Saturday, March 28, 2020


অনন্য ভক্তি
বিশেষ পোষ্ট
শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ
সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রীচরণে আমার দণ্ডবৎ প্রণাম I
''হরি - গুরু - বৈষ্ণব তিনিহেঁ স্মরণ।
তিনেহেঁ স্মরণ হইতে বিঘ্ন বিনাশন।।
অনায়াসে হয় নিজ বাঞ্ছিত পূরণ ।।''

'অনন্য' অন্য কাউকে নয়, শধু আমাকে। ভগবান গীতায় বিভিন্ন স্থানে অনন্য ভক্তির অনেক মহিমা গীত করেছেন।যেমন দুস্তর মায়া সহজে অতিক্রম করার উপায় একমাত্র অনন্য শরণাগতি। অনন্যচেতা ব্যক্তির কাছে আমি সুলভ। অনন্য ভক্তির দ্বারাই পরম পুরুষকে লাভ করা যায়। অনন্য ভক্তের যোগক্ষেম আমি বহন করি। অনন্য ভক্তির সাহায্যেই ভগবানকে জানা, দেখা প্রাপ্ত করা সম্ভব হয়। অনন্য ভক্তদের আমি অতি শীঘ্র উদ্ধার করি। অনন্য ভক্তিই গুণাতীত হওয়ার উপায়। এইভাবে অনন্য ভক্তির মহিমা বলে ভগবান সম্পূর্ণ গীতার সার বলেছেন
''সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।।''(গীতা ১৮/৬৬)

অর্থাৎ,- সর্ব প্রকার ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরণাগত হও। আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করব। তুমি শোক করো না,অর্থাৎ উপায় উপেয়, সাধন সাধ্য - সবই আমি।

‘’দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া
মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে।।‘’ (গীতা /১৪)

অর্থাৎ,- আমার এই দৈবী মায়া ত্রিগুণাত্মিকা এবং তা দুরতিক্রমণীয়া। যাঁরা শুধুমাত্র  আমার শরণাগত হন, তাঁরা এই মায়া অতিক্রম করতে পারেন।

'মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে',- মানুষের মধ্যে যাঁরা কেবল আমার শরণাগত হন, তাঁরা এই মায়া অতিক্রম করেন। কারণ তাঁদের লক্ষ্য শুধু আমার দিকে থাকে, ত্রিগুণের দিকে নয়। যেমন, সত্ত্ব - রজ - তম এই তিন গুণ আমাতে অবস্থিত নয় এবং আমিও এগুলিতে অবস্থান করি না। আমি নির্লিপ্ত থেকে সকল কর্ম করি যাঁরা আমার এই স্বরূপ জানেন, তাঁরা গুণাদিতে আবদ্ধ হন না এবং মায়া অতিক্রম করতে পারেন।

এখানে 'মামেব' বলার অর্থ হল, তাঁরা অনন্য ভাবে কেবল আমারই শরণাত হন; অন্য কারো নয়। কারণ আমি ছাড়া যে আর কোনো সত্তাই নেই তাঁরা তা জানে। যাঁরা শুধু আমারই স্মরণ নেন, তাঁরা পার হয়ে যান। মায়ার আশ্রয় নিও না অর্থাৎ টাকা -পয়সার জিনিসপত্র ইত্যাদি সবই থাক, কিন্তু এগুলিকে নিজের আধার বলে যেন না মনে করি, এদের আশ্রয় না গ্রহণ করি, এদের বিশ্বাস না করি আর এদের ওপর গুরুত্ব যেন না দিই। এগুলির ব্যবহারের অধিকার আমাদের আছে। কিন্তু এগুলোর ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য যেন না থাকে। গুলির উপর আধিপত্য করাই হলো এদের ওপর আশ্রিত হওয়া। আশ্রিত হলে এগুলির প্রভাব থেকে পৃথক হওয়া শক্ত হয়ে পড়ে।

'দূরত্যয়া ' মায়া সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ এই তিন গুণের সমষ্টি বলে গুণময়ী, এবং ঈশ্বরের স্বভাবভূতা বলে দৈবী। এই মায়াকে অতিক্রম করা বড় কঠিন, অর্থাৎ শত শত বার অতিক্রমের চেষ্টা করে, একে অতিক্রম করা যায় না, তাই দুরত্যয়া (দুস্তরা) কারণ মায়া এমনই জিনিষ যে, যতই মায়া বন্ধন মোচনের চেষ্টা করা যায়, ততই জড়িয়ে পড়তে হয়। তাই একে ত্যাগ করার বৃথা চেষ্টা না করে অনন্য ভাবে ভগবানকে জানার মাধ্যমেই কেবল মায়া বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায়।

‘’অনন্যচেতাঃ সততং যো মাং স্মরতি নিত্যশঃ
তস্যাহং সুলভঃ পার্থ নিত্যযুক্তস্য যোগিনঃ।।‘’ (গীতা /১৪)

অর্থাৎ,- হে পার্থ ! যিনি একাগ্রচিত্তে কেবল আমাকেই নিরন্তর স্মরণ করেন, আমি সেই নিত্যযুক্ত ভক্তযোগীর কাছে সুলভ হই।
'অনন্যচেতাঃ' যাঁর চিত্ত ভগবান ব্যতীত কোন ভোগ - ভূমি বা কোনো ঐশ্বর্যের দিকে একেবারেই যায় না; যাঁর হৃদয়ে ভগবান ব্যতিরেকে আর কারও স্থান নেই, গুরুত্ব নেই, তাঁকে বলা হয় অনন্যচিত্র। যেমন, প্রতিব্রতা রমণীর প্রতিই ব্রত ধর্ম হয়ে থাকে। স্বামী ছাড়া তার মনে অন্য কোন পুরুষের কথা আসক্তিবসত মনেই আসে না অর্থাৎ 'আমি শুধু ভগবানের আর ভগবানই আমার; আমার আর কেউ নেই এবং আমিও আর কারও নই।'এই ভাব হলেই তিনি 'অনন্যচেতাঃ' হন।

'সততম' মানে নিরন্তন অর্থাৎ ঘুম ভেঙ্গে ওঠা থেকে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত সব সময় যে আমাকে স্মরণ করে; 'নিত্যশঃ' মানে সর্বদা অর্থাৎ এই কথাটি যখন থেকে ধারণা করেছে তখন থেকে আমৃত্যু আমাকে স্মরণ করে।‘তস্যাহং সুলভঃ পার্থ নিত্যযুক্তস্য যোগিনঃ’ সেই নিত্যযুক্ত ভক্তযোগীর কাছে আমি সুলভ হই। 'নিত্যযুক্ত' নিরন্তন ভগবানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকাই ভক্তকে 'নিত্যযুক্ত' বলা হয়। একমাত্র ভগবানই আমার আপন, তিনি ছাড়া এই শরীর, ইন্দ্রিয়াদি, প্রাণ, মন, বুদ্ধি কিছুই আপন নয়- দৃঢ়তার সঙ্গে এটি মেনে নিলে ভগবান সহজলভ্য হন। শরীরাদিকে আপন বলে মনে করলে ভগবান কে সহজে পাওয়া যায় না।

ভগবানের সঙ্গে ভিন্নতা এবং জগত সংসার এর সঙ্গে নিজের একত্ব কখনো হয়নি, কখনো হবে না, হওয়া সম্ভবও নয়। এই নিয়মেই মানুষের ভগবানের সঙ্গে স্বতঃস্বাভাবিক অভিন্নতা থাকে এবং জগত সংসারের সঙ্গে ভিন্নতা থাকে। কিন্তু মানুষ ভ্রমবশত নিজেকে ভগবানের থেকে এবং ভগবানকে নিজের সঙ্গে পৃথক বলে মনে করে এবং নিজেকে শরীর এবং শরীরকে আপন বলে ভেবে থাকে। এই বিপরীত ধারণার জন্যই মানুষ জন্ম মৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হয়। এই বিপরীত ধারণা সর্বতোভাবে দূর হলে ভগবানকে লাভ করা সহজ হয়।

‘’পুরুষঃ পরঃ পার্থ ভক্ত্যা লভ্যস্ত্বনন্যয়া।
যস্যান্তঃস্থানি ভূতানি যেন সর্বমিদং ততম্।।‘’ (গীতা /২২)

অর্থাৎ,- হে পার্থ ! সর্বশ্রেষ্ঠ পরমেশ্বর ভগবানকে ''অনন্য ভক্তি'' মাধ্যমেই কেবল লাভ করা যায়। তিনি যদিও তাঁর ধামে নিত্য বিরাজমান, তবুও সর্বব্যাপ্ত এবং সব কিছু তাঁর মধ্যেই অবস্থিত।

অনন্য ভক্তির তাৎপর্য হলো পরমাত্মা ভিন্ন অন্য কোন দেবতার স্মরণ না করে তাঁর সঙ্গে যুক্ত হওয়া।পরমপুরুষ পরমাত্মাকে কেবল অনন্য ভক্তি দ্বারা লাভ করা যায়।পরমাত্মা ছাড়া প্রকৃতির আর সমস্ত কার্যকে বলা হয় 'অন্য' যে ব্যক্তি সেই 'অন্য' কে পৃথক সত্তা মনে করে তাকে গুরুত্ব দেওয়া, তাতে আসক্ত হয়, তার অনন্য ভক্তি হয় না। ফলে পরমাত্মা প্রাপ্তিতে বিলম্ব হয়। যদি সে পরমাত্মা ব্যতিরেকে অন্য কোনো কিছুরই সত্তা এবং বিশেষত্বকে মেনে না নেয় এবং ভগবানের সম্পর্ক, ভগবানের প্রসন্নতা লাভের আশায় প্রতিটি ক্রিয়া করে, তবে এটিকে অনন্য ভক্তি বলা হয়। এই অনন্য ভক্তি দ্বারাই সে পরম পুরুষ পরমাত্মাকে লাভ করে।

পরমাত্মার ব্যতিরেকে আর কারোরই অস্তিত্ব বা গুরুত্ব মানা উচিৎ নয়। প্রকৃতি এবং প্রকৃতির কার্যাদি জগৎ - সংসারকে অস্তিত্ব দিয়েই কথা বলা যেতে পারে। কারণ মানুষের হৃদয়ে 'এক পরমাত্মা আছেন আর এক জগৎ সংসার আছে' এই কথাটি বদ্ধমূল হয়ে আছে। কিন্তু একমাত্র পরমাত্মতত্ত্বই বাস্তবে সমস্ত দেশ, কাল, বস্তু, ব্যক্তি, ঘটনা ইত্যাদি রূপে বিরাজমান। বরফ, তুষার, বৃষ্টি, কুয়াশা, হিম, নদী, পুকুর, সমুদ্র ইত্যাদি রূপে যেমন এক জলই বিরাজিত, তেমনই জগতেও স্থুল - সূক্ষ্ম কারণ রূপে যা কিছু পরিলক্ষিত হয়, তা সবই কেবল পরমাত্নার তত্ত্ব।
‘’অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্যুপাসতে।
তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্।।'' (গীতা /২২)

অর্থাৎ,- অনন্য চিত্তে আমার চিন্তায় মগ্ন হয়ে, পরিপূর্ণ ভক্তি সহকারে যাঁরা সর্বদাই আমার উপাসনা করেন, তাঁদের সমস্ত অপ্রাপ্ত বস্তু আমি বহন করি এবং তাঁদের প্রাপ্ত বস্তুর সংরক্ষণ করি।

'অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্যুপাসতে' যা কিছু দেখা, শোনা বোঝা যায়, সেগুলি সভি ভগবানেরই স্বরূপ আর তাতে যা কিছু পরিবর্তন হচ্ছে, সেগুলি সবি ভগবানের লীলা। কথা যাঁরা দৃঢ়ভাবে মেনে নেন বা বুঝে নেন তাঁদের ভগবান ছাড়া আর কিছুতে মহৎ বুদ্ধি হয় না। তাঁরা ভগবানে নিত্য যুক্ত হয়ে থাকেন। তাই তাঁদের 'অনন্য' বলা হয়। কেবল ভগবানকেই মহত্ব দেওয়ায়, তাঁকেই প্রিয় ভাবায় তাঁদের দ্বারা স্বত ভগবদচিন্তাই় হয়ে থাকে।

'অনন্য' বলার অপর ভাবটি হল যে তাঁদের সাধন সাধ্য একমাত্র ভগবান অর্থাৎ শুধু ভগবানের শরণাগত হওয়া, তাঁকেই চিন্তা করা, তাঁরই উপাসনা করা এবং তাঁকেই প্রাপ্ত করা। এইরূপ তাঁদের দৃঢ় ভাব হয়। ভগবান ব্যতিরেকে তাঁদের আর অন্য কোনো ভাব থাকে না। কারণ ভগবান ব্যতীত আর সবই বিনাশশীল। সুতরাং ভগবান ছাড়া তাঁদের মনে আর কোনো ইচ্ছা জাগে না, নিজ জীবন নির্বাহের ইচ্ছাও হয় না। তাই তাঁদের 'অনন্য' বলা হয়।তাঁরা খাওয়া-দাওয়া, চলা-ফেরা, কথা-বার্তা ইত্যাদি যা কিছু করেন, তা সবই ভগবানের উপাসনা হয়ে থাকে; কারণ তাঁরা সমস্ত কাজই করেন ভগবানের প্রসন্নতার জন্য।

'তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাম্' যাঁরা অনন্য চিত্তে ভগবানের চিন্তা করেন এবং তাঁরা প্রসন্নতার জন্যই সব কাজ করেন এখানে তাদের 'নিত্যাভিযুক্তানাম' বলা হয়েছে।
'যোগক্ষেমং বহাম্যহম্ ' অপ্রাপ্ত বস্তুর প্রাপ্তি করানোকে বলা হয় 'যোগ' এবং প্রাপ্ত সামগ্রী রক্ষা করাকে বলা হয় 'ক্ষেম' ভগবান বলেছেন যেসব ভক্ত নিত্য আমাতে যুক্ত হয়ে থাকেন, তাঁদের যোগক্ষেম আমি বহন করে থাকি।

ঠিক ভাবে দেখলে বোঝা যায় যে অপ্রাপ্ত বস্তুর প্রাপ্তি কখনোও 'যোগে' বহন করা এবং প্রাপ্ত না করানোও 'যোগে' বহন করা। কারণ ভগবান তাঁর ভক্তদের হিত চান এবং তিনি সেই কাজই করেন যাতে ভক্তদের মঙ্গল হয়। অনুরূপভাবেই প্রাপ্ত বস্তু রক্ষা করাও 'ক্ষেমের' বহন হয় আর রক্ষা না করাও 'ক্ষেমের' বহন। যদি ভক্তের ভক্তি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, তাদের কল্যাণ হতে থাকে তাহলে ভগবান প্রাপ্ত সামগ্রী রক্ষা করেন। কারণ এতেই তাদের ক্ষেম' হয়। প্রাপ্ত বস্তু রক্ষা করলে যদি ভক্তের ভক্তি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত না হয়, তার কল্যাণ না হয়, তাহলে ভগবান সেই প্রাপ্ত বস্তু বিনাশ করে দেন ; কারণ বিনাশ করাতেই তাঁর 'ক্ষেম' হয়। তাই ভগবানের ভক্তগণ অনুকুল প্রতিকুল উভয় পরিস্থিতিতেই পরম প্রসন্ন থাকেন। ভগবানের নির্ভরতা থাকায় তাঁদের এই দৃঢ়বিশ্বাস থাকে যে, যে কোন পরিস্থিতিই আসুক তা সবই 'ভগবদ' প্রেরিত। অতএব 'অনুকূল পরিস্থিতি ভালো আর প্রতিকূল পরিস্থিতি ভালো নয় তাদের এই মনোভাব দূর হয়।তাঁদের কেবল ভাব থাকে যে, ভগবান যা করেছেন তা ঠিক আর যা করেননি তাও ঠিক। ভগবানের যা বিধান তাতেই আমাদের মঙ্গল নিহিত।

হে আমার প্রাণোধন কৃষ্ণ তুমি আমাদের হৃদয়ে ভক্তির ভাব জাগিয়ে দাও। সবাই একমনে তন্ময় হয়ে শ্রীহরিনাম জপ করুন,-
''হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।''
🌺🌹জয় নিতাই জয় গৌরসুন্দর 🌹🌺🌹 জয় নিতাই জয় গৌরসুন্দর 🌹🌺

No comments:

Post a Comment

🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴🌴🌳 🌻🌼 শ্রীবলরামের রাসযাত্রা 🌹 শ্রীকৃষ্ণের বসন্তরাস 🌼🌻 🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴...