Saturday, March 7, 2020


জগন্নাথ লীলা
একবার শ্রীশ্রী গৌরসুন্দর সকল ভক্ত লয়ে পুরীতে ওড়ন ষষ্ঠী দেখতে এলেন। এই উৎসবে বিভিন্ন প্রকার বাদ্যযন্ত্র যেমন মৃদঙ্গ, মহুরী, শঙ্খ, দুন্দুভি, কাহাল, ঢাক, ডগর, কাড়া ইত্যাদি গগন বিদারী শব্দে মুখরিত হয়ে উঠেছে। 'ওড়ন ষষ্ঠী ' হতে মকর সংক্রান্তি পর্যন্ত সেই নূতন পোষাক পরিচ্ছেদ জগন্নাথ প্রয়োগ করেন। জগন্নাথ দেবের নীলাভ দেহে শুক্ল, পীত নীলবর্ণের স্বর্ণজরি মুক্তাখচিত রেশমী বস্ত্র অতি শোভা পাচ্ছে। পুষ্পের বালা, পুষ্পমুকুট পুষ্পহার দিয়েজগন্নাথ দেব অলঙ্কৃক আছেন। ষোড়শ উপাচারে যথা গন্ধ পুষ্প, ধুপ, দীপসহ পূজা শেষে বিভিন্ন প্রকারের ভোগ নিবেদন করা হল। প্রেমাবেশে মহাপ্রভু পার্ষদবৃন্দসহ 'ওড়ন ষষ্ঠী' উৎসব শেষ রাত পর্যন্ত দর্শন করলেন। শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভু উপাসক ও উপাস্য(জগন্নাথ) তাঁর কৃপা বিনা কে ঈশ্বরের মন বুঝতে পারে? প্রভু স্বয়ং দারুরূপে যোগাসনে উপবিষ্ট হয়ে, সন্ন্যাসী রূপে ভক্তিযোগ অবলম্বন পূর্বক নিজ নিজের সেবা করেন।

উৎসব শেষে মহাপ্রভু পরমানন্দে নিজ বাসায় প্রত্যাগমন করলেন। ভক্তদের বিদায় দিয়ে তিনি স্বগৃহে বিরলে নিজানন্দে বিভোর হলেন। ভক্তরা যার যে বাসায় গমন করলেন। বিদ্যানিধি স্বরূপ দামোদর যাওয়ার পথে একে অপরকে অকপটে মনের কথা আলাপন করছেন। বিদ্যানিধি মহাশয় স্বরূপ দামোদরের কাছেসন্দেহ ভরে জিজ্ঞাসা করলেন,"এই দেশে শ্রুতি স্মৃতি থাকতে কেন জগন্নাথদেবকে অধৌত মাড় যুক্ত বস্ত্র দেওয়া হয়?" স্বরূপ দামোদর বলছেন, - "শোন, এসব এখানকার দেশাচার; এতে এখানে কোন দোষগ্রহণ করে না। কেন তুমি এটাকে এত গুরুত্ব দিচ্ছ? এর দোষ ধরা তোমার উচিত নয়। শ্রুতি স্মৃতি জানলে সব জায়গায়, সব সময় পালন করতে হবে এমন কথা নেই। এই উৎসব এইভাবে বহুকাল যাবৎ পালিত হচ্ছে। ঈশ্বরের যদি অন্তরে ইহা না চায় তাহলে রাজা কেন নিষেধ করেন না"? "ভাল কথা, ঈশ্বর তাঁর ইচ্ছামত যাকিছু করতে পারেন। তবে সেবক কেন ঈশ্বরের ন্যায় কার্য্য করেন"? 

বিদ্যানিধি বললেন। "পূজারী, পাণ্ডা, শৃঙ্গারকারী সেবক, পড়িছা, বেহারা- তারা কি করে এই অশুদ্ধ বস্ত্র স্পর্শ করে? জগন্নাথ স্বয়ং ঈশ্বর, সব কিছুই তাঁর সম্ভব। তাই বলে সকলেই কি তাঁর আচরণ করবে? মাড়যুক্ত কাপড় স্পর্শ করে, হাত না ধুলে শুদ্ধ হয় না। যদি তারা সকলে সুবুদ্ধি সম্পন্ন তাহলে কেন তারা ইহা করে না? রাজমন্ত্রী যদি এসব বিচার না করেন তাহলে তিনি নির্বোধ। রাজাও বুঝি মাড়যুক্ত বস্ত্র মস্তকে ধারন করেন?" স্বরূপ দামোদর উত্তরে বললেন, -  "শুন ভাই! আমি যত বুঝি এই ওড়ন যাত্রা উৎসবেদোষ নাই। পরমব্রহ্ম জগন্নাথরূপে অবতীর্ণ হয়ে এই সব বিধিনিষেধ বিচার করতে বাধ্য নন। বিদ্যানিধি বললেন, - "আমি স্বীকার করছি জগন্নাথ পরমব্রহ্ম, তিনি যদি বিধি নিষেধ লঙ্ঘন করেন তাতে কোন দোষ আসে না। কিন্তু নীলাচলে বাস করে এই সব সেবকেরাও কি ব্রহ্ম হয়ে গেছে? কেন তারা এই লোকাচার বর্জন করবে? আরে!এখানে সকলেই যে ব্রহ্মের অবতার হয়েছে"!!

সেবকদের দোষ নির্ণয়ের আলোচনায় উভয়ে হাসা-হাসির মাধ্যমে হাতা হাতি করছেন। কেউই জানতেন না জগন্নাথের সেবকদের প্রভাব কত। কিন্তু কৃষ্ণ জানেন, তাঁর প্রতি ভক্তদের অনুরাগ কত গভীর। কখনো কখনো কৃষ্ণ নিজ সেবকেরে ভুল করান এবং পরবর্তীতে তা খণ্ডন করে হৃদয়ের দোষত্রুটি মোচন করেন। প্রকৃতপক্ষে বিদ্যানিধির অন্তরে এই যে ভ্রম, তার কারণও কৃষ্ণ। আবার তাঁর অসীম কৃপা দিয়ে তিনি ভক্তদের ভ্রম চ্ছেদ করেন। অনুগ্রহ করে এবারে শুনুন কিভাবে কৃষ্ণ বিদ্যানিধির অন্তরের ভ্রান্তি দূর করলেন। দুই বন্ধু (স্বরূপ দামোদর পুণ্ডরীক বিদ্যানিধি) এইভাবে রঙ্গ রসে শ্রীকৃষ্ণের নিত্যসেবা করতে যার যে বাসায় ফিরলেন। 

বিদ্যানিধি অন্যান্য কার্য্যাদি সমাপন করে বিশ্রাম নিমিত্ত শয়ন করলেন। অন্তর্যামী প্রভু চৈতন্য গোসাই জগন্নাথ রূপ ধারন করে স্বপ্নে প্রেমনিধির নিকটে এলেন। প্রেমনিধি মহাশয় দেখেন জগন্নাথ বলরাম বিজয়ীর বেশে উপস্থিত। জগন্নাথ বিদ্যানিধিকে ধরে ক্রোধ ভরে মুখে চড় মারলেন। দুই ভাই মিলে বিদ্যানিধির দুই গালে এতই জোরে চড় মেরেছেন যে বিদ্যানিধি মহাশয়ের দুই গাল এবং জগন্নাথ-বলরামের দুই হস্তের আঙ্গুল সমূহ ফুলে গেছে। দুঃখ পেয়ে প্রেমনিধি, "কৃষ্ণরক্ষা কর ! অপরাধ ক্ষমা কর !" বলে ডাকতে লাগলেন। এই বলে দু'ভা'য়ের পদতলে লুণ্ঠিত হলেন। "গোসাই ! কোন অপরাধে আমাকে মারছেন?" প্রভু বলেন,- "প্রভু বলেন, তোর অপরাধের অন্ত নাই। আমি এবং আমার সেবকের কোন জাতি নাই। তাই এইসব জাতি আচার আমাদের বেলায় প্রয়োজন নয়। তুমি এইসব জান তবুও সেই কথাই বারবার বলছ। তবে কেন এই জাতিনাশা স্থানে রয়েছ? তুমি যদি জাত্যাভিমান রক্ষা করতে চাও তাহলে স্বদেশে ফিরে যাও। আমি যেভাবে এই উৎসবের ব্যবস্থা করেছি, তুমি শাস্ত্র বিচারে ভেবেছ বুঝি কোন অনাচার হয়েছে। আমাকে পরমব্রহ্ম বলে আবার আমার ভক্তের নিন্দা করছ যে, কেন তারা মাড় যুক্ত কাপড় আমাকে দিয়েছে?" খুব ভীত হয়ে বিদ্যানিধি কাঁদতে লাগলেন ও জগন্নাথের চরণে মস্তক অবনত করলেন। "পাপিষ্ঠের সকল অপরাধ ক্ষমা কর I হে প্রভু ! যে বদনে তোমার ভক্তের প্রতি অবজ্ঞা ভরে হেসেছি, তুমি' ভালো করে সে বদনের শাস্তি বিধান করেছ। আজ আমার বড় শুভদিন। তোমার পদ্মহস্তে আমার মুখে চড় মেরে আমাকে খুবসৌভাগ্যবান করেছ" জগন্নাথদেব উত্তর করলেন,"তোমাকে আমার পরমভক্ত জেনে এই বিশেষ অনুগ্রহ প্রদর্শন করলাম "

স্বপ্নে দুই ভাই রাম হরি, বিদ্যনিধিকে দেখাতে এসেছিলেন তার প্রতি কত প্রেম। এই স্বপ্ন দেখে বিদ্যানিধি জেগে উঠে গালে চড়ের বেদনা অনুভব করে হাসতে লাগলেন। জগন্নাথের চড়ে দুই গাল ফুলে উঠেছে। প্রেমনিধি তা দেখে বললেন, "ভাল, ভাল তো! যে অপরাধ করেছি, তাতে এই শাস্তি পেয়ে অল্পে বেঁচেছি।" দেখ! দেখ! বিদ্যানিধির কি মহিমা সেবকের প্রতি জগন্নাথ দেবেরদয়ার চরম সীমা। কৃষ্ণের নিজের পুত্র প্রদুম্নকেও এভাবে কখনো শিক্ষার নিমিত্তে চড় মারেন নি।সীতাদেবী, রুক্মিনী, সত্যভামা কেউই এমন কৃপা পায়নি। যদিও তিনি সাক্ষাতে অপরাধীকে মারেন, কিন্তু স্বপ্নে শাস্তিরূপ প্রসাদ দান করেন, কুত্রাপি পরিদৃষ্ট হয় না। কিন্তু কেউ যদি স্বপ্নে তার পাপের সাজা অথবা কোন সম্পদ পায়, জেগে উঠে দেখে কিছুই নাই। পরন্তু স্বপ্নে শাস্তি প্রদান করলে কেউ জানতে পারে না

No comments:

Post a Comment

🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴🌴🌳 🌻🌼 শ্রীবলরামের রাসযাত্রা 🌹 শ্রীকৃষ্ণের বসন্তরাস 🌼🌻 🌳🌴🪴🌲🦚🍁💐🏵️🌺🌷🌺🏵️💐🍁🦚🌲🪴...