Saturday, March 21, 2020


চাঁদ কাজী উদ্ধার
শ্রী শ্রী গুরু গৌরাঙ্গ জয়তঃ 
সকল সাধু,গুরু,বৈষ্ণব  গৌর ভক্তবৃন্দের শ্রী চরণে আমার দণ্ডবৎ প্রণাম I
''হরি - গুরু - বৈষ্ণব তিনিহেঁ স্মরণ।
তিনেহেঁ স্মরণ হইতে বিঘ্ন  বিনাশন।।
অনায়াসে হয় নিজ বাঞ্ছিত পূরণ ।।''

গয়া থেকে ফিরে সবাই দেখলো যে কৃষ্ণপ্রেমে  নিমাইয়ের হৃদয় উদ্বেল হয়ে উঠেছে। তাঁহার চরিত্রের পরিবর্ত্তন লক্ষ্য করলেন সবাই। তাঁহার হাস্য - কৌতুক,বিদ্যার দম্ভ সব যেন কোথায় হারিয়ে গেল। তাঁহার অন্তরে দেখা দিল সংসার বৈরাগ্য। ছাত্র পড়াতে আর মন নেই বলে তাঁহার টোল বন্ধ হয়ে গেল। তিনি কৃষ্ণনাম - কীর্ত্তনে মেতে উঠলেন। তিনি নিত্যানন্দ,অদ্বৈত আচার্য্য আদি প্রমুখ বৈষ্ণবগণ সঙ্গে শ্রীবাস অঙ্গনে দরজা বন্ধ করে সারারাত্রি কীর্ত্তন করতে থাকেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জনপ্রিয়তা দেখে কিছু ব্রাহ্মণ খুব ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন এবং তারা তাঁর প্রচারকার্যে নানা রকম বিঘ্ন উৎপাদন করতে শুরু করেন। তারা এত ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে পড়েছিল যে, অবশেষে তারা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বিরুদ্ধে নবদ্বীপের মুসলমান চাঁদ কাজীর কাছে নালিশ করেন বঙ্গভূমি তখন পাঠানদের অধীন ছিল এবং তখন বাংলার নবাব ছিলেন হুসেন শাহ চাঁদ কাজী

নবদ্বীপের মুসলমান কাজী ব্রাহ্মণদের সেই অভিযোগটিতে প্রভূত গুরুত্ব দান করেন। প্রথমে তিনি নিমাই পণ্ডিতের অনুগামীদের উচ্চস্বরে হরিনাম সংকীর্ত্তন করতে নিষেধ করেন। কিন্তু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর অনুগামীদের কাজীর সেই নির্দেশ অমান্য করতে নির্দেশ দেন, এবং তাঁরা পূর্বের মতোই সংকীর্ত্তন করে যেতে থাকেন। কাজী তখন সেই সংকীর্ত্তন বন্ধ করার জন্য তাঁর কিছু সৈনিক কর্মচারীকে পাঠান এবং তারা সংকীর্ত্তন কারীদের কয়েকটি মৃদঙ্গ ভেঙে দেয় এবং নাম - সংকীর্ত্তন বন্ধ করা জন্য আদেশ দেন।। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যখন এই ঘটনার কথা শুনতে পান, তখন তিনি মহাক্রোধে সমস্ত ভক্ত বৃন্দকে ডেকে  শ্রীবাস অঙ্গনে একটি সভা আয়োজন করেন। সভাতে সমস্ত ভক্ত বৃন্দকে অভয় দান দিয়ে বলিলেন আজ থেকে দরজা বন্দ করে আর সংকীর্ত্তন হবেনা। আজ থেকে ঘরে ঘরে নগরে নগরে সর্বত্র উচ্চ স্বরে শ্রীহরিনাম সংকীর্ত্তন হবে। সন্ধ্যার সময় তিনি হাজার - হাজার মৃদঙ্গ এবং করতালসহ লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিয়ে এক বিরাট শোভাযাত্রার আয়োজন করেন, এবং কাজীর আইন অমান্য করে এই শোভাযাত্রা নবদ্বীপের পথে পথে হরিনাম কীর্ত্তন করতে করতে কাজীর বাড়ীর দিকে এগিয়ে যায়।

অবশেষে শোভাযাত্রা যখন কাজীর বাড়িতে এসে পৌঁছায়, তখন ভয়ে কাজী তাঁর বাড়ির উপরতলার একটি ঘরে গিয়ে লুকিয়ে থাকেন। সেই বিশাল জনসমাবেশ কাজীর বাড়ির সামনে সমবেত হয়ে প্রচণ্ড ক্রোধ প্রকাশ করতে থাকে, কিন্তু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাদের শান্ত হতে বলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আশ্বাস পেয়ে অবশেষে কাজী তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন এবং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে গ্রাম সম্পর্কে তাঁর ভাগ্নে বলে সম্বোধন করে তাঁকে শান্ত করতে চেষ্টা করেন। তিনি তাঁকে বলেন যে, গ্রাম-সম্পর্কে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মাতামহ শ্রীনীলাম্বর চক্রবর্তী হচ্ছেন তাঁর মামা এবং সেই সূত্রে তাঁর মা শ্রীমতী শচীদেবী হচ্ছেন তাঁর ভগ্নী। তিনি মহাপ্রভুকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘মামার প্রতি ক্রুদ্ধ হওয়া কি ভাগ্নের উচিত?’’ মহাপ্রভু তখন উত্তর দেন যে, যেহেতু কাজী হচ্ছেন তাঁর মামা, তাই তাঁর কর্তব্য হচ্ছে যথাযথভাবে ভাগ্নেকে গৃহে স্বাগত জানান।

শ্রীমন্মহাপ্রভু কাজী কে বললেন,- প্রকৃতপক্ষে কলিযুগে সমস্ত যজ্ঞ নিষিদ্ধ। কেননা সেগুলি মূর্খ লোকদের কতকগুলি অনর্থক প্রয়াস মাত্র। এই কলিযুগের একমাত্র যজ্ঞ হচ্ছে সংকীর্ত্তন যজ্ঞ। অন্যান্য যুগের তুলনায় কলিযুগ অত্যন্ত অধঃপতিত। কলিযুগে ধর্মের পতনের ফলে মানুষের যে কি অবস্থা, সেই সম্বন্ধে শ্রীমদ্ভাগবতে(//১০)বলা হয়েছে,-

 ''প্রায়েণাল্পায়ুষঃ সভ্য কলাবস্মিন্ যুগে জনাঃ।
মন্দাঃ সুমন্দমতয়ো মন্দভাগ্য হ্যপদ্রুতাঃ।।''
অর্থাৎ,- এই কলিযুগের মানুষেরা প্রায় সকলেই অল্পায়ু। তারা কলহপ্রিয়, অলস, মন্দগতি, ভাগ্যহীন এবং সর্বোপরি তারা নিরন্তর রোগ আদির দ্বারা উপদ্রুত।‘’

কৃতে যদ্ধ্যায়তো বিষ্ণুং ত্রেতায়াং ঘজতো মখৈ। দ্বাপরে পরিচর্যায়াং কলৌ তদ্ধরিকীর্ত্তনাৎ।‘’ শ্রীমদ্ভাগবত (১২//৫২)

অর্থাৎ, সত্যযুগে বিষ্ণুকে ধ্যান করে, ত্রেতাযুগে যজ্ঞের মাধ্যমে যজন করে এবং দ্বাপর যুগে অর্চন আদি করে যে ফল লাভ হত, কলিযুগে কেবলমাত্রহরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র’’ কীর্ত্তনে সেই সকল ফল লাভ হয়।

এইভাবে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কাজীকে বোঝালেন, এবং কাজী তখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর চরণাশ্রয় গ্রহণ করলেন। কাজী বললেন যে দিন তার সৈনিক কর্মচারীগণ বৈষ্ণবদের মৃদঙ্গ ভেঙ্গে দেন সেই দিন রাত্রে স্বপ্নে কাজী দেখলেন একটা জীব যাহার আধা শরীর মানুষের আর আধা শরীর সিংহের, সে আমার বুকের উপরে বসে গর্জ্জন করে আমাকে বলছে তুমি আমার মৃদঙ্গ ভেঙেছ আমি তোমার বুককে কেটে দেব,এই বলে তার নখ পঞ্ঝা আমার বুকে চাপ দিয়ে তখন আমি কাপঁতে কাপঁতে হাত জোড় করে অনুরোধ করিলাম আমাকে ক্ষমা কর,আমি আর কখনও মৃদঙ্গ ভাঙব না বৈষ্ণবের নাম - সংকীর্ত্তনে কখনও বাধা দেব না,এই দেখ আমার বুকে  নখ - পঞ্ঝার চিহ্ন। তারপর কাজী ঘোষণা করেছিলেন যে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রবর্তিত সংকীর্ত্তন যজ্ঞে কেউ যেন কখনও বাধা না দেয় এবং তিনি তাঁর উইলে লিখে যান যে, তাঁর বংশের কেউ যদি সংকীর্ত্তনে বাধা দেয়, তা হলে সে তৎক্ষণাৎ বংশচ্যুত হবে।

এইভাবে পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হয় এবং দুই বিদগ্ধ পণ্ডিত কোরান এবং হিন্দু-শাস্ত্র সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনায় প্রবৃত্ত হন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কাজীকে জিজ্ঞাসা করেন, মাতৃবৎ যে গাভী মানুষের উপকার করে আসছে সেই গাভীকে কেন তাঁরা হত্যা করেন এবং তখন কাজী কোরান থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর সেই প্রশ্নের উত্তর দেন। কাজী তাঁকে আরও বলেন যে, বেদেও গো-মেধ যজ্ঞের উল্লেখ রয়েছে। কাজী বলেন-
‘’তোমার বেদেতে আছে গো-বধের বাণী।
অতএব গো-বধ করে বড় বড় মুনি।।‘’

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেন,- বেদে গো-বধ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাই হিন্দুরা কখনই গো-বধ করে না। বেদ এবং পুরাণে নির্দেশ আছে যে, যদি কোন প্রাণীকে নবজীবন দান করা যায়, তা হলে কেবল সেই প্রাণীকে বধ করা যেতে পারে। তাই মুণি-ঋষিরা বৃদ্ধ পশুদের যজ্ঞে বলি দিয়ে সিদ্ধ বেদমন্ত্রে তাদের নবজীবন দান করতেন। এইভাবে তাঁরা জড়দ্গব পশুদের পুনরায় যৌবন প্রদান করতেন। তার ফলে সেটি বধ হত না, পক্ষান্তরে তাদের নবজীবন লাভ হত। কিন্তু কলিযুগের ব্রাহ্মণদের সেই শক্তি নেই, তাই কলিযুগের গো-বধ সর্বতোভাবে নিষিদ্ধ। তিনি তারপর চাঁদ কাজীকে বলেন-
‘’তোমরা জীয়াইতে নার,-বধমাত্র সার।
নরক হইতে তোমার নাহিক নিস্তার।।
গো-অঙ্গে যত লোম, তত সহস্র বৎসর।
গোবধী রৌরব মধে পচে নিরন্তর।।‘’
(শ্রীচৈতন্য-চরিতামৃত আদি লীলা সপ্তদশ পরিচ্ছেদ ১৬৫-১৬৬)

নবদ্বীপে শ্রীধাম মায়াপুরের সন্নিকটে শ্রীচাঁদ কাজীর সমাধি এখনও বর্ত্তমান  আছে এবং ভগবদ্ভক্তরা এখনও সেখানে গিয়ে তাঁদের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন। কাজীর বংশধরেরা এখনও রয়েছেন এবং তাঁরা কখনও সংকীর্ত্তনে বাধা দেন না, এমন কি হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার সময়ও তাঁরা কখনও সংকীর্ত্তন যজ্ঞে বাধা দেননি। এই ঘটনা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নিরীহ বৈষ্ণব ছিলেন না। বৈষ্ণব হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবানের নির্ভীক ভক্ত এবং প্রয়োজন হলে তিনি সিংহ বিক্রমে যথার্থ সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। প্রকৃতিগতভাবে একজন যথার্থ বৈষ্ণব অহিংসা শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করেন এবং তাঁর মধ্যে সমস্ত দিব্য গুণাবলী বর্ত্তমান। কিন্তু অভক্তরা যখন পরমেশ্বর ভগবান বা তাঁর ভক্তদের নিন্দা করেন, তখন তাঁরা কোন মতেই তা সহ্য করেন না।
সদা জপ করুন…

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে I
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে I I

No comments:

Post a Comment

🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴🌴🌳 🌻🌼 শ্রীবলরামের রাসযাত্রা 🌹 শ্রীকৃষ্ণের বসন্তরাস 🌼🌻 🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴...