Thursday, March 12, 2020


ভক্তিকল্প - বল্লরী
         
ব্রহ্মাণ্ড ভ্ৰমিতে কোন ভাগ্যবান জীব।
গুরু - কৃষ্ণ প্রসাদে পান ভক্তিলতা বীজ।।
মালী হঞা করে সেই বীজ আরোপণ।
শ্রবণ কীৰ্ত্তন জলে করয়ে সেচন।।
উপজিয়া বাড়ে লতা ব্রহ্মাণ্ড ভেদি যায়।
বিরজা ব্রহ্মলোক ভেদি পরব্যোম পায়।।
তবে যায় তদুপরি গোলোক বৃন্দাবন।
কৃষ্ণচরণ কল্প বৃক্ষে করে আরোহণ।।
তাঁহা বিস্তারিত হঞা ফলে প্রেমফল।
ইহা মালী সেচে শ্রবণ - কীর্ত্তনাদি জল।।
যদি বৈষ্ণব অপরাধ উঠে হাতি মাতা।
উপারে বা ছিণ্ডে তার শুকি যায় পাতা।।
তারে মালী যত্ন করি করে আবরণ।
অপরাধ হাতী যৈছে না হয় উদ্গম।।

কিন্তু যদি লতার অঙ্গে উঠে উপশাখা।
ভুক্তি মুক্তিবাঞ্ছা যত অসংখ্য তার লেখা।।
নিষিদ্ধাচার কুটি নাটি জীব হিংসন।
লাভ প্রতিষ্ঠাদি যত উপশাখাগণ।।
সেকজল পাঞা উপশাখা বাড়ি যায়।
স্তব্ধ হঞা মূলশাখা বাড়িতে না পায়।।
প্রথমেই উপশাখা করিবে ছেদন।
তবে মূলশাখা বাড়ি যায় বৃন্দাবন।।
প্রেমফল পাকি পড়ে মালী আস্বাদয়।
লতা অবলম্বি মালী কল্পবৃক্ষ পায়।।
তাঁহা সেই কল্প বৃক্ষের করয়ে সেবন।
সুখে প্রেমফল রস করে আস্বাদন।।
এইত পরম ফল, পরম পুরুষাৰ্থ।
যার আগে তৃণ তুল্য চারি পুরুষাৰ্থ।।
শুদ্ধ ভক্তি হৈতে হয় প্রেমের উৎপন্ন।
অতএব শুদ্ধভক্তির কহিরে লক্ষণ।।
অন্যবাঞ্ছা, অন্য পূজা ছাড়ি জ্ঞানকৰ্ম্ম।
আনুকূল্যে সর্বেন্দ্রিয় কৃষ্ণানুশীলন।
এই শুদ্ধভক্তি, ইহা হৈতে প্রেম হয়।
পঞ্চ রাত্রে ভাগবতে এই লক্ষণ কয়।।
ভুক্তি মুক্তি আদি বাঞ্ছা যদি মনে হয়।
সাধন করিলে প্রেম উৎপন্ন না হয়।।
সাধন ভক্তি হৈতে হয় রতির উদয়
রতি গাঢ় হৈলে প্রেম নাম কয় ।।
প্রেমবৃদ্ধি ক্রমে নাম স্নেহ মান প্রণয়
রাগ অনুরাগ ভাব মহাভাব হয় ।।
                              ---( চৈঃ চঃ মধ্যখণ্ড ১৯ অধ্যায় )
সমস্ত জীব নিজের কর্ম্ম অনুযায়ী ব্রহ্মাণ্ডের নানা জায়গায় নানা দেহে ভ্রমন করছেন অর্থাৎ জন্ম মৃত্যুর ভিতর দিয়ে যাচ্ছেন এইরকম ব্রহ্মাণ্ডের নানা যোনীতে ভ্রমন করতে করতে বহু লক্ষ কোটি জীবের মধ্যে কোন সৌভাগ্যবান জীব নিজের সুকৃতির ফলে, গুরু কৃষ্ণের প্রসাদে ভক্তিলতা বীজ প্রাপ্ত হন, কৃষ্ণভক্তির বীজ তাঁর হৃদয়ে অঙ্কুরিত হয়

শ্রবণ - কীর্ত্তন রূপ জলে সেচন করলে সেই বীজ অঙ্কুরিত হয়ে ভক্তিলতা জন্মায় তা ক্রমশ বিরজাকে (সমুদ্রকে ) ব্রহ্মলোককে ( নিত্যধামকে ) ভেদ করে পরব্যোমে ( ভগবৎ ধামে) আশ্রয় পায় ভক্তিলতার মূল উপড়ে গেলে বা ছিড়ে গেলে তার পাতাও শুকিয়ে যায় মত্ত হস্তীর মত বৈষ্ণব - অপরাধ সহজেই ভক্তিলতাকে ধ্বংস করতে পারে বৈষ্ণব অপরাধ যেমন - বৈষ্ণবকে প্রহার,নিন্দা,দ্বেষ,অনভিবাদন,অপমান অথবা বৈষ্ণবকে দর্শন করে হৃষ্ট না হওয়া  কিন্তু যদি লতার সঙ্গে উঠে উপশাখা - এখানে উপশাখা অর্থেপরগাছা’ - কে বলা হচ্ছে সাধকের মনের কামনা বাসনা গুলি এই রকমই তাঁর মনের ভক্তিলতার পরগাছা স্বরূপ এই পরগাছা ভক্তিলতার ক্ষতিসাধন করে  

ভুক্তি-মুক্তি বাঞ্ছা, শাস্ত্র - নিষিদ্ধ আচার, কুটীনাটী , কুতর্ক বা কুটীলতা , জীবহিংসা , অর্থলাভের বাসনা , পূজিত হবার বাসনা বা প্রতিষ্ঠা - স্পৃহা আদি যত উপশাখাগণ - এগুলি থাকলে সাধকের ভক্তি আর পুষ্ট হতে পারেনা এইরকম সেকজল পেয়ে উপশাখা গুলি বেড়ে যায় , মূলশাখা বাড়তে পায় না । এভাবে সাধনার পথে কত বাধাই আসতে পারে কেউ যখন উপরে ওঠার চেষ্টা করে তখন তার পথে অনেক বাধা আসে তাকে আটকাবার জন্যে কিন্তু খুব সচেতনভাবে চেষ্টা করতে হবে এইসব জিনিস থেকে দূরে থাকার জন্যে নিজস্ব দিব্য প্রেরণার যেসব শত্রু অন্তর্জগৎ থেকে আসে তাদের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে সাধু, গুরু শাস্ত্রের সাহায্য নিতে হয় নিজেদের আন্তরিকতা থাকলে তবেই ক্রমশঃ উন্নতি লাভ করা সম্ভব

এই জন্য প্রথমেই উপশাখা ছেদন করা কর্তব্য। অর্থাৎ হরিভক্তি লাভ করতে হলে প্রথমতঃ ভুক্তি মুক্তি স্বৰ্গভোগ প্রভৃতি সমস্ত ফলের বাসনা পরিত্যাগ করে , কেবল হরিচরণ আশ্রয় না করলে শ্রবণ কীৰ্ত্তন ইত্যাদি সকল প্রকার সাধন ভজন বৃথা হয়ে যায়। এই ভক্তিলতা অবলম্বন করে সাধক কল্পবৃক্ষ লাভ করেন এবং পরম সুখে স্থাপক প্রেমফল রস আস্বাদন করেন এই ভগবৎ প্রেমরস আস্বাদনই পরম ফল - পরম পুরুষার্থ। এর কাছে চার পুরুষাৰ্থই তৃণ তুল্য শুদ্ধ ভক্তি থেকে প্রেম উৎপন্ন হয়

শুদ্ধ ভক্তির লক্ষণগুলি,- ''অন্য বাঞ্ছা, অন্যপূজা, শুষ্ক জ্ঞান কৰ্ম্মের অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করে পবিত্রভাবে সকল ইন্দ্রিয়ের আনুকূল্যে হরিপ্রেমরস অনুশীলন করাই শুদ্ধ ভক্তি, একেই অহৈতুকী ভক্তি বলা যায়'' পিশাচীতুল্য ভোগবাসনা মুক্তিস্পৃহা হৃদয়ে থাকলে বহু সাধনাতেও প্রেম উৎপন্ন হয় না। নারদ পঞ্চরাত্রে বলা হয়েছে,-

সৰ্ব্বোপাধি বিনির্ম্মুক্তং তৎপরত্বেন নিৰ্ম্মলং 
হৃষীকেন হৃষীকেশ সেবনং ভক্তিরুচ্যতে।।

অর্থাৎ অন্য বাঞ্ছা পরিত্যাগ করে একাগ্রচিত্তে পবিত্র ভাবে ইন্দ্রিয়াদির আনুকূল্যে ভগবৎ অনুশীলন করার নামই ভক্তি ভাগবতে লিখিত হয়েছে,-

"মদ গুণশ্রুতি মাত্রেণ ময়ি সৰ্ব্বগুহাশয়ে
মনোগতিরবিচ্ছিন্না যথা গঙ্গাম্ভাসোহম্বুধৌ।।
লক্ষণং ভক্তিযোগস্য নির্গুণস্য হ্যুদাহৃতং।
অহৈতুক্য ব্যবহিতা যা ভক্তিঃ পুরুষোত্তমে।।''

আমি সৰ্ব্বান্তৰ্য্যামী পুরুষোত্তম আমার গুণ শ্রবণ মাত্র সাগর অভিগামী গঙ্গাসলিলের ন্যায় আমাতে অবিচ্ছিন্না ফল - অভিসন্ধি - শূন্য এবং ভেদদর্শন - বর্জিত মনের যে গতি তাই নির্গুণ ভক্তিযোগের লক্ষণ বলে কথিত হয়েছে। এটিই অহৈতুকী অব্যবহিত ভক্তি।

ইক্ষুরস যেমন ক্রমশঃ ঘনীভূত হয়ে গুড় খণ্ডসার শর্করা মিছরি উত্তম মিছরি প্রস্তুত হয়, সেইভাবে সাধন ভক্তি থেকে রতির উদয় হয় রতি গাঢ় হলে তাকে প্রেম বলা যায় প্রেমের ক্রমশঃ বৃদ্ধিতে স্নেহ, মান, প্রণয়, রাগ, অনুরাগ, ভাব মহাভাব উৎপন্ন হয়ে থাকে।

জ্ঞান, কৰ্ম্ম, দেব, দেবী, বহু যতনেতে সেবি, প্রাপ্তফলে হৈলে তুচ্ছ জ্ঞান।
সাধুজন - সঙ্গাবেশে, কৃষ্ণকথার শেষে, বিশ্বাস হয় বলবান ৷।

সেই বিশ্বাসে ভাই, শ্রদ্ধা বলিসদা গাই, ভক্তিলতা - বীজ বলি তারে
কৰ্ম্মি-জ্ঞানী জনে যারে, শ্রদ্ধা বলে বারে বারে, সেই বৃত্তি শ্রদ্ধা হইতে নারে।।

নামের বিবাদ মাত্র , শুনিয়া জ্বলে গাত্ৰ, লৌহে যদি বলহ কাঞ্চন।
তবু লৌহ লৌহ রয়, কাঞ্চন কভু নয়, মণি -স্পর্শে নহে যতক্ষণ
                                                           ---(শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর )
নিতাই গৌর হরিবোল নিতাই গৌর হরিবোল

No comments:

Post a Comment

🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴🌴🌳 🌻🌼 শ্রীবলরামের রাসযাত্রা 🌹 শ্রীকৃষ্ণের বসন্তরাস 🌼🌻 🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴...