Wednesday, March 18, 2020


শ্রীবাস পণ্ডিত
আবির্ভাব
''শ্রীবাস পণ্ডিতো ধীমান যঃ পুরা নারদো মুনিঃ।  
পর্ব্বতাখ্যো মুনিবরো য আসিন্নারদপ্রিয়ঃ। 
শ্রীরাম পণ্ডিতঃ শ্রীমান তৎ কনিষ্ট সহোদরঃ।।
নাম্নাম্বিকা ব্রজে ধাত্রী স্তন্যদাত্রী স্থিতা পুরা।
সৈবেয়ং মালিনী নাম্নী শ্রীবাস গৃহিণীমতা।।''
                                        ---(গৌ.গ. দীপিকা)
কৃষ্ণ লীলায় যিনি নারদ,তিনি গৌর লীলায় শ্রীবাস। নারদের বন্ধু পর্ব্বত মুনি শ্রীবাস পণ্ডিতের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ''শ্রীরাম পণ্ডিত' রূপে অবতীর্ণ।শ্রীবাস গৃহিণী শ্রীমালিনী দেবী ব্রজের ধাত্রী স্তন্য দাত্রী 'অম্বিকা'।

শ্রীবাস পণ্ডিত পঞ্চতত্ত্বের অন্তর্গত শুদ্ধ ভক্ত।শ্রীবাস পণ্ডিতের পূর্ব নিবাস শ্রীহট্ট।পরে নবদ্বীপ আসিয়া গৌরপার্ষদ রূপে গৌরলীলা পুষ্টি সাধন করেন।শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত ও শ্রীচৈতন্যভাগবত পাঠে জানা যায় শ্রীবাস পণ্ডিতের চারি ভাই যথা,-শ্রীবাস পণ্ডিত,শ্রীরাম পণ্ডিত,শ্রীপতি পণ্ডিত ও শ্রীনিধি পণ্ডিত শ্রীমন্মহাপ্রভুর লীলার সঙ্গী ছিলেন। শ্রীবাস পণ্ডিতের পিতা বৈদিক ব্রাহ্মণ শ্রী জলধর পণ্ডিত।

একদিন শ্রীবাস পণ্ডিত পথিমধ্যে শ্রীমন্মহাপ্রভুকে দেখিতে পাইয়া কহিলেন,- ''লোক কৃষ্ণ ভক্তি লাভের জন্য পড়াশুনা করে,যদি সেই কৃষ্ণ ভক্তিই না হইল,সেই রূপ পড়াশুনার লাভ কি,অতএব কালবিলম্ব না করিয়া তুমি কৃষ্ণ ভজন কর।শ্রীমন্মহাপ্রভু নিজ ভক্ত মুখে এই কথা শুনিয়া সানন্দে বলিলেন,- ''তুমি ভক্ত,তোমার কৃপায় আমার নিশ্চয়ই কৃষ্ণভক্তি হইবে।।''

গয়া হইতে প্রত্যাবর্ত্তনের পর শ্রীমন্মহাপ্রভু প্রেমোন্মত্ত হইয়া নানাপ্রকার বিকার প্রদর্শন করিলে শচীমাতা উহা পুত্রের বায়ু রোগ মনে করিয়া মর্মাহত হইলেন। শ্রীবাস পণ্ডিত শ্রীমন্মহাপ্রভুর নিকট পৌঁছিলে,শ্রীমন্মহাপ্রভু তাঁহাকে বলিলেন,- ''আমাকে সকলে বায়ুরোগগ্রস্ত বলিতেছে,তুমি বল আমার কি হইয়াছে ?'' শ্রীবাস পণ্ডিত তদুত্তরে হাসিয়া বলিলেন,- ইহা বড় ভাল কহিলে,-

''তোমার যেমত বাই,তাহা আমি চাই।।  
মহাভক্তিযোগ দেখি তোমার শরীরে।
শ্রীকৃষ্ণের অনুগ্রহ হইল তোমারে।।''

শ্রীমন্মহাপ্রভুর ইচ্ছা ক্রমে প্রতিরাত্রে  শ্রীবাস মন্দিরে শুধু পারিষদগণ লইয়া সংকীর্ত্তন বিলাস আরম্ভ হইল।শ্রীহরিবাসার দিবসে শ্রীবাস অঙ্গনে কীর্ত্তন আরম্ভ হইলে শ্রীমন্মহাপ্রভুর বিবিধ প্রেমবিকার প্রকাশ পাইতে লাগিল।

‘’শ্রীহরি  - বাসরে হরি -  কীর্ত্তন বিধান I
                                     নৃত্য আরম্ভিলা প্রভু জগতের প্রাণ I I
পুন্যবন্ত শ্রীবাস - অঙ্গনে শুভারম্ভ I
                                  উঠিল কীর্ত্তন ধ্বনি গোপাল গোবিন্দ I I
মৃদঙ্গ মন্দিরা বাজে  শঙ্খ করতাল I
                                        সংকীর্ত্তন সঙ্গে সব হইল মিশাল I I
ব্রহ্মাণ্ড ভেদিল ধ্বনি পুরিয়া আকাশ I
                                       চৌদিকের অমঙ্গল যায় সব নাশ I I
চতুর্দ্দিগে  শ্রীহরি - মঙ্গল -  সংকীর্ত্তন I
                                    মাঝে  নাচে জগন্নাথ মিশ্রের নন্দন I I’’

শ্ৰীবাসের ভবনে বহির্দ্বার রুদ্ধ করিয়াই কীৰ্ত্তন হইয়া থাকে। কীৰ্ত্তনদ্বেষী লোকদিগকে বাটীর মধ্যে প্রবেশ করিতে দেওয়া হয় না। পাছে রসভঙ্গ হয় বলিয়া বহিরঙ্গ লোক সকলকে সঙ্কীৰ্ত্তনস্থানে প্ৰবেশাধিকার প্রদান করা হয়না। 

একদিন এক নিষ্ঠাবান ব্ৰাহ্মণ অনেক অনুনয় বিনয়ের পর শ্ৰীবাস পণ্ডিতের অনুমতি পাইয়া সঙ্কীৰ্ত্তনের মধ্যে প্ৰবেশ করিয়াছিলেন। শ্ৰীগৌরাঙ্গ সেই দিবস "সঙ্কীৰ্ত্তনে উল্লাস হইতেছে না" — এইরূপ ছল করিয়া, তাঁহাকে বাটী হইতে বাহির করিয়া দিলেন। আবার পরক্ষণেই, সেই ব্ৰাহ্মণের, তাদৃশ অপমানেও আপনাকে অপমানিত বোধ করার পরিবর্তে, অন্তরে রুচি উৎপন্ন হইয়াছে জানিয়া, তাঁহাকে প্ৰেমালিঙ্গন প্ৰদানে কৃতাৰ্থ করিলেন এই প্রকারে জগতে এই শিক্ষা প্রচার করিলেন যে, অপরাধের নিবৃত্তি না হইলে, কেবল বাহ্য নিষ্ঠায় কৃতাৰ্থ হওয়া যায় না। 
এই ঘটনার পর হইতে আর কেহ কাহাকেও হঠাৎ সঙ্কীৰ্ত্তনে প্রবেশ করাইতে সাহস করিতেন না যদি কেহ কোন দিন কোনরূপে প্ৰবেশ করিয়া গোপনেও সঙ্কীৰ্ত্তন দর্শন করিতেন, প্ৰভু তাঁহাকেও কিঞ্চিৎ শিক্ষা না দিয়া ছাড়িতেন না। 

শ্ৰীবাসপণ্ডিতের শাশুড়ীর ভাগ্যেও একদিন তাহাই ঘটিয়াছিল। শ্ৰীগৌরাঙ্গ ভক্তগণের সহিত অঙ্গনে সংকীৰ্ত্তন  করিতেছেন। শ্ৰীবাসপণ্ডিতের শাশুড়ী সংকীৰ্ত্তন দেখিবেন বলিয়া গোপনে গৃহমধ্যে লুকাইয়া আছেন। শ্ৰীবাস পণ্ডিত পৰ্য্যন্ত বৃত্তান্ত অবগত নহেন। শ্ৰীগৌরাঙ্গ অপরাপর দিনের ন্যায় সেদিনও নিজ আনন্দে নৃত্য করিতেছেন। অন্তৰ্য্যামী প্ৰভু সকলই জানেন, কিন্তু কৌতুক করিবেন বলিয়া বারবার বলিতে লাগিলেন, “আমার সঙ্কীৰ্ত্তনে উল্লাস হইতেছে না কেন ? বোধ হয়, কেহ কোথাও লুকাইয়া আছে।প্রভুর কথা শুনিয়া এবং প্রকৃতই সেদিন কাহারও সঙ্কীর্ত্তনে উল্লাস হইতেছে না বুঝিয়া বাড়ির সর্বত্র অন্বেষণ করা হইল ; কিন্তু কোথাও কাহাকে দেখা গেল না। দ্বিতীয়বার অন্বেষণ করা হইল। এবার শ্ৰীবাসপণ্ডিত নিজের শাশুড়ীকে ঘরের এক কোণে ডোল চাপা দেখিতে পাইলেন। তখন শ্ৰীগৌরাঙ্গের অনুমতি অনুসারে তাঁহাকে গৃহ হইতে বাহির করিয়া দেওয়া হইল। পরে সকলেই যথারীতি সঙ্কীৰ্ত্তনে মত্ত হইলেন এবং পূর্বপূর্ববৎ আনন্দ অনুভব করিতে লাগিলেন।

শ্রীমন্মহাপ্রভু সন্ন্যাস গ্রহণের পর নীলাচলে অবস্থান করিলে প্রতিবৎসর শ্রীবাস পণ্ডিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণের সহিত চাতুর্মাস্য কালে পুরীধামে আসিতেন। শ্রীবাস পণ্ডিত শ্রীমন্মহাপ্রভুর সহিত গুণ্ডিচা মন্দির মার্জ্জন লীলায় রথযাত্রায় অবস্থান করিতেন। রথাগ্রে সাত সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বিতীয় সম্প্রদায়ের মূল গায়ক ছিলেন শ্রীবাস পণ্ডিত;সে সম্প্রদায়ের নর্ত্তক ছিলেন শ্রীমন্নিত্যানন্দ প্রভু।

শ্রীমন্মহাপ্রভু কাটোয়ায় সন্ন্যাস গ্রহণ করিলে শ্রীমন্মহাপ্রভুর বিরহ সহ্য করিতে না পারিয়া শ্রীবাস পণ্ডিত নবদ্বীপ ধাম - বাস পরিত্যাগ পূর্ব্বক জ্ঞাতিবর্গসহ কুমারহট্টে আসিয়া বসবাস করিয়াছিলেন।শ্রীঈশ্বরপুরী পাদের আবির্ভাব স্থানও কুমারহট্টে।শ্রীমন্মহাপ্রভু ঐস্থানে আসিয়া শ্রীঈশ্বরপুরী পাদের জন্মস্থানের মৃত্তিকা লইয়া বহির্ব্বাসে বাঁধিয়াছিলেন। তদবধি আগন্তুক যাত্রী মাত্রই ঐস্থানের মৃত্তিকা ভক্তিভরে গ্রহণ করিতে করিতে ক্রমে উহা ডোবায় পরিণত হয়।উহাই 'চৈতন্য ডোবা' নামে প্রসিদ্ধ।

চৈত্র কৃষ্ণাষ্টমী তিথিতে শ্রীবাস পণ্ডিতের আবির্ভাব এবং আষাঢ় কৃষ্ণা - দশমী তিথিতে তিরোভাব তিথি উদযাপিত হইয়া থাকে।

No comments:

Post a Comment

🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴🌴🌳 🌻🌼 শ্রীবলরামের রাসযাত্রা 🌹 শ্রীকৃষ্ণের বসন্তরাস 🌼🌻 🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴...