Sunday, March 29, 2020


দিব্য প্রেমময়ী সেবা
বিশেষ পোষ্ট
শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ
সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার দণ্ডবৎ প্রণাম I

ভক্তির মাধ্যমেই ভগবানকে জানা যায়।শ্রীকৃষ্ণের প্রদর্শিত পন্থা ছাড়া আর অন্য কোন ভাবে শ্রীকৃষ্ণকে জানা যায় না, তাই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেই অর্জুনকে বলেছেন,-
''ভক্ত্যা মামভিজানাতি যাবান্ যশ্চাস্মি তত্ত্বতঃ।
ততো মাং তত্ত্বতো জ্ঞাত্বা বিশতে তদনন্তরম্।।''
অর্থাৎ,- ভক্তির দ্বারা কেবল স্বরূপত আমি যে রকম হই, সেরূপে আমাকে কেউ তত্ত্বত জানতে পারেন। এই প্রকার ভক্তির দ্বারা আমাকে তত্ত্বত জেনে, তার পরে তিনি আমার ধামে প্রবেশ করতে পারেন।(গীতা ১৮/৫৫) 

এছাড়াও ভগবান অর্জুনকে বলেছেন,-
''নাহং বেদৈর্ন তপসা দানেন চেজ্যয়া।
শক্য এবংবিধো দ্রষ্ট্রুং দৃষ্টবানসি মাং যথা।।''
অর্থাৎ,- তুমি তোমার দিব্য চক্ষুর দ্বারা আমার যেরূপ দর্শন করছ,  সেই প্রকার আমাকে বেদ অধ্যয়ন, তপস্যা, দান পূজার দ্বারা কেউই দর্শন করতে সমর্থ হয় না।(গীতা ১১/৫৩ )

 ‘’ভক্ত্যা ত্বনন্যয়া শক্য অহমেবংবিধোহর্জুন।
জ্ঞাতুং দ্রষ্টুং তত্ত্বেন প্রবেষ্টুং পরন্তপ।।‘’
অর্থাৎ,- হে অর্জুন! হে পরন্তপ! অনন্য ভক্তির দ্বারাই কিন্তু এই প্রকার আমাকে তত্ত্বত জানতে, প্রত্যক্ষ করতে এবং আমার চিন্ময় ধামে প্রবেশ করতে সমর্থ হয়।(গীতা ১১/৫৪)

তাহলে অর্জুন কিভাবে লাভ করলেন প্রশ্ন মনে জাগবে। তার উত্তর হচ্ছে অর্জুন ভগবানের ভক্ত ছিলেন।
'' এবায়ং ময়া তেহদ্য যোগঃ প্রোক্তঃ পুরাতনঃ।
ভক্তোহসি মে সখা চেতি রহস্যং হ্যেতদুত্তমম্।।''
অর্থাৎ,- সেই সনাতন যোগ আজ আমি তোমাকে বললাম, কারণ তুমি আমার ভক্ত সখা এবং তাই তুমি এই বিজ্ঞানের অতি গূঢ় রহস্য হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে।(গীতা /)

এমনকি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এক সময় শ্রীবাস ঠাকুরকে বললেন, “শ্রীবাস, আজকে কীর্ত্তনে  আনন্দ পাচ্ছি না কেন?”  তখন শ্রীবাস ঠাকুর বললেন, প্রভু একজন পয়ঃ বা দুধ পানকারী নিষ্ঠাবান ব্রহ্মচারী এসেছেন। তখনপ্রভুবললেন, “পয়ঃ পানে মোরে নাহি পায় আচ্ছা শ্রীবাস তুমি বল,
গজেন্দ্র বানর গোপে কি তপ করিল।
বল দেখি, তারা মোরে কেমতে পাইল।।
তখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু স্থাপন করলেন ভক্তির মাধ্যমেই কেবল তাঁকে জানতে পারবে। সে যে কেউ হতে পারে অন্য কোন উপায়ে নয়। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাতেও সে কথা প্রতিপন্ন করে উল্লেখ আছে,-
''মাং হি পার্থ ব্যপাশ্রিত্য যেহপি স্যুঃ পাপযোনয়ঃ।
স্ত্রিয়ো বৈশ্যাস্তথা শূদ্রাস্তেহপি যান্তি পরাং গতিম্।।''

অর্থাৎ,- হে পার্থ! যারা আমাকে বিশেষভাবে আশ্রয় করে, তারা স্ত্রী, বৈশ্য, শুদ্র আদি নীচকুলে জাত হলেও অবিলম্বে পরাগতি লাভ করে।(গীতা /৩২)

এখন কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, কিভাবে ভক্তি লাভ করা যায়? তার উত্তর হচ্ছে, ভগবান কাউকে সরাসরি ভক্তি দান করেন না। যদি ভগবান ভক্তিদান করেন তাহলে আপনি সহজেই বলবেন, ভগবান আমাকে ভক্তি দেননি তাই করিনি। সেই জন্য ভগবানভক্তিসম্পত্তি গচ্ছিত রেখেছেন ভক্তের কাছে। ভক্তের কৃপায় আপনি ভক্তি লাভ করতে পারেন।

ভক্তিশব্দটির মূল উৎস হচ্ছেভজধাতু, যার অর্থ হচ্ছেভগবানের দিব্য প্রেমময়ী সেবা’’  এখন ভক্তের কৃপা আপনি সরাসরি লাভ করতে পারেন; পূর্ব জন্মের সুকৃতির ফলে লাভ করতে পারেন বা পরম্পরা ক্রমেও লাভ করতে পারেন। উদাহরণ স্বরূপ ভাগবতের প্রথম স্কন্ধে নারদ মুনি বলেছেন, যদিও আমি দাসীপুত্র ছিলাম, ছোট ছিলাম, পড়াশুনা ছিল না, কিন্তু আমার কয়েকটি গুণ ছিল, আমি ) সংযত ছিলাম, ) খেলাধূলার প্রতি উদাসীন ছিলাম, ) আমি দূরন্ত ছিলাম না,  ) আমি প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলতাম না,  ) সর্বশেষে আমিঅনুবর্তিনিঅর্থাৎ বাধ্য ছিলাম। সেই কারণে বেদজ্ঞ ঋষিরা চলে যাওয়ার সময় আমাকে সরাসরি কৃপা করলেন। তার ফলে আমি ভক্তি লাভ করেছি। (ভাঃ //২৪-২৫)

যদি কোন ব্যক্তির মধ্যে উপরি উল্লিখিত চারটি গুণ না থাকলেও যদি একটি গুণ বিশেষভাবেঅনুবর্তিনিঅর্থাৎ সাধু - গুরু - বৈষ্ণবের কথায় শ্রদ্ধা থাকে তা হলেই খুব সহজে ভক্তি লাভ করা যাবে। চৈতন্যভাগবত মধ্যখণ্ডে দ্বিতীয় অধ্যায়ে উল্লেখ আছে- চৈতন্য মহাপ্রভু ভক্তদের দেখলেই প্রণাম করতেন আর ভক্তরাতোমার হউক ভক্তি কৃষ্ণের চরণে’’ - বলে আশীর্বাদ করতেন।  নিমাই ভক্তি লাভের জন্য নিজ ভক্তদের কাপড় ধুয়ে দিতেন।
''হরি - গুরু - বৈষ্ণব তিনিহেঁ স্মরণ।
তিনেহেঁ স্মরণ হইতে বিঘ্ন বিনাশন।।
অনায়াসে হয় নিজ বাঞ্ছিত পূরণ ।।''

পূর্ব জন্মে গজেন্দ্র ইন্দ্রদ্যুম্ন নামক তামিল দেশের রাজা ছিলেন। কিন্তু সেই জীবনে ভগবানের খুব স্তুতি করতেন। পরবর্তী জীবনে কুমীরের দ্বারা আক্রান্ত হলেও সেই স্তোত্র স্মৃতি পথে জাগরিত হলো। ভগবান এসে উদ্ধার করলেন। পূর্ব জন্মের সুকৃতির ফলে গজেন্দ্র ভক্তি লাভ করলেন। যদিও তিনি পশু শরীরে ছিলেন। ঠিক তেমনি পরম্পরাক্রমে যাজ্ঞিক ব্রাহ্মণপত্নীগণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রূপ - গুণ শুনেছিলেন। যখনই শুনলেন কৃষ্ণ - বলরাম ক্ষুধায় অত্যন্ত কাতর হয়ে অন্ন প্রার্থনা করেছেন, সঙ্গে সঙ্গে দ্বিজপত্নীগণ তাঁদের দর্শন করার জন্য এবং তাঁদের সেবা করার জন্য উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠলেন। ভগবান তাঁদের সেবা গ্রহণ করে তাঁদের কৃপা করলেন।

এমনকি যদি ভক্তদের দেখে কেউ অনুসরণ করার ইচ্ছা করেন তাতেও ভক্তি লাভ করতে পারেন।  এমনকি ভগবদ্ধামে ফিরে যেতে পারেন। তার একটি উদাহরণ শ্রীল প্রভুপাদ ব্যবহার করতেন।  এটি পুরাণের কাহিনী। খুব শিক্ষাপ্রদ। তাই শ্রীল প্রভুপাদ স্থান কাল ভেদে ব্যবহার করতেন। এক সময় এক দুষ্ট প্রকৃতির মানুষ গ্রামে বাস করত এবং সকলকে জ্বালাতন করত। শেষে মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলে চাকরকে ডেকে বলল, “তুমি একটা জপ মালা কিনে নিয়ে এসো তাড়াতাড়ি।‘’ চাকর মালিকের কথা মতো বাজার থেকে জপ মালা নিয়ে যখন বাড়ীতে ফিরল তার পূর্বেই মালিক মারা গেল। এমতাবস্থায় যমদূত বিষ্ণুদূত উভয়েই এসেছেন। কথা প্রসঙ্গে বিষ্ণুদূত বললেন, যদিও সারা জীবন পাপ কর্ম করেছে কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে ভক্তদের দেখে হরিনাম করার ইচ্ছা করেছে। তাই তার মৃত্যুর সময় ভগবানের নাম মনে পড়েছে এবং চেতনা নামের চিন্তায় কৃষ্ণ - উন্মুখী ছিল তাই বৈকুণ্ঠে যাবে। যমরাজের দূতেরা প্রণাম করে চলে গেলেন। 

শ্রীমদ্ভাগবতের ষষ্ঠ স্কন্দে উল্লেখ আছে,- যমরাজ বলছেন, “হে দূতগণ, যারা শ্রীকৃষ্ণের নাম - গুণগান করে না, যারা শ্রীকৃষ্ণের চরণে প্রণাম করে না, যারা মনুষ্য জীবনের একমাত্র কর্তব্য বিষ্ণু ব্রত করে না, তাদেরকে আমার কাছে নিয়ে এসো। (ভাঃ //২৯)  কখনও কখনও আমরা দেখি ভক্তরা অহৈতুকী ভাবেও কৃপা করে থাকেন, যেমন চৈতন্য চরিতামৃতে একটি কাহিনী আছে, নারদমুনি অহৈতুকীভাবে মৃগারি ব্যাধকে কৃপা করলেন।

শ্রীল প্রভুপাদ যখন বিদেশে প্রথম প্রচারে গিয়েছিলেন তখন অহৈতুকীভাবে পাশ্চাত্যবাসীদের কৃপা করেছিলেন। সিদ্ধান্ত খণ্ডন করার জন্য দুষ্ট বুদ্ধিতে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, ভক্তদের অহৈতুকী কৃপা হলে তবে ভক্তি লাভ করব। এই সম্বন্ধে শ্রীল প্রভুপাদ এক সময় প্রবচন কালে বলেছিলেন আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে যে, আমরা মানুষ,পশু নই। তাই আমরা ইচ্ছানুসারে দেহটিকে ব্যবহার করতে পারি। আর সব থেকে বড় ভাগ্যের ব্যাপার আমরা ভারতবাসী। আমাদের মাঠে - ঘাটেও ধর্ম নিয়ে আলোচনা হয়। গীতার ত্রয়োদশ অধ্যায় অনুযায়ী ভগবান (গীতা ১৩/)  আপনাকে একটি দেহ স্বরূপ জমি দিয়েছেন এবং তার মালিক আপনি।  এখন এই জমিতে আপনি ভক্তির বীজ স্বরূপ উৎকৃষ্ট ফসল চাষ করতে পারেন, ভাল চাষীর পরামর্শে অর্থাৎ ভাল সাধুর পরামর্শে। নতুবা ইন্দ্রিয় সুখ ভোগ স্বরূপ নিকৃষ্ট ফসল চাষ করতে পারেন। 

উৎকৃষ্ট ফসল হিসেবে আপনি বুঝতে পারবেন- “আমি কৃষ্ণের নিত্য দাস’’ তাঁর সেবা করাই আমার ধর্ম। আর নিকৃষ্ট ফসল হিসেবে আপনি বুঝতে পারবেন- “এই শরীরটিই আমি’’ অর্থাৎ শরীর কেন্দ্রিক সব কিছু করব। সিদ্ধান্ত এই যে, আমরা যদি দেহের প্রয়োজনের সংগ্রামেই ব্যস্ত থাকব, তাহলে পশু ছাড়া আর কিছুই নই। কারণ- আহার, নিদ্রা, ভয়, মৈথুন পশু-প্রবৃত্তি।  কিন্তু যেহেতু আমি একজন সত্যিকারের সৎ মানুষ, তাই আমি ভগবানকে জানবার জন্য, তাঁকে ভক্তি করার জন্য দেহটিকে ব্যবহার করব।

আমরা যদি শাস্ত্রের কথা অবহেলা করব তাহলে আমাদের কষ্ট পেতে হবে।  সে সম্বন্ধে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন,
‘’যঃ শাস্ত্রবিধিমুৎসৃজ্য বর্ততে কামকারতঃ।
সিদ্ধিমবাপ্নোতি সুখং পরাং গতিম্।।‘’
অর্থাৎ,-  যে শাস্ত্রবিধি পরিত্যাগ করে কামাচারে বর্তমান থাকে, সে সিদ্ধি, সুখ অথবা পরাগতি লাভ করতে পারে না।(গীতা ১৬/২৩)

কৃষ্ণভক্তি করাটা খুব কঠিন নয়, খুব সহজ। যেমন একটি তালা  চাবিটি দিয়ে বামদিকে ঘোরাবেন তালা বন্ধ হয়ে যাবে আর ডানদিকে ঘোরাবেন তালা খুলে যাবে। আপনি যখন কৃষ্ণকেন্দ্রিক কিছু করবেন সেটিই ভক্তি হয়ে গেল। কৃষ্ণকেন্দ্রিক সব কিছু কিভাবে করবেন মঠবাসী সন্ন্যাসী বা ভক্তদের কে জিজ্ঞাসা করবেন, উত্তর পেয়ে যাবেন। আপনি জীবনে পরীক্ষা করে দেখুন জীবন আনন্দময় হয়ে উঠবে।

হে আমার প্রাণোধন কৃষ্ণ তুমি আমাদের হৃদয়ে ভক্তির ভাব জাগিয়ে দাও। সবাই একমনে তন্ময় হয়ে শ্রীহরিনাম জপ করুন,-
''হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।''
🌺🌹জয় নিতাই জয় গৌরসুন্দর 🌹🌺🌹 জয় নিতাই জয় গৌরসুন্দর 🌹🌺

No comments:

Post a Comment

🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴🌴🌳 🌻🌼 শ্রীবলরামের রাসযাত্রা 🌹 শ্রীকৃষ্ণের বসন্তরাস 🌼🌻 🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴...