Sunday, February 2, 2020


শ্রীমন্মধবাচার্য্য
(তিরোভাব)
দক্ষিণ - কানাড়া জেলার প্রধান নগর ম্যাঙ্গালোর,তদুত্তরে উড়ুপি গ্রামে পাজকাক্ষেত্রে সন ১০৪০ শকাব্দে মতান্তরে ১১৬০ শকাব্দে শিবাল্লী ব্রাহ্মণকূলে মধ্বাচার্য্য রামচন্দ্রের বিজয়োৎসব তিথিতে আবির্ভূত হন।তাঁহার পিতার নাম মধ্বগেহ ভট্ট,মাতার নাম বেদবিদ্যা।তাঁহার বাল্যে কালের নাম বাসুদেব।
শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতীগোস্বামী প্রভুপাদ শ্রীমন্মধবাচার্য্যর বাল্য পৌগণ্ডলীলায় কয়েকটি অলৌকিক ঘটনার কথা উল্লেখ করিয়াছেন। বাল্যকালে উড়ুপি হইতে পাজকাক্ষেত্রে,প্রত্যাগমন কালে নির্ব্বিঘ্নে আগমন,মাতার অনুপস্থিতিকালে জ্যেষ্ঠা ভগ্নীর সমক্ষে ক্রন্দন নিবৃত্তিছলে গবাদির ভোজ্য এক নাদা ভূষি ভোজন,প্রচণ্ড ষণ্ডের পুচ্ছে আবদ্ধ থাকিয়া ঝুলন এবং উত্তমর্ণের ঋণ আদায় জন্য ধন্না দিয়া থাকায় তেঁতুল বীজকেই অর্থরূপে পরিণত করিয়া তদ্বারা পিতৃঋণ শোধন।

পঞ্চম বর্ষে তিনি উপনয়ন সংস্কার লাভ করেন।এইকালে পাঠাভ্যাসে বিশেষ কৃতিত্ব দেখাইয়া ছিলেন।''নারায়ণ পণ্ডিত রচিত 'মধ্বাচার্য্য বিজয়' প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক গ্রন্থে লিখিত আছে,স্বয়ং বায়ু নারায়ণের আদেশে, ধর্ম্ম সংস্থাপনার্থ আবির্ভূত হইয়া মধ্বাচার্য্য নামে প্রসিদ্ধ হন। নয়বর্ষ বয়সে সনৎ- কুলোদ্ভব অচ্যুতপেক্ষাচার্য্যের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং পূর্ণপ্রজ্ঞ নাম লাভ করেন।
দীক্ষার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁহার বৈরাগ্যোদয় হইয়াছিল। সংসার পরিত্যাগের পরে তিনি আনন্দতীর্থ,জ্ঞানানন্দ,আনন্দগিরি প্রভৃতি নামে পরিচিত হইলেন।
দ্বাদশ বয়সে তিনি শ্রীঅচ্যুতপ্রেক্ষর নিকট সন্ন্যাস গ্রহণ করেন এবং পূর্ণপ্রজ্ঞ তীর্থ নাম লাভ করেন। সন্ন্যাস পরে দক্ষিণদেশের নানাদেশে পর্যটনের পর শৃঙ্গেরী মঠাধিপ বিদ্যাশঙ্কর সহ তাঁহার নানা বিচার হয়। 

শ্রীমন্মধবাচার্য্য বদরিকাশ্রমে শ্রীল ব্যাসদেবের দর্শন লাভ কৃপালাভের পর তাঁহার আদেশে তিনি ব্রহ্মসূত্র ভাষ্য রচনা করেন। শ্রীমন্মধবাচার্য্য বেদান্তের তিনটি ভাষ্য লেখেন,যথা
০১.শ্রীমদ ব্রহ্মসূত্রভাষ্যম। শ্রুতি স্মৃতি প্রমাণের দ্বারা সিদ্ধান্ত সঙ্গতি দেখানো হইয়াছে।
০২.অনুব্যাখ্যানম,শ্লোকাকারে রচিত। এখানে অন্য মতবাদ খণ্ডন করিয়া নিজমত স্থাপন করা হইয়াছে।
০৩.অনুভাষ্যম,এখানে বেদান্তের প্রত্যেক অধিকরণের তাৎপর্য্য শ্লোকাকারে সংক্ষিপ্ত ভাবে লিখিত হইয়াছে।

বিশ্বকোষের বর্ণনায় জ্ঞাত হয় যে শ্রীমন্মধবাচার্য্য গীতাভাষ্য প্রনয়ণ করিয়া বদরিকাশ্রমে গমন করেন এবং তথায় ব্যাসদেবকে গ্রন্থ উপহার দিয়েছিলেন।  ব্যাসদেবও প্রীত হইয়া তাঁহাকে তিনটি শালগ্রাম শিলা অর্পণ করেন।এই শিলাত্রয় মধ্বাচার্য্যের যত্নে সুব্রহ্মণ্য,উদিপী মধ্যতল এই তিন স্থানের মঠে প্রতিষ্ঠিত হয়।উক্ত শালগ্রাম ব্যতীত তিনি উদিপীতে এক কৃষ্ণমূর্ত্তিও প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন।

শ্রীমন্মধবাচার্য্য মায়াবাদ বিচার খণ্ডন করিয়া তত্ত্ববাদ বিচার করায় তাঁহার সম্প্রদায় নামে খ্যাত হইয়াছে।ইনি বায়ুর তৃতীয় অবতার।এই জন্য শ্রীমন্মধবাচার্য্য মহাবলশালী অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন ছিলেন।তাঁহার পুত চরিত্রে তাঁহার অলৌকিক শক্তির বহু ঘটনাবলীর কথা প্রচারিত আছে।শ্রীমন্মধবাচার্য্য হনুমানের ন্যায় ভারী হাল্কা হইতে পারিতেন ৩০ জন পুরুষের বলধারী 'করঞ্জয়' নামক একজন বলশালী ব্যক্তি ভূমিতে সংলগ্ন শ্রীমন্মধবাচার্য্যের পদাঙ্গুষ্ঠকে বিচ্ছিন্ন করিতে পারেন নাই। আবার ক্ষীণকায় হইয়া বালকের স্কন্ধদেশে চড়িয়া বেড়াইলেও বালকের আদৌ ভারবোধ হয় নাই।বাল্যকালে তিনি তেঁতুল বীজকে অর্থে পরিণত করিয়া পিতৃঋণ পরিশোধ করিয়াছিলেন।

''বাংলাদেশে শ্রীমন্মহাপ্রভুর অনুগত গৌড়ীয় - সম্প্রদায়ের সকলেই শ্রীমন্মধবাচার্য্যের অনুগত। তাঁহার অপরনাম শ্রীমধ্বমুনি। সেই শ্রীপাদ আনন্দতীর্থ বা পূর্ণপ্রজ্ঞের অষ্টাদশ অধস্তন - শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্যদেব,সপ্তদশ অধস্তন - শ্রীঅদ্বৈত প্রভু শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু।এই তিন প্রভু শ্রীমধ্বমুনিকে স্বীয় গুরুপরম্পরা মধ্যে স্বীকার করিয়াছেন।শ্রীমধ্বমুনি অঙ্গুলি নির্দ্দেশ পূর্বক শ্রদ্ধালু জগৎবাসীকে দেখাইলেন,জীবের অধিষ্ঠানে যে নিত্য ভগবৎসেবাতাৎপর্য্য,তনমুলেই আস্তিক্যবাদ প্রতিষ্ঠিত।  ভগবানের আনুগত্য ব্যতীত জীবের অন্য গতি নাই।
গৌড়ীয় বেদান্তাচার্য্য শ্রীমন বলদেব বিদ্যাভূষণ প্রভু তাঁহার রচিত 'প্রমেয়রত্নাবলী'গ্রন্থে শ্রীমধ্বমত সংক্ষেপে বর্ণন করিয়াছেন,

'শ্রীমধ্বঃ প্রাহ বিষ্ণুং পরতমমখিলামায়বেদ্যঞ্চ বিশ্বং।
সত্যং ভেদঞ্চ জীবান হরিচরণ জুষস্তারতম্যঞ্চ তেষাম।।

মোক্ষং বিষ্ণুভিঘ্রলাভং তদমলভজনং তস্য হেতুং প্রমাণং।
প্রত্যক্ষাদিত্রয়ঞ্চে ত্যুপদিশতি হরিঃ  কৃষ্ণচৈতন্যচন্দ্রঃ।।'

শ্রীমন্মধবাচার্য্য বলেন,বিষ্ণুই পরতম তত্ত্ব;তিনি অখিলস্নায় বেদ্য,বিশ্ব সত্য,জীব সকল বিষ্ণু হইতে ভিন্ন;তাঁহারা শ্রীহরির চরণসেবক।তাঁহাদের মধ্যে তারতম্য বিদ্যমান;বিষ্ণু পাদপদ্ম লাভই জীবের মোক্ষ।শ্রীবিষ্ণুর শুদ্ধভজনই মুক্তিলাভের উপায়।প্রত্যক্ষ অনুমান শব্দ এই ত্রিবিধ প্রমাণ।ভগবান হরি শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য চন্দ্রও এই উপদেশ করিতেন।

শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে শ্রীমন্মহাপ্রভুর সহিত মধ্ব সম্প্রদায়ের তত্ত্ব আলোচনা প্রসঙ্গেতে জ্ঞাত হয়,-তত্ত্ববাদীর মত - বর্ণাশ্রম ধর্ম্ম কৃষ্ণে সমর্পণ করাই কৃষ্ণভক্তের শ্রেষ্ঠ সাধন এবং সেই সাধনবলে শ্রেষ্ঠ সাধ্যরূপ পঞ্চবিধ মুক্তি লাভ করিয়া সিদ্ধ ব্যক্তি বৈকুন্ঠে গমন করেন।শ্রীমন্মহাপ্রভু উক্ত মত শুনিয়া বলিয়াছিলেন,শাস্ত্রমতে শ্রবণ - কীর্ত্তনই শ্রেষ্ঠ সাধন,সেই সাধনবলে কৃষ্ণ প্রেমসেবারূপ সাধ্যফলের লাভ হয়।

শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর অমৃতপ্রবাহভাষ্যে লিখিয়াছেন,-
কর্ম্মার্পণ ইত্যাদি দ্বারা চিত্ত শুদ্ধ হয়।চিত্ত শুদ্ধ হইলে সৎসঙ্গ - বলে অনন্য কৃষ্ণভক্তিতে শ্রদ্ধার উদয় হয়।শ্রদ্ধোদয় হইলে শ্রবণ - কীর্ত্তনাদিরুপ সাধনভক্তি হয়।শ্রবণ - কীর্ত্তনাদি ভক্তি সাধন করিতে করিতে অনর্থের যত বিবৃত্তি হয়,প্রেমের ততই অভ্যুদয় হয়।সুতরাং কর্ম্ম বা কর্ম্মার্পণ হইতে অনিবার্য্য রূপে কৃষ্ণভক্তির উদয় হইবার সর্ব্বত্র সম্ভাবনা নাই। কেননা সৎসঙ্গজনিত 'শরনাপত্তি' লক্ষণা শ্রদ্ধার অপেক্ষা করে।

''প্রভু কহে কৰ্ম্মী,জ্ঞানী দুই ভক্তিহীন।
তোমার সম্প্রদায়ে দেখি সেই দুই চিহ্ন।।

সবে,একগুন দেখি তোমার সম্প্রদায়ে।
'সত্যবিগ্রহ ঈশ্বরে' করহ নিশ্চয়ে ।।''

প্রভু কহিলেন,- ওহে তত্ত্ববাদী আচার্য্য,তোমার সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্তগুলি প্রায়ই শুদ্ধভক্তির বিরুদ্ধ। তথাপি ঈশ্বরের সত্য নিত্য - বিগ্রহ স্বীকাররূপ একটি মহদ্গুণ তোমার সম্প্রদায়ের দেখিতেছি। সেইজন্য শ্রীমাধবেন্দ্র পুরী এই প্রধান সিদ্ধান্ত অবলম্বন করিয়া মধ্বসম্প্রদায় স্বীকার করিয়াছিলেন।
শ্রীমন্মধবাচার্য্য ৭৯ বৎসর বয়সে মাঘী শুক্লানবমী তিথিতে শিষ্যগণের নিকট ঐতরেয়োপনিষদ ভাষ্য ব্যাখ্যা করিতে করিতে তিরোধান - লীলা করেন।

No comments:

Post a Comment

🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴🌴🌳 🌻🌼 শ্রীবলরামের রাসযাত্রা 🌹 শ্রীকৃষ্ণের বসন্তরাস 🌼🌻 🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴...