Monday, March 30, 2020


শুদ্ধ ভক্তি
শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ
সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার দণ্ডবৎ প্রণাম I
''হরি - গুরু - বৈষ্ণব তিনিহেঁ স্মরণ।
তিনেহেঁ স্মরণ হইতে বিঘ্ন বিনাশন।।
অনায়াসে হয় নিজ বাঞ্ছিত পূরণ ।।‘’

শুদ্ধ ভক্তির লক্ষণ কি ???
শ্রীমদ্ভাগবতের তৃতীয় স্কন্ধে (/২৯/১২-১৩) ভগবান শ্রীকপিলদেব তাঁর মাতা দেবহূতিকে পারমার্থিক তত্ত্ব নির্দেশ দেবার সময় শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তির লক্ষণ বর্ণনা করে বলেছেন,- "হে মাতঃ, যাঁরা আমার শুদ্ধ ভক্ত এবং যাঁদের পার্থিব কোন লাভের বাসনা অথবা মনোধর্মপ্রসূত জ্ঞানের প্রতি কোন আসক্তি নেই, তাঁদের চিত্ত সর্বদাই আমার সেবায় এতই গভীরভাবে মগ্ন যে, তাঁরা আমার কাছ থেকে কিছুই প্রত্যাশা করেন না। এমন কি, তাঁরা আমার ধামে আমার সঙ্গে বাস করার সৌভাগ্য পর্যন্ত কামনা করেন না।" শ্রীমদ্ভাগবতে কপিলদেবের এই উক্তিতে শুদ্ধ ভক্তের যথার্থ মনোভাব বর্ণিত হয়েছে , এবং ভক্তির সামান্য লক্ষণও বর্ণিত হয়েছে।

শ্রীল রূপ গোস্বামী শাস্ত্র - প্রমাণের মাধ্যমে ভক্তির বিভিন্ন লক্ষণ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন যে, শুদ্ধ ভক্তির ছয়টি লক্ষণ আছে---

১।শুদ্ধ ভক্তি ক্লেশঘ্নী, অর্থাৎ সব রকম প্রাকৃতিক ক্লেশ তৎক্ষণাৎ নিবৃত্তি করে।
২।শুদ্ধ ভক্তি শুভদা, অর্থাৎ সর্বতোভাবে মঙ্গলময়।
৩।শুদ্ধ ভক্তি সান্দ্রানন্দবিশেষাত্মা, অর্থাৎ শুদ্ধ ভক্তি দিব্য আনন্দ প্রদান করে।
৪।শুদ্ধ ভক্তি সুদুর্লভা, অর্থাৎ শুদ্ধ ভক্তি লাভ করা সুদুর্লভ।
৫।শুদ্ধ ভক্তি মোক্ষলঘুতাকৃৎ, অর্থাৎ শুদ্ধ ভক্তি মোক্ষকেও তুচ্ছ করে দেয়।
৬।শুদ্ধ ভক্তি শ্রীকৃষ্ণাকর্ষিণী, অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণকে আকর্ষণ করার একমাত্র উপায়।

শ্রীকৃষ্ণ সর্বাকর্ষক, কিন্তু শুদ্ধ ভক্তি তাঁকেও আকর্ষণ করে। অর্থাৎ শুদ্ধ ভক্তি শ্রীকৃষ্ণের চেয়েও বলবতী, কারণ তিনি হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের অন্তরঙ্গা শক্তি।

মহাপ্রভু যখন উত্তরপ্রদেশে গিয়েছিলেন মধ্বাচার্যের যারা অনুগামী তত্ত্ববাদী তাদের সঙ্গে তাঁর যে আলোচনা হয়, তাতে তাদের বক্তব্য হল মুক্তিই হল ভক্তির একমাত্র লক্ষণ। এই মুক্তি মানে কৈবল্য বা সাযুজ্য মুক্তি নয়। তারা সামীপ্য, সারুপ্য, সালোক্য এবং সার্ষ্টি এই চার রকমের মুক্তি কামনা করে বৈকুন্ঠে ভগবানের কাছে ফিরে যেতে চায়। মহাপ্রভু সেই তত্ত্ববাদীদের যিনি আচার্য বা মহান্ত তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন,- শাস্ত্রে বলা হচ্ছে ভক্তকে মুক্তি দেওয়া হলেও সে মুক্তি চায় না। ভগবান কপিলদেব বলেছেন যে
''সালোক্যসার্ষ্টিসামীপ্যসারূপ্যৈকত্বমপ্যুত।
দীয়মানং গৃহ্নন্তি বিনা মৎসেবনং জনাঃ।।'' (ভাগবত /২৯/১৩)

অর্থাৎ,- মুক্তি পাঁচ রকমের যথা - সাযুজ্য বা ভগবানের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়া, সালোক্য বা ভগবানের লোকে বাস করা, সারূপ্য বা ভগবানের রূপ প্রাপ্ত হওয়া, সামীপ্য বা ভগবানের সান্নিধ্যে বাস করা এবং সাষ্টি বা ভগবানের সমান ঐশ্বর্য প্রাপ্ত হওয়া। ভগবদ্ভক্ত পার্থিব সুখভোগের কথা দূরে থাকুক , এই পাঁচটি মুক্তি কোনটিই কামনা করেন না। প্রীতি সহকারে ভগবানের সেবা করেই তিনি তৃপ্ত হন এটিই হচ্ছে শুদ্ধ ভক্তির লক্ষণ। তাহলে ভক্তকে ভগবানের সেবা ছাড়া যে কোন মুক্তি দিলেও সে যদি তা গ্রহণ না করে তাহলে সেই মুক্তি কেন আমাদের লক্ষ্য হবে?

মহাপ্রভু দ্বিতীয় শ্লোকে বললেন,-
''মুক্তি স্বয়ং মুকুলিতাঞ্জলি সেবতেহস্মান্।
ধর্মার্থকামগতয়ঃ সময়প্রতীক্ষাঃ (শ্রীকৃষ্ণকর্ণামৃত ১০৭ শ্লোক)

অর্থাৎ,- মুক্তিদেবী মুকুলতাঞ্জলি হয়ে ভক্তের কাছে প্রার্থনা করে তাকে যেন সেবা করার সুযোগ দান করা হয়। তাহলে এখানে মুক্তিদেবী করোজোড়ে যদি ভক্তের কাছে প্রার্থনা করে যে আমাকে সেবা করার সুযোগ দান করুন, তাহলে ভক্ত হয়ে সেই মুক্তি কেন গ্রহণ করবেন? মহাপ্রভু তাদের বোঝালেন তোমরা ভক্তির মাধ্যমে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা করছো, এটা প্রকৃতপক্ষে ভক্তির লক্ষণ নয়। তাহলে ভক্তির উদ্দেশ্য কি? ভক্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রেম।

ভগবানের প্রতি প্রেম অর্জন করাই হচ্ছে ভক্তির একমাত্র উদ্দেশ্য এবং সেই প্রেমভক্তি হচ্ছে শুদ্ধভক্তির চরম স্তর। তাহলে দেখা যাচ্ছে ভক্তি তিন রকমের। যথা কর্মমিশ্রা, জ্ঞানমিশ্রা শুদ্ধভক্তি এবং এই শুদ্ধভক্তির চরম স্তরই হল প্রেমভক্তি। এই প্রেমভক্তি দান করতেই মহাপ্রভু এসেছেন। প্রেমভক্তি লাভের উপায় হচ্ছে শুদ্ধ চিত্তে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ কীর্ত্তন করা।
''হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।''
এই শুদ্ধভক্তি অত্যন্ত অপূর্ব বস্তু এবং এই শুদ্ধভক্তি যে কোন ব্যক্তি লাভ করতে পারে।
''যেই ভজে সেই বড় অভক্তহীন ছার।
কৃষ্ণভজনে নাহি জাতিকুলাদি বিচার।।'' (চৈঃ চঃ অন্ত /৬৭)
এখানে বলা হচ্ছে, যেই ভজে সেই বড়। এখানে কোন রকম উপাধির বিচার নেই।

''সর্বোপাধিবিনির্মুক্তং তৎপরত্বেন নির্মলম্।
হৃষীকেণ হৃষীকেশ-সেবনং ভক্তিরুচ্যতে।।'' (নারদ পঞ্চরাত্র)

অর্থাৎ,- যখন আমরা কৃষ্ণভাবনাময় হই, তখন আমরা সব রকম মিথ্যা উপাধি থেকে মুক্ত হই; এবং শ্রীকৃষ্ণের সেবায় যুক্ত হওয়ার ফলে আমাদের দর্শন, স্পর্শন, ঘ্রাণ আদি সমস্ত ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়াগুলি নির্মল বা পবিত্র হয়। তখন আমরা সর্বত্রই শ্রীকৃষ্ণকে দর্শণ করতে পারি। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের চক্ষু নির্মল না হচ্ছে, ততক্ষণ আমরা শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন  করতে পারি না। কিন্তু ভগবানের সেবার মাধ্যমে যখন তা পবিত্র হয়, তখন আমরা শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করতে পারি। তখন শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া আর কিছুই দর্শন হয় না। সেটি সমস্ত উপাধি-মুক্ত। মহাপ্রভু সেই সম্বন্ধে বলেছেন যে
''নাহং বিপ্রো নরপতির্নাপি বৈশ্যো শূদ্রো
নাহং বর্ণী গৃহপতির্নো বনস্থো যতির্বা।
কিন্তু প্রোদ্যন্নিখিলপরমানন্দপূর্ণামৃতাব্ধে-
র্গোপীভর্তুঃ পদকমলয়োর্দাসদাসানুদাসঃ।।''  (পদ্মাবলী ৭৪)

আমি ব্রাহ্মণ নই, ক্ষত্রিয় রাজা নই, বৈশ্য বা শুদ্র নই, ব্রহ্মচারী নই, গৃহস্থ নই, বানপ্রস্থ নই, সন্ন্যাসীও নই। আমার একমাত্র পরিচয় হচ্ছে গোপীভর্তা যে কৃষ্ণ, সেই গোপীজনবল্লভ শ্রীকৃষ্ণচন্দ্রের দাসের অনুদাসের দাস। আর সেটিই হল বৈষ্ণবের প্রকৃত পরিচয়।

হে আমার প্রাণোধন কৃষ্ণ তুমি আমাদের হৃদয়ে ভক্তির ভাব জাগিয়ে দাও। সবাই একমনে তন্ময় হয়ে শ্রীহরিনাম জপ করুন,-
''হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।''
🌺🌹জয় নিতাই জয় গৌরসুন্দর 🌹🌺🌹 জয় নিতাই জয় গৌরসুন্দর 🌹🌺

No comments:

Post a Comment

🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴🌴🌳 🌻🌼 শ্রীবলরামের রাসযাত্রা 🌹 শ্রীকৃষ্ণের বসন্তরাস 🌼🌻 🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴...