শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর
(আবির্ভাব)
শ্রীল নরোত্তম ঠাকুরের কৃষ্ণলীলায় সিদ্ধ পরিচয় নাম চম্পক মঞ্জরী। রাজশাহী জেলার অন্তর্গত গোপালপুর পরগণায় খেতুরীধামে পঞ্চদশ শকাব্দের মধ্যভাগে মাঘী - পূর্ণিমায় শুভ তিথিতে আবির্ভাব হয়েছিলেন শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর।তাঁহার পিতা রাজা শ্রীকৃষ্ণানন্দ দত্ত ছিলেন গোলাপুর পরগণার অধিপতি,
জননী শ্রীনারায়ণি দেবী। কৃষ্ণ পার্ষদ বৈষ্ণব যে কোন কূলে আসিতে পারেন ইহা জানাইবার জন্য শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছাক্রমে নরোত্তম ঠাকুরের কায়স্থকূলে আবির্ভাবলীলা।
'জাতিকূল সব নিরর্থক জানাইতে।
জন্মাইলেন হরিদাসে ম্লেচ্ছকুলেতে।।'
বৈষ্ণবকে প্রাকৃত জগতের অন্তর্গত জাতিবুদ্ধি করিলে নরক প্রাপ্তি ঘটে।
শৈশবকাল হইতেই নরোত্তম ঠাকুরের ভাবি মহাপুরুষোচিত চিহ্নসকল প্রকাশিত হইয়াছিল। তিনি শ্রীগৌর - নিত্যানন্দ গুণমহিমা চিন্তনে সর্বদা মগ্ন থাকিতেন।রাজৈশ্বর্য্যের
প্রতি তাঁহার বিন্দুমাত্র আসক্তি ছিলনা।শ্রীমন্মহাপ্রভু সপার্ষদে স্বপ্নে তাঁহাকে দর্শন দিয়াছিলেন।নরোত্তম
ঠাকুর সংসার কিরূপে ছাড়িবেন যখন চিন্তা করিতেছিলেন,পিতা পিতৃব্য সকলেই রাজকার্য্যে অন্যত্র গেলে ,সেই অবসরে জননীদেবীকে প্রকারান্তরে বুঝাইয়া,রক্ষককে ভুলাইয়া কার্ত্তিক পূর্ণিমা তিথিতে সংসার ত্যাগ করিলেন। প্রেমবিলাস গ্রন্থে এইরূপ বর্ণিত আছে নরোত্তমকে প্রেম দিবার জন্য শ্রীমন্মহাপ্রভু
কুতুবপুরে আসিয়া পদ্মাবতীতে স্নান করতঃ তাহার তটে নৃত্য কীর্ত্তন করিতে লাগিলেন ও পদ্মাবতীকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন,
"এই প্রেম নাও, গোপনে রাখিয়া দিবে।
নরোত্তম আসিলে তাঁহাকে দিবে।।'
তখন পদ্মাবতী বলিলেন, 'কেমন করিয়া বুঝিব নরোত্তম আসিয়াছে’? তদুত্তরে মহাপ্রভু বলিলেন, -
যাঁহার পরশে তুমি অধিক উছলিয়া।
সেই নরোত্তম, প্রেম তারে তুমি দিবা।"
যে স্থানে মহাপ্রভু নরোত্তমের জন্য প্রেম রাখিলেন তাহাই পরবর্ত্তীকালে 'প্রেমতলী' বলিয়া প্রসিদ্ধ হইয়াছে।
নরোত্তম ঠাকুরের যখন বয়স ১২ বৎসর স্বপ্নে নিত্যানন্দ প্রভু দর্শন প্রদান করতঃ পদ্মাবতীর স্থানে গচ্ছিত প্রেম লইবার জন্য নরোত্তমকে আদেশ করিলেন।
নরোত্তম ঠাকুর স্বপ্নাদিষ্ট হইয়া একদিন একাকী পদ্মানদীতে যাইয়া স্নান করিলে,তাঁহার চরণস্পর্শে পদ্মাবতী উচ্ছলিয়া উঠিলেন। পদ্মাবতী চৈতন্য মহাপ্রভুর বাক্য স্মরণ করিয়া নরোত্তমকে প্রেম সমর্পণ করিলেন।প্রেম পাইবার মাত্রেই নরোত্তমের ভাব,বর্ণ সব পরিবর্ত্তন হইয়াগেলে।
নরোত্তমের প্রেম বিকার দেখিয়া পিতামাতা তাঁহাকে প্রকৃতিস্থ করিবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করিয়া ব্যর্থ হইলেন।নরোত্তম শ্রীচৈতন্য - নিত্যানন্দ প্রেম - মদিরাপানে উন্মত্ত হইয়া গৃহবন্ধন ছেদন করিয়া বৃন্দাবনের দিকে ধাবিত হইলেন।নরোত্তম রাজপুত্র হইলেও ভগবদ বিরহে কাতর হইয়া সর্বপ্রকার দেহসুখ জলাঞ্জলি দিয়া দিবারাত্র ক্রন্দন করিতে করিতে নগ্নপদে চলিতে চলিতে শ্রীধাম বৃন্দাবনে আসিয়া শ্রীরূপ - সনাতন গোস্বামীর সানিধ্য পাইয়া পরম সন্তোষ লাভ করিলেন।
নরোত্তম ঠাকুরের আবির্ভাব মাঘী পূর্ণিমায়,সংসার ত্যাগ কার্ত্তিক পূর্ণিমায় এবং লোকনাথ গোস্বামীর নিকট দীক্ষা গ্রহণ শ্রাবণ পূর্ণিমায়।শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর সাক্ষাৎ শিষ্য বা পার্ষদরূপে পরিগণিত শ্রীল লোকনাথ গোস্বামী গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণের মধ্যে সর্বপ্রথম শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর দ্বারা আদিষ্ট হইয়া শ্রীল ভূগর্ভ গোস্বামীকে সঙ্গে লইয়া বৃন্দাবনে আসিয়াছিলেন।শ্রীলোকনাথ গোস্বামী তীব্র বৈরাগ্যের সহিত শ্রীব্রজমণ্ডলে
ভজন করিয়াছিলেন।তিনি
বিবিক্তা - নন্দী বৈষ্ণব ছিলেন।কাহাকেও শিষ্য করিবেন না এইরূপ তাঁহার সংকল্প ছিল। নরোত্তম ঠাকুরের সংকল্প ছিল তিনি লোকনাথ গোস্বামীর শিষ্য হইবেন।নরোত্তম ঠাকুর রাজপুত্র হইয়াও লোকনাথ গোস্বামীর কৃপালাভের জন্য বৃন্দাবনে তাঁহার বাহ্য কৃত্যের স্থানটি প্রত্যহ মধ্যরাত্রে যাইয়া পরিষ্কার করিয়া রাখিতেন এবং হস্ত ধৌতের জন্য উত্তম মাটি ও জল রাখিয়া দিতেন।শ্রীলোকনাথ
গোস্বামী প্রত্যহ নিজ বাহ্যকৃত্য স্থানটি নির্ম্মল ও দুর্গন্ধমুক্ত দেখিয়া আশ্চর্য্যান্বিত
হইলেন।কে এইরূপ কার্য্য করিতেছে তাহা জানিবার জন্য শৌচস্থানের সন্নিকটে গোপনে অবস্থান করিয়া হরিনাম করিতে লাগিলেন। মধ্যরাত্রে একজনকে প্রবেশ করিয়া উক্ত কার্য্য করিতে দেখিয়া তিনি তাঁহার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলেন রাজপুত্র নরোত্তমের এইরূপ কার্য্য জানিতে পারিয়া লোকনাথ গোস্বামী অত্যন্ত সংকুচিত হইলেন।তিনি উক্ত কার্য্য করিতে নিষেধ করিলেন। নরোত্তম ঠাকুর লোকনাথ গোস্বামীর পাদপদ্মে নিপাতিত হইয়া কাঁদিতে লাগিলেন। নরোত্তম ঠাকুরের দৈন্য ও আর্ত্তি দেখিয়া স্নেহার্দ্রচিত্ত হইয়া লোকনাথ গোস্বামী দীক্ষা প্রদান করিলেন। গুরুসেবা কি ভাবে করিতে হয় তাহা নরোত্তম ঠাকুর নিজে আচরণমুখে জগৎ বাসীকে শিক্ষা দিলেন।
শ্রীলোকনাথ গোস্বামীর একমাত্র শিষ্য ছিলেন শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর। বৃন্দাবনে শ্রীল জীব গোস্বামীর আশ্রয়ে শ্রীনিবাস,নরোত্তম ও দুঃখীকৃষ্ণদাস শাস্ত্র অধ্যয়ন ও শিক্ষালাভ করিয়াছিলেন।শ্রীল জীব গোস্বামী শ্রীনিবাস,নরোত্তম ও দুঃখী কৃষ্ণদাসকে যথাক্রমে 'আচার্য্য' 'ঠাকুর' ও 'শ্যামানন্দ' নাম প্রদান করিয়াছিলেন।শ্রীলোকনাথ গোস্বামী কৃষ্ণৈকনিষ্ঠ বিরক্ত বৈষ্ণবের ভজনাদর্শ কিরূপ হওয়া উচিত তাহা শিক্ষা দেবার জন্য এবং উত্তরবঙ্গের কৃষ্ণ - বহির্মুখ জগৎ এর আত্যন্তিক কল্যাণ বিধানের জন্য নরোত্তম ঠাকুরকে তাঁহার পূর্বাশ্রমে খেতুরীতে যাইবার জন্য আদেশ প্রদান করিলেন।শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর শ্রীল গুরুদেবের বিরহে ব্যাকুল হইলেও শ্রীল গুরুদেবের আদেশকে শিরোধার্য্য করিয়া খেতুরীতে আসিয়া শুদ্ধ প্রেমভক্তির বাণী প্রচার করতঃ উত্তরবঙ্গ বাসী নরনারীগণের উদ্ধার সাধন করিলেন।
শ্রীল লোকনাথ গোস্বামীর আদেশে শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর খেতুরীতে শ্রীগৌরাঙ্গ,শ্রীবল্লভীকান্ত,শ্রীকৃষ্ণ,শ্রীব্রজমোহন,শ্রীরাধারমণ ও শ্রীরাধাকান্ত এই ছয় বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। খেতুরীতে শ্রীবিগ্রহ প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে নরোত্তম ঠাকুর যে মহামহোৎসব করিয়া ছিলেন তাঁহার আজও বৈষ্ণব সমাজে প্রসিদ্ধ রহিয়াছে।
শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর খেতুরীতে মহোৎসবের পূর্বে শ্রীগৌড়মণ্ডল ও ক্ষেত্রমণ্ডল পরিক্রমা করতঃ বিভিন্ন স্থান দর্শন এবং গৌরপার্ষদগণের কৃপা লাভ করিয়াছিলেন।খেতুরীতে শ্রীবিগ্রহ প্রতিষ্ঠা মহোৎসবে তদানীন্তন গৌরপার্ষদগণ ও গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ প্রায় সকলেই উপস্থিত ছিলেন।শ্রীল শ্রীনিবাস আচার্য্য প্রভুর উপস্থিতিতে ও পৌরোহিত্যে শ্রীবিগ্রহ প্রতিষ্ঠা মহোৎসব সুসম্পন্ন হয়।গণসহ শ্রীমন্মহাপ্রভু খেতুরীতে নরোত্তম ঠাকুরের সংকীর্ত্তন মহোৎসবে প্রকটিত হইয়াছিলেন।খেতুরী
মহোৎসবের পর শ্রীল নরোত্তম ঠাকুরের যশ সর্বত্র বিস্তৃত হইল। শ্রীরামকৃষ্ণ আচার্য্য,শ্রীগঙ্গানারায়ণ
চক্রবর্ত্তী প্রভৃতি বিশিষ্ট ব্রাহ্মণগণ শ্রীল নরোত্তম ঠাকুরের শিষ্য হইলেন।
গোপালপুর গ্রামে শ্রীবিপ্রদাস ব্রাহ্মণের গৃহে ধানের গোলায় এক ভয়ঙ্কর সর্প ছিল। তাহার ভয়ে কেহ সেখানে যাইত না।শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর সেই গৃহে শুভ বিজয় করিলে সর্প অন্তর্ধান করে এবং সেই গোলা হইতে ‘গৌর – বিষ্ণুপ্রিয়া’ বিগ্রহ প্রকটিত হইয়া নরোত্তম ঠাকুরের কোলে উঠেন।
''গোলা হইতে প্রিয়াসহ শ্রীগৌরসুন্দর।
ক্রোড়ে আইলা হইল সর্বনয়ন গোচর।।''
বর্ত্তমান উক্ত বিগ্রহ গম্ভীলাতে আছেন।
কোনও এক স্মার্ত্ত ব্রাহ্মণ অধ্যাপক নরোত্তম ঠাকুরকে শুভ্র - বুদ্ধি করিয়া নিন্দা করায় গলিত কুন্ঠব্যাধির দ্বারা আক্রান্ত হইয়া ছিল।পরে ভগবতীদেবীর দ্বারা স্বপ্নাদিষ্ট হইয়া নরোত্তম ঠাকুরের চরণে ক্ষমা প্রার্থনা করিলে কুন্ঠব্যাধি হইতে মুক্ত হয়।
শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর কীর্ত্তনের দ্বারাই প্রচার করিয়াছিলেন।ঠাকুর মহাশয় 'গরানহাটী' নামে কীর্ত্তনের অপূর্ব সুর প্রবর্ত্তন করিয়াছিলেন। তাঁহার রচিত 'প্রার্থনা' ও 'প্রেমভক্তি - চন্দ্রিকা' ভক্তগণের প্রাণস্বরূপ ।শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর গৌরনিজজন রূপানুগবর ছিলেন,তাহাও তাঁহার রুপগোস্বামীর পাদপদ্মে অনন্য নিষ্ঠাসূচক কীর্ত্তন হইতে জ্ঞাত হওয়া যায়।
শ্রীরূপমঞ্জরীপদ, সেই মোর সম্পদ,
সেই মোর ভজন-পূজন I
সেই মোর প্রাণ-ধন, সেই মোর আভরণ,
সেই মোর জীবনের জীবন II
সেই মোর রস-নিধি, সেই মোর বাঞ্ছা-সিদ্ধি,
সেই মোর বেদের ধরম I
সেই ব্রত, সেই তপ, সেই মোর মন্ত্র-জপ,
সেই মোর ধরম-করম II
অনুকূল হবে বিধি, সে-পদে হৈবে সিদ্ধি,
নিরখিব এ দুই নয়নে I
সে রূপ-মাধুরী-রাশি, প্রাণ-কুবলয়-শশি,
প্রফুল্লিত হবে নিশিদিনে II
তুয়া অদর্শন-অহি, গরলে জারল দেহী,
চির-দিন তাপিত জীবন I
হা হা প্রভু! কর দয়া, দেহো মোরে পদ-ছায়া,
নরোত্তম লইল শরণ II
শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর কার্ত্তিকী কৃষ্ণা - পঞ্চমী তিথিতে তিরোধান লীলা করেন।
No comments:
Post a Comment