Wednesday, March 25, 2020


হিন্দু নব বর্ষ
''হিন্দু নববর্ষ'' চৈত্র শুক্ল প্রতিপদ বিক্রমী সংবত ২০৭৭রে (২৫ মার্চ ২০২০) আপনার সবাইকে জানাই শুভ অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।

হিন্দু বর্ষগণনা পদ্ধতি বর্ষ প্রতিপদ,- 
হিন্দু কাল গণনা পদ্ধতি অনুসারে চন্দ্র চৈত্র মাসের শুক্ল প্রতিপদ তিথিটি বৎসরের প্রথম দিন হিসেবে পরিগণিত হয়। এই দিনটি বর্ষ প্রতিপদা হিসেবে দেশ জুড়ে প্রতিপালিত হয়। ভারতবর্ষের প্রাচীন পরম্পরা অনুসারে দুই ধরণের বর্ষগণনা প্রচলিত আছে। সৌর মান অনুসারে এবং চন্দ্র মান অনুসারে।  উল্লেখ্য, দুই ধরণের বর্ষগণনাই অত্যন্ত যুক্তিসম্মত বৈজ্ঞানিক। চন্দ্র মান অনুসারে শুক্ল পক্ষের প্রতিপদ তিথি থেকে অমাবস্যা পর্যন্ত একটি মাস হয়। সৌর মান অনুসারে সূর্য একটি রাশিতে যত দিন থাকে তত দিনে একটি মাস হয়। অর্থাৎ, পৃথিবীর চন্দ্রের বার্ষিক গতি অনুসারে মাসগুলি নির্ধারণ করা হয়। অপরপক্ষে পাশ্চাত্ত্য বর্ষগণনা পদ্ধতির এরকম কোন সুনির্দিষ্ট আধার নেই। মাসগুলির নামও অত্যন্ত বৈজ্ঞানিক উপায়ে নির্ধারিত হয়। যেমন, যে মাসে পূর্ণিমা তিথিতে চন্দ্র বিশাখা নক্ষত্রে অবস্থিত থাকে সেই মাসটি বৈশাখ মাস, জ্যৈষ্ঠা নক্ষত্রে চন্দ্র থাকলে তাকে জ্যৈষ্ঠ মাস ইত্যাদি। আবার যে মাসে সূর্য মেষ রাশিতে থাকে তাকে মেষ মাস, বৃষ রাশিতে থাকলে বৃষ মাস ইত্যাদি।

ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে প্রান্তীয় পরম্পরা অনুসারে সৌর বা চন্দ্র মানে বর্ষগণনা হয়ে থাকে। রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, গুজরাত, কর্ণাটক, অন্ধ্র প্রদেশ, তেলেঙ্গানা, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাঞ্চল প্রমুখ রাজ্যে বিভিন্ন নামে বর্ষ প্রতিপদা বছরের প্রথম দিন হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। যেমন, মহারাষ্ট্রে গুড়ি পাওয়া, রাজস্থানে থপনা প্রভৃতি। আবার পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, তামিলনাড়ু, পাঞ্জাব, হিমাচল, মণিপুর প্রভৃতি প্রান্তে সৌর মান অনুসারে বর্ষগণনা হয়ে থাকে। এই সমস্ত স্থানে পয়লা বৈশাখ (পশ্চিমবঙ্গ), বিশু (কেরল), সাজিবু নোঙ্গমা পনবা (মণিপুর), সেরি সাজা (হিমাচল), বৈশাখী (পাঞ্জাব) প্রভৃতি নামে বর্ষের প্রথম দিনটি পালিত হয়।

যাই হোক, ভারতবর্ষের অধিকাংশ প্রান্তে চন্দ্র বর্ষগণনাই স্বীকৃত। যে সমস্ত প্রান্তে সৌর বর্ষগণনা প্রচলিত সেই সমস্ত প্রান্তেও এই দিনটিকে সমারোহের সঙ্গেই পালিত হয়ে থাকে। বিভিন্ন প্রান্তে সনাতন হিন্দু সংস্কৃতি অনুসারে পারম্পরিক রীতিতে বিভিন্ন ভাবে এই দিনটি পালিত হয়ে থাকে। যেমন, বিশেষ ধরণের প্রতীকী খাদ্য গ্রহণ বা বর্ষফল শ্রবণ প্রভৃতি। দাক্ষিণাত্যে নিমফুল, গুড়, মরীচ, নুন, তেঁতুল কাঁচা আম দিয়ে তৈরী একরকম খাদ্য ভক্ষণ করা হয়। এই ছয়টি বস্তুর ছয়রকম স্বাদ, যা ছয়টি ভাবনার প্রতীক। নিম (তিক্ত) দুঃখের, গুড় (মিষ্ট) আনন্দের, মরীচ (ঝাল) ক্রোধের, নুন (লবণ) ভয়ের, তেঁতুল (টক) বিরক্তির কাঁচা আম (কষা) বিস্ময়ের প্রতীক। এর মাধ্যমে বার্তা দেওয়া হয় যে, জীবনে বিভিন্ন আবেগ এবং তৎপ্রসূত বিভিন্ন পরিস্থিতির সমাহার। প্রত্যেকটি আবেগের যথাযথ নিয়ন্ত্রণ মিশ্রণেই জীবন সার্থক হয়ে উঠতে পারে।

ব্যক্তি বা সংগঠন উভয় ক্ষেত্রেই এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তির জীবনে যেমন উত্থান পতন আছে সংগঠনও তেমনই চড়াই উতরাই পার করে সাফল্য লাভ করে। যে ব্যক্তি বা সংগঠনের চলার পথে কোন বাধা বিপত্তি আসেনি, যে সর্বদাই কুসুমাস্তীর্ণ মার্গ অতিক্রম করে এগিয়ে গিয়েছে তাকে কোনওভাবেই সফল বলা চলে না। সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে ধ্যেয় লক্ষ্যের উদ্দেশ্যে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে এগিয়ে চলার মধ্যেই সফলতার সৌন্দর্য্য। আমরাও প্রতিদিন প্রার্থনা করিকণ্টকাকীর্ণমার্গং স্বয়ং স্বীকৃতং নঃ সুগং কারয়েৎআমরা স্বেচ্ছায় যে কণ্টকাকীর্ণ মার্গকে বরণ করে নিয়েছি তা আমাদের কাছে সুগম হয়ে উঠুক।

কিন্তু, এই প্রতিবন্ধকতাকে জয় করার জন্য আমাদের সহনশীলতা, বিচক্ষণতা প্রভৃতি গুণাবলীর অনুশীলন, ক্রোধ প্রভৃতি ভাবাবেগের যথাযথ অনুশীলন এবং সর্বোপরি অক্ষয় ধ্যেয়নিষ্ঠা নিতান্ত প্রয়োজনীয়। সামাজিক কার্যকর্তা রূপে সমস্ত স্বয়ংসেবকের বিচক্ষণ সহনশীলতা নিতান্ত জরুরী।
বেদে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করা হয়েছে– ‘’সহঃ অসি সহঃ ময়ি ধেহি, মন্যুঃ অসি মন্যুং ময়ি ধেহি’’– (হে পরমেশ্বর) তুমি সহনশীলতার স্বরূপ আমাকে সহনশীল কর, তুমি ক্রোধ স্বরূপ আমাকে ক্রোধ প্রদান কর।

চৈত্র শুক্ল প্রতিপদের ঐতিহাসিক মাহাত্ব
বর্ষ প্রতিপদার এই পুণ্যতিথি আমাদের সামনে নতুন আশার আলো নিয়ে সর্বদা উপস্থিত হয়েছে। হিন্দু শাস্ত্রে এই তিথিকে সৃষ্টির আরম্ভ রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। হিন্দু রাষ্ট্রের সংস্থাপক ও পরিরক্ষকগণ চিরকাল এই তিথিটিকে একটি বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে পালন করেছেন। সম্রাট বিক্রমাদিত্য এই পুণ্যতিথিতে রাজ্য স্থাপিত করেছিলেন,তাই তাঁহার নামেতে বিক্রমী সংবতের প্রথম দিন আরম্ভ হয়। অধর্মের নাশ করে ধর্মের প্রতিষ্ঠার তিথি হিসেবে এটি পালিত হয়। মহারাজ যুধিষ্ঠির কুরুক্ষেত্রের ধর্মযুদ্ধে অধর্মের প্রতীক কৌরবদের নাশ করার পর নিজের রাজ্যাভিষেকের জন্য এই তিথিটিকে বেছে নিয়েছিলেন। প্রভু শ্রীরাম চন্দ্রের ও রাজ্যাভিষেক এই পুণ্য তিথিতে হয়েছিল।

সুতরাং, বর্ষ প্রতিপদা আমাদের সামনে প্রতি বছর এই ধর্মরাজ্য হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শিক্ষাকে স্মরণ করানোর জন্য উপস্থিত হয়। বর্তমান যুগে পাশ্চাত্ত্যের সাংস্কৃতিক আক্রমণে যখন সমাজ পয়লা জানুয়ারী কিংবা একত্রিশে ডিসেম্বরে লক্ষ্যহীন ভোগসর্বস্বতার যে উদ্দামতায় নিমজ্জিত হয় সেই আক্রমণকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যেও এই তিথিকে সাড়ম্বরে পালন করা প্রয়োজন। এই তিথিতে প্রাচীনদের স্মরণ করে আমরা অন্ধকার থেকে আলোয়, অজ্ঞান থেকে জ্ঞানের পথে চলার নবীন সংকল্প গ্রহণ করে সমাজকে সঠিক পথে চলার জন্য প্রেরিত করব।

No comments:

Post a Comment

🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴🌴🌳 🌻🌼 শ্রীবলরামের রাসযাত্রা 🌹 শ্রীকৃষ্ণের বসন্তরাস 🌼🌻 🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴...