মহাপ্রভুর
সন্ন্যাস
সন্ন্যাস যাবার
আগের দিন গৌরহরি বিষ্ণুপ্রিয়াকে মহাসুখে নিশ্চিন্তে শয়ন করিয়ে আস্তে আস্তে উঠলেন বিছানা
থেকে। তারপর রাতের বসন ভূষণ ত্যাগ করে ও সামান্য বস্ত্র পরিধান করে আঙ্গিনায় আসলেন।
মনে মনে জননীকে প্রণাম করে সদর দরজা খুলে বাড়ির বাহিরে আসলেন। শেষে নিজ ভবনকে, শ্রীনবদ্বীপধামকে
ও জননীকে সম্বোধন করে প্রণাম করলেন এবং দ্রুতপদে গঙ্গাভিমুখে চললেন। সেই শীতকালে শেষরাত্রিতে,
শীতে গঙ্গায় ঝাঁপ দিলেন। তখন আর শরীরে সুখ দুঃখ বোধ নাই। ক্ষণকাল পরে গঙ্গার অপর পারে
উঠে, সেই আর্দ্রবস্ত্রে দ্রুতগমনে কাটোয়া অভিমুখে চললেন।
যে গঙ্গার
ঘাটে শ্রীগৌরাঙ্গসুন্দর পার হলেন। নবদ্বীপের লোক সেই ঘাটকে অভিশাপ দিয়েছিল। সেই হতে
ঘাটের নাম হল "নিরদয়ের ঘাট।" বিষ্ণুপ্রিয়া
মহাসুখে ঘোর নিদ্রায় অভিভূত ছিলেন। হঠাৎ পালঙ্কে হাত বুলাইতে লাগলেন। পালঙ্কে হাত বুলিয়ে
দেখলেন, সেখানে শ্রীগৌরাঙ্গ নাই। প্রিয়াজী জিজ্ঞাসা করলেন, "তুমি কোথায় গেলে"।
দেখেন ঘরের কপাট খোলা। পতি ঘরে নাই বুঝতে পারলেন। তাঁর মনে উদ্বেগ বাড়তে লাগল। এইবার
ভাবছেন মাকে এই সংবাদ দিবেন। শেষে আর থাকতে না পারে জননীর ঘরে গিয়ে আর দাঁড়াতে না পারে,
বসে পড়লেন।তখন দুয়ারে আঘাত করতেছেন। আর ডাকছেন,- ''মা উঠ ! মা উঠ।" বিষ্ণুপ্রিয়ার
গলাতে করুন স্বর শুনে মা' চটপট করে উঠল। আর বলছেন "কে ও যেন মা বিষ্ণুপ্রিয়া ।
নিমাই ঠিক আছে তো"
বিষ্ণুপ্রিয়া
বললেন, "হা মা আমি, মা তিনি ঘরে ছিলেন, কোথায় চলে গিয়েছেন।"
মা' প্রদীপ
জ্বালিয়ে আর দুয়ার খুললেন। শচীমাতা রাজপথে
প্রদীপ হাতে করে চলছেন। আর বিষ্ণুপ্রিয়া ছায়ার মত শাশুড়ির বস্ত্র ধরে পিছনে পিছনে যাচ্ছেন।
শচী মাতা নিমাই নিমাই বলে ডাকছেন। কোন উত্তর
পাচ্ছেন না। শচী মার গলা বেশী দূর যাচ্ছে না। শচী মা ভেঙ্গে বসে পড়লেন বাড়ির আঙিনায়।
প্রভাতে কান্নার
রোল উঠল। শুধু শচীর ঘরে না, সারা নদীয়াতে।
পড়িয়া ধরণী
তলে, শোকে শচীদেবী বলে,
লাগিল দারুণ
বিধি বাদে।
অমূল্য রতন
ছিল, কোন ছলে কেবা নিল,
সোনার পুতুলি
গোরাচাঁদে।।
প্রথমেই বলিলেন
শ্রীবাস উদার।
আই কেনে রয়েছেন
বাহির দুয়ায়ে।।
অঙ্গুরী অঙ্গদবালা,
গোরাচাঁদের কন্ঠমালা,
খাট পাট সোনার
দুলিচা।
সে সব রয়েছে
পড়ি, নিমাই গিয়াছে ছাড়ি,
মুঞি প্রাণ
ধরিয়াছে মিছা ।।
গৌরাঙ্গ ছাড়িয়া
গেল, নদীয়া আঁধার হৈল,
ছটপট করে মোর
হিয়া।
যোগিনী হইয়া
যাব, যেথায় গৌরাঙ্গ পাব,
কান্দিব তার
গলায় ধরিয়া।।
যে মোর নিমাই
দিবে, বিনামূল্যে কিনে বলে,
হব মুই তার
দাসের দাসী।।
বাসুদেব ঘোষ
ভণে, শচী কান্দে অকারণে,
জীব লাগি নিমাই
সন্ন্যাসী।।
শোকাতুর বিষ্ণুপ্রিয়া,
শচীদেবীকে বললেন,"মা তোমার পুত্র চিরদিন স্বেচ্ছাময়। সে কী বস্তু তা স্মরণ করে
তোমরা শান্ত হও। ভারতের যেখানে থাকে তাঁকে খুঁজে বার করবই করব। মিলন করাব তোমার সঙ্গে
।
"জীব
লাগি করিল সন্ন্যাস। পরম নিন্দুক পাষন্ডও শোকাভিভুত হল। নিন্দা দ্বেষ উড়ে গেল, চলে
গেল অনুগতি। নিন্দা দ্বেষ যাহার মনেতে যা ছিল,প্রভুর বিরহে সর্বজীবের খন্ডিল।"
তোমরা কেউ
দেখেছ যেতে,
সোনার বরণ
গৌরহরি জনকে সন্ন্যাসী সাথে।
তাঁর ছেঁড়া
কাঁথা গায়ে, প্রেমে ঢুলু ঢুলু যায়, যেন পাগলের প্রায়।
মুখে হরেকৃষ্ণ
বলে, দণ্ড করোয়া হাতে।।
এদিকে শ্রীগৌরাঙ্গ সেই শীতে আর্দ্রবস্ত্রে কাটোয়ার
অভিমুখে বিদ্যুৎগতিতে চলছেন। প্রভু কাটোয়ার সুরধনীর তীরে এসে কেশব ভারতীর আশ্রমে উপস্থিত
হয়ে সন্ন্যাসীকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন। প্রভু বললেন,
"প্রভু আমি এসেছি। আপনি কৃপা করে আমাকে সন্ন্যাসমন্ত্র দিন। আমাকে কৃষ্ণদাস করে
তুলুন।"
প্রভুর মুণ্ডন
দেখি কান্দে যত পশুপাখী
আর কান্দে
যতেক নিবাসী।
বৎস নাহি দুগ্ধ
খায় তৃণে দন্তে গাভী ধায়
নেহালে গৌরাঙ্গ
মুখ আসি।।
আছে লোক দাঁড়াইয়া
গৌরাঙ্গ মুখ চাহিয়া
কারো মুখে
নাহি সরে বাণী।
দুনয়নে জল
ঝরে গৌরাঙ্গের মুখ হেরে
বৃক্ষবৎ হৈল
সব প্রাণী।।
ডোর কৌপীন
পরি মস্তক মুণ্ডন করি
মায়া ছাড়ি
হৈলা উদাসীন।
বৈসে ডগমগি
হৈয়া করেতে করঙ্গ লইয়া
প্রভু কহে
আমি দীন হীন।।
তোমরা বৈষ্ণব
বর এই আশীর্বাদ কর
দুই হাত দিয়া
মোর মাথে।
করিলাম সন্ন্যাস
নহে যেন উপহাস
ব্রজ গিয়া
পাই ব্রজনাথে।।
এত বলি গোরা
রায় প্রেমে উর্ধ্বমুখে ধায়
কোথা বৃন্দাবন
বলি কাঁদে।
ভ্রমে প্রভু
রাঢ়দেশে নিত্যানন্দ তান পাশে
বাসু ঘোষ উচ্চস্বরে
কাঁদে।।
এইভাবে শ্রীমন্মহাপ্রভু
সন্ন্যাস নিতে নবদ্বীপ ছেড়ে এলেন কাটোয়াতে।
No comments:
Post a Comment