৎ,- কোনও নায়িকা সঙ্গিনীর কাছে মনের গোপন কথা প্রকাশ করছেন। প্রেমিকার সঙ্গে প্রেমিকের দেখা হয়েছে বহুকাল পরে, কিন্তু যেখানে দেখা হয়েছে, সে জায়গাটা প্রেমিকার ভালো লাগছে না, এমন একটা স্থান যেখানে প্রেমের সার্থক উদ্দীপন ঘটে না। নায়িকা বলছেন,- প্রথম যৌবনে যিনি আমার কৌমার্য্য হরণ করেছিলেন, সেই তিনিই আমার বরণীয় (পতি )। সেই তাঁরই সঙ্গে আমার দেখা হল। এখনও সেই চৈত্র মাসের রজনী বিদ্যমান রয়েছে, সেই বিকশিত মালতীর সৌরভময় মন্দ মন্দ সমীরণ প্রবাহিত হচ্ছে, রয়েছি ত স্বয়ং সেই আমিও ! তবুও প্রথম দিনের সেই রেবানদীর তীরলগ্ন বেতসীতরুর তলে সুরত লীলার স্মৃতিতেই আমার মন সমুৎকণ্ঠিত হয়ে আছে, সেই স্থানই অভিলাষ করছে। সেই রেবার তীরে বেতস-গৃহখানির জন্য আমার মন কেমন করে। ইচ্ছে করে সেইখানে ফিরে যাই আবার।

জগন্নাথের রথের সামনে সমস্ত ভক্তদের মধ্যে যখন এক দৈবভাব উদ্দীপিত হচ্ছে, সেই সময়ে এমন এক প্রাকৃত নায়িকার প্রেমাকুল বর্ণনা সবাইকে অবাক করে দিল।

এই ধূয়া গানে নাচে দ্বিতীয় প্রহর।

কৃষ্ণ লঞা ব্ৰজে যাই এ ভাব অন্তর।।

এই ভাবে নৃত্য মধ্যে পড়ে এই শ্লোক।

সেই শ্লোকের অর্থ কেহ নাহি বুঝে লোক।।

একবার নয়, দুবার নয়, এই শ্লোক মহাপ্রভু পড়ছেন বার বার। কেউ যার অর্থ বুঝল না, কেন মহাপ্রভু এই সময়ে এমন শ্লোক পড়লেন, তার অন্তর্গূঢ় রহস্যটা একজনই মাত্র বুঝতে পারলেন। তিনি হলেন পুরীতে মহাপ্রভুর অন্তরঙ্গ সঙ্গী স্বরূপ-দামোদর। মহাপ্রভুর অন্তরের এই আর্তি কেন, সেটা স্বরূপ বুঝলেন বটে, কিন্তু কাউকে বললেন না।

প্রভুর মনের ভাব বুঝতে পেরে স্বরূপ দামোদর গান ধরলেন,-

‘’সই ! সেই ত পরাণ নাথ পাইনু।

যাহা লাগি মদন দহনে ঝুরি গেনু।।‘’

হে সখী ! সেই এতকাল ধরে যাঁর বিরহে কামাগ্নিতে দগ্ধ হচ্ছিলাম, সেই প্রাণনাথকে অবশেষে লাভ করলাম।

এই শ্লোকের অর্থ জানে একেলা স্বরূপ।

দৈবে সে বৎসর তাহাঁ গিয়াছেন রূপ।।

প্ৰভু মুখে শ্লোক, শুনি শ্ৰীরূপ গোসাঞি।

সেই শ্লোকের অর্থ শ্লোক করিল তথাই ৷।

শ্লোক করি এক তালপত্ৰেতে লিখিয়া।

আপন বাসার চালে রাখিল গুঞ্জিয়া ।।

শ্লোক রাখি গেলা সমুদ্র স্নান করিতে।

হেনকালে আইলা প্ৰভু তাঁহারে মিলিতে।।

হরিদাস ঠাকুর আর শ্রীরূপ সনাতন ।

জগন্নাথ মন্দিরে নাহি যান তিনজন ৷।

মহাপ্ৰভু জগন্নাথের উপলভোগ দেখিয়া।

নিজ গৃহে যান এই তিনেতে মিলিয়া ৷।

এই তিন মধ্যে যবে থাকে যেইজন ৷

তারে আসি আপনে মিলে প্রভুর নিয়ম।।

সেই বছর শ্রীরূপ, সনাতন ও হরিদাসও পুরীতে এসেছিলেন মহাপ্রভুর কাছে। এই তিনজন নিজেদের বড় হীন এবং ম্লেচ্ছ বলে ভাবতেন বলে তাঁরা জগন্নাথদেবের মন্দিরে প্রবেশ করতেন না। এজন্য মহাপ্রভু নিজেই এই তিন জনের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন প্রতিদিন। রথযাত্রার পরের দিন জগন্নাথের প্রাতঃকালীন উপল-ভোগ দর্শন করে মহাপ্রভু এসেছেন ওই তিনজনের সঙ্গে দেখা করতে। এসে দেখলেন রূপ গেছেন সমুদ্র-স্নান করতে। হঠাৎই ওপর দিকে নজর পড়তে শ্রীরূপের ঘরের চালের ওপর তালপাতায় লেখা একটি সংস্কৃত শ্লোক দেখতে পেলেন মহাপ্রভু। সে-যুগে লেখার কালি বহুযত্নে নিজেদের তৈরি করতে হত এবং তালপাতায় লেখার পর তা শুকাতে দিতে হত। ঘরের চালে শ্লোক শুকাতে দিয়ে রূপ স্নানে গেছেন। তখন মহাপ্রভুর নজরে এল রূপের অপূর্ব হস্তাক্ষর,- "শ্রীরূপের অক্ষর যেন মুকুতার পাতি।"

দৈবে আসি প্ৰভু যবে উৰ্দ্ধেতে চাহিলা।

চালে গোঁজা তালপত্রে সেই শ্লোক পাইলা ৷।

শ্লোক পড়ি প্ৰভু আছেন আবিষ্ট হইঞা ।

রূপ-গোসাঞি আসি পড়িল দণ্ডবৎ হইঞা ৷।

উঠি মহাপ্ৰভু তারে চাপড় মারিয়া ।

কহিতে লাগিলা কিছু কোলেতে করিয়া ।।

"মোর শ্লোকের অভিপ্ৰায় কেহ নাহি জানে ।

মোর মনের কথা তুমি জানিলে কেমনে !?"

রূপের লেখা শ্লোক পড়ে মহাপ্রভু একেবারে অবাক হয়ে গেলেন। তাঁর অন্তরের মধ্যে সেই কৃষ্ণপ্রেমের আকুল ভাব জাগল, তিনি আবিষ্ট হয়ে রইলেন। স্নানশেষে রূপ ফিরে এসেই দণ্ডবৎ প্রণাম করে লুটিয়ে পড়লেন মহাপ্রভুর গায়ে। প্রভু তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন,- "কেউ যেকথা বুঝতে পারলনা, আমার মনের কথা তুই জানলি কিভাবে ?"

আনন্দে মহাপ্রভু সেই শ্লোক-পাতি নিয়ে চললেন স্বরূপ দামোদরকে দেখানোর জন্য।

স্বরূপে পুছেন প্ৰভু হইয়া বিস্মিতে।

"মোর মনের কথা রূপ জানিল কেমতে" !?

স্বরূপ কহিল," যাতে জানিল তোমার মন ।

তাতে জানি হয় তোমার কৃপার ভাজন" ৷।

প্ৰভু কহে," তারে আমি সন্তুষ্ট হইয়া ।

আলিঙ্গন কৈল সর্বশক্তি সঞ্চারিয়া ৷।

যোগ্যপাত্র হয় গূঢ়রস বিবেচনে ।

তুমিহ কহিও তাঁরে গূঢ় রসাখ্যানে" ।।

গূঢ়রস ব্রজের উজ্জ্বল রস। একমাত্র শ্রীরূপ গোস্বামীই জানতেন।  কেন এই শ্লোকটি মহাপ্রভুর এত প্রিয় ছিল। শ্রীরূপই গূঢ়রস বিচারের উপযুক্ত পাত্র।

শ্রীরূপ গোস্বামী- কৃত সেই শ্লোক,-

প্রিয়ঃ সোহয়ং কৃষ্ণঃ সহচরি কুরুক্ষেত্র- মিলিত।

স্তথাহয়ং স রাধা তদিদমুভয়োঃ সঙ্গমসুখং।।

তথাপ্যন্তঃ খেলন্মধুর মুরলী পঞ্চম জুষে।

মনো মে কালিন্দী পুলিন বিপিনায় স্পৃহয়তি।।

অর্থাৎ,- শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবন থেকে মথুরাতে যাবার পর আর কোনদিন বৃন্দাবনে ফিরে আসেননি। ব্রজবাসীগণ কৃষ্ণ বিরহে মৃতপ্রায়, শ্রীরাধা উন্মাদিনী। দীর্ঘ বিরহের পর শ্রীরাধা ও গোপীগণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণের সাথে মিলিত হয়েছেন। 

শ্রীরাধা তখন একজন গোপীকে বলছেন,- “হে সহচরী, সেই অতি প্রেমাষ্পদ শ্রীকৃষ্ণ এই কুরুক্ষেত্রে এসে আমার সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। আমিও সেই রাধা, পুনরায় আমাদের সেই একই মিলনের সুখ তবুও আমার মন শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবনের ক্রীড়াশীল মুরলীর পঞ্চমসুরে আনন্দ- প্লাবিত যমুনা পুলিনের সেই বিপিনের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠছে।''

এই শ্লোকের সংক্ষেপার্থ শুন ভক্তগণ।

জগন্নাথ দেখি যৈছে প্রভুর ভাবন ৷।

শ্ৰীরাধিকা কুরুক্ষেত্রে কৃষ্ণের দর্শন।

যদ্যপি পায়েন তবু ভাবেন ঐছন।।

শ্রীজগন্নাথের রথ এগিয়ে চলেছে। রথের চতুর্দিকে নৃত্যগীত করতে করতে মহাপ্রভু ভাবছেন, কুরুক্ষেত্র থেকে তিনি (শ্রীরাধিকা) শ্রীকৃষ্ণকে বৃন্দাবনে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

শ্লোকের ভাবার্থ করি সংক্ষেপে ব্যাখ্যান।।

পূর্বে যৈছে কুরুক্ষেত্রে সব গোপীগণ। 

কৃষ্ণের দর্শন পাইয়া আনন্দিত মন।।

জগন্নাথ দেখি প্রভু সে ভাব উঠিলা।

সেই ভাবাবিষ্ট হইয়া ধুয়া গাওয়াইলা।।

অবশেষে রাধা করে কৃষ্ণে নিবেদন,-

"সেই তুমি সেই আমি সেই নবসঙ্গম।

তথাপি আমার মন করে বৃন্দাবন।।

বৃন্দাবনে উদয় করাও আপন চরণ।।

এথা লোকারণ্য হাতী ঘোড়া রথধ্বনি।

সেথা পুষ্পারণ্য ভৃঙ্গ পিকনাদ শুনি।।

এই রাজবেশ সঙ্গে সব ক্ষত্রিয়গণ।

তাঁহা গোপবেশ সঙ্গে মুরলী - বদন।।

ব্রজে তোমা সঙ্গে যেই সুখ আস্বাদন ।

সেই সুখ-সমুদ্রের ইঁহা নাহি এক কণ।।

আমা লইয়া পুনঃ লীলা কর বৃন্দাবনে।

তবে মোর মনোবাঞ্ছা হয়েত পূরণে।।''

এটি ভাগবতে বর্ণিত শ্রীরাধিকার উক্তি। শ্রীকৃষ্ণের সাথে বৃন্দাবনে পুনর্মিলনের আকাঙ্ক্ষা বা বাসনারূপ ভাব। রাধারাণীর সেই মহাভাব মহাপ্রভুর হৃদয়ে উৎসারিত হয়েছে। রূপ গোস্বামীর সংস্কৃত অনুবাদে শ্রীরাধার সেই আকুলতাই ধরা পড়েছে। তিনি সহচরী সখীদের বলছেন,- "সেই প্রিয়তম কৃষ্ণের সঙ্গেই আমার দেখা হল, আমিও সেই আমিই আছি। এমনকী আমাদের মধ্যে যে সেই মধুর মিলন তাও ঘটেছে এই কুরুক্ষেত্রে। তবু সেই যমুনাপুলিন বনে মধুর মুরলীর পঞ্চমতান যা আমার মনের মধ্যে মিলনের বাসনা জাগ্রত করত, ব্রজের সেই যমুনাপুলিনে যদি কৃষ্ণের সাথে আমার মিলন হত, সেই বাসনা আমার অন্তরে অতৃপ্তই রয়ে গেল।"

''সই ! সেইত পরাণ নাথ পাইনু।

যাহা লাগি মদন দহনে ঝুরি গেনু।।"

💐জয় শ্রীরাধা💐 হামার ধন রাধা শ্রীরাধা শ্রীরাধা🏵