জীবের স্বরূপ হয় কৃষ্ণ নিত্য দাস
জীবের স্বরূপ হয় সর্বদা নিত্যকৃষ্ণ দাস।
সেই দাসত্ব বরণ করে জীব করে আনন্দে অভিলাষ।।
যেই জীব এই দাসত্ব নিজ মস্তকে ধারণ করে।
সেই প্রকৃত জ্ঞানী শাস্ত্রে মহাজনেরা বলে।।
যার হৃদয় সর্বদা কৃষ্ণ দাসত্বতে রত।
তার হৃদয়ে কৃষ্ণ সর্বদা আনন্দ অবিরত।।
কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলে দাস করে কৃষ্ণ সেবা।
দাসের সেবা পেয়ে কৃষ্ণ হয়ে যায় আত্মহারা।।
শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর কৃপা যদি আমাদের হয়, তাহলে আমরা কৃষ্ণের কৃপা, জগন্নাথের কৃপা লাভ করতে পারব ।
‘’হেন নিতাই বিনে ভাই রাধাকৃষ্ণ পাইতে নাই
দৃঢ় করি ধর নিতাই পায় I I‘’
দৃঢ় করি ধর নিতাই পায় I I‘’
দৃঢ় করে নিতাইয়ের চরণ ধরতে হবে ! বহু যোনি ভ্রমণ করতে করতে আমরা এই মনুষ্য জন্ম লাভ করেছি ।
‘’ব্রহ্মাণ্ড ভ্রমিতে কোন ভাগ্যবান্ জীব ।
গুরু-কৃষ্ণ-প্রসাদে পায় ভক্তিলতা - বীজ ॥‘’
গুরু-কৃষ্ণ-প্রসাদে পায় ভক্তিলতা - বীজ ॥‘’
(চৈঃ চঃ ২/১৯/১৫১)
এই ব্রহ্মাণ্ড ভ্রমণ করতে করতে কোনো
ভাগ্যবান জীব যদি গুরু-কৃষ্ণ প্রসাদে ভক্তিলতা-বীজ পেয়ে সেই ভক্তির বীজটা যদি ঠিক মত লালনপালন করে কল্পবৃক্ষ পর্যন্ত করা যায়, তাহলে আমাদের জীবন স্বার্থক হয়ে যাবে । যাঁকে নিত্যানন্দ প্রভু কৃপা করেছেন, তাঁদের কৃষ্ণ কৃপা লাভ হবে । এটা মনে রাখতে হবে । আরও একটা কথা হচ্ছে যে, ভক্ত হতে হলে, ভক্তের দাস প্রথম হতে হবে । আমরা মঠে বা এই লাইনে এসেছি ভক্ত হতে নয়—আমাদের ভক্তের দাস হতে হবে । এটা মনে রাখতে হবে । আমরা বৈষ্ণব হতে নয়, বৈষ্ণবের দাস হতে এসেছি ।
ভক্তি কার সবচেয়ে বেশী আছে ? ব্রজগোপীদের । কিন্তু সেই ব্রজগোপীরা কী বলেন ? এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা, মন দিয়ে এটা বুঝতে হবে । গোপীরা বলেন, “আমাদের কিছুই কৃষ্ণভক্তি নেই ! যে ভক্তি প্রহ্লাদ মহারাজের আছে (তাঁর ভক্তি দ্বারা কৃষ্ণ একবারে নরসিংহরূপ নিয়ে চলে এসেছেন !), সেরকম ভক্তি আমাদের হয় না । আমাদের কবে সেরকম ভক্তি হবে ?” ওঁদের এত ভক্তি কিন্তু তাঁরা নিজেরা বলেন যে, আমাদের কোন ভক্তি নেই ।
যে ভক্ত হয়, তাঁর লক্ষণ হচ্ছে যে, সে কখনও বলবেন না, “আমি বৈষ্ণব হয়ে গেছি !” বা “আমি ভক্ত হয়ে গেছি”, “আমি কিছু বড় হয়েছি”—যে সত্যিকারের বৈষ্ণব হয়, সে ভাবছেন, “আমার কোন যোগ্যতা নেই । আমি অধম পতিত জীব ।” আমরা কীর্ত্তনেও গাই, “যোগ্যতা বিচারে কিছু নাহি পাই তোমার করুণা সার ।” আমাদের এটা সব সময় মনে রাখতে হবে । “আমার কিছু নেই, কিছু দেওয়ার মত নেই । প্রভু, আমি তোমার দাসের যদি ধূলিকনা হয়ে থাকতে পারি, সেটা তো যথেষ্ট । আমি বড় কিছু হতে চাই না ।”
'আমি ত' বৈষ্ণব', এ বুদ্ধি হইলে অমানী না হ'ব আমি ।
নিজেকে বৈষ্ণব বলে মনে করলে আমরা অপরকে সম্মান করতে পারব না । শুধু সেবা করতে হবে । “আমি গুরু হয়ে গেছি, আমাকে সবাই সেবা করবে”—সেটা ভুল সিদ্ধান্ত । মহাপ্রভু সেটা নিজেই শিখিয়ে দিয়েছেন : ভগবান হয় তিনি নিজে সেবা করেছেন, তিনি প্রত্যেক জায়গায় গিয়ে হরিনাম প্রচার করেছেন । ভগবান তাঁর নিজের জায়গায় বসে থাকতে পারতেন (নারায়ণ যেমন এক জায়গায় বসে আছেন), কিন্তু আমার গৌরহরি, আমার প্রভু নিজে আচরণ করে সব জায়গায় গিয়ে হরিনাম বিতরণ করেছেন ।
কে কীর্ত্তন করতে পারেন ? কার সেরকম অধিকার আছে ?
‘’দৈন্য, দয়া, অন্যে মান, প্রতিষ্ঠা বর্জ্জন ।
চারিগুণে গুণী হই করহ কীর্ত্তন ॥‘’
চারিগুণে গুণী হই করহ কীর্ত্তন ॥‘’
দৈন্য হইতে হবে । দয়া থাকতে হবে । অপরকে সম্মান করতে হবে । প্রতিষ্ঠা বর্জ্জন করতে হবে—কোন নাম, যশ অর্জন করার কোন কিছু দরকার নেই ।
আমরা কেন ধামে যাচ্ছি ? ধামে সেবা করতে । ধামে গিয়ে সেবা কি করে করব ? ঘরের মধ্যে বসে ঘুমানো আর গল্প করা নয় । ঘুম আসতে পারে, আপনারা ঘুমোবেন কিন্তু পাঠ কীর্ত্তন বসে শুনবেন, আরতির সময় ঠাকুরের দর্শন করবেন । আমরা যাচ্ছি তীর্থ যাত্রা করতে নয়—আমরা যাচ্ছি ধামের সেবা করতে । তীর্থযাত্রা পরিশ্রম কেবল মনের ভ্রম,
‘সর্ব্বসিদ্ধি গোবিন্দচরণ।'
‘সর্ব্বসিদ্ধি গোবিন্দচরণ।'
শ্রীলভক্তিবিনোদ ঠাকুরও কত সুন্দর করে লিখেছেন :
মন, তুমি তীর্থে সদা রত ।
অযোধ্যা, মথুরা, মায়া, কাশী, কাঞ্চী, অবন্তীকা,
দ্বারাবতী আর আছে যত ॥
তুমি চাহ ভ্রমিবারে, এ সকল বারে বারে,
মুক্তিলাভ করিবার তরে ।
সে কেবল তব ভ্রম, নিরর্থক পরিশ্রম,
চিত্ত স্থির তীর্থে নাহি করে ॥
তীর্থফল সাধুসঙ্গ, সাধুসঙ্গে অন্তরঙ্গ,
শ্রীকৃষ্ণভজন মনোহর ।
যথা সাধু, তথা তীর্থ, স্থির করি, নিজ-চিত্ত,
সাধুসঙ্গ কর নিরন্তর ॥
যে তীর্থে বৈষ্ণব নাই, সে তীর্থেতে নাহি যাই
কি লাভ হাঁটিয়া দূরদেশ ।
যথায় বৈষ্ণবগণ, সেই স্থান বৃন্দাবন,
সেই স্থানে আনন্দ অশেষ ॥
কৃষ্ণভক্তি যেই স্থানে, মুক্তিদাসী সেইখানে,
সলিল তথায় মন্দাকিনী ।
গিরি তথা গোবর্ধন, ভূমি তথা বৃন্দাবন,
আবির্ভূতা আপনি হ্লাদিনী ॥
বিনোদ কহিছে ভাই, ভ্রমিয়া কি ফল পাই,
বৈষ্ণব-সেবন মোর ব্রত ॥
অযোধ্যা, মথুরা, মায়া, কাশী, কাঞ্চী, অবন্তীকা,
দ্বারাবতী আর আছে যত ॥
তুমি চাহ ভ্রমিবারে, এ সকল বারে বারে,
মুক্তিলাভ করিবার তরে ।
সে কেবল তব ভ্রম, নিরর্থক পরিশ্রম,
চিত্ত স্থির তীর্থে নাহি করে ॥
তীর্থফল সাধুসঙ্গ, সাধুসঙ্গে অন্তরঙ্গ,
শ্রীকৃষ্ণভজন মনোহর ।
যথা সাধু, তথা তীর্থ, স্থির করি, নিজ-চিত্ত,
সাধুসঙ্গ কর নিরন্তর ॥
যে তীর্থে বৈষ্ণব নাই, সে তীর্থেতে নাহি যাই
কি লাভ হাঁটিয়া দূরদেশ ।
যথায় বৈষ্ণবগণ, সেই স্থান বৃন্দাবন,
সেই স্থানে আনন্দ অশেষ ॥
কৃষ্ণভক্তি যেই স্থানে, মুক্তিদাসী সেইখানে,
সলিল তথায় মন্দাকিনী ।
গিরি তথা গোবর্ধন, ভূমি তথা বৃন্দাবন,
আবির্ভূতা আপনি হ্লাদিনী ॥
বিনোদ কহিছে ভাই, ভ্রমিয়া কি ফল পাই,
বৈষ্ণব-সেবন মোর ব্রত ॥
“থাকা, খাওয়া, ভাল জায়গা পেলাম না”—এটা সব ক্ষুদ্র স্বার্থ । গুরুমহারাজ বলতেন, “বৃহৎ স্বার্থ পাইতে হইলে, ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করতে হয় ।” ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য আমরা এই জগতে বৃহৎ স্বার্থ কেন হারিয়ে ফেলব ? আপনারা সবচেয়ে বড় স্বার্থ পেতে পারেন : আপনি যেখান থেকে এসেছেন সেখানে যেতে পারেন । নিজের বাড়িতে চলে যেতে হবে ! আমরা বার বার এই সমুদ্রের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছি । মায়াদেবী আমাদের বিষয় সমুদ্রের মধ্যে ফেলে দিলেন আর এখন উপায় কি করে পাওয়া যায় ? আমরা আগে ছাগল, বিড়াল, গরু
হয়ে জন্ম গ্রহণ করলাম—বিভিন্ন দেশে জন্ম গ্রহণ করে এই সংসার সমুদ্রের মধ্যে পড়ে আছি কিন্তু এই জন্মে আমরা কোন ভাগ্যের ফলে গুরুর কাছে এসেছিলাম । যখন মহাপ্রভু নিজে তাঁর গুরুর চরণে এসে গেছেন, তিনি বলেছেন :
‘’সংসার-সমুদ্র হৈতে উদ্ধারহ মোরে ।
এই আমি দেহ সমর্পিলাম তোমারে I I’’
এই আমি দেহ সমর্পিলাম তোমারে I I’’
(চৈঃ চঃ, ১/১৭/৫৪)
আপনারা সাধু-গুরু-বৈষ্ণবের সঙ্গে পরিক্রমা করতে এসেছেন । আপনারা এই সংসার সমুদ্র হইতে উদ্ধার পেতে পারেন—ভগবানের কাছে নিজের বাড়িতে ফিরে চলুন ! ভগবান আপনাদেরকে ডাকছেন, আপনাদেরকে খুঁজছেন কেননা আপনারা তো তাঁর হারানো সন্তান । আপনাদের পিতার বাড়িতে ফিরে যেতে হবে । সেই জন্য আমরা সাধু-সঙ্গে ধাম
পরিক্রমায় করতে করতে কৃষ্ণ-কীর্ত্তন করে থাকি ।
‘’কবে জীবে দয়া হইবে উদয় ।
নিজ সুখ ভুলি' সুদীন-হৃদয় I I’’
নিজ সুখ ভুলি' সুদীন-হৃদয় I I’’
নিজের সুখটা বিলিয়ে দিয়ে অপরের চিন্তা করতে হবে । “আমার কষ্ট হয় হোক, কিন্তু অপরের যেন কষ্ট না হয়,”—এটাকে বলে দয়া । সেই ভাবে আমাদের চিন্তা করতে হবে ।
‘’নিজের পোষণ কভু না ভাবিব রহিব ভাবের ভরে।‘’
“আমি নিজের চিন্তা করব না । আমি ভাল চিন্তা করব ।” কোন চিন্তা করলে হবে না । যদি আপনারা ভগবানের চিন্তা করবেন, ভগবান আপনাদের সব ব্যবস্থা করে দেবেন । কোন চিন্তার কারণ নেই ।
জয় শ্রীলগুরুমহারাজ কি জয় ।
জয় গৌরসুন্দর কি জয় I I
No comments:
Post a Comment